আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হোয়াইকং-এর কুদুম গুহা


সেলফোনে ‘দে ছুট’ ভ্রমণ সংঘের বন্ধুদের জানিয়ে দিলাম সামনের ছুটিতে কুদুম গুহা যাব। বন্ধুদের প্রশ্ন, ওরে বাবা এ আবার কোন জায়গা। উত্তর না দিয়ে শুধু ভ্রমণের তারিখটি জানিয়ে দিলাম। দুর্গম অঞ্চল, প্রতিনিয়ত বিপদে পড়ার সম্ভাবনা। তাই বাছাই করে শুধু দুঃসাহসী অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বন্ধুদের ‘গুহায়’ যাওয়ার সঙ্গী করলাম।

বেশ কয়েকবার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা টাইগার জসিম, নাসিরুদ্দিন কচি ও এমরান এবারের অভিযাত্রী। পঁচিশ তারিখ রাতে রওনা হয়ে সকাল ১১টায় পৌঁছলাম পর্যটন নগরী কক্সবাজার। রুম বুকিং করা ছিল তাই বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হয়নি। সে দিনটি নীল জলরাশির নোনা জলে সাঁতার আর বিশালাকৃতির ঢেউয়ে ডুব দিয়ে আনন্দে কাটিয়ে দিলাম। রাতে পূর্ণিমার আলোতে বিচের অ্যাঞ্জেল ড্রপ রেস্টুরেন্টে কাঁকড়া ভাজা খাওয়ার স্বাদ নিলাম।

পরের দিন সকালে টেকনাফের হোয়াইকংয়ের উদ্দেশে যাত্রা। কক্সবাজার থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা পথ বাস জার্নি করে পৌঁছলাম হোয়াইকং বাজার। সেখান থেকে সিএনজি করে হাড়িখোলা। হাড়িখোলায় কর্তব্যরত পুলিশ বাধা দিল সিকিউরিটি ছাড়া কুদুম গুহায় না যাওয়ার জন্য। কোনোভাবেই তখন তাদের কাছ থেকে অনুমতি মিলল না, যখন বিকল্প চিন্তা শুরু করলাম।

কারণ ভ্রমণে গিয়ে অভিযান অসমাপ্ত রেখে ফিরেছি এমন রেকর্ড আমার ঝুলিতে নেই। হাড়িখোলায় কিছুক্ষণ অবস্থান করে যা দেখলাম, তা রীতিমত শিউরে ওঠার মতো। হাড়িখোলা থেকে শাপলাপুর বাজারে গিয়ে পুলিশ স্কটে জনগণ ও মালবাহী গাড়িতে যেতে হয়, অন্যথায় দিনদুপুরেই নির্ঘাত দুর্ধর্ষ ডাকাতের সম্মুখীন। কুদুম গুহা পর্যবেক্ষণের আকুল বাসনা দেখে পুলিশ সদস্যরা আমাদের হোয়াইকং পুলিশ ফাঁড়িতে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। নব উদ্দীপনায় ছুটলাম ফাঁড়ির পানে, ফাঁড়ির ইনচার্জ দ্বারা যেন কোনো বাধা না আসে সে জন্য ত্বরিত গতিতে অবহিত করলাম আমার শ্রদ্ধেয় সচিবালয়ের সহকারী কর্মকর্তা শরফুদ্দিন আহম্মেদ রাজু ভাইকে।

ফোনে তিনি আমাকে নিরাশ না করে শুধু ফাঁড়ি পৌঁছতে কতক্ষণ সময় লাগবে তা জেনে নিলেন। এরই মধ্যে ফাঁড়ি পৌঁছে ইনচার্জ জাহের সাহেবের শরণাপন্ন হলাম। ঢাকা থেকে এসেছি জেনেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফোর্স রেডি করে আমাদের সঙ্গে গুহা যাত্রায় পাঠিয়ে দিলেন। আমাদের চারজন সদস্যের সঙ্গে চারজন অস্ত্রধারী পোশাক পরিহিত পুলিশ, সঙ্গে আরও দু’জন সিভিল পুলিশ। আমাদের ভাবসাবই এখন অন্যরকম।

