আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোট ঘটনার বড় যাতনা-১



কয়েকদিন পূর্বে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় দেখলাম ফেনীর একটি মাদ্রাসার ছোট্ট এক ছাত্র তার হুজুরের জন্য রাতের খাবার না এনে ঘুমিয়ে পড়ে। এ মহা (?) আপরাধের জন্য তাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে তারই প্রিয় হুজুর! অবশ্য উদর জ্বালা শুরু হলে মানুষের মাথা একটু গরম হয়ে উঠে! তাই বলে পো ষাঁড়ের মতো গুতিয়ে রক্তাক্ত করতে হবে একটি ছোট্ট বাচ্চাকে? বেশ কয়েক বছর আগে কিশোরগঞ্জের একটি বড় মাদ্রাসায় বেড়াতে যাই। মাদ্রাসাটি কওমী এবং আবাসিক। সে মাদ্রাসার নামিদামি একজন মুফতি সাহেব আমার বন্ধু। এশার নামাজের পর খাবার-দাবার সেরে বন্ধু বললেন, চলেন মাদ্রাসাটি ঘুরেফিরে দেখে আসবেন।

ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন ক দেখতে লাগলাম। ছাত্ররা সবাই পড়া নিয়ে ব্যস্ত। তৃতীয় তলার একটি ক েগিয়ে দেখি ৬ বা ৭ বছরের দু'টি বাচ্চা সামনে বই রেখে ফোরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। উল্লেখ্য যে, কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা চেয়ার টেবিল ব্যবহার করে না। তারা ফোরে বসেই পড়াশুনা করে।

আমি বললাম, আহা! বাচ্চা দু'টিকে মশা খেয়ে ফেলবে তো। তিনি আমাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত বাচ্চা দু'টির কাছে গিয়ে জোরে জোরে বেত্রাঘাত শুরু করলেন! বাচ্চা দু'টি দিকবিদ্বিক জ্ঞান হারিয়ে রুমের এক কোণে জড়ষড় হয়ে বসে থাকে। বেলুন ফুটো করে দিলে যেমন চুপসে যায় তেমনি হলো আমার দশা। ঘুমন্ত শিশুর উপর এমন অমানবিক বেত্রাঘাত আমার সহ্য হচ্ছিল না। আর এক মুহুর্তও মাদ্রাসাটিতে অবস্থান করতে মন চাচ্ছিল না।

আমার সকল কৌতুহল উবে যায় মুহুর্তের মধ্যেই। মানুষ এতটা বিবেক বিবর্জিত হয় কি ভাবে? মুফতি সাহেবের প্রতি আমার অনেক উঁচু ধারণা ছিল। ছিল শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। কিন্তু কেন যেন তাকে আর সহ্য করতে পারছি না। আজো ভয়ার্ত শিশু দু'টির কথা মনে হলে কষ্ট পাই।

আমার ছাত্র জীবনের কথা। তখন আমি কিশোরগঞ্জের অন্য একটি নামকরা কওমী মাদ্রাসার ছাত্র। বয়সে আমি কিশোর। কয়েকদিন পরই পরীা অনুষ্ঠিত হবে তাই মাদ্রাসার কাস বন্ধ। আমরা পরীার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

পাশের রুম থেকে আমার কাশের একজন ছাত্র এসে বললো, পান্দেনামার (কিতাবের নাম) একটি শের (কবিতার ছত্র) বুঝিয়ে দিতে হবে। বললাম, কিতাবটি নিয়ে এসো, বুঝিয়ে দেই। সে বলল, পাশের রুমে চলে এসো, আমাদের কাশের আরো দু'জন আছে তারাও বুঝতে চায়। তাদেরকে পান্দেনামার দাঁত ভাঙ্গা 'শের' পড়ে তরজমা করে বুঝাচ্ছি। এরই মধ্যে একজন সূফী টাইপের হুজুর চুপিসারে আমাদের কাছে এলেন।

আমার পিঠে তার সর্ব শক্তি দিয়ে জালিবেতের দু'ঘা বসালেন এবং কোন কথা না বলেই চলেগেলেন! আমার মনে হলো আগুনের ফুলকি এসে পড়েছে আমার পিঠে! ব্যথার চেয়ে লজ্জা পেয়েছিলাম বেশী! কারণ বিশাল হলরুমের বিভিন্ন কাশের অসংখ্য ছাত্র আমাকে করুনার দৃষ্টিতে দেখতে ছিল। হুজুরের বেতের আঘাতের স্থানটি পেঁকে পূঁজ হয়েছিল। হুজুরের কান্ডজ্ঞানহীন ঘটনাটির কোন ব্যাখ্যা এখনো দাড় করাতে পারিনি। উক্ত মাদ্রাসার একটি ক েআমরা চারজন ছাত্র এবং একজন হুজুর থাকতাম। হুজুর বোর্ডিং সুপার হিসেবে এডিশনাল দায়িত্ব পালন করতেন।

একদিন ছদকায় (দান) পাওয়া একটি খাসি রান্না করে হুজুরদের জন্য এ ক েরেখেছিল প্রধান বাবুর্চি। রাত্রে যখন হুজুর গোস্তের পাতিল থেকে অন্যান্য হুজুরদের জন্য গোস্ত নিতে গেলেন তখন তাঁর মনে হলো পাতিল থেকে কে যেন দু'চারটি গোস্তের টুকরা খেয়েফেছে! আমাদের চারজনকে অভিযুক্ত করা হলো। আমরা অস্বীকার করলাম। এ বিষয়ে আমরা কিছুই জানতাম না। চুরি করে গোস্ত খাওয়ার অপরাধের সন্দেহে তিনি আমাদেরকে রাত দশটার দিকে ক থেকে বের করে দিলেন।

প্রচন্ড শীত। প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা বরান্দায় ঘুরাফিরা করছি আর ভাবছি হয়তো হুজুর ডেকে নিয়ে যাবেন। কিন্তু রাত এগারটার পরও যখন তিনি ডাকেননি তখন অন্য তিনজন বিভিন্ন রুমে তাদের পরিচিতজনদের সাথে শেয়ার করে শুয়ে পড়ে। ােভে দুঃখে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কারো সাথে ঘুমাবো না।

গায়ে চাদর জড়িয়ে সারা রাত একা একা বিশাল লম্বা বারান্দায় বসেছিলাম। সামনে মাঠ। মাঠের ওপারে জঙ্গল! কখনো কখনো ভয়ে গা শিউরে উঠছিল। মিথ্যা অপবাদের উদ্ভূত শাস্তি সেদিন আমার চিন্তার জগতকে তছনছ করে দিয়েছিল।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।