নিঃস্বার্থ মন্তব্যকে ধন্যবাদ, সাময়িক ভাবে আমি মন্তব্যে নেই
গন্তব্য ছিল অনেক দুরে যাওয়ার। দৈর্ঘে প্রস্থে উচ্চতায় সবার সামনে। কখনো ট্রেনে চড়তে ভাললাগতো না। তার চেয়ে উঁচু পাহাড়েও না। কারণ শিশুরা পাহাড়ে চড়াকে উঁচুই মনেই করে না।
উড়োজাহাজের চালক হবো। যখন ক্লাসে গোপন উচ্চাকাঙ্খাটা বলে ফেলেছিলাম, দেখি ক্লাসের মতিন, সোবহান, আরিফ সবাই চালক হতে চায়। অথচ পরদিনই রচনা পরীক্ষাতে লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম শিক্ষক হতে চাই। নোট বইয়ে উড়োজাহাজের এইম ছিল না। আর কে না জানে নম্বরটাই থাকে মধ্যবছরের পরীক্ষার উদ্দেশ্য।
যা হোক উড়োজাহাজ না দেখে তার চালক হতে চাওয়ার এইমটা হাস্যকার। হাই স্কুলে শুনেছিলাম যে চালক ছাড়াই অনেক প্লেন চলতে শুরু করেছে। খবরটা শুনে জীবনের প্রথম ইচ্ছেটা যেন "নোজ ডাইভ" দিয়েছিল।
বড় হয়ে যখন সত্যিই এরোপ্লেনের চালক দেখেছি, তখন আমি জমি বিক্রি করে টিকেট কেনা পিছন সীটের একজন যাত্রী।
সৌভাগ্য যে আমার বহুমুখী এইমে উড়োজাহাজ ছাড়াও আরও কিছু ছিল।
তখন জীবনের উদ্দেশ্যটা নতুন বাইসাইকেল চালকের মতো এদিক ওদিক নড়তে থাকতো । পড়ে গেলে উঠে ধুলে ঝেড়ে নিতাম। আবার নতুন এইম বেছে নিতাম। মক্তবের মুন্সী ঈদের খিচুড়ি খেতে খেতে পরকালের উদ্দেশ্যটা বুঝিয়ে ফেলেছিল। তার এইম ছিল জান্নাত।
আমার কাছেও জান্নাত ভাললাগতো। মুন্সীর চেহারপরিচ্ছদ হতে রাজি ছিলাম না। তাই খুব সিরিয়াস হতে পারিনি।
আর জান্নাতে যেতে বেশী সৎ থাকতে হয়, পাপীরা জান্নাতে যেতে পারে না। কিন্তু মনে পড়ে সে বার আমি বাবাকে পরীক্ষার নম্বরপত্র দেখাই নি।
মিথ্যে বলিনি, কিন্তু সত্য গোপন করাও একটা পাপ। এভাবে যত পাপ হয়েছে আঙুল গুনে যোগ করে শৈশবেই জান্নাতে যাওয়া প্রায় অসম্ভব বুঝে গিয়েছিলাম। তবুও বড় হয়ে মরে যাবার আগে সৎ থাকার স্বপ্নটা মরে নি।
কিন্তু মিথ্যে ছাড়া চলা যে কঠিন সেটা নিশ্চিত হয়েছিলাম। মদের আগে সিগারেট, সিগারেটের আগে মিথ্যে বলার অভ্যেস ধরেছিলাম।
উপায় ছিল না, কারণ ভাইয়ের ব্যাঙ্কের পয়সা চুরি করে, লুকিয়ে সিনেমা দেখে সত্য বলা সহজ না।
স্কুল জীবনে মিনিট ধরে জীবনকে গুনতে গুনতে ক্লাস থেকে ফিরতাম। যদি ভাবতাম বাড়িতে পৌছবো ১০ মিনিটে। ১২ মিনিট হলে খুব আফসোস হতো, নিজেকে কী অপদার্থই না মনে হতো। তখন শিখেছিলাম নিয়মানুবর্তিতা মানে জীবন।
শুধু নিয়মানুবর্তিতা নয় মিতব্যয়িতা, অধ্যাবসায় সহ ডজনখানেক নিয়ম কুমিরের ছানার মতো বোঝানো হতো।
যত স্কুলের উপরে যাই উদ্দেশ্যটা যেন বাড়তেই থাকে। একটা এইমের পেট থেকে অনেক এইম বের হয়। রাতে স্বপ্নে ভয়ও দেখায়। অবশেষে পিতার এইম কে এইম করে ঘামতে ঘামতে বীজগণিত মেলাতে থাকি।
ঘড়ির কাটা টেনে হিচড়ে নিয়ে যেত সময়কে। সময়ে অভাবে অংক মেলাতে না পারলে হাত ঘড়িকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চাইতাম।
ঘড়ি যারা মানেনি, পরে অনেকেই বাবার পয়সায় দামী ঘড়ি কিনেছিল। টিউটরের সাজেশন দিয়ে সাত বিষয়ে উচ্চ নম্বর পেয়েছিল কত সহজে । আর আমার ডেস্কের অনেক রাতজাগা শ্রম দুর্বাঘাসে মিশে গিয়েছিল।
যে ফজলু স্যার সৎ থাকতে বলতো, তাকেই একদিন সেক্রেটারীর পুত্রকে আলাদা বেঞ্চে বসিয়ে পাস করাতে দেখলাম। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের অনেকেই হয়তো নিয়মানুবর্তী ছিল, আবার ছিল না, বেতনটা ছিল তাদের এইম, এইম ইন লাইফ। এভাবে অনেক অনেক বার, সময়, উদ্দেশ্য আর জীবন - তিনটারই সংজ্ঞা খুজতে বসেছি ডিকশনারীতে।
এখনো খুঁজে যাই। কুষ্টিয়াতে গিয়েছিলাম।
নদীর ধারে ছবি তুলে রাখতে। ঘরে বাঁধাই করা ছবি নেই। বাউলদের ছবি ড্রইংরুমে খুব চলে। ইচ্ছা ছিল বন্ধুদের ডেকে বাউলের সঙ্গে ছবি দেখাই। তার পর বাউলদের দেখে একটু অবাকই হয়েছি।
জীবনের উদ্দেশ্যটা শেখেনি অথচ কষ্টটা আমার সমানই। স্কুলের রচনা পরীক্ষা তার ট্র্যাকে ছিল না, সুতরাং যন্ত্রনাটা কম হওয়ার কথা।
বড় হয়ে উদ্দেশ্যহীনতাকেও উদ্দেশ্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছি। ট্রেন আছে চড়ে বসার জন্য, গন্তব্য আছে, না হলে টিকেট কাটা যাবেনা। কিন্তু তাড়া নেই,জানালা দিয়ে আকাশটা দেখতে ভাল লাগলে গন্তব্যে না থামলেও চলে।
শুধু আকাশের সেই আনন্দের সঙ্গে ভুল গন্তব্যে নামার কষ্টটা বিনিময় করা শিখে নিতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।