আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চন্দ্রকথা-গ্রহণ

গোধুলি ভালবাসায় ভিজে একসারা একাকী একজন।

আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে। দুই হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। প্রকৃতি যেন আজ মেতেছে ধ্বংসের খেলায়। এই প্রলয়ের মাঝেই সব কিছুকে তুচ্ছ করে পালিয়ে যাচ্ছি আমি চন্দ্রকে নিয়ে।

বুকের মাঝে কি এক বন্য উন্মাদনা। কি হবে ভবিষ্যত এই ভাবনা এখন অর্থহীন আমার কাছে। একটু আগে অনাকাংক্ষিত ভাবে পাওয়া সুযোগ আমি কিছুতেই মিস করতে চাই না। কি এক ঘোরের মাঝে ছুটে চলেছি। মনে হচ্ছে এখনও ট্রেনের সেই কম্পার্টমেন্টে দাঁড়িয়ে আমি আর আমার দিকে প্রচন্ড বেগে ধেয়ে আসছে মুর্তিমান আতঙ্ক।

নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠি। সেই মুহুর্তে আমার মাঝে কি ভর করেছিল জানি না। শুধু মনে হচ্ছিল চন্দ্রের গায়ে একটা আচঁড়ও যদি লাগে আমি সব কটাকে নিজ হাতে খুন করব। শান্ত চোখে দেখছিলাম লোকটার ছুটে আসা। চন্দ্র প্রবল আতংকে ক্রমাগত চেঁচাচ্ছিল আর আমাকে সরিয়ে সেখানে নিজে দাঁড়াবার চেষ্টা চালাচ্ছিল।

চন্দ্রের চেঁচামেচির কারণেই কি না কে জানে সীটে বসা লোকগুলি উঁকিঝুকি মারতে শুরু করেছে। লোকটা দু'হাত দুরেও নেই পৌঁছে গেছে প্রায়। এমন সময় আচমকাই কিসে যেন পা পিছলে দড়াম করে পড়ল মেঝেতে বদমাশটা। কে জানি ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠল। কয়েক ঘন্টা আগে আমার সামনে বসে থাকা সেই ভয়ংকর লোকটা! যার ভয়ে পালিয়েছিলাম।

শয়তানটা কিসে আছাড় খেয়েছে বুঝতে পারলাম। কাঁচা ঘুম এভাবে ভেঙ্গে যাওয়ায় লোকটা যেন একেবারে আগুন হয়ে গেল রেগে। নিচে পড়ে থাকা লোকটাকে তুলে একটা আছাড় দিল প্রচন্ড বেগে। তুমুল মারামারি বেঁধে গেল দুই পক্ষের মাঝে। এখানে আর এক মুহুর্তও নয়।

কালক্ষেপণ না করে ট্রেনের চেইন টেনে দিলাম। ট্রেন পুরোপুরি থামার অপেক্ষায় না থেকে দৌঁড়ে নিচে নামলাম। একবার উঁকি দিলাম ভেতরে। তাকিয়ে দেখি পুরো কম্পার্টমেন্টের লোকজনই প্রায় জড়িয়ে পড়ছে মারামারিতে। আর দেরী নয়।

একবার চন্দ্রের দিকে তাকালাম,দেখি চোখের জলে মাখামাখি হয়ে আছে সারা মুখ। এত্ত মায়া লাগল! বুকের ভেতর অদ্ভুত এক দৃঢ়তা এসে ভর করল যেন। চন্দ্রের হাত শক্ত করে ধরে বললাম 'চলুন পালাই'। চন্দ্র ইশারায় সম্মতি জানাতেই ছুট লাগালাম। রেলপথ থেকে অনেক দূরে এক বনানীর কাছে দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিচ্ছি একটু।

এখন কত রাত কে জানে। ট্রেন ছাড়ার পর থেকে আর সুযোগই হয়নি ঘড়ি দেখার। একবার আকাশের দিকে তাকাই। মেঘ জমেছে বেশ। বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে যেকোন সময়।

