আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

১/১১-এর জন্য দায়ী মওদুদ হুদা সাকা ও আমিনুল


সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক উল হক ওয়ান-ইলেভেনের জন্য বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার আমিনুল হক, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে দায়ী করে বলেন, আমার জুনিয়র, তাকে সবাই কম চেনে, সে হল ব্যারিস্টার আমিনুল হক। এই আমিনুল হকই খালেদা জিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিল। আপিল বিভাগের বিচারপতিদের তালিকা ছিল আমার কাছে। সাকা চৌধুরী এসে ওই তালিকা নিয়ে তাতে দাগ দিয়ে দিতেন, কার প্রমোশন হবে আর কার হবে না। ব্যারিস্টার আমিনুল হক, ব্যারিস্টার মওদুদ, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা আর সাকা চৌধুরী- এ চারজনই ওয়ান-ইলেভেনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী।

আর দুর্ভাগ্য হল, এ চারজনই ওয়ান-ইলেভেনের সময় নির্যাতিত হয়েছেন। আর ড. কামাল হোসেন হলেন এ ওয়ান-ইলেভেনের পরামর্শদাতা। এ ওয়ান-ইলেভেন নিয়ে অন্যদের গালি দিয়ে কোন লাভ নেই। গালি দিতে হলে এদেরই দিতে হবে। শনিবার যুগান-র আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান বক্তার বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।

গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় বক্তারা বলেন, ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়াই বড় কথা নয়, সময়ের প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করতে হলে দেশ ও জাতির কল্যাণের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ নাগরিক সমাজের মতামত নিয়ে মৌলিক অধিকার ও মৌলিক কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ওপর ভিত্তি করে, ধীরে ধীরে একটি অত্যাধুনিক, প্রগতিশীল, জনকল্যাণমুখী সংবিধান তৈরি করতে হবে। তাড়াহুড়া করে কোন বিশেষ ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে সংবিধান সংশোধন করলে তার ফল ভালো হবে না। বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সংশোধন করা হলে ভবিষ্যতে ওই বিশেষ ব্যক্তি বা দলকেই এ ধরনের সংশোধনের বিরূপ ফল ভোগ করতে হবে। বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য সামনে রেখে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে।

পেশিশক্তির মাধ্যমে কেউ যাতে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসতে না পারে সংবিধানে সে ব্যবস'া থাকতে হবে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক উল হক আরও বলেন, ’৭২ সালের সংবিধান নয়, এ সংবিধানকে যুগোপযোগী ও আধুনিক করতে হবে। তিনি সংবিধান প্রণয়নের আগে ড. কামাল হোসেন, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলামসহ বিশেষজ্ঞ এবং বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই সংবিধানের সংশোধনী চূড়ান- করার পরামর্শ দেন। যুগান-র সম্পাদক অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপির সভাপতিত্বে পত্রিকার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘৭২-এর সংবিধানে প্রত্যাবর্তন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আরও অংশ নেন বিএনপি নেতা সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি, আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না, সিপিবি নেতা হায়দার আকবর খান রনো, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট আবুল মকসুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ও যুগান-রের নির্বাহী সম্পাদক সাইফুল আলম। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন যুগান-রের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক হাসান মামুন এবং অনুষ্ঠানে উপসি'ত ছিলেন প্রধান প্রতিবেদক রফিকুল ইসলাম রতনসহ যুগান-রের সম্পাদকীয় বিভাগের সাংবাদিকরা।

বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম ওয়ান-ইলেভেনসহ বিভিন্ন সামরিক শাসনের পেছনে রাজনীতিবিদদের দায়ী করে বলেন, আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মধ্যে সততা, যোগ্যতা ও দেশপ্রেমের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। কোন সরকারই তাদের কথা রাখে না। নির্বাচনের আগে সবাই এক কথা বলে, নির্বাচনের পরে ক্ষমতায় বসে কাজ করে অন্যটা। মুখে দেশের কথা, জনগণের কথা বললেও লক্ষ্য থাকে চেয়ার দখল করার আর আখের গোছানোর। চেয়ারে যিনিই বসেন, তিনিই নিজেকে রাজা ভাবেন, বাকিদের ভাবেন প্রজা।

