আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আজি হতে শতবর্ষ পরে


না, কবিতা চর্চা বা রবীন্দ্র-কবিপ্রতিভা নিয়ে কোনো জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করতে বসিনি আজ। অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বশ্রুত অনুজীব বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক ফার্নার আমাদের স্নায়ুর মূল ধরে নাড়া দিয়েছেন। ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি পড়বে কে? ফার্নার জানিয়েছেন যে, আগামী ১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে মানবজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। প্রমাণ হিসেবে তিনি ইস্টার আইল্যান্ডের কথা বলেছেন। ঐ দ্বীপে এক সময় মানুষ গিয়ে ঘর বাঁধে।

ঐ দ্বীপটি মানুষের প্রয়োজন মেটাতে মেটাতে এক সময় নিঃস্ব হয়ে পড়ে। পরিবেশ বিপর্যয়, জীববৈচিত্র্য হ্রাসসহ নানা অসুখে ধরে দ্বীপটির পরিবেশে। প্রকৃতির মৃত্যু ঘটে। সেই সঙ্গে মানুষেরও। খবরটি পড়ার পর আমার এতোদিনের চিন্তা-ভাবনায় এক বড় ধরনের তোলপাড় শুরু হয়েছে।

এতোদিন আমরা সভ্যতার, জ্ঞানবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা নিয়ে গর্ব করেছি। কতো বড় বড় গবেষণা হয়েছে। কিভাবে মানুষ সেই ‘অসভ্য’ পশুর স্তর পার হয়ে, বর্বরতার নিষ্ঠুরতাকে কবর দিয়ে সভ্যতা গড়ে তুলেছে, সে ইতিহাস শুনিয়েছেন অনেক পণ্ডিত-গবেষক। সভ্যতার কতো স্তর! কৃষি সভ্যতা, কৃতদাস সভ্যতা, সামন্ততান্ত্রিক সভ্যতা, পুঁজিবাদী সভ্যতা। পূর্ববর্তী স্তর থেকে পরবর্তী স্তর উন্নত।

আজকের পুঁজিবাদী কর্পোরেটতন্ত্র অনেকের কাছেই শেষ স্তর মনে হয়। কিন্তু ফ্রাঙ্ক ফার্নার একি শোনালেন। ৯৫ বছর বয়সী ভদ্রলোক আমাদের সব গর্ব চূর্ণ করে দিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের পূর্ব পুরুষরা দেখিয়ে দিয়েছিল, বিজ্ঞানের আশীর্বাদ না পেয়েও কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপাদন না করেও কিভাবে ৪০ থেকে ৫০ হাজার বছর টিকে থাকা যায়। তার এই বক্তব্যের মধ্যে অনেককিছুই লুকিয়ে আছে, যা বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

এই ছোট্ট লেখায় তার সব দিক তুলে ধরা সম্ভব নয়। তাছাড়া বিষয়টি নিয়ে পড়াশুনা-গবেষণার বিস্তর সুযোগ আছে। বিজ্ঞানকে তিনি আশীর্বাদ হিসেবেই বিবেচনা করেন। আবার এ কথাও বলেন সে আশীর্বাদ-বঞ্চিত মানুষ ৪০-৫০ হাজার বছর টিকেও ছিল বলেই আজ আমাদের মতো ‘সভ্য’ মানুষের আবির্ভাব সম্ভব হয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ যা করে তাই-ই বিজ্ঞান, তাই-ই প্রযুক্তি, এ কথা সত্যি।

কিন্তু বিজ্ঞান বলতে পুঁজিবাদের উত্থানের সঙ্গে যে নতুন বিজ্ঞানের জন্ম হয়, সচরাচর তাকেই আজ আমরা বিজ্ঞান বলি। এ বিজ্ঞানের বয়স কতো? গ্রিক সভ্যতা থেকে ধরলে ২৫০০ বছর। আর কপার্নিকাস থেকে ধরলে বড়জোর ৫০০ বছর। এই ২৫০০ অথবা ৫০০ বছরের অর্জন নিয়ে আমাদের গর্বের সীমা নেই। সে গর্ব চূর্ণ করে দিলেন ফ্রাঙ্ক ফার্নার।

বিজ্ঞান ছাড়া মানুষ ৪০-৫০ হাজার বছর টিকে ছিল আর বিজ্ঞান নিয়ে মানুষ মাত্র ২৫০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীকে ইস্টার আইল্যান্ডের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। বিষয়টি যেমন জটিল, তেমনি ভয়ঙ্করভাবে অধ্যয়ন সাপেক্ষ। সামান্য অধ্যয়ন আমাকে বিষয়টি নিয়ে অনেক দিন আগেই ভাবিয়ে তোলে। তার কারণের সন্ধানে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছি। আজকের এই ছোট্ট লেখায় কোনো বিশেষজ্ঞের সাহায্যে নয়, একান্তই আমার নিজস্ব চিন্তা তুলে ধরবো।

