আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কপি পেস্ট...............রিমান্ড কাহিনী।

* আমি খুজে বেড়াই নিজেকে *

বেগম জিয়া গণআন্দোলন গড়ে তুলতে চান বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলেরই সে অধিকার আছে। বিএনপির দু'টি সরকারের পতন হয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গণআন্দোলনের ফলে। গণআন্দোলন করবেন, অতি উত্তম, কিন্তু আঙ্গুল তুলে হুমকি দিচ্ছেন কেন? গত মাসখানেক ধরে মনে হচ্ছে তাঁর ধারণা হয়েছে, আন্দোলনের জমি উর্বর। সে জন্যই হুমকির মাত্রা বাড়ছে।

বেগম জিয়া এ কাজটি প্রায়ই করেন। কেন? তিনি কি আমাদের সবাইকে ব্যাটম্যান মনে করেন? বুঝলাম (ব্যাটম্যান শব্দটি তাঁর চেয়ে ভাল কেউ বুঝবে না) তাঁর স্বামী ছিলেন একজন লে. জেনারেল, ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি তাঁকে দান করেছেন আরেক লে. জেনারেল, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সবাই তাঁর ব্যাটম্যান। হঁযা, খন্দকার দেলোয়ার, মওদুদ আহমেদ, এম কে আনোয়ার_ তাদের তিনি ব্যাটম্যান মনে করম্নন কিছু আসে যায় না। কিন্তু তাঁর নেতাকর্মী ছাড়া বাকি সবাই কারও ব্যাটম্যান নয়_ এ বিষয়টি তার মনে রাখা উচিত। তিনি বলছেন, "অনেক সহ্য করেছি, আর নয়, এবার আঘাত এলে প্রতিঘাতের মাধ্যমে কঠোরভাবে জবাব দেয়া হবে।

" গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সতর্ক করে বললেন, অতু্যৎসাহী হয়ে কাজ করবেন না, সময় বদলালে আপনাদেরও রিমান্ডে নেয়া হতে পারে। সরকারকে উদ্দেশ করে বলেছেন, কোথায় কত কমিশন খাচ্ছেন, দুর্নীতি করছেন সব রেকর্ড করা প্রমাণ আছে যথাসময়ে প্রকাশ করা হবে। চট্টগ্রামে কারচুপি হলে ইসিকে ছাড়া হবে না, পালানোর পথ পাবেন না। বিচারপতিদের বললেন, নির্ভয়ে কাজ করুন, সময় মতো আমরা পাশে দাঁড়াব। [জনকণ্ঠ, ১০.৬.১০] সরকারী দলের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়ার ব্যাপারে আমাদের মাথাব্যথা নেই।

কিন্তু প্রশ্ন জাগে, তাঁর স্বামীর ওল্ড কমরেডসরা বন্দুকবাজি করলে তার দল কেন হাঁটু গেড়ে ক্রন্দন করতে থাকে। তিন উদ্দিনের রাজত্বকালে তার দলের বাঘা বাঘা নেতারা যেমন বেড়াল হয়ে যায় তাতো দেখাই আছে। বেগম জিয়া অবশ্য স্বভাবসিদ্ধভাবে সত্য বিকৃত করেন। তিনি সবসময় দুই উদ্দিনের কথা বলেন, সবচেয়ে বড় উদ্দিনের কথা বলেন না, কারণ বড় উদ্দিন বা ইয়েস উদ্দিনকে তিনিই এনেছিলেন ব্যাটম্যান হিসেবে। কিন্তু ব্যাটম্যানের চাকরি তো বদলির।

ইয়েস উদ্দিন তখন মইনুদ্দিনের ব্যাটম্যান হিসেবে যোগ দেন। আরও লৰণীয়, বেগম জিয়া বা বিএনপি তড়পার গণতান্ত্রিক দল ৰমতায় এলে। তখনই তার স্বর উচ্চগ্রামে থাকে। বন্দুকবাজরা এলে স্পিকটি নট। আর ঐ বোধ থেকে তিনি প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, আদালত সবাইকে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেন।