কথা ও কাজে মিল না থাকায় বিভিন্ন সময়ে দেশে সংবিধান লংঘন ও সামরিক শাসনের মতো ঘটনা ঘটেছে। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন, নির্বাচন সম্পর্কে ক্ষমতাসীন দলসহ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্ম হয়েছে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়েছেন। তাকে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে এ পদে আনা হয়েছিল। কিন' তার আগের পদে ফিরে যাওয়ার জন্য সংবিধান সংশোধন করে সংবিধান লংঘন করা হয়েছে।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন সংবিধান লংঘন করে সামরিক শাসন যেন না আসে, সেজন্যই সংবিধান সংশোধন করা হবে। কিন' সংবিধানের কোথাও তো সংবিধান লংঘন করতে বলা হয়নি। সামরিক শাসন আসে তো রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা আর অদক্ষতার কারণে। রাজনীতিবিদরাই তো তাদের ক্ষমতায় আসার পথ করে দেন। যত বিধানই করা হোক না কেন, রাজনীতিবিদদের চরিত্রের পরিবর্তন না ঘটলে এ অবস'ার উত্তরণ সম্ভব নয়।

এজন্য তিনি রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক মনোবৃত্তির সঠিক চর্চা করার আহ্বান জানান। তবে সামরিক শাসন জারি হলেও পরবর্তী সময়ে ফৌজদারি আইনে বিচার করার বিধান সংযুক্তির দাবি করে তিনি বলেন, সামরিক শাসন জারির পর যখন তা থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ করা হয়, তখন সামরিক শাসন জারিকারীদের বিচার করার বিধান করা যেতে পারে। সংবিধানে এমন একটি বিধান যুক্ত করা উচিত, যাতে কেউ সংবিধান লংঘন করলে পরবর্তী সময়ে ফৌজদারি আইনে তার বিচার করা যায়। তিনি মেক্সিকো ও আর্জেন্টিনায় এ বিধান রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বহাল রাখার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, এ অনুচ্ছেদের কারণে এমপি কথা বলতে পারেন না- এ কথা ঠিক নয়।

পার্লামেন্টারি পার্টিতে কথা বলতে পারেন, কোন বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। সংসদে এসে কথা বলতে পারেন, প্রয়োজনে পদত্যাগ করতে পারেন। তিনি ইংল্যান্ডের সাম্প্রতিককালের উদাহরণ দিয়ে বলেন, দ্বিমত হওয়ায় লেবার পার্টির মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে আবার এমপি পদে দাঁড়িয়েছেন। আমাদের দেশেও চতুর্থ সংশোধনীর বিরোধিতা করেন ২ জন সদস্য। তারা সদস্যপদ হারিয়েছিলেন এবং ৩ জন সদস্য চতুর্থ সংশোধনীতে স্বাক্ষর না করায় তাদের সদস্যপদ ও দল বিলুপ্ত হয়েছিল।

এমপিরা এ সাহস দেখান না কেন? যতদিন পর্যন- রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ পরিবর্তন না আসবে, ততদিন পর্যন- এই ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করেও লাভ হবে না। সংবিধান সংশোধনের জন্য বিশেষ কমিটি গঠনকে স্বাগত জানিয়ে সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, পঞ্চম সংশোধনীর লিখিত রায়ের আগে কমিটি গঠন করে কোন অসুবিধা হয়নি, বরং এ কমিটি আরও বেশি আলোচনার সুযোগ পাবে। পঞ্চম সংশোধনীর লিখিত রায় এখনও আপিল বিভাগ দেয়নি। তারা কি দেবে তা এখনও জানি না। তাই এ কমিটির আলোচনার বিষয়বস' কি হবে, তা এখনও বলা সম্ভব নয়।

