আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে- ২ । নেপালী বিয়ে

চলতাছে আরকি

হরতালের একাল সেকাল নেপালে এখন বিয়ের মৌসুম। সব লগ্ন একসাথে ভীড় করছে। কিছুদিন আগে ধুমধামসে হয়ে গেল বলিউডি নায়িকা মনীষা কৈরালার বিয়ে। দেখলাম নেপালী তরুন সমাজের মুখে আহা-উহু শব্দ- যেনবা এক বিরাট সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। আজকে বলব একটি সাধারন মধ্যবিত্ত বিয়ের কথা, তাদের আচারাদি এবং প্রথা সমুহ নিয়ে।

নেপালিরা মুলত হিন্দু হলেও আমরা যেরকম হিন্দুদের দেখি বাংলাদেশ বা ভারতে তার চেয়ে নেপালী হিন্দুরা প্রথার দিক থেকে কিছুটা আলাদা। যেমন তাদের মন্দিরে আমাদের দেশের মত বড় কোন মুর্তি নাই। খুব ছোট ছোট পাথরের মুর্তি। এরা গরুর মাংশ না খেলেও মহিষের মাংশ খায়। বুদ্ধ এবং কৃষ্ণ একইভাবে এখানে সমাদৃত।

নিজের কাজের সুত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দু-তিনটি দেশে ঘনিষ্ঠভাবে ঘোরা, দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তাতে করে আমার মনে হয়েছে নেপালের মানুষ সবচেয়ে কম সাম্প্রদায়িক। ভারত বাংলাদেশের মত ধর্মীয় পরিচয় ততটা বড় নয়। হয়ত সারা দুনিয়ার ট্যুরিস্টরা আসার কারনে এরকম হয়েছে। আরেকটা কারন মনে হয় বৃটিশদের ছায়া না পড়া।

ভারতবর্ষে যেমন বৃটিশরা ডিভাইড এন্ড রুল খেলেছে সেরকম নেপালে পারেনি। আর ঐতিহাসিকভাবে বুদ্ধের জন্মভুমি এবং পাহাড়ি হিসাবে এরা অনেক বেশি শান্ত শিষ্ট। ভারতে যেখানে বাবরী মসজিদ নিয়ে হিন্দু মৌলবাদীরা তুলকালাম করেছে সেখানে নেপালের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধমন্দির সয়ম্ভুর প্রাঙ্গনে সহাবস্থান করছে একটি হিন্দু মন্দির। সামাজিক বিবর্তনের ধারায় একসময়ে বিবাহ প্রথার উদ্ভব হয়। প্রাচীনকালে যখন মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ছিল তখন বিয়ের প্রথা সেভাবে কার্যকর ছিলনা।

কৃষিযুগের উদ্ভবের সাথে সাথে যখন মানুষ সম্পদের মালিক হতে শুরু করে তখন সম্পদের ভবিষ্যত উত্তরাধিকারী নির্নয়ের প্রয়োজন হয়ে পড়ে, সন্তানের পিতৃপরিচয় মুখ্য হয়ে পড়ে, বিবাহের মত একটি সামাজিক প্রথার উদ্ভবের প্রয়োজন দেখা দেয়। পরবর্তীতে সমাজের রিপ্রোডাক্টিভ ফিটনেস বাড়ানোর কারনে বিবাহ প্রথা স্থায়ী রুপ নেয়। সব ধরনের গোত্র ও মতবাদও বিয়েকে নিজেদের প্রথার অধীন করে নেয়। সন্তানের সামাজিক স্বীকৃতির দরকার হয়ে পড়ে। এই সামাজিক স্বীকৃতি কেউ দেয় মন্ত্র পড়ে, কেউ দেয় দোয়া পড়ে, কেউবা শুধু মালা বদল।

আসল কথা হল রিপ্রোডাক্টিভ ফিটনেসের জন্য একটি সামাজিক স্বীকৃতি। তবে প্রেম ভালোবাসাও একটি ফ্যাক্টর। তবে তার সাথে বিয়ের যোগাযোগ সব সময় খুব স্পষ্ট নয়, কারন বিবাহ বহির্ভুত প্রেম যেমন আছে তেমনি প্রেম করলেই বিয়ে হবে এমন কথা নেই। নেপালে প্রায় সত্তরটিরও উপরে জাতী গোষ্ঠী আছে, যদিও জনসংখ্যা আমাদের তুলনায় পাচ ভাগের একভাগ। হিন্দু ধর্মীয় সাধারন যে বর্ণবাদ আছে তার পাশাপাশি আরো কিছু ভেদাভেদ আছে।