বেগম জিয়ার সাম্প্রতিক ক্রোধের কারণ, তাঁর নীল চোখের বালক মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার। তাঁর আরেক নীল চোখের বালক এহসানুল হক মিলনও কারাগারে। বিএনপির মূল দৃষ্টি এখন মাহমুদুর রহমান, মিলন নয়। কারণ তিন উদ্দিনের সময় মিলনই একমাত্র উলেস্নখযোগ্য বিএনপি নেতা যাকে তিন উদ্দিন টোকাটিও দেয়নি। এর অর্থ হতে পারে, মিলন ঠিক বিএনপিরও নয়, অন্য আরেক পৰের খাস লোক।

এটি বোধহয় বিএনপির নেতৃবৃন্দ এতদিন পর অনুধাবন করছে, কিন্তু মাহমুদুর রহমান বেগম সাহেবার খাস বান্দা। মওদুদ আহমদ, খোকা, আব্বাস, এদের অনেককে অনেক ঘাটের পানি খেয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিঁড়িতে পা রাখতে হয়েছে। মাহমুদুর রহমানকে সোজা এনে কর্তৃত্বে বসিয়ে দেয়া হয়েছে, বেগম জিয়ার তাকে পছন্দ করার কারণও আছে। মাহমুদ একই রকম ঔদ্ধত্য, তারও ধারণা সবাই তার ব্যাটম্যান। বেগম জিয়া দাবি করেছেন মাহমুদুর রহমানের ওপর ' পৈশাচিক অত্যাচার' করা হয়েছে।

তাই মিসেস জিয়া "রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, সংবিধান ও আইনের বাইরে কাজ করবেন না। এর পরিণাম ভাল হবে না। ফ্যাসিস্টদের মদদকারী হওয়া থেকে বিরত থাকুন। " সরকারী কর্মকর্তারা আইন ভঙ্গ করবেন না। কোন সরকারই শেষ সরকার নয়।

" (্্ঐ ১৪-৬-১০) আগেও বলেছি, এখনও বলছি, বর্তমান সরকার প্রায় পঞ্চাশভাগ ৰেত্রে ভুল সব নিয়োগ করেছেন বা পরামর্শ শুনছেন। উত্তরা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে এখন আটক না করে তখন করা যেত। হিযবুত তাহরীর সঙ্গে তার যোগ ছিল বলে পত্রিকার খবর। সেটি সত্য হলে আগেই ব্যবস্থা নেয় যেত। কিন্তু তা না করে গ্রেফতার করা হলো তার অফিস থেকে, তাও আবার তার প্রকাশকের মামলায়।

প্রকাশকের মামলার পর তা যাচাই করে ব্যবস্থা নিলে আপত্তি ছিল না এবং এ নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্যও করত না। মাহমুদুর রহমানকে তার কর্মচারীরা ছাড়া কেউ পছন্দ করত বলে জানি না। কেননা তার প্রধান রোগ 'ওরাল ডায়রিয়ার' কোন চিকিৎসা তিনি করাননি। তার কথাবার্তায় শিৰাদীৰা থেকে অসংস্কৃত ভাবটিই বেশি ফুটে উঠত। উদ্ধত অসংস্কৃত এই ব্যক্তিটি প্রায়ই তার খবরের কাগজে সত্য মিথ্যা, গুজব, অতিরঞ্জন ছড়িয়ে খবর পরিবেশন করতেন, যে কারণে ছিলেন বেগমের প্রিয়পাত্র।

এ ব্যক্তিটি প্রায়ই ঘোষণা করতেন, তিনি কাউকে ভয় পান না। এসব সত্ত্বেও, এবং গ্রেফতারের কারণ থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিটি অপছন্দ সত্ত্বেও, আমি বা আমাদের অনেক নীতিগত কারণে তার এ ধরনের গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানিয়েছি। বিএনপির হাতে কোন ইসু্য না থাকাতে মাহমুদুর রহমানকে এখন জিরো থেকে হিরো বানাবার প্রয়াস চালাচ্ছে। তাকে হিরোতে পরিণত করল বর্তমান সরকার। আপনাদের একুশে টিভির ঘটনাটা মনে আছে? রায় বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।

বিএনপি আমলে মার খাওয়া, নিহত হওয়া সাংবাদিকদের সংখ্যা মনে আছে? আজকে বিএনপির যারা মাহমুদকে নিয়ে মাতামাতি করছেন তাদের একজনও তখন নীতিগত প্রশ্নে বেগম জিয়া বা তার সরকারের কার্যকলাপের প্রতিবাদ করেননি। এখানেই তাদের সঙ্গে অন্যদের তফাত। এখানেই মানুষ ও বিএনপিতে তফাত। এখানেই তফাত ব্যাটম্যান ও রাজনৈতিক নেতা বা কমর্ী বা সৎ বুদ্ধিজীবীরা। সম্প্রতি সংবাদপত্রে ও টিভির খবরে সেই মাহমুদুর রহমানকে দেখলাম।

