আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে- ৩ | প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও ঘনীভূত সংকট

চলতাছে আরকি

নেপালের প্রধানমন্ত্রী মাধব কুমার নেপাল আজ সন্ধ্যা ছয়টায় তার পদত্যাগ করেছেন। জাতীয় যুক্তফ্রন্টের শরীকদার সিপিএন - ইউএমএল (কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল, ইউনাইটেড মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্ট) এর অন্যতম প্রবীন এই নেতা মাওবাদীদের চাপের মুখে পদত্যাগ করেছেন বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। প্রায় তের মাস আগে ২০০৯ এর ২৩ মে তিনি ক্ষমতা নেন। তার আগে মাওবাদী নেতা পুষ্প কুমার দাহাল প্রচণ্ড প্রায় দেড় বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মাধব কুমারের এই পদত্যাগ নেপালের অনিশ্চিত রাজনীতির পথে আরেকটি সংকটের বার্তা এনে দিল।

নেপালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটা আভাষ আপনাদের দিয়েছিলাম যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে পর্ব -১ এ। রাজতন্ত্রের পতন এবং মাওবাদীদের ক্ষমতার আসনে উত্থান নেপালীদের কোন ভরসার জায়গা দিতে পারেনি। সাবেক সেনা প্রধান রুক্সমনগাড কতোয়ালের নিয়োগ নিয়ে রাষ্ট্রপতি এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রচন্ডের মনোমানিল্যের রেশ ধরে প্রচন্ড পদত্যাগ করেছিলেন। তখন তাদেরই আরেক শরীক সিপিন ইউএমএল এর মাধব কুমার নেপাল প্রধানমন্ত্রী হন। রাজতন্ত্রের পর থেকেই নেপালে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান তৈরির চেষ্টা চলে আসছিল।

সংবিধান তৈরির জন্য সর্বদলীয় কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। তার সাথে ছিল দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞ কনসালটেন্টবৃন্দ। কিন্তু গত তিন চার বছরেও সেই সংবিধান আলোর মুখ দেখেনি। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে ড কামাল হোসেনরা এত অল্প সময়ে এরকম একটি আধুনিক সংবিধান রচনা করে ফেলেছিলেন আর এরা তিন বছর ধরে কেন পারছেনা? পারছেনা তার প্রধান কারন রাজনৈতিক দল সমুহের মধ্যে অবিশ্বাস এবং অনৈক্য। কেউ চাচ্ছে ফেডারেশন মডেল, কেউ চাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার মডেল ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই ঝুলে থাকা অবস্থার মধ্যেই ঐকমত্যে পৌছাতে না পেরে মাধব কুমার পদত্যাগ করলেন। সংকট কেন ঘনীভূত হচ্ছে? কারন, ভবিষ্যত নেতৃত্বের অভাব। জনগন মাওবাদীদের দেখেছে, ইউএমএল কে দেখল। বলা বাহুল্য, এদের কারোরই এর আগে সরকার চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল না। এবার তাহলে কে? আরেকটি বিকল্প হতে পারত নেপালি কংগ্রেস, যারা দীর্ঘদিন ধরে নেপালের রাজনীতে শাসন করেছে প্রতাপের সংগে।

কিন্তু নেপালি কংগ্রেসের প্রধান পুরুষ গিরিজা প্রসাদ কৈরালার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তারা যে নেতৃত্বের সংকটে পড়েছে তা থেকে সহসা বেরিয়ে আসার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। গিরিজা কৈরালার কন্যা সুজাতা কৈরালাকে দিয়ে সেই সংকট মোকাবেলার একটা চেষ্টা করা হয়েছিল বটে কিন্তু সে চেষ্টা কাজে দেয়নি দলের মধ্যে ঐকমত্যের অভাবে। এখন আমার মনে হচ্ছে, আমরা যতই পারিবারিক গণতন্ত্রের (বংগবন্ধু কন্যা হাসিনা বা জিয়া জায়া খালেদা) সমালোচনা করিনা কেন, আমাদের মত দেশগুলোতে, যেখানে গণতান্ত্রিক চেতনা অতটা উন্নত নয়, সেখানে মাঝে মাঝে দলীয় ঐক্যের জন্য এরকম পারিবারিক ব্যক্তির একটা প্রয়োজনীয়তা বোধহয় থেকেই যায়। তাই বলে আমি খালেদা ও তার পুত্র তারেক বা হাসিনার দোষসমুহকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছিনা। যাই হোক, এই মুহুর্তে নেপালিদের বড় সংকট হল আগামীর নেতৃত্বে কে আসছে তার কোন সঠিক দিগনির্দেশনা না থাকা।

