আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চল মামা ইস্কুল পালাই

salehin.arshady@gmail.com
তখন আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। সদ্য এক লেভেল গর্বিত সিনিয়র হয়েছি। স্কুলে পড়ার অনেক চাপ। হাউসে ফিরে কিছুই পড়া হয় না। শয়তানি-বান্দ্রামি করতেই সব সময় শেষ হয়ে যায়।

সিনিয়র দের সাথে আড্ডা মারা, গল্প শুনা আর কমিক্স পড়া টাই তখন মুখ্য কাজ। পড়তে বসলেও বইয়ের ফাঁকে থাকত চাচা চৌধুরী না হয় টিনটিন। সেই সময় আমার যম এর নাম ছিল সমাজ। সমাজের কিচ্ছু বুঝতাম না আমি। ক্লাসে ভ্যাবলার মত বসে থাকতাম।

ক্লাস ফোরের বাচ্চাদের civic sense শেখানোর এই অপচেষ্টা আমাকে ভীত করে ফেলেছিল। ইতিহাস অধ্যায় টা পড়লেই মাথা হ্যাং করত। যেটা আমার পছন্দ না সেটা আমি কোনদিনই পড়তে পারিনা। দেখতে দেখতেই পরীক্ষা চলে আসল। পরীক্ষার আগের দিন স্কুলেঃ আমি আর তারেক স্কুলে পাশাপাশি বসতাম।

তারেকেরও আমার মতই সমাজে এলার্জী। আমরা দুইজনই কিছু পারি না। তাইলে খাতায় লিখব টা কি? বসে বসে ভাবছি কিভাবে ক্লাস টেস্ট টা বাতিল করা যায়। হাউসে থাকলে স্কুলে আসতেই হবে, স্কুলে আসলে টেস্ট দিতেই হবে আর ফেল করতে হবে। ফেল করলে আমার প্রিফেক্টশিপ চলে যাবে, আর এটা সহ্য করা আমার জন্য অসম্ভব।

চল মামা স্কুল পালাই। হাউস থেকে পালানোর কোন উপায় নাই?? এখন একমাত্র উপায় হাসপাতালে এডমিট হওয়া। কি অসুখ বানানো যায় ?? পেট ব্যাথা বললে ডাক্তার কোন দিন এডমিট করাবে না। তল পেটের এপেন্ডিসাইটিস এর ব্যথার অভিনয় করা অনেক কঠিন। গত মাসেই একজন সিনিয়র ভাই ধরা পড়সিলো।

এপেন্ডিসাইটিস ও বাদ...শেষ পর্যন্ত রসূন থেরাপী কেই চুজ করলাম। আমি আর তারেক আলাদা হাউসে থাকতাম। আমি ছিলাম জয়নুলে আর ও কুদরতে। কিভাবে কি করব, কিভাবে অভিনয় করব এইসব প্ল্যান করতে করতে হাউসে ফিরে গেলাম। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে কাল হাসপাতালে দেখা হবে।

উত্তেজনায় দুপুরে ঘুমই আসল না। এখন রসুন পাই কই? এটা তো আর বাসা না যে আম্মুর রান্নাঘর থেকে নিয়ে নিলাম। রসুনের চিন্তায় আর বিছানায় থাকতে পারলাম না, ছটফট করে উঠে গেলাম। ভর দুপুর। পুরো হাউস ঘুমাচ্ছে।

বাগানের মালি, রান্না ঘরের বাবুর্চিরাও নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে। চুপিচুপি গেলাম কিচেনে। আমাদের কিচেন টা ছিল বিশাল। ইয়া বড় বড় চুলা, কোন জানালা নাই, সব কিছুই কেমন যেন হলুদ হলুদ আর সাথে ভ্যাপসা গরম। ভিতরে তো ঢুকে গেছি, কিন্তু রসুন রাখে কোথায় তাই তো জানি না।

ভয় আর উত্তেজনায় রসুন খোঁজা শুরু করে দিলাম। আল্লাহর অশেষ রহমতে পেয়ে গেলাম রসুন। ৪-৫টা রসুন নিয়েই রুমে চলে আসলাম। এখন থেরাপী নেয়ার পালা। বিকাল গেলো খেলতে খেলতে, রাতেও ছিলাম ভাল।