কিন্তু এ কোন মাহমুদ? বিষণ্ন, নমিত, তার সমসত্ম ঔদ্ধত্য চূর্ণ। এর কারণ তার ভেতরটা ছিল ফাঁপা। কিন্তু ফাঁপা মানুষ যারা নন তাদের কাছে রিমান্ড, জেল, মুক্তি সব একই রকম, মাত্রার ভিন্নতা থাকতে পারে মাত্র। রিমান্ডের পর ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, শাহরিয়ার কবির, আমার অনুজ বন্ধু ড. হারম্ননুর রশীদ এমনকি ড. আনোয়ারকেও দেখেছি। সে চিত্র ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত।

এর অর্থ সফরবাদী, ফ্যাসিবাদী, লুটেরা, জঙ্গীবাদী, প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বাসীদের চরিত্র এবং প্রগতিবাদী, গণতন্ত্রমনা, মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদ বিরোধীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অন্যরকম। মাহমুদুর রহমান রিমান্ড নিয়ে যা বলেছেন, তা উদ্ধৃত করছি। ৯ জুন আমাকে ক্যান্টনমেন্ট থানায় রিমান্ডে নেয়া হয়। ওইদিন রাতে পাঁচ-ছয়জন লোক গিয়ে প্রথমে আমার চোখ বাঁধে। এরপর শুরম্ন হয় নির্যাতন।

তিনি আদালতের উদ্দেশে বলেন, আপনি একজন নারী, তবু বলতে হচ্ছে আই ওয়াজ আনড্রেসড। (আমাকে বিবস্ত্র করা হয়) আমার চোখ বাঁধা হয়েছে। কনুই দিয়ে পিঠের ওপর আঘাত করে বসিয়ে আমার প্যান্ট খুলে ফেলা হয়। আমাকে বিবস্ত্র অবস্থায় হঁ্যাচকা টান দিয়ে মারতে থাকে তারা। এক পর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

সম্ভবত এর প্রায় দুই ঘণ্টা পর যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমি দেখি থানার সেকেন্ড অফিসারের রম্নমে আমাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তখন আমি নড়তে পারছিলাম না। আমার কোমরের পেছনে ব্যথা হচ্ছিল। তিনি আদালতকে বলেন, তারা আমাকে কোন প্রশ্নই করেনি। তারা আসল কিন্তু একটি প্রশ্নও করল না।

শুধু টর্চার করল। পরের দিন বেলা পৌনে ১টার দিকে আবার আমার চোখ বাঁধা হলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম আমি একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক। চোখ বাঁধলেন কেন? তারা বলল রিমান্ডে নাকি এটাই নিয়ম। আমি জানি না, আপনাদের আইন আদালতে এরকম নিয়ম আছে কিনা? ম্যাজিস্ট্রেটের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনার প্রতি সম্মান রেখে বলছি, পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে।

কোন সাৰী নেই। তবু মামলা করামাত্রই আপনারা রিমান্ড দেন। কিন্তু রিমান্ডের নামে আমাদের ওপর যে কি টর্চার হয় সেটা দেখার কেউ নেই। রিমান্ডের চার দিন গেছে। আলস্নাহ আছেন তিনি সবই দেখছেন।

[যুগানত্মর ১৩-৬-১০] আমাদের যখন মাহমুদুর রহমানের আমলে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয় তখনও আলস্নাহ সব দেখেছিলেন। কোন দোষী ব্যক্তির শাসত্মি হয়নি। বেগম জিয়া এই রিমান্ডে নেয়ার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সুপ্রীমকোর্টের জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত আইনবিদরা বলেছেন, তারা এর আইনগত ব্যবস্থা নেবেন। তাদের সঙ্গে তখন আমাদের সেই মসৃণভাবে তথ্য বিকৃতকারী মওদুদ আহমদও ছিলেন এবং মিটি মিটিভাবে হাসছিলেন।