তবে কমিটিতে সামরিক শাসনসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বিচারপতিদেরও সমালোচনা করে বলেন, বিচারপতিরা সংবিধান সংরক্ষণের শপথ নিলেও এর আগে তারা সামরিক শাসনের বৈধতা দিয়েছেন। শুধু ব্যতিক্রম বিচারপতি মোর্শেদ। এদেশে বিচারপতি কায়েনির মতো একজন বিচারপতির বড় অভাব রয়েছে। বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম আরও বলেন, ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া মানেই পিছিয়ে যাওয়া নয়।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে গেলে দেশ শত বছর এগিয়ে যাবে। সমাজতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা- এ দুটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে দেশ এগিয়ে যেতে পারে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর হতে পারে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েম ছাড়া গত্যন-র নেই। তবে এর বিরুদ্ধে কায়েমি স্বার্থবাদীদের বড় ধাক্কা আসবে- এ ধাক্কা সামাল দিতে হবে।

বিশিষ্ট আইনজীবী সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক উল হক বলেন, সংবিধানকে যুগোপযোগী এবং ২০৫০ সালের উপযোগী করতে হবে। এজন্য ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে আসা কখনোই সম্ভব নয়। সবার মতামতের ভিত্তিতে সংশোধন করলে সংবিধান গ্রহণযোগ্য ও যুগোপযোগী হবে। এজন্য তিনি বিশেষজ্ঞ ও সর্বস-রের জনগণের প্রতিনিধির মতামত নেয়ার জন্য কমিটিকে পরামর্শ দেন। তিনি সংবিধানের বিশেষ কমিটি গঠন সম্পর্কে বলেন, এ কমিটিতে বিএনপির থাকা প্রয়োজন ছিল।

বিএনপির মতামত গৃহীত না হলে তারা নোট অব ডিসেন্ট দিতে পারেন। ব্যারিস্টার রফিক উল হক বলেন, সরকার ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের কথা বলছে। এটা করার জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছে তাতে কো-চেয়ারম্যান করা হয়েছে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে। কিন' তিনি তো নিজেই ’৭২-এর সংবিধানে স্বাক্ষর করেননি। বঙ্গবন্ধু নিজে যেখানে স্বাক্ষর করেছেন, সেখানে তিনি দ্বিমত পোষণ করেছেন।

আর তাকেই সেই ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার হক বলেন, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে লিভ টু আপিল করা হয়েছে। কিন' আপিল বিভাগ লিভ মঞ্জুর করেনি। আপিল বিভাগের উচিত ছিল পঞ্চম সংশোধনীর ক্ষেত্রে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) মঞ্জুর করা।

কিন' সংবিধানে এরকম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত থাকা সত্ত্বেও আপিল বিভাগ লিভ দিল না- এটা একটা লজ্জার বিষয়। এরকম একটি বিষয় নিয়ে দাঁড়ালেই আপিল বিভাগের লিভ মঞ্জুর করা উচিত। কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে লিভ খারিজ করা হয়েছে। তারপর ৫ মাস অতিবাহিত হয়েছে, কোথায় সেই পর্যবেক্ষণ? বিচারপতি হামিদুল হক রিমান্ড সম্পর্কে ২০০০ সালে একটি রায় দিয়েছেন। এর বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল।

আপিল বিভাগও হামিদুল হকের রায় বহাল রেখেছে। ৩ মাসের মধ্যে এ রায় কার্যকরের কথা বলেছেন। কিন' সরকারের কোন উদ্যোগ নেই। কোর্টের যখন প্রয়োজন, তখন সরকার কোর্টকে ব্যবহার করে, আর যখন প্রয়োজন নেই, তখন কোর্টকে বাদ দেয়া হয়। প্রবীণ এ আইনজীবী আরও বলেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং বিসমিল্লাহ পরিবর্তন করা হলে সাবেক রাষ্ট্রপতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার প্রতিবাদ করে তার প্রতিনিধিকে চলে আসতে বলেছেন।

বিএনপিও এর প্রতিবাদ ও সমালোচনা করতে পারে। তাই বিশেষ কমিটিকে এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে সংবিধান সংশোধনের সুপারিশ করতে হবে। আর ভোলার উপনির্বাচনের মতো একটি নির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই সবকিছু বিবেচনায় এনে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এজন্য সবার মতামত নিতে হবে।

