আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পান-বন্দনা



দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লোকজন কবে পানের অভ্যাস রপ্ত করেছিল, সে ব্যাপারে ইতিহাস নীরব। তবে বাৎসায়নের কামসূত্রের একটি স্তবকে রয়েছে পান-বন্দনা : 'দাঁত পরিষ্কার করে আয়নায় তাকাতে তাকাতে তাম্বুল(পান) চিবিয়ে মুখে সুগন্ধ ছড়িয়ে প্রত্যেকের উচিত দিনের কাজে হাত দেয়া। ' পাঁচ হাজার বছর আগে লেখা শ্রীমদ্ভগবতে লেখা আছে দেবতা কৃষ্ণ পান খেতেন। বলা হয়ে থাকে দেব চিকিৎসক ধন্বন্তরীর সহায়তায় আয়ুর্বেদ পণ্ডিতরা এটা আবিষ্কার করেন। ইতিহাসে রয়েছে, সম্রাট শাহ জাহানের মা রানী নূরজাহান অন্দরমহলে নারীদের কাছে পান জনপ্রিয় করে তোলেন।

তিনি পানের সঙ্গে চিবানোর বেশ কিছু উপাদানও আবিষ্কার করেন। ইবনে বতুতাও সে আমলে বাংলাদেশের পান-সংস্কৃতির কথা বলেছেন। আর মধ্যযুগের কবি আলাওলের কবিতায় পাওয়া যায়, 'অধর রাতুল কৈল তাম্বুল রসে। ' পানের পিকের রং তামাটে। রঙের দিকে খেয়াল রেখে সংস্কৃতে তাম্র থেকে তাম্বুল শব্দটি এসেছে।

এক প্রকার গাছের নির্যাস 'কথ' এর কারণে পান চিবুলে তা লাল হয়ে যায়। প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও পানের নানা গুণকীর্তন রয়েছে। হৃদয়-আকৃতির পান পাতা কচি অবস্থায় তুলতে হয়। এ সময় স্বাদ থাকে বেশি। সংস্কৃত সাহিত্যে পানের মহিমা বলা হয়েছে এভাবে 'মুখের সৌন্দর্য বাড়াতে, মুখ বিশুদ্ধ করতে, বাজে গন্ধ তাড়াতে পান মহৌষধ।

' এক সময় হিন্দু বিধবাদের জন্য পান নিষিদ্ধ ছিল। যেহেতু পান আনন্দের প্রতীক সেহেতু বিধবারা এটা চিবানোর অনুমতি পেতেন না। অবশ্য সংস্কৃত 'পর্ণ' থেকেই বাংলায় পান শব্দটি এসেছে। অথচ পানের অস্ট্রিক নাম ছিল বর। কিন্তু বাংলা ভাষা থেকে শব্দটি হারিয়ে গেছে বা পানের দাপটে তা টিকতে পারেনি।

বর শব্দটি এখনও নিজের অপসৃয়মান অস্তিত্ব ঘোষণা করছে 'বারুই' ও 'বারুজীবী' শব্দে। বাংলাদেশের সংস্কৃতির অনিবার্য অংশ পান। হিন্দুশাস্ত্র মতে, সুপারি খয়ের চুন সংযুক্ত হলেই তাকে 'তাম্বুল' আখ্যা দেয়া হয়। নইলে ওটা স্রেফ পর্ণ। সংস্কৃতে তাম্বুল, তামিলে ভেট্টিলাই, তেলেগুতে তমলপাক, মারাঠিতে বিদয়েচি, গুজরাটিতে পান/নাগর-বেল, বার্মিজে কুন আ, কানাড়িতে বিলেদেলে, মালয়লমে বেত্তিনাই, খেমারে মেলু, থাই ভাষায় প্লু, সিংহলিতে বলাত, মালয়ে দেউন সিরিহ, আরবিতে তানবোল, ফারসিতে বগেঁ তাবোল/তাবোল, ফিলিপাইনে ইকসু ও ভিয়েতনামে ট্রাউ নামে পান পরিচিত।

পানের লতা কোনো কিছুকে অবলম্বন করে সাপের মতো জড়িয়ে থাকে বলে সংস্কৃতে পানের আরেক নাম নাগবল্লী। আমরা পান রাখি ডাবরে আর যে পাত্রে পরিবেশন করি তাকে বলে বাটা। বাটা ও ডাবর যথাক্রমে হিন্দি 'বট্টা' ও 'ডাবর' থেকে এসেছে। অবশ্য হিন্দি 'ডাবর' এসেছে সংস্কৃত 'দভ্র' থেকে আর সংস্কৃত দভ্র অর্থ সাগর। ডাবরকে এক সময় 'তাম্বুলকরঙ্ক' বা 'তাম্বুলপেটিকা' বলা হত।

পানের ডিবার নাম ছিল তাম্বুলসম্পুট। তখন রাজপরিবারেও পানের প্রচলন ছিল। রাজাকে পান দেওয়ার জন্য নিয়োজিত থাকত বিশেষ শ্রেণীর দাস, যারা তাম্বুলকরঙ্ক বাহিনী নামে পরিচিত ছিল। বানভট্টের কাদম্বরীতে তাম্বুলকরঙ্ক বাহিনীর কথা উল্লেখ রয়েছে। তাম্বুলগুণ মানে পানের গুণ বা ধর্ম।

পানের এ গুণ তের প্রকার - কটু, তিক্ত, উষষ্ণ, মধুর, ক্ষার, কষায়, বাতঘ্ন, কৃমিনাশক, কফহর, দুর্গন্ধিদোষাপহ, বক্তাভরণ, সুগন্ধিকরণ ও কামাগ্নিসন্দীপন। এক সময় পানের বরজ থেকে আয় এতোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, বাংলার সুবাদার আযিম উস শান পান চাষকে 'সাউদিয়া খাস’'নাম দিয়ে একচেটিয়া রাজকীয় ব্যবসায়ে পরিণত করেন। আর ১৭৬৭ সালে রবার্ট ক্লাইভও একই পথ ধরেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।