অনেক কাল আগে, এক দেশে ছিল এক তাতী, সে আবার পিঠা খেতে বড় ভালবাসত।
একদিন সে তার মাকে বলল, "মা, আমার খুব পিঠা খাইতে ইচ্ছা করতাছে, আমারে পিঠা বানাইয়া দেও না। "
সেইদিন তার মা তাকে লাল-লাল, গোল-গোল, চ্যাপটা-চ্যাপটা সাতটা চমৎকার পিঠা তৈরি করে দিল। তাঁতীতো সেই পিঠে পেয়ে খুবই খুশি। সে খুশির চোটে নাচতে লাগল আর বলতে লাগল....
"একটা খামু, দুইটা খামু,
সাত বেটাকেই চিবিয়ে খামু!"
তাঁতীর মা বলল, "খালি নাচবিই যদি, তাইলে খাবি কখন?"
জোলা বলল, "খামু কি এখানে নাকি? সবাই যেখানে দেখতে পারবো, সেখানে যাইয়া খামু"
এই কথা বলে জোলা পিঠাগুলি নিয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল, আর বলতে লাগল,
"একটা খামু, দুইটা খামু,
সাত বেটাকেই চিবিয়ে খামু!"
নাচতে নাচতে জোলা একেবারে বনের কছের ঝোপড়া বটগাছতলায় চলে এল, যেখানে হাট হয়।
সেই গাছের তলায় এসে সে খালি নাচছে আর বলছে,
"একটা খামু, দুইটা খামু,
সাত বেটাকেই চিবিয়ে খামু!"
এখন হয়েছে কি-সেই গাছে সাতটা ভূত থাকত। তাঁতী সাত বেটাকেই চিবিয়ে খাব বলছে, এই কথা শুনে তারা খুব ভয় পেয়ে গেলো। তারা সাতজনে তখন গুটিগুটি হয়ে কাঁপছে, আর বলছে,ওরে সর্বনাশ হয়েছে! ঐ দেখ, কেত্থেকে এক বিটকেল ব্যাটা এসেছে, আর বলছে আমাদের সাতজনকেই চিবিয়ে খাবে! এখন কি করি বল্ তো!
অনেক ভেবে তারা একটা হাঁড়ি নিয়ে তাতীর কাছে এল। এসে জোড়হাত করে তাকে বলল, "দোহাই কর্তা! আমাদের চিবিয়ে খাবেন না। আপনাকে এই হাঁড়িটি দিচ্ছি, এইটি নিয়ে আমাদের ছেড়ে দিন।
"
ওদিকে সাতটা মিশমিশে কালো তালগাছের মতো ভূত, তাদের কুলোর মত কান, মুলোর মত দাঁত, চুলোর মত চোখ-দেখে তাতীতো ভয়েই কাবু। তাদের দেখে সে এমনি চমকে গেল যে, সেখান থেকে ছুটে পালাবার কথাও তার মনেই এল না। সে বলল, "হাঁড়ি নিয়া আমি কি করমু?"
ভূতেরা বলল, "আজ্ঞে, আপনার যখন যা খেতে ইচ্ছে হবে, তাই এই হাঁড়ির ভিতর পাবেন। "
তাতী বলল, "বটে! আচ্ছা পায়েস খামু এখন"
বলতে বলতেই সেই হাঁড়ির ভিতর থেকে চমৎকার পায়েসের গন্ধ বেরুতে লাগল। তেমন পায়েস তাতীতো কখনো খায়ই নি, তার মাও খায় নি, তার বাপও খায় নি।
কাজেই জোলা যার-পর-নাই খুশি হয়ে হাঁড়ি নিয়ে সেখান থেকে চলে এল, আর ভূতেরা ভাবল, "বাবা! বড্ড বেঁচে গিয়েছি। "
তখন বেলা অনেক হয়েছে, আর তাঁতীর বাড়ি সেখান থেকে অনেক দূরে। তাই তাঁতীর ভাবল, "এখন এই রোদে কেমনে যে বাড়ি যাই! বন্ধুর বাড়ি কাছে আছে, এবেলা সেইখানে যাই। তারপর বিকাল বেলায় বাড়ি যামু"
এই ভেবে সে তার বন্ধুর বাড়ি গেলো। সেই বন্ধুটা ছিল আবার খুব বদমাইশ।
সে তাঁতী হাঁড়িটি দেখে জিজ্ঞাসা করল, "হাঁড়ি কই থেইক্কা আনলি রে?"