যেমন কাঠমান্ডুর প্রাচীন সম্প্রদায় হল নেওয়ার। নেওয়ারীদের মধ্যে আবার বিভিন্ন গোত্রভাগ আছে, খুবই কনফিউজিং লাগে শুরুতে। বিয়ের সময় এই গোত্রভাগ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তবে অন্যান্য সব জায়গার মত এসব আস্তে আস্তে লোপ পাচ্ছে, অনেকেই অন্যগোত্রের ছেলে মেয়েকে বিয়ে করছে, প্রেম করছে। অবাক হলাম নেপালি বিয়েতে কোন জবরজড়ং পুরোহিত না দেখে।

দু পরিবার নিজেদের মধ্যে থেকে একজনকরে ব্রাহ্মণ ঠিক করে। তারাই বিয়ের আনুষ্ঠিকতা সারে। এই ব্রাহ্মণরা ঠিক মন্দিরের লোকই হতে হবে এমন কোন কথা নেই। এরা চাকুরীজীবি বা ব্যাবসায়ী বা অন্য কোন পেশার লোক। আমাদের দেশের মত মোল্লা কিংবা পুরোহিত বা পাদ্রী নয়।

প্রথার দিক থেকেও তেমন কোন হুলুস্থুল নেই। উপোষ থাকা কিংবা হাতে একটি লাঠি নিয়ে বসে থাকার মত ব্যপার কমই আছে। বাংলাদেশে একবার এক হিন্দু বন্ধুর বিয়ের বরকর্তা হবার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমার মুসলিম নাম দেখে অবশ্য কোন কোন মুরুব্বী আপত্তি তুলছিলেন কিন্তু আমার বন্ধু সেসব কথায় কান দেয়নি। তখন দেখেছি এক বিশাল প্রথা-যজ্ঞের।

নেপালে সেরকম কিছু নেই। সকাল বেলায় মেয়ের বাড়িতে গিয়ে আধুনিক স্যুট প্যান্ট পরিহিত পুরুতমশাইরা তাদের কৃত্যকর্ম সারলেন। তারপর খাওয়াদাওয়া এবং শেষমেষ বারাতিরা সহকারে বউ নিয়ে আসা। পরদিন একটা রিসেপশন। নেওয়ারি বিয়েতে মদ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এদের জন্ম মৃত্যু বিবাহ সব ক্ষেত্রেই সুরা পান আবশ্যক। আমার মত নিরামিষ, যাদের সুরা পানে আসক্তি কম, তাদের জন্য রয়েছে ঘরে তৈরি একধরনের ঘোল। নেপালিদের খাবারদাবার খুবই সিম্পল এবং স্বাস্থ্যসম্মত। মোঘলরা ভারতবর্ষে অনেক কিছু দিয়েছে। তার সাথে দিয়েছে একটি অসাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস।

ঘিয়ে ভাজা চুপচুপে পরটা, মুরগী মুসল্লাম, বিরিয়ানী, তেহারী, রোস্ট আরো কত কি। এতসব জম্পেস খানাপিনা পেয়ে আমাদের হয়েছে পোয়া বারো। স্বীকার করতে হয় যে, এসব খান পিনা দেখলে আমারো জ্বিব রসালো হয়ে ওঠে। কিন্তু নেপালিদের খানা পিনা অনেক সিম্পল। যেমন বিয়েতে তারা দেয় ভাত, ডাল, তরকারী সাথে একটি মাছ বা মাংশের আইটেম।

বর এবং কনে একটি মালা পরে। মালাটি দুর্বা ঘাস দিয়ে তৈরি। ওরা বলে ‘দুবো কি মালা’। দুর্বা ঘাস এদের কাছে পবিত্রতার প্রতীক। সব পুজা পার্বনে দুর্বা ঘাসের ব্যবহার।

আমার কাছে মনে হয়েছে নেপালিরা সাধারনত প্রকৃতি ঘনিষ্ঠ। তাদের ব্যবহার এবং এটিচ্যুডও অনেক মাটি ঘনিষ্ঠ। আমাদের মত বা ভারতীয়দের মত কুটিলতা কম। তবে বিয়ের মধ্যে যে পুরুষতান্ত্রিকতা আছে সেটি এখানেও আছে। নববধুকে বর এর পা ধরে প্রনাম করতে হয়।

তাছাড়া বরপক্ষের যে একটি আপারহ্যন্ড আমাদের সমাযে প্রচলিত আছে সেটা এখানেও বিদ্যমান। আল্টিমেটলি সন্তান যেহেতু পিতার পরিচয়ে পরিচিত হয়, সম্পদের উত্তারিধিকার যেভাবে নির্নিত হয় তাতে করে এই পুরুষতান্ত্রিকতা এসব আচার-প্রথা-ধর্মের মধ্যে থেকেই যায়। আরো অনেক খুটিনাটি বিষয় বাদ দিলাম। সাধারণভাবে নেপালিরা অনেক বেশি সিম্পল এবং কম আড়ম্বরপুর্ণ। আমাদের মত অতি অপচয় সেখানে অনেক কম।

জবরজরং কম থাকলেও শেষ পর্যন্ত মনে হয় সিম্পল ইজ বিউটিফুল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।