আমি সবসময় ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ি। সেদিন তারও আগে উঠে গেলাম। রসুনের কোয়া গুলো একটু থেতলে নিলাম। থেতলানো রসুন গুলো দুই বগলের চিপায় রেখে আবার শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগলাম, যদি আজকে সফল হতে পারি তাহলে লেজেন্ডদের কাতারে চলে যাব।

আমাদের আইডলরাও এই ভাবে স্কুল ফাকি দিতো। তাদের নাম কত শ্রদ্ধার সাথে সবাই স্মরন করে। আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে ঘুমায় গেলাম। ঘুম ভাঙ্গার যখন বেল পরল তখন আমার গায়ে ধুম জ্বর। বডির টেম্পারেচার খুব অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে।

কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হল আমার খারাপ লাগছে না। কিন্তু অভিনয় না করলে তো সব মাটি হয়ে যাবে। তাই শুরু করলাম কোঁকানি আর ফোঁপানি। অবস্থা বেগতিক, আমার পিটি মাফ...প্রথম সাফল্য। এখন হাসপাতাল যাইতে হবে, ডাক্তারকে বোকা বানাতে হবে।

অভিনয় করে তাকে বুঝাতে হবে যে আমার যাই যাই অবস্থা, আমাকে এডমিট করেন। সব ভালো যার শেষ ভালো। আল্লাহ পাক সবসময় দূর্গতদের রক্ষা করেন। হাসপাতালে কাটানো দিন গুলো বেশ মজায় কাটতো। কোন নিয়ম নাই, কি করছি কেউ দেখার নাই।

কোন পড়ালেখা নাই, যখন মন চায় ঘুমাই, গল্পের বই পড়ি, ক্রিকেট খেলি আর শুধু রাস্তা দেখি। আমি আর তারেক সারাদিন রাত আড্ডা দিতাম। কিন্তু হাসপাতালে বেশীদিন থাকলে দম বন্ধ হয়ে আসে। অনেক কিছুই হারাতে হয়। হাউসের সেই চিল্লাচিল্লি, একসাথে হাউকাউ, খাওয়া দাওয়া, প্রাকটিস, খেলা ধুলা...কত কি।

হাসপাতাল থেকে আসছি তাই আমার ফিটনেস নাই বলে আমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে নামানো হল না। তখন কিভাবে বলতাম যে আমি একদম ফিট আছি। মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। একটানা দুই মাস ধরে হোস্টেলে আছি। এত পড়ালেখা আর ভালো লাগছে না।

বিরক্ত হয়ে গেলাম প্রতিদিন মড়ার কুইজ দিতে দিতে। খুবই অস্থির লাগছে। কতদিন আম্মুকে দেখি না। বাসার কথা মনে পড়ছে বারবার। আরও পনের দিন পর পেরেন্টস ডে...উফফ কত্তদিন বাকি।

মাঝে মাঝে বিকাল বেলা খেলার ফাঁকে মন উদাস হয়ে যেত। আমাদের খেলার মাঠ ছিল রাস্তার একদম পাশেই। উঁচু দেয়ালের পাশেই এক নার্সারী ছিল (এখন ও আছে)। মাঝে মাঝেই বল রাস্তায় পরে যেত। ওয়াল টপকে নার্সারী থেকে বল আনার সময় রাস্তার গাড়ী-ঘোড়া দেখতাম।

তখনই মন টা কেমন যেন করে উঠত। এখন যদি আর হাউসে না ফিরি?? এখন থেকে বাসায় চলে যাই?? একটা গাড়ীতে চড়ে বসব। খুব কি কঠিন হবে?? যদি ধরা পড়ি, খুব বেশী হলে না হয় রেড টিসি দিয়ে দিবে। আর কোনদিন কলেজে যেতে পারব না। কলেজ থেকে বের করে দিবে?? আমি এই হাউস, এই স্কুল, এই বন্ধুদের ছেড়ে থাকব কি করে?? এইসব ভাবতে ভাবতে আর পালানো হয়ে উঠে না।