কাকে বিশ্বাস করা যায় বা কাকে যোগ্য মনে করা যায় সেটি একটি বড় সমস্যা। সংকটের আরেকটি দিক হল নেপালের ভৌগলিক অবস্থান। নেপাল একটি বার্গারের মত। তার দুপাশে আছে বিশাল ক্ষমতাধর চিন এবং ভারত। মাঝখানে বেচারা নেপাল কাটলেটের মত।

দু পক্ষের মন যুগিয়ে তাকে চলতে হয়। একপক্ষকে খুশি করতে গেলে আরেকপক্ষ হয় বেজার। ফলে দুপক্ষই নেপালকে তাদের দাবার গুটি হিসাবে ব্যবহার করতে চায়। নেপালের অধিকাংশ ব্যবসা বানিজ্য ভারতীয় বংশোদ্ভুত মাড়োয়ারিদের হাতে। বড় বড় কর্পোরেট হাউজগুলো মাড়োয়ারিরা চালায়।

আবার ভাষা, ধর্ম এবং কালচারের দিক থেকে নেপাল যতটা ভারতীয় ততটা চৈনিক নয়। ফলে ভারতের যে বিশাল প্রভাব নেপালে আছে সেটা যেমন নেপাল কোনভাবেই ঝেড়ে ফেলতে পারবেনা তেমনি ভারতও এই সুযোগে তার সমস্ত কলকাঠি নাড়ানোর সুযোগ ছাড়বেনা। এখানে বিভিন্ন আড্ডায় বলাবলি হয় যে, নেপালের সচিবালয় চালিত হয় ভারতীয় হাইকমিশনের নির্দেশে। হাইকমিশন অনেকসময় সরকারের চেয়েও শক্তিশালী। আর নেপালের যেহেতু সামুদ্রিক বন্দর নেই সেহেতু প্রায় সব আমদানীর জন্যই কলকাতা বন্দরের উপর নির্ভর করতে হয়।

আজকে যখন এই লেখাটা লিখছি তখন নেপালে চলছে জ্বালানী তেল সংকট। কলকাতা বন্দর থেকে জ্বালানী তেল ছাড়াতে দেরী হচ্ছে। কাজেই ভারত ইচ্ছা করলেই নেপালকে সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিতে পারে। (এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি তার ট্রানজিট চুক্তি আসলেই কাজে লাগাতে পারে তাহলে একটি ভালো কাজ হবে)। এখন যেই ক্ষমতা নিক তাকে এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই কাজ করতে হয়।

ফলে সবসময় জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে যে তারা কাজ করতে পারে তা নয়। বরং শক্তিশালী প্রতিবেশিদের মেজাজ মর্জি অনেকসময় নেপালের ক্ষমতার নেপথ্য চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করে। এইযে পদত্যাগ নাটক, বা সংবিধান নাটক – এসব যে কারো কলকাঠিতে হচ্ছেনা কে বলতে পারে। এখন দেখার বিষয়, নেতৃত্বশুন্যতা এবং প্রতিবেশিদের মাতব্বরি এড়িয়ে নেপাল কিভাবে এসব সংকট মোকাবেলা করে। তবে সেটি যে সহসা হচ্ছে না তার আভাষ কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার এই সুন্দর, শান্তিকামী দেশটির জনগন নিজেদের জন্য সঠিক রাস্তাটি অচিরেই খুজে পাবে- এ আশাই আমরা করতে পারি। যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে পর্ব ১ Click This Link target='_blank' > যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে পর্ব ২

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।