আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অসম আসাম(১ম পর্ব)

পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয় ,,,,,পথের পাশেই আছে মোর দেবালয়
আসামের বিখ্যাত বিহু উৎসব আসাম যাবার কোনো প্ল্যানই ছিলনা। শিলং ঘুরছি মনের আনন্দে, ভীষন ভালো লাগছে চেরাপুন্জী, শিলং পিক, বড়া পানি, হঠাৎ আমার স্বামী বল্লো 'চলো দুদিনের জন্য আসাম ঘুরে আসি, ব্রহ্মপূত্র নদ টা দেখবো, বল্লাম 'চলো' আমি তো আর ছেলের মত ছাত্র বা স্বামীর মত চাকুরীজীবি নই যে ছুটির ঝামেলা। ভিসা আছে, তাদেরও ছুটি আছে, আমার সমস্যা কি! আমি তো খুশী! রান্না বান্নার ঝামেলা নেই, এটা খাবোনা সেটা খাবোনা বলে কারো বায়না নেই, ঘর দোর গুছানোর দরকার নেই। বুয়ার সাথে ক্যাটর ক্যাটর নেই। কি শান্তি ! হাত ধুয়ে খেতে বসি, হাত ধুয়ে উঠে আসি।

যার যা মন যা চায় তাই খাও। এসে দেখছি রুম/বাথরুম সব ঝকঝকে। বাসায় ফেরার জন্য পাগল হওয়ার তো দরকার নেই! ব্লগের বন্ধুরা এটা আমার মনের গোপন কথা আমার স্বামী বুঝতে পারে কি না জানি না। শুরু হোলো আমার ধান ভানতে শীবের গীত। আচ্ছা আসাম যাবার কথা হচ্ছিল।

চার দিনেই শিলং দেখা শেষ ঢাকায় আসতে যেতে ২ দিন লাগবে। কেনা কাটার ও কিছু নেই। সুতরাং পরবর্তী গন্তব্য আসাম। পাহাড় নদী সমতল সব কিছু মিলিয়ে একটি অসম ভূ প্রকৃতি, সংস্কৃত ভাষায় এই অসম শব্দ থেকেই আসাম নামের উৎপত্তি বলেই প্রচলিত আছে। গল্পের বইয়ে পড়া ডাকিনী যোগীনিদের সেই কামরূপ কামাখ্যার মন্দির, সেই কাজীরাঙা অভয়ারন্য, সেখানে বিলুপ্ত প্রায় এক শিং ওয়ালা গন্ডার, বাঘ আরো কত প্রানী, হাতীর পিঠে চেপে সাফারী ভ্রমন, ব্রন্মপূত্র নদ সব একসাথে মনের মধ্যে ভেসে উঠলো।

শিলং এ এক ভদ্রলোক আমাদের জানালো আমাদের হোটেলের কাছ থেকেই আসামের গৌহাটির বাস ছেড়ে যায়। বেলা প্রায় ৩ টা বাজে আমরা তিনজন সরকারী বাসে চেপে বসলাম যা ছিল একটা ভুল সিদ্ধান্ত। বৃষ্টি হচেছ খুব জোরেও নয় খুব হাল্কা ও নয় মাঝারি টাইপের। পাহাড়ী পথ ঘুরে ঘুরে উঠছে নামছে , রাস্তা লাল মাটিতে পিচ্ছিল, এত আস্তে আস্তে বাস চলছিল মনে হচ্ছিল এই রাস্তা আর ফুরোবেনা। চড়াই উৎরাই চলছে সমানে।

সরকার থেকে নির্ধারিত স্লো স্পীড আর ক্রমাগত ডাইনে বায়ে বাঁক নেয়া, আমার প্রচন্ড খারাপ লাগছিল। বিরক্তিকর! মাথা ব্যাথা করছে। বাসের জানালা দিয়ে চেয়ে দেখছি রাস্তার পাশে নালার মতন ছোট্ট একটা চিকন পানির ধারা অনেকক্ষন ধরে প্রায় শিলং ছাড়ার পর থেকেই আমাদের সাথে সঙ্গী হয়ে চলছে, কিছুদুর যেতেই দেখলাম সে ক্রমে ক্রমেই একটু চওড়া, তারপর আরেকটু চওড়া হয়ে শেষে এসে নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রচন্ড গজর্নশীল এক স্রোতস্বীনী পাহাড়ি নদীতে পরিনত হোলো যা কিনা আমরা একটি বড় ব্রীজের মাধ্যমে অতিক্রম করলাম, যা আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছিল। বাসের মধ্যেই কলকাতার এক দম্পতির সাথে পরিচয় হোলো যারা এখন বদলীর কারনে আসামের গৌহাটিতে বাসা বেধেছে। আসামের প্রধান নগরী গৌহাটি পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসলো।