তাঁতী বলল, "বন্ধু, এ যে-সে হাঁড়ি নয়, এর ভারি গুণ। "
বন্ধু বলল "তাই নাকি? আচ্ছা দেখা তো দেখি তোর পাতিলের কেমন গুণ। "
তাঁতী বলল, "তুই যা খাইতে চাস, তাই আমি এর ভিতর থেইকা বাইর কইরা দিতে পারমু। "
বন্ধু বলল, "আমি রাবড়ি, সন্দেশ, রসগোল্লা, সরভাজা, মালপুয়া, পাস্তুয়া, কাঁচাগোল্লা, ক্ষীরমোহন, গজা, মতিচুর জিলিপি, অমৃতি, চমচম এইসব খাইতে চাই"।
তাঁতীর বন্ধু যা বলছে, সে হাঁড়ি ভিতর হাত দিয়ে তাই বার করে আনছে।
এ-সব দেখে তার বন্ধু ভাল যে, এ জিনিসটি চুরি না করলে হচ্ছে না
তখন সেই পাজিটা তাঁতীকে খুব আদরযত্ন করতে লাগল! পাখা এনে তাকে হাওয়া করল, গামছা দিয়ে তার মুখ মুছিয়ে দিল, আর বলল, "আহারে ভাই, তোর তো খুব কষ্ট হইছে! গা দিয়া ঘাম ঝরতাছে! একটু ঘুমাবি নাকি ই? বিছানা কইরা দিমু?"
সত্যি সত্যি তাঁতীর তখন খুব ঘুম পেয়েছিল। কাজেই সে বলল, "আইচ্ছা বিছানা কইরা দাও। "
তখন তার বন্ধু বিছানা করে তাকে ঘুম পাড়িয়ে, তার হাঁড়িটি বদলে তার জায়গায় ঠিক তেমনি ধরনের আর একটা হাঁড়ি রেখে দিল।
তাঁতীতো এসবের কিছুই জানে না, সে বিকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ি চলে এসেছে আর তার মাকে বলছে, "দেখো মা, কি চমৎকার একটা হাঁড়ি আনছি। তুমি কি খাবা, মা? সন্দেশ খাবা? পিঠা খাবা? দেখো আমি হাড়ির ভিতর থেইকা সব বাইর কইরা দিতাছি।
"
কিন্তু এত আর সে হাঁড়ি নয়, এর ভিতর থেকে সে-সব জিনিস বেরুবে কেন? মাঝখান থেকে তাঁতী বোকা হয়ে গেল, তার মা তাকে বকতে লাগল।
তখন তাঁতীর খুব রাগ উঠে গেলো। সে ভাবলো এটা সেই ভূত ব্যাটাদেরই কারসাজি। তার বন্ধু যে তাকে ঠকিয়েছে, এ কথা তার মনেই হল না।
কাজেই পরদিন সে আবার সেই বটগাছতলায় গিয়ে বলতে লাগল,
"একটা খামু, দুইটা খামু,
সাত বেটাকেই চিবাইয়া খামু!"
তা শুনে আবার ভূতগুলো কাঁপতে কাঁপতে একটা ছাগল নিয়ে এসে তাকে হাত জোড় করে বলল, "মশাই গো! আপনার পায়ে পড়ি, এই ছাগলটা নিয়ে যান।
আমাদের ধরে খাবেন না। "
তাঁতী বলল, "ছাগলের কি গুণ?"
ভূতরা বলল, "ওকে সুড়সুড়ি দিলে ও হাসে, আর ও মুখ দিয়ে খালি মোহর পড়ে। "
অমনি তাঁতী ছাগলের গায়ে সুড়সুড়ি দিতে লাগল। আর ছাগলটাও হি হি করে হাসতে লাগল, আর মুখ দিয়ে ঝর ঝর করে খালি মোহর পড়তে লাগল। তা দেখে তাঁতীর মুখে আর হাসি ধরে না।
সে ছাগাল নিয়ে ভাবল যে, এ জিনিস বন্ধুকে না দেখালেই নায়।
সেদিন তার বন্ধু তাকে আরো ভাল বিছানা করে দিয়ে দু"হাতে দই পাখা দিয়ে হাওয়া করল। তাঁতীর ঘুমও হল চমৎকার। সেদিন আর সন্ধ্যার আগে তার ঘুমই ভাঙল না। তার বন্ধু তো এর মধ্যে কখন তার ছাগল চুরি করে তার জায়গয় আর-একটা ছাগল রেখে দিয়েছে।
সন্ধ্যার পর তাঁতী তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে তার বন্ধুর সেই ছাগলটা নিয়ে বাড়ি এল। এসে দেখল, যে তার মা তার দেরি দেখে ভারি চটে আছে। তা দেখে সে বলল, "আর রাগ কইরো না মা। আমার ছাগলের গুণ দেইখা তুমি খুশি হইয়া নাচবা! বলেই সে ছাগলের বগলে আঙুল দিয়ে বলল, "কাতু কুতু কুতু কুতু কুতু!!!"
ছাগল কিন্ত তাতে হাসলো না, তার মুখ দিযে মোহরও বেরুল না। তাঁতী আবার তাকে সুড়সুড়ি দিলে বলল, "তু কুতু কুতু কুতু কুতু কুতু কুতু কুতু!!"
