গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।
কবি ও সমাজ সংগঠক সুফিয়া কামালের আন্দোলন ও সংগ্রামী জীবনের অনেক কিছুই আমাদের অজানা। সেই অজানা অধ্যায়ের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরলাম।
আন্দোলন ও সংগ্রামে সুফিয়া কামাল
নির্যাতিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের আর্তনাদ ব্যথিত করত সুফিয়া কামালকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মানব সভ্যতার চরম বিপর্যয়ে বিচলিত হয়ে উঠেন সুফিয়া।
তিনি সৃস্টি কর্তার কাছে এ অবস্থার অবসান কামনা করে লিখলেন ‘প্রতিকার’ কবিতা। কলম হাতে তিনি এগিয়ে এলেন নির্যাতিত মানবাত্মার প্রতি। তিনি লিখলেন,
“রক্তিম আলোকে হেরি পৃথিবীর রক্তশক্ত হৃদয়
কৃষ্ণাব বেদনা-ঘাতে শত তময়!
তোমার দিগন্তের আজ বেলাশেষে গোধূলীর আলো
ফোটে নাকো, দেখা যায লেখা সেথা কালো কালো
কুন্ডলিত ধুম্ররাশি! অকস্মাৎ তীব্র বিস্ফোরণ
নয়ন ধাঁধিয়া তোলে! মানুষের মৃত্যু আয়েজন
নিত্য সমারোহ চলে নির্ঘোষিয়া শয়তানের জয়।
সহিয়া রহিবে তুমি এত, দয়াময়?
আদিগন্ত ব্যাপি আজ নাচি চলে যার,
তান্ডব বিভৎস লীলা; করিবে না কি এর প্রতিকার?”
সংগঠক সুফিয়া কামাল
তখন ১৯৪৬ইং সাল। কোলকাতায় সা¤প্রদায়িক দাংগা চরম আকার ধারণ করে।
সুফিয়া তাঁর মেয়ে ও বেগম মরিয়ম মনসুরের মেয়ে জাকিয়াকে নিয়ে কোলকাতায় ব্রেবোণ কলেজে দাংগা আক্রান্ত লোকদের জন্যে একটি আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তুলেন এবং দীর্ঘদিন সেটা পরিচালনা করেন।
সমাজের নিগৃহীত ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের হয়ে কথা বলার বীজ প্রোথিত হয়েছিল সুফিয়ার ভিতর সেই কৈশোর থেকেই। দেশ বিভাগের পর সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন সুফিয়া। তখন থেকেই তার সামনে খুলে যায় সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের বিশাল প্রোপট। সেই সময়ের নারী নেত্রী লীলা রায়ের অনুরোধে সুফিয়া যোগ দেন ‘শান্তি কমিটিতে।
’ এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রা করা। সুফিয়া অচিরেই তার সাহসিকতা ও সাংগঠনিক দতার জন্যে এই কমিটির সভানেত্রী মনোনীত হন।
১৯৪৭ইং সনে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রগতিশীল মহিলাদের নিয়ে গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান মাহলা সমিতি’। এই সমিতিরও সভানেত্রী নির্বাচিত হন সুফিয়া কামাল। একই সময়ে স্থানীয় বিশিষ্ট মহিলাদের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘ওয়ারী মহিলা সমিতি’।
সুফিয়া কামাল এই সমিতিরও সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৫১ইং সনে গঠিত হয় ‘ঢাকা শহর শিশু রা সমিতি’। সুফিয়া কামাল এই সমিতিরও সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৬০ইং সনে সুফিয়া কামাল প্রতিষ্ঠা করেন ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন স্মৃতি কমিটি’। এর উদ্দেশ্য ছিল বেগম রোকেয়াকে জনসমে পরিচিত করে তোলা।
স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে সুফিয়া কামালের বাসায় বসেই প্রথম সিদ্ধান্ত হয় ‘৭১ এ ঘাতক-দালার নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠনের। মূলত তাঁর ও শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপেই দু’ধারায় বিভক্ত ঘাতক বিরোধী আন্দোলন এক ধারায় মিলিত হয় এবং জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক ও অধ্যাপক আব্দুল মান্নানকে সদস্য সচিব করে ৪৫ সদদ্যের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ‘৭১ এর ঘাতক দালাল জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়। তিনি গণআদালতের একজন বিচারক ও নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে শেষ মুহূর্তে তাঁর নাম বাদ দেয়া হয়। এই কমিটি কর্তৃক গঠিত ‘জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের’ তিনি ছিলেন চেয়ারপারসন।
জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর তিনি এই কমিশনের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
সরাসরি রাজনৈতিক আন্দোলন
সুফিয়া কামাল ছিলেন একজন অকুতোভয় যোদ্ধা। যে কোন রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে জাতীর প্রয়োজনে, সংকট সময়ে তিনি সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন সোচ্চার কন্ঠে। ১৯৫২ইং সালের ভাষা আন্দোলন তথা বাঙালী জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর বিদেশী আগ্রাসন নাড়িয়ে দেয় সুফিয়া কামালের সাহিত্য জীবনকে। রাজনৈতিক এই প্রোপটে পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে তাঁর লেখনী।
তাঁর জীবনকালের সাহিত্য সাধনার যত ফসল আমরা পেয়েছি তার একটা বিরাট অংশই এই ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে।
১৯৫৪ইং সনে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন বাতিল করে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী ২১ ফেব্র“য়ারীর শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে এদেশের ছাত্রসমাজ। এর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে সুফিয়া কামালও এর প্রতিবাদ জানান। এর আগে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে তেল ও নুনের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে সমাজের সকল স্তরের মহিলারা সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে মন্ত্রি আতাউর রহমানকে প্রকাশ্য রাস্তায় ঘেরাও করে যা এর আগে কখনও ঘটেনি।
এরপর আসে উনসত্তুরের গণ অভ্যুত্থান। পশ্চিমা ভয়-ভীতি আর প্রলোভনে যখন অনেকে দিশেহারা তখন সুফিয়া এগিয়ে আসেন সাহস ও অনুপ্রেরণা নিয়ে।
প্রতিবাদী সংগ্রামী সুফিয়া কামালের জীবনের উলেখযোগ্য ঘটনা ছিল ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খানের সাথে সরাসরি আলোচনা। ঐতিহাসিক তাসখন্দ চুক্তি সম্পাদনের পর পরই ঢাকায় আসেন আয়ুব খান। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন অস্ত্রবাজদের রাজত্ব।
প্রতিকারের আশায় মহানগরীর শান্তিপ্রিয় মানুষ একটি কমিটি গঠন করে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে তার সাথে দেখা করতে যায়। সেদিন সুফিয়া কামালের সাহসী প্রতিবাদে প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন ফিল্ড মার্শাল। সুফিয়া বলেছিলেন, “আপনি তাসখন্দ চুক্তি করে অতবড় পাক-ভারত যুদ্ধ থামিয়ে দিতে পারলেন। সে তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডগোল তো সামান্য। এ পারবেন না একি হয়?
স্বাধীনতার পর সত্তর দশকের শেষে এবং আশির দশকের সামরিক সরকার, স্বৈরাচার, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে তিনি শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যুদ্ধ করে গেছেন।
যে কোন প্রকার দুঃশাসন ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিতে আস্ফালন বিরুদ্ধে তাঁর কন্ঠ উচ্চারিত হতো সবার আগে।
১৯৭৫ইং সনে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেন সুফিয়া কামাল। তাঁর সংগ্রামী চেতনায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। তারপর আসে ১৯৯০ এর গণঅভ্যুত্থান।
সামিল হন সুফিয়া কামালও। কার্ফ্যু অমান্য করে তিনি মৌন মিছির বের করেন। ফলে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন উজ্জীবিত হয় আর এক দফা। পতন হয় স্বৈরাচারের।
এক কথায় সুফিয়া কামাল ছিলেন সব্যসাচী প্রতিবাদী কন্ঠ।
যেখানেই অত্যাচার-অবিচার, রাজনৈতিক দমন-নীপিড়ন সেখানেই সোচ্চার ছিল তাঁর কন্ঠ। ভাষা আন্দোলন, বাংলা হরফ রার আন্দোলন, রবীন্দ্র সংগীত রার আন্দোলন, বিশ্ব শান্তি রার আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, কালা-কানুনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ‘৭১ এর ঘাতক ও দালালদের বিরুদ্ধে জোট গঠন, ফতোয়াবাজী ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সব জায়গায় জড়িয়ে আছে সুফিয়া কামালের নাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।