হাসিনা-খালেদার জন্য তো সংবিধান সংশোধন করা হচ্ছে না, সংবিধান সংশোধন করা হচ্ছে দেশের জনগণের জন্য। তিনি ওয়ান-ইলেভেনের জন্য ব্যারিস্টার আমিনুল হক, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে দায়ী করে বলেন, তাদের কারণেই ওয়ান-ইলেভেনের সৃষ্টি হয়েছে। আর তারাই ওয়ান-ইলেভেনে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছেন। এ ইতিহাসকে সবার উপলব্ধিতে আনতে হবে। তাই সংবিধান নিয়ে খেলতে গেলে, যারাই খেলবেন, তারাই ভবিষ্যতে ‘ভিকটিম’ হবেন।

এ প্রসঙ্গে তিনি রাষ্ট্রধর্ম ও বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সংবিধানে প্রবর্তনের কথা উল্লেখ করে বলেন, মালয়েশিয়ার সংবিধানের আলোকে অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও এ সংবিধানে মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। এখানে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টানসহ অন্য ধর্মাবলম্বীরা সুষ্ঠুভাবে ধর্ম পালন করছেন- এ কথা ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি স্বীকার করেছেন। তাই বিশেষ কমিটি শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বিলুপ্ত করার জন্য করা হলে এটা ভুল হবে। তিনি আরও বলেন, ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া কখনোই সম্ভব নয়।

সংবিধান হতে হবে সবার জন্য, কোন রাজনৈতিক দলের জন্য নয়। বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বলেন, সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন কেন? বিসমিল্লাহ আছে বলেই কি? আর সংবিধানের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করার জন্যই কি সংবিধানের সংশোধন হচ্ছে? সরকারের সংবিধান সংশোধনের এজেন্ডা পরিষ্কার নয়। এজেন্ডা নির্ধারণ করতে হবে। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর সময়ও বিএনপি কোন পূর্ব এজেন্ডা নির্ধারণ করে দেয়নি। সংবিধানে সবার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে হবে।

সংবিধানকে যুগোপযোগী এবং সময়োপযোগী করতে হবে। তিনি বলেন, আদালতের রায় সংবিধান সংশোধনের ভিত্তি হতে পারে না। আর যদি দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সংবিধান সংশোধন করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এ সংবিধান সংশোধন পরিবর্তন করা হবে। পঞ্চম সংশোধনী খারাপ কিসে? পঞ্চম সংশোধনী তো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়েছিল। চতুর্থ সংশোধনী বাতিল করেছিল।

এটাই কি পঞ্চম সংশোধনী করার অপরাধ? তাছাড়া আদালতের রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা হল। এখন বিএনপিকে ডাকছেন নিজেদের সমাধি নিজেদের দিয়েই করে দেয়ার জন্য। নাকি বর্তমান সরকার সবাইকে আনতে চাচ্ছে তাদের মতো করে সংবিধানের বৈধতা দেয়ার জন্য? দুই নেত্রীকে একত্রে বসার জন্য ব্যারিস্টার রফিক উল হককে উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দিয়ে নাজমুল হুদা বলেন, দুই নেত্রীকে একত্রে বসতে হবে। এজন্য চাপ সৃষ্টি করুন। মৌলিক ইস্যুগুলোর ব্যাপারে একটা সমাধানে পৌঁছতে হবে।

কারণ এ দুই নেত্রীই দেশ চালাচ্ছেন। সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ’৭২ সালের সংবিধান বঙ্গবন্ধু চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে কবর রচনা করেছেন। তাহলে আমরা কি বলব, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নন? সংবিধান সংশোধন একটি স্পর্শকাতর বিষয়। তবে সময়ের প্রয়োজনে জনকল্যাণে সংবিধান অবশ্যই পরিবর্তন করা উচিত। আলাপ-আলোচনা করেই এ সংশোধন করা প্রয়োজন।