তখন সেই ছাগল রেগে গিয়ে শিং বাগিয়ে তার নাকে দিলো একটা বিষম গুঁতো।
আর তার নাক দিয়ে রক্তও পড়ল প্রায় আধ সের তিন পোয়া। তার উপর আবার তার মা তাকে এমনি বকুনি দিল যে, তেমন বকুনি সে আর খায় নি।
তাতে জোলার রাগ যে হল, সে আর কি বলব! সে আবার সেই বটগাছতলায় গিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল,
"একটা খামু, দুইটা খামু,
সাত বেটাকেই চিবাইয়া খামু!"
বেটারা আমাকে দুবার ফাঁকি দিছোস, ছাগল দিয়ে আমার নাক থেঁতলা করে দিছোস-আজ আর তোদের এক দিন কি আমার একদিন!
ভূতেরা তাতে ভারি আশ্চর্য হয়ে বলল, "সে কি জনাব, আমার কি করে আপনাকে ফাঁকি দিলাম, আর ছাগল দিয়েই বা কিরে আপনার নাক থেঁতলা করলাম?"
তাঁতী তখন তার নাক দেখিয়ে বলল, "এই দেখ, গুঁতা মাইরা ছাগল আমার কি দশা করেছ। তোদের সব কয়টারে ধইরা চিবাইয়া খামু!"
ভূতেরা বলল, "ওটা তাহলে আমাদের ছাগল না। আপনি কি এখান থেকে সোজাসুজি বাড়ি গিয়েছিলেন?"
তাঁতী লল, "না, আগে বন্ধুর ওখানে গেছিলাম।
সেখানে কিছুক্ষন ঘুমাইয়া তারপর বাড়ি গেছ."
ভূতেরা বলল, "এইখানেই তো কর্ম্মো সাবার হয়েছে। আপনি যখন ঘুমোচ্ছিলেন, সেই সময় আপনার বন্ধু আপনার ছাগল চুরি করেছে। একথা শুনেই তাঁতী সব বুঝতে পারল। সে বলল, "ঠিক ঠিক। সে চুরই আমার হাঁড়ি চুরি করেছে।
এখন কেমনে কি?"
ভূতেরা তাকে কতগুলো লাঠি দিয়ে বলল, "এই লাঠি আপনার হাঁড়িও এনে দেবে, ছাগলও এনে দেবে। ওকে শুধু একটিবার আপনার বন্ধুর কাছে নিয়ে বলবেন, "লাঠি লাগ। "
তা হলে দেখবেন, কি মজা হবে! শত শত লোক ছুটে এলেও এ লাঠির সঙ্গে পারবে না, লাঠি তাদের সকলকে পিটেয়ে সাইজ করে দেবে। "
তাঁতী তখন সেই লাঠিটি বগলে করে তার বন্ধুর গিয়ে বলল, "দোস্ত, একটা মজা দেখবি?"
বন্ধু ত ভেবেছে, না জানি কি মজা হবে।
তারপর যখন তাঁতী যখন বলল, "লাঠি, লাগ" তখন সে এমনি মজা দেখল, যেমন তার জন্মে আর কখনো দেখে নি।
লাঠি তাকে পিটিয়ে পিটিয়ে তার মাথা থেকে পা অবধি চামড়া তুলে ফেলল। সে ছুটে পালাল, লাঠি তার সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে তাকে পিটতে পিটতে ফিরিয়ে নিয়ে এল। তখন সে কাঁদতে কাঁদতে হাত জোড় করে বলল, "তোর পায়ে পড়ি ভাই, তোর হাড়ি নে, তোর ছাগল নে, আমারে ছাইড়া দে"
জোলা বলল, "ছাগল আর হাঁড়ি আন্, তারপরে তোরে ছাড়মু। "
তখন পাজী বন্ধুটা পিটুনি খেতে খেতেই হাঁড়ি আর ছাগল এনে হাজির করল।
তাতী হাঁড়ি হাতে নিয়ে বলল, "সন্দেশ আসুক" অমনি হাঁড়ি সন্দেশে ভরে গেল।
ছাগলকে সুড়সুড়ি দিতে না দিতেই সে হো হো করে হেসে ফেলল, আর তার মুখ দিয়ে চারশোটা মোহর বেরিয়ে পড়ল। তখন সে তার লাঠি, হাঁড়ি আর ছাগল নিয়ে বাড়ি চলে গেল।
এখন আর তাঁতীতো আর গরিব নেই, সে বড়লোক হয়ে গেছে। তার বাড়ি, গাড়ি, হাতি-ঘোড়া-খাওয়া-পরা, চাল-চলন, লোকজন সব রাজার মতন।
আপাতত এইখানেই শেষে!
এই গল্প থেকে যা শিক্ষনীয় " মাইরের উপরে ঔষুধ নাই "
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।