আমার বক্তব্য বাংলাদেশের সবাই অস্বীকার করতে পারেন। অনেকের কাছে, আমার কাছেও এ চিন্তা প্রতিক্রিয়াশীল, বিজ্ঞানবিরোধী বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ফার্নার এ কথাগুলো বলার একটা বেদি আমাকে উপহার দিলেন। অধ্যাপক জেমস লাভলকের কথায় তার সমর্থন পাই। অষ্টাদশ শতক বিশ্বের বিশেষ করে ইউরোপের ইতিহাসে আলোকিত শতক বলে পরিচিত।

ভলটেরার, রুশোর মতো দার্শনিক এ শতকে আলোকবর্তিকা নিয়ে এসেছিলেন। সে কথা আমরা সবাই জানি এবং গর্বের সঙ্গে তাদের কথা বলি। কিন্তু লাভলক একি বলছেন? এমন কথাতো কেউ বলেননি। ‘অষ্টাদশ শতকের শিল্পবিপ্লবের পর জীববৈচিত্র্যে ধ্বংসসহ জলবায়ু পরিবর্তনের সে মহাঅনিষ্ট পর্বের শুরু হয়েছে, তারই উপসর্গ এখন দেখা দিতে শুরু করেছে। ’ আমরা জানি শিল্পবিপ্লব যুক্তরাজ্যকে ‘সভ্যতার’ চূড়ায় নিয়ে গিয়েছিল।

সেই ‘শিল্পবিপ্লবই’ আজকের ধ্বংসের কারণ মনে করছেন লাভলক। ফার্নারের বক্তব্য অনেকের কাছে বিজ্ঞানবিরোধী মনে হতে পারে। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে তার কারণ অন্যত্র মনে হয়। সমাজ বিবর্তনে কোনো এক পর্যায়ে কৃষি-বিপ্লব সংঘটিত হয়। সে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানুষ প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের যাত্রা শুরু করে।

তার পরের ইতিহাস সবাই জানেন। কিভাবে সভ্যতার বিকাশ হয়। কিন্তু কৃষি-বিপ্লবের অপরিহার্য সৃষ্টি একেশ্বরবাদী ধর্ম। পুরোনো বাইবেল যেন তারই জয়গাথা। কিন্তু তার আগেও হাজার হাজার বছর মানুষ কোনো কোনো একাধিক ধর্মে বিশ্বাস করে এসেছে।

সমাজ ও নৃ-বিজ্ঞানীরা সে স্তরকে ‘সর্বপ্রাণবাদ’ ধর্ম বলে অভিহিত করেন। সে সর্বপ্রাণবাদ ধর্ম ছিল পরিবেশ-বান্ধব। মানুষের উপকারে লাগে সবকিছুই ছিল সে সময়ের মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র- আরাধনার পাত্র। তার এক অসাধারণ ছবি এঁকেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার ‘একটি তুলসীগাছের কাহিনী’ গল্পে। তুলসীগাছটা আবার শুকিয়ে উঠেছে।

তার পাতায় খয়েরি রং। গৃহকর্ত্রীর চোখ ছলছল। কেন? সে কথা তুলসীগাছের জানা কথা নয়, মানুষেরই জানার কথা। কোনো মানুষ তুলসীগাছ পুজো করে। কেন? সে কথা সবাই জানেন।

সেই অপরাধে কেউ তুলসীগাছকে ধংস করতে চায়। এমন অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়। সর্বপ্রাণবাদ প্রকৃতিবান্ধব- প্রকৃতি বাঁচিয়ে রাখতে চায়। কেননা, সে বোঝে প্রকৃতিই জীবন। কিন্তু প্রথম প্রচারিত একেশ্বরবাদী ধর্মগ্রন্থে ‘মানুষকেই’ কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছে।

মানুষের জন্যই ঈশ্বর নামের কোনো এক সত্তা সবকিছু সৃষ্টি করেছে। গাছ-পশুপাখি, নদী-খাল-বিল, চন্দ্র-সূর্য সব। তাই সবকিছুর ওপর দখলিস্বত্ব স্থাপিত হয় মানুষের। শুরু হয় দখলের ইতিহাস। রুশো এমনই একটি গল্প বলেছেন সোস্যাল কনট্রাক্ট বইতে।