বীরদর্পে চান্দের (স্থানীয় ভাষায়) গাড়িতে চড়ে আবার বাংলাদেশের একমাত্র মাটির গুহা কুদুম অভিমুখে যাত্রা। হাড়িখোলায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে হাতের বামে প্রায় দুই কিলোমিটার পাহাড়, গিরি পথ, বিশালাকৃতির সেগুন, চন্দন বৃক্ষের শীতল ছায়া; কখনওবা ভয়ঙ্কর জঙ্গলের পাশ দিয়ে হেঁটে চলা। হঠাত্ হাতির পায়ের চিহ্ন দেখে থমকে দাঁড়ালাম। পুলিশ সদস্যরা অভয় দিলেন, বন্যহাতি সাধারণত কাউকে ক্ষতি করে না। ওরা মানুষের ভালোমন্দ বুঝে।

একজন জানালেন, ইউনিফর্ম পরা পুলিশদের ওরা শুঁড় তুলে সালাম জানায় এবং সাধারণ মানুষ মন থেকে হাতিকে মামা বললে ওরা ক্ষতি করে না। ওদের কথায় এখন বন্যহাতি দেখারও স্বাদ জাগল। কিন্তু এক উদ্দেশ্যে বের হয়ে অন্য উদ্দেশ্য যোগ হলে তাতে দুটিই ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা। তাই পরবর্তী ভ্রমণে বন্যহাতি দেখার ইচ্ছা সুপ্ত করলাম। পাহাড় থেকে পাহাড় কাঠের পাটাতনের কয়েকটি ব্রিজ পার হতেই হাজির হলাম সেই মাহেন্দ্রক্ষণে।

গুহার মুখে এসে আশ্চর্যে আমাদের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাঁটু পানিতে গুহার ভেতর প্রবেশ করলাম। পানির ভ্যাপসা গন্ধ, এর পরও আনন্দ। অন্ধকারে বাস করা পাখিদের উড়ে চলা, চামচিকার কিচিরমিচির, ঘুটঘুটে অন্ধকার। সে এক অন্যরকম রোমাঞ্চ।

আমাদের সঙ্গে নেয়া টর্চ সেখানে অকেজো, ভাগ্য ভালো পুলিশ সদস্যরা তাদের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টর্চ লাইট সঙ্গে নিয়েছিল। গুহার ভেতরের উপরে অংশে টর্চের আলো পড়তেই বিস্ময়ে অবাক, ওহ্! আল্লাহ্ এত সুন্দর প্রাকৃতিক নিদর্শন তুমি আমাদের দিয়েছ অথচ তার সদ্ব্যবহার আমরা করতে জানি না। গুহার অন্ধকারে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে মনের আনন্দে বের হয়ে এলাম। এবার চারপাশ ঘুরে দেখা হলো নয়নাভিরাম প্রকৃতি। আরও দেখা হলো পাইথনের খোলস।

কথা প্রসঙ্গে জানা হলো পাইথনের অন্যতম প্রিয় খাবার চামচিকা। তাই গুহার ভেতর প্রবেশ মুহূর্তে টর্চ ও শক্ত লাঠি রাখা জরুরি। গলা শুকিয়ে কাঠ কিন্তু সঙ্গে বিশুদ্ধ পানি নেই। তখন মনে পড়ে গেল ‘দে ছুট’ ভ্রমণ সংঘের প্রথম সদস্য বন্ধু শেখ মোঃ মোক্তার আলীর কথা। দুর্গম অঞ্চলে ভ্রমণে যাওয়ার প্রাক্কালে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিতে কখনও ভুল হয়নি তার।

তাই বন্ধুদের কিঞ্চিত্ ভর্ত্সনা করে মোক্তারের কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম। যেতে চাইলে: ঢাকা থেকে কক্সবাজার। নিজস্ব বাহনে অথবা লিংক রোড থেকে টেকনাফের গেটলক বাসে। নামতে হবে হোয়াইকং বাজার। স্থানীয় ফাঁড়ি থেকে পুলিশ স্কট নিয়ে যেতে হবে কুদুম গুহা।

জনপ্রতি সর্বমোট খরচ হবে ৫ হাজার টাকা। তবে খরচ থাকা-খাওয়ার ওপর নির্ভর। খরচ যাই হোক কক্সবাজারে কাঁকড়া ভাজার স্বাদ নিতে কিন্তু ভুলবেন না। পরিশেষে বলতে হয়, প্রকৃতির দান কুদুম গুহার প্রতি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যদি সুদৃষ্টি দেয় তাহলে দার্জিলিংয়ের রক গার্ডেনের চেয়ে আমাদের হোয়াইকংয়ের কুদুম গুহার নয়ন জুড়ানো অপার সৌন্দর্যের প্রাকৃতিক দৃশ্য কোনো অংশে কম হবে কি?
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।