সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবসের ভাবনা:
“সুসময়ে অনেকেই বন্ধু বটে হয়,
অসময়ে হায় হায় কেউ কারো নয়"”।
যখন মানুষের ভাল সময় আসে তখন অনেক বন্ধু জুটে যায়। কিন্তু সঠিক বন্ধুকে বুঝতে না পারলে মহাবিপদের সম্মুখীন হতে হয়। বাস্তবে সঠিক বন্ধু নির্বাচন করাই হচ্ছে সবচেয়ে সঠিক কাজ। অথচ মানুষ পরিচিত হন, তার বন্ধুদের মাধ্যমে।
ইংরেজীতে কথা আছে-"A man is known by the company he keeps"।
বন্ধুত্বের উপকারিতা, বন্ধুদের মাধ্যমে নিজেকে বিকাশ করা ও বন্ধুত্বের মাঝে জীবনকে আনন্দ ঘন করার মাঝেই আনন্দ। জাগতিক উৎকর্ষতা উপভোগ করার আমেজই আলাদা, তাই বন্ধুত্বের আদর্শ ও তারই মাঝে মধুর ও উৎফুল্ল মানসিকতাকে বিকাশ করার লক্ষ্যেই প্রতিবছর আগস্ট মাসের প্রথম রবিবার বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে “বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবস"”।
বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবস একটি সাংস্কৃতিক কৃষ্ঠি ও আনন্দঘন দিবস হিসাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উৎযাপিত হয়ে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ১৯৩৫ সালে আগস্ট মাসের প্রথম রবিবারকে বন্ধুত্ব দিবস হিসাবে ঘোষণা দেয়।
অবশ্য এখন সারা বিশ্বেই ফেব্রুয়ারী মাসের ১৪ ফেব্রুয়ারী বিশ্ব ভালোবাসা দিবস এবং অনেক দেশেই ফেব্রুয়ারী ১৮-২৪, এ সাত দিনকে বন্ধুত্বের সপ্তাহ হিসাবে পালন করে থাকে।
বন্ধুত্বের পরিধি ও ক্ষেত্র ব্যাপক। ছেলেদের মেয়ে বন্ধু এবং মেয়েদের ছেলে বন্ধু থাকে, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হচ্ছে “ভালবাসা"”। যার মধ্যে আছে ভিন্ন আবেগ ও অনুভূতি। ভালবাসার পাত্র ও পাত্রীর মধ্যে অনেক অভিনয় ও লুকোচুরি থাকে।
তাই ভালবাসা দিবস আলাদাভাবে ও ভিন্ন অনুভূতি নিয়ে উৎযাপিত হয়। কিন্তু বন্ধু ও বান্ধবীর মধ্যে যে আলাপচারিতা ও মতের বিনিময় তার মূল্যায়ন সম্পূর্ণ ভিন্ন। অনেক সময় একজন পুরুষ ব্যক্তি তার আর্থিক ও পারিবারিক সমস্যা নিজের স্ত্রীকে বলেন না। অথচ সেই সমস্যাটিই তার বিশিষ্ট ও অন্তরের বন্ধুকে অকপটে বলেন, সাহায্য প্রত্যাশা করেন এবং পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন। অনেক মহিলারা স্বামীকে গোপন কথাটি না বলে, বন্ধু/বান্ধবীকে বলেন।
তাই অনেকেই মনে করেন, যার কমপক্ষে ৫ জন ভাল বন্ধু আছে সে জীবনে কখনো পরাস্ত হয় না। ভাল বন্ধু পাওয়া, সৃস্টিকর্তার আশীর্বাদ।
সঠিক বন্ধুই হচ্ছে সৎ পথের পরিচালক, উন্নতির সোপান, অন্তরের আত্মীয়। আপন ভাই সব সময় বন্ধু হয় না, কিন্তু একজন বন্ধু সর্বদাই একজন ভাই। বন্ধুত্ব হচ্ছে সোনালী সুতো যা হৃদয়কে একসূত্রে গেঁথে দেয়।
ইংরেজীতে প্রবাদ আছে,"Only your real friends tell you when your face is dirty, life without a friend is like death without a witness. Ì Walking with a friend in the dark is better than walking alone in the light. Ì Only unsinkable ship is FRIENDSHIP"
সঠিক বন্ধু কে বা কারা, এবং কিভাবে তাকে নির্বাচন করা যাবে এ নিয়ে অনেক মতবাদ আছে। একটি সংস্কৃত শ্লোকে সঠিক বন্ধুর পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে, “দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্র বিল্পবে, রাজার দুয়ারে ও শ্বশ্মানে যে তোমার পাশে থাকবে সেই প্রকৃত বন্ধু”। যে আমার আগে হাটে অথবা যে আমার পিছু চলে, সে আমার বন্ধু নয়; সেই আমার বন্ধু যে আমার পাশে পাশে চলে”।
অনেক বন্ধু থাকা নিরাপদ নয় এবং উপকারেও আসে না। ঈশপের একটি গল্প হচ্ছে, একবার এক শিকারী কুকুর একটি খরগোশকে তাড়া করছিল।
খরগোশের অনেক বন্ধু। তাই সে প্রথমে গিয়ে ঘোড়া বন্ধুকে বলল, আমাকে শিকারী কুকুর আক্রমণ করেছে, তুমি আমায় পিঠে করে নিয়ে পালিয়ে যাও। ঘোড়া বলল, আমার অনেক কাজ, তুমি তোমার বন্ধু ষাঁড়-এর কাছে যাও। খরগোশটি ষাঁড়ের কাছে গেলে সে বলল, গাভীটি আমার জন্য অপেক্ষা করছে, তুমি তোমার বন্ধু ছাগলের কাছে যাও। ছাগলের কাছে খরগোশ গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করলে, ছাগল বলল, আমার পিঠে উঠলে তুমি পড়ে যাবে, বিপদ হবে, তুমি তোমার বিশেষ বন্ধু ভেড়ার কাছে যাও।