চিন্তিত হয়ে পড়লাম। চন্দ্রকে বলতেই যাচ্ছিলাম যে 'বৃষ্টি হতে পারে' এমন সময় দূরে কাদের ফিসফাসের শব্দ ভেসে এল। কারা যেন নিচু স্বরে খুব সতর্ক ভাবে কথা বলছে। লোকগুলো অনেক দূরে। গাছপালার ফাঁক দিয়ে আলোর ঝলকানি দেখতে পেলাম।

আতংকের একটা শীতল স্রোত যেন বয়ে গেল। কারা এরা? চন্দ্রের খোঁজে আসছে না তো? ইঙ্গিতে চন্দ্র কে চুপ থাকতে বললাম। ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছি ঢুকে যাচ্ছি বনের গভীরে। লোকগুলি কাছকাছিই কোথাও আছে। কথা শোনা যাচ্ছে আগের চেয়ে জোরে।

হ্যাঁ এরা চন্দ্রকেই খুঁজছে। সম্ভবত আমরা যখন পালাচ্ছি তখন চন্দ্রের স্বামীর সাঙ্গপাঙ্গরা কোন ভাবে দেখে ফেলেছিল আমাদের। কখন থেকে এরা পিছু নিয়েছে কে জানে। এতটাই উত্তেজিত ছিলাম যে কিছুই খেয়াল করিনি। মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে।

মাঝে মাঝে বিদ্যুত চমকে চারদিক আলোকিত করে তুলছে। সেই আলোয় দেখলাম লোকগুলো খুব বেশি দূরে নেই। জংলা মত একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে কি যেন শলাপরামর্শ করছে ওরা। আতংকিত চোখে দেখছি লোকগুলা ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে, সবার হাতেই অস্ত্র। আর হয়ত ঘন্টাখানেক লাগবে ওদের আমাদের ধরে ফেলতে।

কি করি?! পাগলের মত চারপাশে একবার তাকাই। বনটা খুব বড় নয় যে অনায়াসে লুকানো যাবে। গাছপালাও বেশ দূরে দূরে। ঝোপঝাড়ের অস্তিত টের পাওয়া যাচ্ছে আবছা আবছা ভাবে। বড় একটা ঝোপের আড়ালে বসে আছি আমরা।

একমনে সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে চলেছি। চন্দ্র একদম আমার গা ঘেঁসে বসে আছে। প্রচন্ড ভয় পেয়েছে মেয়েটা। একদম চুপ হয়ে আছে। বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে।

বড় বড় ফোঁটার সাথে দমকা ঝড়ো হাওয়া। ভিজে চুপসে গেলাম মিনিটখানেকের মাঝেই। এ এক দিক দিয়ে ভালই হলো। এই প্রবল বৃষ্টিতে আমাদের খুঁজে পেতে সময় লাগবে শত্রুপক্ষের। খুব বেশি খোঁজাখুজ়ির মাঝে যাবে না ওরা এমন আশা নিয়ে বসে আছি ঘাপটি মেরে।

' উফফ!! ওহ মাগো! কি কামড় দিলো?' খুব কাছ থেকেই কে জানি আর্তনাদ করে উঠল। ' সাপ ! সাপ !! ' ভয়ার্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠল লোকটা। 'সাপ ???!!!!' পায়ের নিচ দিয়ে কি যেন চলে গেল। শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল মেরুদন্ড বেয়ে। চন্দ্র লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

চেঁচিয়েই উঠতেই যাচ্ছিল। মুখে হাত চাপা দিয়ে কোন রকমে থামালাম ওকে। ঝোপ থেকে দূরে সরে এলাম। ঝোঁপটার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। ঘাড় ঘুরালেই দেখে ফেলবে আমাদের।

কিন্তু মনে হয় না সেই অবস্থা আছে লোকটার। যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে পড়ে গেল নিচে। ছুটন্ত পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। ভয়ার্ত গলায় চিতকার করতে করতে ছুটে পালাচ্ছে লোকগুলা। কেন ওরা এত ভয় পেয়েছে বুঝতে পারলাম বিদ্যুত চমকানোর সাথে সাথে।

