আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে - ১| হরতালের একাল সেকাল

চলতাছে আরকি

নেপালের সাম্প্রিতক ৬ দিনের হরতাল ও আমাদের শিক্ষণীয় দিক ৯০ এর দশকের শুরুতে নেপালে যে সর্বদলীয় জন-আন্দোলন হয়েছিল তাতে করে মানুষ ভেবেছিল যে নেপালের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। কিন্তু তৎকালীন রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহাদেব এর সপরিবারে খুন হওয়ার মধ্য দিয়ে সেই আশার অপমৃত্যু ঘটেছিল। বীরেন্দ্রর মৃত্যুর পর জ্ঞানেন্দ্র ক্ষমতা নেন। অনেকেই সন্দেহ করেন যে বীরেন্দ্রর মৃত্যুর পেছনে জ্ঞানেন্দ্রর কলকাঠি নিশ্চয়ই ছিল। বীরেন্দ্র পার্লামেন্ট ভেংগে দিয়ে আবার নিজের একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।

কিন্তু দেশের আপামর জনসাধারন অর্থনৈতিকভাবে যেমন দরিদ্র তেমনি তাদের সামনে আশার কোন পথও খোলা ছিলনা। এমত পরিস্থিতিতে উত্থান ঘটে মাওবাদীদের। মাওবাদী নেতা ‘প্রচণ্ড’ দুর্গম অঞ্চলের গরীব নিষ্পেষিত মানুষের সমর্থনের উপর ভর করে শক্তিশালি হয়ে ওঠে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঘেরাটোপের শেষে তারা নির্বাচিতও হয়। কিন্তু হা হতোম্মি! জনগনের স্বপ্নের মুক্তি আর মেলে না।

দেড় বছরের শাসনের পর বিভিন্ন ইস্যুতে জেরবার হয়ে নিজেরাই স্বেচ্চায় ক্ষমতা থেকে সরে দাড়ায় এবং নেপালের সরকার গঠন করে ইউএমএল (ইউনাইটেড মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট)। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে মাওবাদীরা এখনো সবচেয়ে বড় শক্তি। অন্যদিকে নেপালি কংগ্রেস এর দিকপাল গিরিজা প্রসাদ কৈরালার মৃত্যুর পর কংগ্রেস নেতৃত্ব হারিয়ে এক লক্ষ্যহীন নৌকায় পরিনত হয়েছে। গত কয়েক দশকের যে রাজনৈতিক দিশাহীনতা বিরাজ করছে নেপালে তার অনেক কারন আছে। বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত নেপালি জনগন, চীন ও ভারতীয় রাজনীতির দাবার বোর্ড হিসাবে নেপালকে ব্যবহার, পাহাড়ী দুর্গমতা, অর্থনৈতিক পশ্চাদপরতা ইত্যাদি।

এর ফলে এক রাজনৈতিক অরাজকতা বিরাজ করে আসছে সবসময়। হরতাল, বনধ, চাকা জ্যাম এসব নিয়মিত ঘটনা হয়ে আসছিল। সম্প্রতি গত মে মাসের এক তারিখ থেকে মাওবাদীরা অনির্দিষ্ট কালের জন্য হরতাল ঘোষণা করে। এই হরতাল টানা ৬ দিন চলে। সব কিছু ছিল স্থির।

এমনকি দোকানপাট, বাইসাইকেল এসবও ছিল নিষিদ্ধ। হরতালের এজেন্ডা ছিল নেপালের সংবিধান তৈরি। গত কয়েকবছর ধরে চেষ্টা করেও নেপাল একটি সর্বসম্মত সংবিধান তৈরি করতে পারেনি। বিদেশি বিশেষজ্ঞদের মোটা অংকের কন্সালটেন্সি ফি দেয়া হচ্ছে। অথচ কোন ঐকমত্য নেই।

তারই প্রক্ষিতে মাওবাদীরা এই হরতাল ডাকে। কিন্তু এই ইস্যুর সাথে জনগনের খাওয়া পরার সম্পর্ক ছিলনা। কাজেই হরতালের ৪/৫ দিনের মধ্যেই জনগন বিরক্ত হতে শুরু করে। একপর্যায়ে ক্ষুদ্র মাঝারি এবং বড় ব্যবসায়ীরা রাস্তায় নেমে আসে। কোন কিছু অর্জন না করেই মাওবাদীরা ৬ষ্ঠ দিনে তাদের অনির্দিষ্টকালের অবরোধ তুলে নেয়।

এ ঘটনাটি নেপালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপুর্ণ এবং আমাদের জন্যও এতে ভাবনার খোরাক আছে। ৯০ দশকে যেমন আমাদের দেশে এবং এতদিন ধরে নেপালে হরতাল অবরোধ জাতীয় জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। কিছুদিন পর পর হরতাল হবে এটাই সবাই ধরে নিত। এবং এ-আর-এমন-কি টাইপের একটা এটিচ্যুড হরতালের প্রতি মানুষের ছিল। কিন্তু সাধারন জনগন এবং ব্যবসায়িরা যেভাবে শক্তিশালী মাওবাদীদের হরতালকে রুখে দাড়িয়েছে তাতে বোঝা যায় যে ৮০ বা ৯০ দশক আর ২০১০ সাল একই রকম নয়।

এযুগে মানুষ যেমন ইনফরমেশন হাইওয়েতে বাস করে, দুনিয়ার সাথে তাদের যোগাযোগ আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। মানুষ বুঝে গেছে রাজনীতিবিদদের এসব হাঊকাউ আসলে তাদের মুক্তি দিতে অক্ষম। তাদের নিজেদের ভবিষ্যত নিজেদের পরিশ্রমেই অর্জন করতে হবে। এ ঘটনা আসলে রাজনীতিবিদদের কাছে সেরকমই একটি সিগনাল। রাজনীতির ক্ষেত্রে ধীরে হলেও আমাদের দেশেও একটি গুনগত পরিবর্তন গত ৯০ এর দশকের পর থেকে শুরু হয়েছে।

পরিপুর্ণভাবে না হলেও আমরা গণতন্ত্রের চর্চায় ফিরে এসেছি দু দশকের সামরিক বা ছদ্ম সামরিক শাসন ভেঙ্গে। এই গুনগত পরিবর্তন এবার বিএনপির হরতালেও দেখা গেছে। প্রায় দুমাস আগে হরতালের ঘোষণা একধরনের সাবধানী চরিত্রকেই ফুটিয়ে তোলে। আগের মত ইচ্ছে হল আগামীকাল হরতাল—এধরনের বিষয় যে মানুষ খাবে না তা বিএনপিও বুঝতে পেরেছে। তাই আগে থেকে প্রস্ততির একটি সময় তারা রেখেছে।

এই সাবধানতা আমি রাজনীতির গুনগত পরিবর্তনই বলব। এখনও হরতাল হয়ত প্রয়োজন আছে। তবে সেটা আগের মত কথায় কথায় প্রয়োগের দিন বোধহয় শেষ। নেপালের এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিলে আমাদের রাজনীতিকদের জন্য মংগল। তবে কথায় বলে যে, শিক্ষা গ্রহণ আর রাজনীতি সব সময় নাকি একই গতিতে চলেনা।

তাই রাজনীতিতে এত উত্থান পতন আমরা দেখি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।