জঙ্গল থেকে অসভ্য মানুষেরা শহুরে সভ্য জগতে এসে দেখে আম-জাম-কাঁঠাল-পেকে আছে। তারা আনন্দে হৈ চৈ করে গাছে ওঠে যখন সেসব প্রাকৃতিক ফল খেতে শুরু করে, তখন সভ্য মানুষেরা লাঠিসোঁটা নিয়ে তাদের আক্রমণ করে এবং তাড়িয়ে দেয়। জঙ্গলে ফিরে তারা বুঝতে চেষ্টা করে, তারা কি অন্যায় করেছে? তুলসীগাছের মতো ঐসব ‘অসভ্য’ মানুষের তা বোঝবার কথা নয়- বুঝবে ‘সভ্য’ মানুষেরা। তাই এক কথায় বলা যায় একেশ্বরবাদী ধর্ম, সর্বপ্রাণবাদ ধর্মের মতো পরিবেশবান্ধব নয়। পরিবেশ বৈরী।

শুরু হয় পরিবেশের ওপর স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের আক্রমণ। ইতিহাসের অনেক স্তর পার হয়ে আসি বর্তমানে। পুঁজিবাদী সভ্যতায়। যাকে আমরা বলি ‘আধুনিক’- সাম্প্রতিকতম। পুঁজির ক্ষুধা অসীম।

তার কোনো শেষ নেই। তদুপরি সে সব কিছুকেই পুঁজিতে রূপান্তর করে। তাই একজন লাখপতি আজ কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কোটিপতি হয়েও তার আশা মেটে না। মিলিয়নিয়ার থেকে বিলিয়নিয়ার।

বিলিয়নিয়ার থেকে ট্রিলিয়নিয়ার। পুঁজির সে রাক্ষুসে ক্ষুধা সব গিলে খেতে চায়- গিলে খায়। তার কাছে প্রকৃতিও একটি পণ্য। বন ধ্বংস করার অধিকার আছে তার। যে গাছটি কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস শোষণ করে মানুষের বাঁচার পরিবেশ রা করে, পুঁজির কাছে সে গাছটিও পুঁজি।

তাকে কেটে যদি পুঁজি দ্বিগুণ হয়, গাছটি কাটতে তার সামান্য কষ্ট হয় না। বনজঙ্গল ধ্বংস করে, খালবিল-নালা-নদী ভরাট করে আধুনিক শহর গড়ে তুলে যদি একজন পুঁজিপতি হওয়া যায়, সে তাই করবে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হোক, পরিবেশ ধ্বংস হোক- পুঁজির কাছে তা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই ধরিত্রী সম্মেলনে মানুষের বাঁচার সিদ্ধান্তে সায় দেয় না বিশ্বের সম্পদশালী, শিল্পপ্রধান দেশগুলো। কারণ তাদের লভ্যাংশে হাত পড়বে।

আমি যা বলতে চাই, তা যদি সত্যি হয় এবং যদি ফার্নারের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়, তাহলে উন্নত শিল্পপ্রধান দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে। এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশই এখনো পুরোনো সভ্যতার অবশেষ নিয়ে বেঁচে আছে। বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিটা তাদের কম। কারণ তারা প্রকৃতির অনেক কাছাকাছি বাস করে। অনেকেই আছেন আমাদের আদি পূর্ব-পুরুষের জীবন যাপন করেন।

আমাদের চোখে তারা অসভ্য, জংলি। তাদের অনেকেই আজো সর্বপ্রাণবাদ ধর্মে বিশ্বাস করেন। তুলসীগাছ পূজা করেন, গরু-ছাগল-মহিষ আজো অনেকের কাছে দেবতা। কেননা তারা আমাদের উপকার করে। একেশ্বরবাদী ধর্ম পরিবেশ ধ্বংসের কাজটি শুরু করলেও আজকের পুঁজিবাদী সভ্যতায় পরিবেশ সাংঘাতিক হুমকির মধ্যে পড়েছে।

আমরা কি শেষ চেষ্টা করতে পারি না আরো দুটি দিন বেশি বাঁচতে। ডাইনোসর ৬ কোটি বছর পৃথিবী দাবিয়ে বেড়িয়েছিল। মানুষ মাত্র ৭০/৮০ হাজার বছরে তার পাট শেষ করবে? ভাবতে কষ্ট হয়। কেননা, আমরা নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব বলে মনে করি। আমরাই পৃথিবী থেকে প্রাণের অস্তিত্ব বিলীন করতে মাত্র এক লাখ বছর নেব? কিন্তু না, সময় অনেক আগেই পার হয়ে গেছে।

ফার্নার বলছেন, ‘এ অবস্থা উত্তরণের সময় অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। এটা এখন অপরিবর্তনীয় পর্বে ঢুকে পড়েছে। অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে। ’ তবুও কি আজকের কর্পোরেটতান্ত্রিক সভ্যতার মোড়লের ঘুম ভাঙবে? শহিদুল ইসলাম : সাবেক অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। সূত্র : ইত্তেফাক, ২৮ জুন
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।