"তার ও আগে বৃষ্টি নামুক আমাদের বিবেকের মরভূমিতে/ সেখানে মানবতা ফুল হয়ে ফুটুক, /আর পরিশুদ্ধ হোক ধরা,হৃদয়ের গ্লানি..."--শফিকুল ইসলাম
"এই ঘর এই লোকালয়"
গ্রন্থ পর্যালোচনায়--মিলি চৌধুরী
কবিতা জীবনেরই প্রতিচছবি । জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা যা মানুষকে করে রাখে স্মৃতি কাতর । সেই কাতরতার শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে সাহিত্যের এই প্রিয় ভূবন কবিতার মাঝে । কবি বা লেখক তার আপন মনের মাধূরী মিশিয়ে চয়ন করে তোলে কবিতার শরীর । বলা যায় - যা পাওয়া হয়নি ,যা পাবার কথা ছিলো যা পাওয়া যেতো -তা না পাবার প্রয়াসও ঘটে কবিতার ছত্রে ।
মানুষের জীবনটাই চাওয়ার সাথে পাওয়ার অমিলে পরিপূর্ণ । একথা জেনেও বিবাগী মন বার বার অবাধ্য হয় , অবুঝ বিশ্বাসে প্রতারিত হয়ে ফিরে আসে নিজের মাঝেই । আর তখন এক বৈপরিত্যের নিঃশব্দ যন্ত্রনায় ত বিত হয় ভেতরের জগত । তাইতো অবলীলায় সেই যন্ত্রণাকে কবিতার মাঝে তুলে ধরে কবি ।
কবি শফিকুল ইসলাম এক জীবন বিদগ্ধ চেতনার কবি ।
হৃদয়ের টানাপোড়নের কথামালা তিনি অসাধারন মমতা ও মেধায় তুলে এনেছেন তার কাব্যগ্রন্থ "এই ঘর এই লোকালয় " এ । ২০০০সালের ২১ শে বই মেলায় এর প্রথম প্রকাশ । ছোট বড় তেষট্টি কবিতার সমাহার ঘটেছে এই কাব্য গ্রন্থে । কাব্য গ্রন্থের প্রথম কবিতার নাম করনেই কবিতার বইয়ের নাম করন । প্রতিটির কবিতার নাম করনে বিশেষত্ব দেখা যায় দীর্ঘতা ।
সাধারনত সংক্ষিপ্ত নামেই কবিতার নাম হয় । এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায় । আর তাই প্রতিটি কবিতায় নাম করনের মাঝে নতুনত্ব পাওয়া যায় ।
এ গ্রন্থের প্রায় অধিকাংশ কবিতাই বিরহ বেদনায় ভারী । কবির ভালোবাসার জগতের পুরো অংশই না পাবার অথবা পেয়ে হারাবার কষ্টকে গভীর অভিমানে লালন করেছেন ,যা কবিতায় তুলে ধরতে কবি একটু ও দ্বিধাবোধ করেন নি ।
কবির এই সাহসী উচ্চারনে প্রতিটি কবিতায় হয়ে উঠেছে অসাধারন মনোগ্রাহী ও সুখপাঠ্য । বেদনার রূপ কি একই রকম হয় ? হয়তোবা । নতুবা কবির বিরহ ,স্মৃতি কাতর কিছু কিছু কবিতা মনে হয় যেন এ বেদনা নিজের জীবনেরই প্রতিরূপ । নিশ্চয় এটা ভাবা অন্যায় হবেনা । আর এখানেই তো কবির স্বার্থকতা ।
আমাদের আলোচনায় এই গ্রন্থের শেষ থেকেই শুরু করতে চাই । সর্বশেষ কবিতার নাম - "তোমার বাগানে ফুল ফুটিয়ে" ।
"তোমার জন্যে রেখে যাব সুর ,
তোমার জন্যে গান ,
আমার জন্যে রয়ে যাবে অশ্রু,
আমার জন্যে কান্না।
----------------------
তোমার জন্যে রেখে যাব কবিতা
ভালবাসার লাজ রক্তিম পংক্তিমালা
আমার জন্য নিয়ে যাব
অন্তমিলহীন অন্ত্যজ শব্দমালা"।
এই কবিতার অন্তর্নিহিত কষ্টকে কবি প্রকাশ করেছেন সুন্দর করে ।
কবি প্রিয়াকে উজাড় করে সব দিয়ে নিঃস্ব হতে চান । "তোমার চলে যাওয়া মানে" কবিতায় কবি প্রিয়াকে আগলে রাখতে চান । হৃদয়ের সবটুকু ভালবাসার মাধুরী দিয়ে । তিনি যেন ধরেই নিয়েছেন তার আকুতিতে প্রিয়তমা ফিরে আসবেই । কবির আরেকটি কবিতা "আজ মনে হয় তোমাকে ভালবেসে " এ কবিতার প্রথম দুটি চরণেই কবি নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন ,ভালোবাসা কিনেছেন দুঃখের দামে ।
তাই চারপাশ ম্লান হয়ে গেছে প্রিয়ার চলে যাবার কারণে ।
কবির কবিতা "একদিন এসেছিলে ,ভালবেসেছিলে " কবির মনে স্রোতের মতো ভালবাসার প্লাবন এসেছিল । যদিও ছল করেই প্রিয়ার আসা যাওয়া ,তবুও কবির বিশ্বাস সে এসেছিল এবং তাকে ভাল ও বেসেছিল । কিন্তু কিভাবে অজানা কারনে প্রিয়াকে কবি ধরে রাখতে পারেননি । মানুষের মনে বিচিত্র রূপের অবয়ব কবির কাছে দুর্বোধ্য লেগেছে ।