এখন আবার ব্যাটিং এ নামতে হবে...প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশীই সময় নিয়ে রাস্তা থেকে আবার মাঠে ফিরে আসতাম, সাথে থাকত এক চাপা দীর্ঘশ্বাস। এই রকম এক সময়ে কলেজে শুরু হল এক মহামারি। চোখ উঠার মহামারি। প্রথমে একজন দুজনের চোখ উঠল। তাদের স্থান হল আমাদের ক্যাম্পাসের হাসপাতাল।

পরে সব হাউস থেকেই একজন দুজন করে চোখ উঠা এসে হাসপাতাল এর সব সিট শেষ করে দিল। এখন উপায় কি?? সবার মাথা খারাপ, এটা তো ছোঁয়াচে রোগ, এদের তো আলাদা রাখা লাগবে। পরে সব কয়টা হাউসে quarantine centre বানানো হয়েছিল। আমাদের জয়নুল হাউসের quarantine centre ছিল আমাদের common room। প্রথমদিন ৪জন, পরদিন ১০জন এভাবে চক্রবৃদ্ধি হারে চোখ উঠা বাড়তেই ছিল।

যারা quarantine ছিল তাদের কত মজা। সারাদিন টিভি দেখে, কেরাম খেলে, ওদের কোন স্কুল নাই। সারাদিন ঘুমায় খেলে আর খায়। এদের আলাদা করে রাখার পরেও কিভাবে এতজনের মধ্যে রোগ সংক্রামন হচ্ছিলো?? হাউস টিউটরদের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিল। অনেকেই তখন চোখ উঠানোর আপ্রান চেষ্টা করত।

যাদের চোখ উঠেছিল তাদের চোখে কাপড় ঘসে সেটা নিজের চোখে ঘসত। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তাদের চোখ উঠত না। আমিও বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু চোখ উঠে নাই। সবাই চোখ উঠানোর জন্য উঠে পড়ে লাগেছিল।

সিনিয়রদের কাছে কাকুতি মিনতি, ভাই প্লিজ একটু ঘসা দেন। আর জুনিয়র দের আদেশ, অই ঘসা দে। কিন্তু লাভ হত না। আল্লাহ এইবার ও আমার সহায় ছিলেন...একদিন আমিও জেনে গেলাম সেই রহস্য। চোখ উঠানোর রহস্য-কিভাবে চোখ উঠানো যায়।

এই থেরাপীর নাম হল টুথ-পেস্ট থেরাপী। আঙ্গুলের আগায় কোলগেট (পরীক্ষাগারে পরীক্ষিত, পেপ্সোডেন্ট দিয়ে হয় না)নিয়ে বাম চোখের ভিতরে ঘুঁটে দিলাম। আর যায় কই...সাথে সাথেই তীব্র জ্বলুনি শুরু হইল। চোখ ইতোমধ্যে টকটকে লাল। ২দিন quarantine centre এ ছিলাম, তারপর আমাদের বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হল।

সেই দুইদিন আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ২টা দিন। সারাদিন আমরা টেবিল টেনিস খেলতাম, সিনিয়র রা লুকিয়ে টুয়ান্টি নাইন ও খেলত। মাঝে মাঝে খেলতাম দাবা আর কেরাম। স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু আনন্দ বেশীদিন স্থায়ী হয় নাই।

আমার চোখ এখন ও...দশ বছর পরেও ঠিক হয় নাই। বাম চোখ এখন ও লাল হয়ে থাকে, বেশীক্ষন বই পড়লে চোখ দিয়ে পানি পড়ে। তাই এই টুথ-পেস্ট থেরাপী থেকে সাবধান... আরেকবার স্কুল কাট্টি দিয়েছিলাম। সেটার কাহিনী বিশাল। লিখতে গেলে লেখেটা আর কেউ পড়বে না।

সেই এপিক কাহিনী আলাদা করে লিখব আরেক দিন। পুরান দিনের পেঁচাল ১
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।