পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয় ,,,,,পথের পাশেই আছে মোর দেবালয়
গোল্ডেন ফ্লেম ফুল
সকাল।
প্রশ্ন করলাম ছেলের বাবাকে' কি ভাবছো'?
বল্লো 'ফিরে যাবো'। তার এক কথা।
আমি আস্তে করে বল্লাম 'এতদুর এসেছি কিছু না দেখেই চলে যাবো! তোমার ব্রহ্মপুত্র দেখবেনা? গৌহাটি তো এই নদের পারেই'।
নদী আর সাগরের প্রতি তার অসম্ভব দূর্বলতা।
মেঘনা নদীর মোহোনা দেখানোর জন্য সে আমাকে ভোলার চর ফ্যাশন নিয়ে গেছে। কক্সবাজারের সাগরের ঢেউ আর সৈকতের বালিও বোধ হয় আমাদেরকে চিনে ফেলেছে!
আমার কথায় সে চুপ করে থাকায় মনে একটা ক্ষীন আশা জেগে উঠলো। কাজীরাঙার আশা তো কালই ছেড়ে দিয়েছি। কাজীরাঙার প্রোগ্রাম কমপক্ষে দুইদিনের। সেখানে কি অভ্যর্থনা কে জানে! রিস্ক নেয়ার সাহস হোলোনা।
আর কাছাকাছিও না। বেশ দুরে।
না দেখা কাজীরাঙার হাতী
বল্লাম 'চল নাস্তা খেয়ে আশে পাশে একটু দেখে চলে যাব'।
নাস্তা করে আমার স্বামী বের হলো সিগারেট কিনতে আমিও সাথে আছি। ভালো কথা আসামে স এর কোনো ব্যাবহার নেই; স এর বদলে চ যেমন: চিগারেট, চিনেমা, চেলুন ইত্যাদি।
অর্থাৎ সে চিগারেট কিনতে গেল!
সেখানে এক অটো রিকশাওয়ালা আমরা কোথাও যাবো কিনা জানতে চাইলে প্রশ্ন করলাম এখানে কাছে পিঠে কি আছে দেখার?
সে দু একটা নামের মধ্যে কামাখ্যার মন্দিরের কথা বল্লো।
আমরা ভেবেছিলাম অনেক দুর হবে বোধ হয়।
সে জানালো না, গৌহাটি থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দুরে নীলাচল পাহাড়ের উপরেই মন্দির।
বল্লাম চলো কাছেই তো ঘুরে আসি।
অটো ওয়ালা জানালো সে মুসলমান আর ওখানে হিন্দু ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রবেশ নিষেধ।
তবে কোনো সমস্যা নেই।
বন্দোবস্ত সবখানেই আছে। এটা আমরা রামেশ্বরমেও দেখেছি।
সে জানালো ওখানকার পান্ডা (পুজারী)দের সাথে তার ভালো সম্পর্ক। প্রায়ই সে যাতায়াত করে যাত্রী নিয়ে।
আমাদেরও নিয়ে যাবে তবে আমরা যেন কোনো কথা না বলি।
বৃষ্টি হচ্ছে ঝির ঝির করে আমরা রওয়ানা হোলাম। মন্দিরটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৮০০ ফুট উচু নীলাচল পাহাড়ের উপর। বৃষ্টি ভেজা পিছল পথ বেয়ে অটোতে করেই উপরে উঠছি। এটা হচ্ছে আসামের কামরূপ বিভাগের হেড কোয়ার্টার।
বিখ্যাত কামরূপ মন্দির
পাহাড়ের চুড়ায় উঠে দেখলাম বিশাল চত্বর জুড়ে সেই বিখ্যাত মন্দির। পান্ডারা একে একে ভদ্র ভাবে এসে জানতে চাইলো আমরা পুজো দেব কিনা? অটো আলাই উত্তর দিচ্ছে। কি বল্লো শুনতে পেলাম না।
তারা আর আমাদের বিরক্ত করলোনা।
এরা কাশী বা পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পান্ডাদের মত এত নাছোড়বান্দা না।
পূরীতে তো এক পান্ডা রেল স্টেশন থেকে পিছু পিছু এসে হোটেলে আমাদের রুমে ঢুকে পড়লো আমরা কখন পুজা দেব জানার জন্য! আমরা মুসলিম বলেও যেন তার হাত থেকে নিস্তার পাচ্ছিলাম না!