চারপাশে কিলবিল করে বের হচ্ছে অসংখ্য সাপ! আমরা যে ঝোপের আড়ালে বসে ছিলাম সেটাই সম্ভবত সাপের আখড়া। বৃষ্টির সাথে সাথে বের হয়ে এসেছে গর্ত ছেড়ে। চারপাশে এত সাপ দেখে পা দুটোর ওজন বেড়ে গেল একশ মণ। চন্দ্র আতংকিত গলায় চেঁচিয়ে উঠল 'অরণ্য!! সাপ! সাপ!! ও আল্লাহ!!চারপাশেই তো সাপ! অ-র-ণ্য!!! আমার হাতে একটা ঝাঁকি দিল। সম্বিত ফিরে পেলাম যেন এতক্ষণে।

সাপ আমি সবসময়ই ভয় পাই। কেমন জানি গা গুলায় সাপ দেখলে। আর সেই আমি দাঁড়িয়ে আছি সাপের আখড়ার মাঝে! বুকের খাঁচায় এত জোরে বাড়ি খাচ্ছে হৃতপিন্ড যে মনে হচ্ছে যেকোন সময় ফেটে যাবে। চন্দ্র চেঁচিয়েই চলেছে পাগলের মত। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে মেয়েটা।

ওর হাত ধরে টান দিলাম। ছুটতে ছুটতে সরে যাচ্ছি দ্রুত জায়গাটা থেকে। এত জোরে দৌঁড়াচ্ছি যে পা প্রায় পড়ছেই না মাটিতে। একরকম উড়েই চলেছি। জঙ্গলটা থেকে বের হয়েও দৌঁড় থামালাম না।

চন্দ্র খুব হাঁপিয়ে গেছে। তবু দৌঁড়ে চলেছে আমার সাথে সাথেই প্রাণ বাজি রেখে। কেমন করে এই বিভীষিকার হাত থেকে মুক্তি পেলাম জানি না। ঐরকম সাপের আখড়া থেকে কি করে একটা সাপের কামড়ও না খেয়ে অক্ষত দেহে বের হয়ে আসলাম ভেবে অবাক লাগছে। অনেক দূর চলে এসেছি দৌঁড়ে।

সামনেই রাস্তা। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। দুজনেই ভিজে চুপচুপে। সম্ভবত মাঝ রাত পেরিয়ে গেছে। আর হয়ত ঘন্টা খানেক লাগবে দিনের আলো ফুটতে।

এখন পর্যন্ত ভাগ্যের জোরে বেঁচে ফিরে এসেছি। কিন্তু এখন কি করব? রাস্তার দু পাশেই জঙ্গল। সুনসান নিরব চারিদিক। শুধু একটানা বৃষ্টির শব্দ। মাঝে মাঝে বিদ্যুত চমকে চারপাশ আলোকিত করে তুলছে।

কোথায় নেমেছিলাম ট্রেন থেকে আর পালিয়ে কোথায় চলে এসেছি বুঝতে পারছি না। 'চন্দ্র কি করি বলুন তো? এখানে দাঁড়াবার মত জায়গাও তো দেখছি না। ' চন্দ্র কথা না বলে অসহায় একটা ভঙ্গী করল। আবার জঙ্গলে যাবার মত রিস্ক নিতে পারছি না। আবার খোলা আকাশের নিচে এই রকম ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজাও সম্ভব না।

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মতই বিশাল রাস্তাটা চলে গেছে বহুদুর। ভিজে ভিজে এগিয়ে চলেছি অজানা পথে। চন্দ্র আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন বলল। শুনতে পেলাম না। বৃষ্টির শব্দের নিচে চাপা পড়ে গেল ওর কন্ঠ।

ওর হাতটা জড়িয়ে নিলাম নিজের হাতে। চলবে.. চন্দ্রকথা-পলায়ন Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।