এ সংশোধন যেন একক দলের জন্য না হয়, জনগণের কল্যাণে হয়- এটাই মনে রাখতে হবে। সংবিধান সংশোধন করার পর তা গণভোটে পাঠাতে হবে। তিনি বলেন, পঞ্চম সংশোধনী সম্পর্কে আপিল বিভাগের রায় এখনও পাওয়া যায়নি। এখনও আমরা অন্ধকারের মধ্যেই হাঁটছি। আইন-শৃংখলা পরিসি'তির অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি- এগুলো হল সময়ের আলোচিত বিষয়।

এসব বিষয়ে সরকারের কোন নজর নেই, সংবিধান সংশোধনের কথা বলা হচ্ছে। তিনি জামায়াতের প্রতিনিধিকে সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে যুক্ত করার অনুরোধ জানান। তিনি আরও বলেন, বিএনপি যে সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত কমিটিতে আসবে না তা বলা হয়নি। সরকারি দল কি কি সংশোধন করতে চায়, তা আগে নির্ধারণ করতে হবে। বিশেষ উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধন করলে কারও জন্যই মঙ্গল হবে না, দেশে আরও বিভক্তি বাড়বে।

জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি বলেন, সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ কমিটির কোন নির্দিষ্ট এজেন্ডা নেই। ২৯ জুলাই এ কমিটির প্রথম বৈঠকে আলোচ্যসূচি নির্ধারণের চেষ্টা করা হবে। বিশেষজ্ঞ এবং সংসদের বাইরের অন্য দল ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বক্তব্য নিয়ে কমিটি কাজ করবে। বহু মতের লোকের পরামর্শ নেবে কমিটি। এক্ষেত্রে কমিটি উন্মুক্ত থাকবে।

তাড়াহুড়া করে বা মৌলিক অধিকার হরণ করে বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস'াকে নাকচ করে কমিটি কোন কিছুই করবে না। সংবিধানকে যুগোপযোগী করা হবে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ এবং কাজের পরিধি নির্ধারণ করে দেয়া হবে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, তিন জোটের রূপরেখা ও অন্যান্য আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা নিয়েই সংবিধান সংশোধন করা হবে। এ সংবিধানের অপূর্ণতা, অসঙ্গতি দূর করা, সামরিক শাসকদের অবৈধ হস-ক্ষেপ বন্ধ করা- এগুলোই আলোচনার বিষয় হতে পারে।

তিনি প্রতিনিধি পাঠানোর জন্য বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, এ সংবিধান সংশোধনী কমিটিতে শুধু সরকারি দল নয়, বিরোধী দলের প্রতিনিধিও থাকা প্রয়োজন। জাসদ সভাপতি বলেন, সংবিধানকে যুগোপযোগী ও আরও গণতান্ত্রিক করার জন্য যা যা করা দরকার এ কমিটি তা তা করবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকেই সংবিধানকে গণতান্ত্রিক করা হবে। তবে তাড়াহুড়া করে কোন কিছুই করা হবে না। সংসদের রীতি-নীতি অনুযায়ীই সবকিছু করা হবে।

সিপিবি নেতা হায়দার আকবর খান রনো বলেন, ’৭২-এর সংবিধান খারাপ সংবিধান নয়। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সংবিধান হিসেবে সবচেয়ে ভালো সংবিধান। একটি মাত্র ব্যক্তির জন্য সংবিধান সংশোধন করা ভালো হয়নি। এ বিশেষ কমিটি বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন দল ও মতের প্রতিনিধিদের বক্তব্য শুনবে। তবে সুপ্রিমকোর্টের রায়কে মূলধন করেই সংবিধান সংশোধন করতে হবে।

’৭২ সালের সংবিধানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কোন স্বীকৃতি ছিল না, এ স্বীকৃতি দিতে হবে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখা যাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস'াও বাতিল করা ঠিক হবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গঠিত কমিটির কার্যপরিধি স্পষ্ট করা হয়নি। বিএনপি মনে করছে, মৌলিক জিনিসের পরিবর্তন আসছে। দু’দলের মধ্যে বড় ধরনের ফারাক রয়ে গেছে। বড়মাপের ফারাক রেখে কোন কিছু করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন কোন রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হবে না।