যাক এখন মন্দিরের কথা বলি......।
কথিত আছে এই বিখ্যাত প্রাচীন মন্দিরে, হিন্দু দেবতা শিবের স্ত্রী সতীর দেহের অংশ বিশেষ এখানে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। পুজার আসল বেদীটি নীচে আরেকটি ভূগর্ভস্হ মন্দিরে অবস্হিত। পুজার উপকরণ নিয়ে সকাল থেকেই দাড়ানো ভক্তদের বিশাল লম্বা লাইন। অনেকেই ইন্ডিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে শুধু পুজো দেয়ার জন্য।
অনেক জটাধ্বারী সাধু সন্যাসী বসে আছে লাল ধুতি পড়ে। একটু ভয় ভয় লাগছিল। নিষিদ্ধ জায়গায় প্রবেশের ভীতি। আগে কিন্ত সকল ধর্মের লোকের অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল।
আমরা অটো আলার সাথে চুপচাপ উপরেই ঘুরে ঘুরে দেখছি।
মন্দির ছাড়াও চারিদিকে অনেক গুলো ঘর,
মনে হয় বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়।
কাউকে প্রশ্ন করার সাহস হচ্ছিল না, যদি বুঝে ফেলে!
চত্তরের বাইরে দেখি বেশ কিছু দোকান,ছোটোখাটো ধর্মীয় জিনিস পত্র বিক্রী হচ্ছে। আমার এক পরিচিত বৌদির জন্য টোকেন হিসেবে একটা গিফট কিনছি, মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল, হায় আল্লাহ্ এত দাম!
দোকানদার টা সাথে সাথে আমার দিকে কেমন করে জানি তাকালো,
ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসলো।
আমি তাড়াতাড়ি সরে আসলাম সামনে থেকে।
শুনলাম সেই নীলাচল পাহাড়ে প্রায় ২০০ পরিবার বাস করে যারা সবাই সেই মন্দিরের কার্যক্রমের সাথে কোনো না কোনো ভাবে যুক্ত।
সেখানে আমরা একটা পোস্ট অফিস এবং একটি হাই স্কুল ও দেখলাম। চারিদিকে অনেক গাছপালা খুব সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য।
শেষ পর্যন্ত দেখা হোলো সেই ডাকিনী যোগীনিদের জন্য খ্যাত প্রাচীন মন্দিরটি।
এবার যাবো ব্রহ্মপুত্র নদ।
আমরা সবসময় ট্যুরিস্ট কোম্পানীর সাথে ঘুরি আর এখানে অটো আলাই গাইড।
সে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদের উপর একটা ব্রীজ সেটা দেখাতে। সমগ্র ভারতের সাথে দক্ষিনের সাতটি রাজ্যের যোগাযোগের জন্য অন্যতম প্রধান সংযোজন হোলো এই ব্রীজ । নিরিবিলি একটু উচু পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি পথের দুপাশে গাছ তাতে কত রকম জংলী ফুল আর অর্কিডের বাহার।
ব্রহ্মপুত্র নদ
অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন এই ব্রীজটি বিদ্রোহীদের আক্রমনের আশংকা থাকায় দু পাশে সৈন্য বাহীনি পাহারা দিচ্ছে। ছবি তোলা নিষেধ।
একটু খানি ওঠার পারমিশন দিল।
নীচে চেয়ে দেখি
সুদুর চীন থেকে সমতল আর পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে সহস্র মাইল পথ দুরন্ত বেগে পাড়ি দিয়ে আসা এই সেই বিখ্যাত ব্রহ্মপুত্র নদ!
কি বিশাল বিস্তীর্ন বিপুল সেই জলরাশি! কখোনো শান্ত কখনো অশান্ত সব কিছু ভাসিয়ে দিচ্ছে প্রবল বেগে!
