لا إله إلا الله محمد رسول الله
অত্যন্ত গোপনে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হলেও সে সময়ের কারাবন্দিদের বিবরণে জানা যায়, কর্নেল তাহের গোসল করে, নিজে চা বানিয়ে পান করেন। উপস্থিত কারা কর্মকর্তাদেরও তিনি আপ্যায়িত করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় শত্রুর হামলায় একটি পা হারিয়েছিলেন কর্নেল তাহের। চা পানের পর সেই পায়ের স্থলে কৃত্রিম পা লাগিয়ে নিজে হেঁটে ফাঁসির মঞ্চে যান। ফাঁসি কার্যকর করার পর খবর ছড়িয়ে পড়লে বন্দিশালার বিভিন্ন স্থান থেকে সহযোদ্ধা ও কারাবন্দিরা স্লোগান দিতে থাকে 'তাহের তোমায় লাল সালাম', 'কর্নেল
তাহেরের রক্ত থেকে লাখো তাহের জন্ম নেবে।
'
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ সেনাছাউনিতে বন্দি। সেখান থেকে পালিয়ে এসে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান এবং ১১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ১৪ নভেম্বর কামালপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে গ্রেনেড বিস্ফোরণে এক পা হারান। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তাকে বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। তিনি ১৯৭৬ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন।
এ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই বন্দি তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান মুক্ত হন।
১৯৭৬ সালের ২১ জুন এক নম্বর বিশেষ সামরিক আদালতে ১২১-এর (ক) ধারায় কর্নেল তাহের, সিরাজুল আলম খান, মেজর এমএ জলিল, আ স ম আবদুর রব, হাসানুল হক ইনুসহ ৩৪ জন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিকে আসামি করে গোপন বিচার শুরু হয়। হঠাৎ করে ৭ দিনের জন্য আদালত মুলতবি করা হয়। ২৮ জুন আবার শুরু হয়, ১৪ জুলাই পর্যন্ত বিচার কার্যক্রম চলে। ১৭ জুলাই এক রায়ে মেজর এমএ জলিল এবং কর্নেল তাহেরের বড় ভাই ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আবু ইউসুফ বীরবিক্রমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও তাদের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।
আ স ম আবদুর রব, হাসানুল হক ইনু ও ড. আনোয়ার হোসেনকে ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ডসহ অন্য ১৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার মাত্র ৭২ ঘণ্টা পর রায় কার্যকর করা হয়। কর্নেল তাহের ও তার সহযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, বৈধ সরকারকে উচ্ছেদসহ রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছিল। সামরিক আদালতে সে অভিযোগ অস্বীকার করে কর্নেল তাহের তার জবানবন্দিতে বলেন, 'যে সরকারকে আমিই ক্ষমতায় বসিয়েছি, যে ব্যক্তিটিকে আমিই নতুন জীবন দান করেছি, তারাই আজ এই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে আমার সামনে এসে হাজির হয়েছে। এদের ধৃষ্টতা এত বড় যে, তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো আরও অনেক বানানো অভিযোগ নিয়ে আমার বিরুদ্ধে বিচারের ব্যবস্থা করেছে।
' তিনি জবানবন্দিতে আরও উল্লেখ করেন, 'আমি আমার দেশ ও জাতিকে ভালোবাসি। এ জাতির প্রাণে আমি মিশে রয়েছি। কার সাহস আছে আমাদের আলাদা করবে। নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর কোনো বড় সম্পদ নেই। আমি তার অধিকারী।
আমি আমার জাতিকে তা অর্জন করতে ডাক দিয়ে যাই। '
যে ১২১ (ক) ধারায় কর্নেল তাহেরকে সাজা দেওয়া হয়েছিল তাতে সর্বোচ্চ শাস্তি নির্দিষ্ট ছিল যাবজ্জীবন পর্যন্ত। কর্নেল তাহেরের মৃত্যুর ১০ দিন পর ৩১ জুলাই সামরিক অধ্যাদেশ জারি করে যাবজ্জীবনের স্থলে মৃত্যুদণ্ড বসানো হয়। তাই সেদিনই এ রায় আইনজ্ঞদের চোখে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। তাছাড়া একজন পঙ্গু ও বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুদণ্ড বিধিসম্মত কি-না, তা নিয়েও প্রশ্ন ছিল।
এসব কারণে তাহেরের মৃত্যুদণ্ডকে অনেকে হত্যাকাণ্ড বলে অভিহিত করেন। এবার আদালতের মাধ্যমে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর মিলবে বলেই জনমনে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে।
ফাঁসি কার্যকর করার তিনদিন পূর্বে তার বাবা, মা, স্ত্রী, ভাইবোনদের লেখা তার সর্বশেষ পত্রে কর্নেল তাহের বলেছেন, রায় শুনে আমাদের আইনজীবীরা হতবাক হয়ে গেলেন। তারা এসে আমাকে বললেন, যদিও এই ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না, তবুও তারা সুপ্রিম কোর্টে রিট করবেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করবেন বলে জানালেন।
আমি তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম, প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করা চলবে না। এই প্রেসিডেন্টকে আমি প্রেসিডেন্টের আসনে বসিয়েছি। এই বিশ্বাসঘাতকদের কাছে আমি প্রাণভিক্ষা চাইতে পারি না। চিঠিতে কর্নেল তাহের লিখেছেন, ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্ধারিত ৮ নম্বর সেলে আমাকে নিয়ে আসা হলো। পাশের তিনটি সেলে আরও তিনজন ফাঁসির আসামি।
মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যখন জীবনের দিকে তাকাই তাতে লজ্জার তো কিছু নেই। আমার জীবনের নানা ঘটনা আমাকে আমার জাতি ও জনগণের সঙ্গে দৃঢ়বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। এর চাইতে বড় সুখ, বড় আনন্দ আর কী হতে পারে। নীতু, যীশু ও শিশুর কথা_ সবার কথা মনে পড়ে। তাদের জন্য অর্থ-সম্পদ কিছুই আমি রেখে যাইনি।
আমার গোটা জাতি রয়েছে তাদের জন্য। আমরা দেখেছি শত সহস্র উলঙ্গ মায়া মমতা ভালোবাসা বঞ্চিত শিশু। তাদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় আমরা গড়তে চেয়েছি। বাঙালি জাতির উদ্ভাসিত নতুন সূর্য উঠার আর কত দেরি! না আর দেরি নেই, সূর্য উঠল বলে।
তাহেরসহ জাসদ নেতৃবৃন্দের বিচারের জন্য ১৯৭৬ সালের ১৪ জুন বিশেষ সামরিক আইন ট্রাইব্যুনাল জারি করা হয়েছিল।
১৫ জুন ট্রাইব্যুনালের সদস্যরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শন করেন। ২১ জুন বিচার শুরু হয়। অধ্যাদেশ জারি, ট্রাইব্যুনাল গঠন ও ডিআইজি প্রিজনের কক্ষকে আদালত হিসেবে প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া থেকে স্পষ্ট হয় যে, সমগ্র বিচারটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। 'দণ্ড' নির্ধারিত হয়েছিল আগেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।