ভেড়ার কাছে যেতেই ভেড়া বল্ল, বন্ধু, শিকারী কুকুর আমাকেও খেয়ে ফেলবে, আমি পালাচ্ছি তুমি তোমার পথ দেখ। খরগোশ পিছনে তাকিয়ে দেখে শিকারী কুকুরের দাঁত তার মাথার কাছে......।
সঠিক বন্ধু কিভাবে নির্বাচন করা যাবে এ নিয়ে অনেক ভাবনা আছে। দার্শনিক সক্রেটিসের একটি গল্প আছে। মহামতি সক্রেটিসের নাম ডাক তখন গ্রীসের সর্বত্র।
সবাই দার্শনিক সক্রেটিসকে অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তি হিসাবে সম্মান করেন। একদিন এক ভদ্রলোক এসে সক্রেটিসকে বলল, “আপনি কি জানেন, আমি আপনার এক বিশিষ্ট বন্ধু সম্বন্ধে এইমাত্র কি শুনে এসেছি”? সক্রেটিস বললেন, “এক মিনিট অপেক্ষা করুন, কোন কিছু বলার আগে আমি তিনবার ফিলটারে পরিশ্রুত করে আপনার বক্তব্য পরীক্ষা করতে চাই”। ব্যক্তিটি রাজী হলো। সক্রেটিস বললেন, “প্রথমে আপনি আমাকে বলুন, আপনি যা বলছেন, তা যে সত্যি এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত কিনা”? লোকটি বলল, “আমি নিশ্চিত নই, আমি কথাটি শুনেছি"”। সক্রেটিস বললেন, “তাহলে যা বলবেন তার সত্যতা সম্পর্কে আপনি সঠিকভাবে জানেন না”।
সক্রেটিস পুনরায় বললেন, “তাহলে আপনি এখন বলুন, আপনি আমার বন্ধু সম্পর্কে যা বলবেন, তা কি কোন ভাল কথা বা সুসংবাদ”? লোকটি বলল, “না, ইহা হচ্ছে বিপরীত"”। সক্রেটিস বললেন, “তাহলে আপনি আমার বন্ধু সম্পর্কে খারাপ কথা বলবেন, অথচ তা সঠিক কিনা আপনি জানেন না”? সক্রেটিস পুনরায় বললেন, “এবার আসুন, তৃতীয় পরীক্ষা, আপনি আমার বন্ধু সম্পর্কে যা আমাকে বলতে এসেছেন, তা কি আমার কোন উপকারে আসবে”? লোকটি বলল, “না আপনার উপকার হবে না"”। সক্রেটিস তখন বললেন, “আপনি যা বলতে এসেছেন, তা সত্য নয়, ভাল কোন বার্তা নয় এবং আমার কোন উপকারে আসবে না, তাহলে আপনি আমাকে বলতে এসেছেন কেন”? লোকটি বোধদয় হলো, নীরবে তিনি প্রস্থান করলেন। অনাবশ্যক কথাটি বলা হলো না।
মহামতি দার্শনিক সক্রেটিসের এই গল্প থেকে আমরা দুটো শিক্ষা নিতে পারি, তা হচ্ছে আমরা এমন কোন কথা বা বাক্যালাপ করা সঠিক নয় যার সত্যতা সম্পর্কে আমরা অবহিত নই, অথচ তা বিপদ ডেকে আনতে পারে।
দ্বিতীয় হচ্ছে, নিজের প্রিয় বন্ধু সম্পর্কে তার অন্তরালে কোন কথা শোনা উচিত নয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে বাংলাদেশের পারিবারিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে, অতি কথা বলা এবং সত্যতা না জেনে কথা বলা একটি প্রচলিত রেওয়াজ-যা আমাদের পরিহার করতে সচেস্ট হতে হবে।
বন্ধুর সাহচর্য প্রত্যাশা করে তাকে হৃদয় দিয়ে উপলদ্ধি করা এবং বন্ধু সুলভ আচরণকে যথার্থ মূল্য দেওয়ার মাঝে অনেক তাৎপর্য বিরাজ করে। পরস্পরকে বন্ধু ভেবে সৎ উপদেশ দিতে পারলে তবেই সুন্দর পরিসমাপ্তি ঘটবে। সমাজে সৎ চিন্তা ও সুস্থ মানসিকতার উম্মেষ ঘঠবে।
প্রয়োজনে বন্ধুর পাশে থেকে তাকে সাহায্য করতে হবে। তবে নূতন বন্ধুকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে পুরাতন বন্ধুকে অবহলো করলে চলবে না। এ ব্যাপারে একটি উপদেশ হচ্ছ-
"Make new friends, but keep the old,
One is silver and the other is gold"। পুরাতন ও পরীক্ষিত বন্ধু হচ্ছে সোনা, তাকে ভুললে চলবে না।
বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবসে আমাদের ভাবনা হবে- মানুষ মানুষের বন্ধু হবে।
আনন্দ ঘন মুহূর্তে তার অংশীদার হবে। দুঃখের দিনে কাছে থেকে সাহায্য করবে। হিংসা, বিদ্বেষ ও দুর্বৃত্তায়ন থেকে নিবৃত্ত থেকে বন্ধুত্বের বাতাবরণের মাঝে সুন্দর পৃথিবী গড়বে। বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবস বার বার আসবে। মানুষ মানুষের জন্য, মানুষ সকল প্রাণীর জন্য, বন্ধুত্বের হাত বাড়াবে, এ হবে বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবসের অঙ্গীকার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।