কৃষি নির্ভর আসামের জন্য কখনও আশীর্বাদ কখনও অভিশাপ।
কি যে এক ভালোলাগা বলে বোঝাতে পারবোনা। আয়নার মত স্ফটিক স্বচ্ছ জল বা কাক চক্ষু জল যাকে বলে...
আমার তখন এখানকার বিখ্যাত শিল্পী ভুপেন হাজারিকার বিখ্যাত গানটি শুধু মনে পরছিল......
'বিস্তীর্ন দু পারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও
ও গঙা তুমি বইছো কেন?'
যদিও এটা গঙা না ব্রহ্মপূএ!
আমরা অটো আলার কাছে ভুপেন হাজারিকার কথা জানতে চাইলে সে বল্লো তাকে আসামের অনেক লোকজনই পছন্দ করেনা!
কারন হিসেবে জানালো, আসামবাসীর জন্য তার কোনো অবদান নেই। আমরা অবাক হয়ে গেলাম শুনে, হতেও পারে!
কোনো লোকজন গাড়ি ঘোড়া কিচ্ছু নেই।
কি নিরিবিলি চারিদিক, শুনশান নীরবতা।
আমরা একা একা বেশ কিছুক্ষন দাড়িয়ে সেই নিশ্চুপ ভয়ংকর
কিন্ত অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।
অটো আলার ডাকে ফিরে আসলাম বর্তমানে।
জলাভূমির দুটো বক জাতীয় পাখি
এবার শহরের একপাশে নদের তীরে যেখানে ছোট্ট একটা ঘাট আছে সেখানে গেলাম। ছোটো ছোটো লন্চ নৌকা ভীড়ে, যাত্রী এবং মালামাল উঠানামা করে।
সেই ঘাট থেকেই সন্ধ্যাবেলায় ট্যুরিস্ট নিয়ে নৌ বিহারে বের হয়
পর্যটকবাহী লন্চগুলো।
প্রধান আকর্ষন নদী থেকে তোলা টাটকা মাছের বারবিকিউ সাথে
স্হানীয় শিল্পীদের নাচ, গান ।
আমরা মিস করলাম দারূন ভাবে।
যাক যা গেছে তা যাক.......
এখানে আপনাদের একটা তথ্য না দিয়ে পারছিনা,
ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশে যমুনা নামে প্রবেশ করেছে।
বাংলাদেশের যমুনা হয়ে পদ্মা নদী দিয়ে কলকাতা বন্দর পর্যন্ত এই নৌপথ ভারতীয়রা ব্যাবহার করে থাকে তাদের পুর্ব দিকে অবস্হিত সাতটি রাজ্য যা সেভেন সিস্টার নামে পরিচিত, সেখান থেকে চা, কয়লা,বিটুমিন সূর্জমুখীর তেল( উদ্ভিদ জাতীয়) ইত্যাদি পন্য আনা নেয়ার জন্য।
এবং সেটা এই গৌহাটি থেকেই পরিচালিত হয়।
কারন সড়ক পরিবহন অত্যন্ত ব্যায়বহুল।
তখন প্রায় দুপুর দুটো বাজে, সাড়ে তিনটায় আমাদের শিলং এ ফেরার জীপ ছাড়ার কথা।
অটো আলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এক রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার সেরে রওনা হোলাম।
বিদায় আসাম.. বিদায় আমার না দেখা কাজীরাঙা অভয়ারন্য।
আসার জার্নিটা খুবই উপভোগ্য ছিল।
অসমতল আসাম থেকে ফিরে যাচ্ছি পাহাড়ের উপর মেঘের রাজ্য মেঘালয়ের রাজধানী শিলং।
রাস্তার দু পাশে পাহাড় ঝর্না আর কত নাম না জানা ফুল আর ফার্নের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আর দু একবার চা ব্রেকের পর পৌছে গেলাম আমাদের গন্তব্যে।
পথের পাশে ফুটে থাকা স্হানীয় টিউলিপ ফুল
শেষ...
আমার সাথে থাকার জন্য আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ।
ছবিগুলো নেটের সৌজন্যে
লেখকঃ মাহজাবীন জুন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।