আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হে দুর্ভাগা দেশ আমার

ক্লিন'স অল্টারনেটিভ ওয়ার্ল্ড

দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অত্যন্ত দুর্ভাগা। বিষয়টা কয়েক দিন ধরেই আমাকে ভাবাচ্ছে। ভোগাচ্ছে। বিক্ষত করছে। আমার মায়ের দুর্ভাগ্য কল্পনায় যেমন কষ্ট পাই, তার ঠিক কাছাকাছি দেশের জন্য এই আর্তনাদ আমার।

একটু পরিষ্কার করে নিই ব্যাপারটা। আমি বলছি আমাদের দেশের দুর্ভাগ্যের কথা। জাতি হিসেবে বলিনি। কারণ, বাঙালি জাতির পশ্চিম অংশটা দেশ হিসেবে ভালোই আছে। তাদের নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই।

এবং তারা ভালো আছে বলে আমাদের সুখবোধও নিরেট স্টুপিডিটি| যারা জাতির গর্বে গর্বিত হতে চান, তারা দেশের দুর্ভাগ্যকে উপেক্ষা করেন। আমি বাঙালি জাতির চেয়ে বাংলাদেশেকে নিয়ে বেশী চিন্তিত, বেশী্ উদ্বিগ্ন এবং বেশী বেদনার্ত। আমাদের প্রথম দুর্ভাগ্য আমরা ভুলে যাই। আর তাই সময়ে আমাদের সবকিছু সয়ে যায়। আমি এই অত্যন্ত নিকট অতীতের টিপাইমুখ ইস্যুর কথা বলতে পারি।

কত সভা-সেমিনার-চিৎকার হলো, রাস্তায় পুলিশের ব্যাটন আর বুটে রক্তাক্ত হলেন অধ্যাপক, পত্রিকার বর্ধিত পাতাগুলোও দেশের বিদ্যমান জঞ্জাল সংকটকে আরো সংকটাপন্ন করলো। এই সেদিনের কথা। কিন্তু এখন? আমি নিজেও ভুলে গেছি টিপাইমুখ বলতে কোন একটা ক্রিটিকাল মুখ আছে যেটা বন্ধ হলে বাংলাদেশের এক অংশ অবস হয়ে যাবে। আমি ভুলে গেছি, পত্রিকার সম্পাদক ভুলে গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভুলে গেছে, দেশের পানি বিশেষজ্ঞ ভুলে গেছে। আর তাই দেশের সাধারণ মানুষটির কথা বললাম-ই না।

আমরা এতগুলো দেশের মাথা যদি একটা গুরুত্বপূর্ণ ‘মুখের’ কথা ভুলে যাই, তাহলে যে লোকটি নিজের মুখে দুবেলা খাবার জোটাবার সংগ্রামে ব্যস্ত তার কাছ থেকে কোন কিছু প্রত্যাশা করা খুবই অন্যায় দাবী। তাই একদিন যদি টিপাইমুখে বাধের পরিবর্তে একটা পিরামিড খাড়া করে ভারত পৃথিবীর আধুনিক আশ্চর্য নির্মান হিসেবে তাকে ঘোষণা করে, আমরা কিছু্ই করবো না। করতে পারবোও না। কারণ, আমরা ততোদিনে সব ভুলে একাকার। আমরা ততোদিনে আরো নতুন সমস্যা নিয়ে বিকারগ্রস্ত।

আমি আমাদের এই ভুলে যাওয়া রোগের কারণ উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয়েছে, এতো ছোট একটা দেশে ১৬ কোটি মানুষ নিজের জীবন ধারণ নিয়ে এতো বেশী সমস্যাগ্রস্ত যে, তাদের সত্যিই একটা সমস্যা নিয়ে দু’বার ভাবার অবকাশ নেই। পত্রিকাগুলোও নতুন সমস্যার কথাই বেশী প্রচার করবে, সেটাই স্বাভাবিক। যে দেশের শাসকদলের তারকা এমপি বোমা হামলার শিকার হয়, যেখানে নিরুপদ্রব জীবন ধারণের উপযোগী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনুপস্থিত, যেখানে রাষ্ট্রীয় বাহিনী নির্বিচার নির্যাতনের লাইসেন্সধারী, যেখানে সরকারী দলের অনুগত শোষকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র চাদাবাজি আর দুর্বৃত্তায়নের আইনগত হকদার, আর যেখানে বিরোধী রাজনৈতিক দল কেবল নিজেদের কুকীর্তির ফল সামলাতেই ব্যাস্ত, সেখানে একজন মানুষ তো বিপন্ন বর্তমান নিয়েই ভেবে কুল পাবেনা! কোন (অ)দূর ভবিষ্যতে কোথায় কোন বাধ হলে দেশের কী ক্ষতি হবে, কিংবা সর্দি কাশিতে হাজার দুই লোক মারা গেলে দেশের জনসংখ্যার এমন কি-ইবা অবনতি হবে-সেটা নিয়ে ভাবার সময় কই তার। তাই আমরাও এইসব সমস্যার কথা দুএকদিন পর ভুলে যাই।

তারপর রবীন্দ্রনাথের সমাপ্তি গল্পের মৃন্ময়ীর বাবার মতো আবার আমাদের নিত্যকর্মে ফিরে যাই। সত্যিই দুর্ভাগা দেশ বাংলাদেশ। এখানে সবাই রাজনীতিবিদ, সবাই শাসক, সবাই শাসিত। অদ্ভুত বিষয়। অবাক লাগে।

আমি জানিনা পৃথিবীর আর কোথাও পেশাজীবী মানুষেরা এতো নির্লজ্জ দলীয় রাজনীতি করে কি-না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং মসজিদের ইমামরা পর্যন্ত স্বাধীনতার পক্ষ আর বিপক্ষ দলে ভাগ হয়ে পরষ্পরের নাক কাটছে। আর তাদের মাঝখানে পড়ে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির যাত্রা ভঙ্গ হচ্ছে বারবার। স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষ-বিপক্ষের লোকেরা সেই কবে পরকালে গিয়ে হয় বেহেশতে (অথবা, দোযখে) পরষ্পরের সঙ্গী হয়ে দিনানিপাত করছে, আর আমরা এখনো এই পৃথিবীতে কেবলই বিভক্ত হয়ে যাচ্ছি। এক ডাক্তার আরেকজনের গলায় ছুড়ি ধরছে, এক শিক্ষক আরেকজনের বুকে কলম বসা্চ্ছে, এক ছাত্র আরেকজনের মাথায় অস্ত্র ঠেকাচ্ছে।

পৃথিবীর আর কোন দেশে স্বাধীনতার এতো বছর পর স্বাধীনতা এতো বড় ইস্যু হয়ে আছে বলে জানা নেই আমার। হয়তো তারা জানে বলেই এমনটি করছে। আমি এ প্রজন্মের মানুষ হয়েও তাই কোন গুণগত উত্তরণের পথ দেখছিনা। আমার হতাশা কেবলই দীর্ঘায়িত হচ্ছে। কী এক অভিশাপ নিয়ে এ দেশের জন্ম হয়েছিলো।

কী এক আজন্ম দুর্ভাগা দেশ আমার! -ক্লিন

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।