আর তাই কবিতার শেষ পংক্তিতে জানিয়েছেনঃ
"...সেদিনকার প্রতিটি দৃশ্যপট ছিল অনুপম মোহনীয়
আর তোমার রূপের বিভায় উদ্ভাসিত।
একদিন এসেছিলে ,
আর ভালবেসেছিলে ,
মনে আছে, আজ ও মনে আছে" ।
কবি ভূলতে পারেন না বলেই বারংবার কন্ঠরোধ হয়ে যায় নিরবিচিছন্ন বেদনায় । "আকাশের চাঁদ ছিল "কবিতায় কবি প্রিয়াকে চাঁদের চেয়েও অনুপম সৌন্দর্যে দেখেছেন । ফুল,পাখি,নদী সব আছে শুধু চাঁদের রূপকে হারিয়ে দেয়া সেই মানুষটি হারিয়ে গেছে...।
"জানিনা তুমি আমার কথা ভাবো কিনা "এই কবিতায় কবি মিথ্যে সান্ত্বনায় নিজেকে তবিত করেছেন । প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন অসংখ্যবার । মেলেনি উত্তর । পেয়ে হারাবার বেদনা ও কষ্ট কবিকে তাড়িত করেছে । অবশেষে কবি প্রশ্নহীন থেকে মনকে প্রবোধ দিয়েছেন "যতদিন এ মন থাকবে ততদিন এ মন-বেদনার শেষ হবেনা জানি"।
"যেখানেই যাই ,যেদিকে তাকাই" কবিতায় কবি দারুনভাবে স্মৃতিকাতর । তার জীবনের সকল আয়োজনে প্রিয়ার স্মৃতি তাকে সতত তাড়িত করে ফিরছে । স্মৃতি কখনো সুখের হয় ,কিন্তু এ কবিতায় স্মৃতি কষ্টের জোছনায় প্লাবিত । তবুও প্রিয়ার অতীত স্মৃতি কবিকে বেদনা বিধূর করে তুলেছে । "কতকাল এই বিষন্ন শূন্যতায়" এ কবিতায় কবি হারাবার বেদনাকে একদিকে যেমন বুকের ভেতর লালন করেছেন পরম মমতায় , অন্যদিকে না পাবার অদেখা কষ্টানুভুতিকে চারিদিকে ছড়িয়ে যেন বা হালকা হতে চেয়েছেন ।
এই কাব্য গ্রন্থের সকল কবিতার মাঝেই না দেখা হারানোর যন্ত্রণা যা কবিকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাড়িত করেছে । মনের গভীরে সযতনে ভালোবাসার মানুষটিকে স্থান দিয়েছেন যদিও তার বিচেছদ সান্ত্বনায় মেনে নিয়েছেন। এ এক ধরণের অভিমান বৈতো আর কিছু নয় । কবি প্রিয়াকে জোর করে ধরে রাখার পপাতী নন । তাই ভূল করে যে চলে গেছে তার চলে যাওয়াকে কবি নীরবেই মেনে নিয়েছেন ।
"ওফেলিয়ার" মতো যদিও প্রিয়াকে তার ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন । কিন্তু তাকে আর ফিরে আসার আহ্বান জানাননি । একবুক নীরব অভিমানে কবি যোজন দূরত্বে অবস্থান করছেন । মানব মনের এ এক নিগূঢ় রহস্য ।
আলোচনার শেষে বলা যায় - এ কাব্য গ্রন্থের সকল কবিতায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল কবিতাই কাব্যমানে সমৃদ্ধ ।
পরিশীলিত,হৃদয়গ্রাহী । কবিতাগুলো এক নিঃশ্বাসে পড়ে মুগ্ধ হবার মতো । অতিরিক্ত শব্দ চয়নের প্রয়াস নেই , বরং প্রতিটি কবিতায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শব্দ চয়নে, গাঁথনে, সজ্জায় যথেষ্ট মেধা ও মননশীলতার পরিচয় রেখেছেন যা কবিকে কাব্য সাহিত্যে দৃঢ় আসন রাখতে সাহায্য করবে বলে বিশ্বাস করি ।
মানুষের সারাটি জীবনই বিচিত্রতায় ভরা । আর রহস্যময় মানব মনের যে না দেখা জগত ভালোবাসার এবং যাকে ঘিরে কবির সুখ দুঃখের বিচরণ আর সব চাওয়া -প্রাপ্তি পূর্ণতাকে অবহেলা করে প্রিয়ার চলে যাওয়া এ নীরব আকুতি আর শুন্যতার ছবি পরম দতায় কবি এঁকেছেন তার কাব্যে ।
আমরা আশা করবো কবি তার লেখনী চালিয়ে যাবেন আরো অনেকদিন । পাঠক পাবে মননশীল সাহিত্য । কবিকে সানন্দ অভিনন্দন জানালাম,এমন সুন্দর শিল্প সুষমামন্ডিত কাব্য আমাদের উপহার দেয়ার জন্য । প্রবর্তন প্রকাশন ঢাকা থেকে প্রকাশিত "এই ঘর এই লোকালয" কাব্য গ্রন্থটি। জয়তু কবি ।
ইমেইলঃ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।