শিলং থেকে আড়াই বা তিন ঘন্টা লাগে বাসে আসতে। জীপে আরও কম সময় লাগে। গৌহাটি বাস স্টপেজ টা রেলওয়ে স্টেশনের সাথে লাগানো একটা খোলা মাঠের মধ্যে। লোকজন নেমে কেউ কেউ দৌড় দিচ্ছে রেল স্টেশনের দিকে ট্রেন ধরতে, আবার কেউ বেড়িয়ে যাচ্ছে গেট দিয়ে, ওখানে যাদের বাড়ী। আমার ছেলে আর স্বামী নেমে গেটের দিকে এগোচ্ছে, দুজনই মোটামুটি লম্বা দুর থেকেই আমি তাদের দেখছি আর ভাবছি ওরা আমাকে দেখছে, আমি সেই দম্পতির সাথে কথা বলছি ভালো হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট কোথায় পাবো সে ব্যাপারে।

খালি বাস গুলো চলে যাচ্ছে একটা একটা করে, এক মিনিট পরে ওনারা দুজনও হোটেলের সন্ধান দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল। হঠাৎ চমকে চারিদিকে চেয়ে দেখলাম আশে পাশে কেউ নেই, দুরে দুরে কিছু লোকজন দেখা যাচ্ছে কি যাচ্ছে না, আর সেই অচেনা ফাকা মাঠের মধ্যে আমি একদম একা দাড়িয়ে। সাথে সাথে প্রচন্ড ভয়ের একটা হীম শীতল ঠান্ডা স্রোত আমার মাথা থেকে পা বেয়ে নেমে যেতে লাগলো। আমার হাতে একটা ইন্ডিয়ান কারেন্সী, ডলার, এমনকি পাসপোর্টটা পর্যন্ত নেই। এমন ভয়ংকর পরিস্হিতিতে আমি কোনো দিনও পরি নাই।

শিলং এ যেহেতু কেনাকাটার কিছু ছিলনা, টুকটাক যা কিনেছি সে সাথে ছিল দিয়ে দিয়েছে, আমি টাকা পয়সা রাখার কোনো ঝামেলায় যাইনি। অন্যখানে আমি স্হানীয় টাকা ছাড়াও ডলার এবং ক্রেডিট কার্ডও রাখি। আর এখানে এখন পর্যন্ত কোনো হোটেলে ও উঠিনি যে সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করবো। শিলং ফেরারও উপায় নেই। সেখানে আমাদের রুম বুকিং সহ লাগেজ ও রাখা ছিল।

কিন্ত টাকা ছাড়া কি ভাবে যাব ? আমি যখন সেই সম্পূর্ন অপরিচিত জায়গায় অন্ধকারে পাগলের মতন মাঠের মাঝখানে দাড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি আর ভাবছি কি করবো ? তখন দেখলাম তারা বাপ ছেলে আমার দিকে এগিয়ে আসছে, রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ,ভয় এবং চিন্তার থেকে মুক্তি এই সমস্ত প্রতিক্রিয়ার সংমিশ্রন লবনাক্ত পানি হয়ে নিঃশব্দে আমার চোখ বেয়ে ঝরঝর করে নেমে আসলো। আমার ছেলে হাসছে আমার হাত ধরে বল্লো 'আম্মু তুমি বাচ্চাদের মতন কাদঁছো কেন!' আর অত্যন্ত কুল ব্রেনের অধিকারী আমার স্বামী হেসে বললো, 'কান্নার কি হোলো! শোনো এমন পরিস্হিতিতে পড়লে সবসময় যেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছ ঠিক সেখানে দাড়িয়ে থাকবে, নড়বেনা আমি তোমাকে ওখানেই খুজতে আসবো, এটাই হোলো সিস্টেম, আর তাদের সাথে তোমার কি এত কথা? হোটেল! হোটেল আমরাই খুজে নেব। আমি তো ভাবছি তুমি আমার সাথে সাথেই আসছো'। এক্কেবারে মাসুদ রানা মার্কা কথা বার্তা! রাগে দুঃখে আমার মুখ দিয়ে আর কথা বের হচ্ছিল না। সারাদিনের ক্লান্তি এবং শেষ মূহুর্তের এই সাসপেন্স আমাকে অবসন্ন করে ফেলেছিল।

আস্তে আস্তে হেটে রাস্তায় বের হয়ে আসলাম হোটেলের সন্ধানে... চলবে--- ছবিটি নেট থেকে নেয়া। লেখকঃ মাহজাবীন জুন
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।