তবে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনার আলোকে ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাব। কিন' সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনা এখনও পাওয়া যায়নি। সংবিধানকে যদি আধুনিক ও সময়োপযোগী করতে চাই, তাহলে সেটা বড় ব্যাপার। এর জন্য সবার কাছে যেতে হবে, মতামত চাইতে হবে। এজন্য ইন্টারনেটে বিশেষ কমিটির একটি ওয়েবসাইট থাকতে হবে।

জাতীয় পার্টির নেতা কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের জন্য সংবিধান সংশোধন করেই সংবিধান লংঘন করা হয়েছে। এ ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। সংবিধান কোন মহাকাব্য নয়। দেশ এবং জাতির প্রয়োজনে সংবিধানের পরিবর্তন করা যায়। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আর ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া- এ দুটিকে সমন্বিত করতে হবে।

বিশেষ কমিটিকে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ করার জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এটা না হলে সংবিধান নিয়ে আওয়ামী লীগ যদি প্যাঁচ লাগিয়ে দেয়, তাহলে প্রগতিশীল রাজনীতির ক্ষতি হবে। তিনি বলেন, সংবিধান বারবার কাটাছেঁড়া হয়েছে। এতে বর্তমান সংবিধানে ’৭২-এর প্রগতিশীল ধারা নেই।

তাছাড়া ’৭২-এর সংবিধানে ফেরার কথা কেন বারবার বলছি? সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী যখন হয়েছে, তখন সংবিধানের মূল চরিত্র বদলে গেছে। তাই ’৭২-এর চেতনাকে ধারণ করে, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ব্যবস'া চালু করব- এটাই মূল কথা। ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ’৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়া নয়, সংবিধানকে যুগোপযোগী ও আধুনিক করতে হবে। সংসদীয় বিশেষ কমিটির বাইরেও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আলাদা কমিটি গঠন করা যেতে পারে। ভারতে সংবিধান পরিবর্তনের জন্য সুপ্রিমকোর্টের সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল।

ওই কমিটিতে কোন সংসদ সদস্য ছিলেন না। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বিলুপ্ত হলে দেশ গভীর সংকটে পড়বে। আর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলে আবার দেশ উগ্র রাজনৈতিক দলের খপ্পরে ফিরে যাবে কিনা- তা ভেবে দেখতে হবে। তাই আইন বা সংবিধান নিয়ে অনৈতিক খেলা বন্ধ করতে হবে। অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

এ সংবিধানে প্রচুর গলদ ছিল। সংবিধান করতে হবে ২০৫০ সালের উপযোগী করে। সংবিধানে স্পিকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে; রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করতে হবে; মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। ফরোয়ার্ড লুকিং সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। তাই এমনভাবে সংবিধান সংশোধন করতে হবে, জাতি চিরদিন যাতে সংসদ সদস্যদের স্মরণ করে।

যুগান-র সম্পাদক অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি বলেন, সংবিধান সংশোধনে ইতিমধ্যে সর্বদলীয়ভাবে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিএনপি সে কমিটি বয়কট করেছে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোট বলছে, ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে গেলে গণতন্ত্র ধ্বংস হবে, বাকশাল ফিরে আসবে, মিডিয়া স্বাধীনতা হারাবে। অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাদের মৌলিক চেতনার স-ম্ভ, আমাদের মুক্তির সনদ, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের রাষ্ট্র গঠনে আমাদের ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতেই হবে। এ অবস'ায় আপনাদের মতো গুণী, মানবতাবাদী মানুষের ভাবনাগুলো দেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে চাই।

সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে, যা করলে দেশ ও জনগণের কল্যাণ হয়, সে ব্যাপারে বক্তব্য প্রদানের জন্য গোলটেবিলে উপসি'ত বক্তাদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। যুগান-রের নির্বাহী সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, বর্তমানে সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। সংশোধনের ধারায় আরও একটি সংশোধনী যুক্ত হতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে সরকার সে ব্যাপারে ঘোষণা দিয়েছে। এর জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করেছে।

এর পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা শুরু হয়েছে। আমরা জাতির সামনে আপনাদের সুচিনি-ত মতামত তুলে ধরার জন্যই এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছি। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরও বড় আকারের গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হবে। (দৈনিক যুগান্তর)
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।