এহসানুল হক মিলনের একমাত্র সনত্মান তানজিদা 'বাবার কাছে খোলা চিঠি' শীর্ষক এক বিজ্ঞাপনে জানিয়েছে, "আজ তুমি কারাগারে চার দেয়ালে বন্দী হয়েছ একজন ছিনতাইকারী হিসাবে। ওরা তোমার বিরম্নদ্ধে মামলা করেছে মোবাইল ফোন আর ভ্যানেটি ব্যাগ ছিনতাইয়ের অভিযোগে। বাবা, কোর্টের জজ সাহেবরাও কি বিশ্বাস করছেন এই অভিযোগ? কেন তোমাকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন মঞ্জুর করলেন বিচারক? দেশে কি বিচার বলতে কিছু নেই? " [ আমাদের সময়, ১৪. ৬. ১০] এই প্রচার করে অনেকের বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ কারণে মূল তথ্যগুলি আবার সামনে রাখা বাঞ্ছনীয়। নিজামী-খালেদা ২০০১ সালে সমস্ত বাংলাদেশকে রিমান্ডে নিয়েছিলেন।

সে তুলনায় পুলিশ রিমান্ড সামান্য কয়েক দিনের। পাঁচটি বছর বেগম জিয়াই নয়, তার ব্যাটম্যানরাও ছিল ক্ষমতাশালী। যেমন, মিলন কচুয়াকে রিমান্ডে নিয়েছিল। মেজর হাফিজ, ভোলাকে রিমান্ডে নিয়েছিল। পাবনা ছিল নিজামীর রিমান্ডে।

আর এর নেতৃত্বে ছিলেন সেই মহিলা আর সেই ধর্মব্যবসায়ী। পাঁচ দিনের রিমান্ড আর পাঁচ বছরের রিমান্ডের তফাতটা মনে করে দেখুন। তখন আমরা পাঁচ দিনের রিমান্ড ও পাঁচ বছরের রিমান্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছি। নিম্ন ও উচ্চ আদালতে আর্জি জানিয়েছি। তখন, আজ যেই সব সাংবাদিক মানববন্ধন করছেন, নয়াদিগনত্ম ও আমার দেশে কলামে রিমান্ডের বিরম্নদ্ধে দসত্মা দসত্মা লিখছেন তারা তখন ছিলেন একেবারে নিশ্চুপ।

দার্শনিকদের মতো তাদের ভাষ্য ছিল এসব ইহজাগতিক ব্যাপারে তাদের কোন কিছু বলার নেই, এগুলো সরকারের ব্যাপার। রিমান্ডে পুলিশ সবসময় নিয়েছে। কিন্তু রিমান্ডের ভয়াবহতাটা বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারে ২০০১ সালে। এই মৃদু হাসির মওদুদ তখন আদালত নিয়ন্ত্রণ করেছেন, রিমান্ড বলবতে সাহায্য করেছেন। এই খন্দকার মাহবুব হোসেন ও বার সমিতির সদস্যরা একজনও রিমান্ডের বিপৰে দাঁড়াননি।

এই মাহমুদুর রহমান, এই মিলন, এই এম কে আনোয়াররা তখন হাততালি দিয়ে, রিমান্ড সমর্থন করেছেন। বিএনপি যদি রিমান্ডে নেয়ার এই (ভয়াবহতা) প্রক্রিয়া জোরদার না করত তা হলে আজ এই অবস্থা হতো না। আমি এবং আমার কলামিস্ট বন্ধুরা তখন যেমন রিমান্ডের [আমাকেও নেয়া হয়েছিল] বিরম্নদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছি, লিখেছি, এখনও তেমনি যে কোন ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচারের প্রতিবাদ জানাচ্ছি। শুধু তাই নয়, রিমান্ড সংক্রান্ত হাইকোর্টের নির্দেশনা আইনে পরিণত করারও দাবি জানাচ্ছি। এখানেই বিএনপির ব্যাটম্যান ও অন্যদের তফাত।

এখানেই বিএনপির সঙ্গে মানুষের তফাত। জনাব মওদুদ থেকে মাহমুদ, জনাব খোন্দকার দেলোয়ার থেকে মিলন, জনাব খোন্দকার মাহবুব থেকে বিএনপিবাদী পিচ্চি ব্যারিস্টারদের সামনে এখন কয়েকটি উদাহরণ দিই। ২০০১ সালে গ্রেফতার করা হয় ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে। শিক্ষাদীক্ষা, দৰতা, আচার-ব্যবহার, সংস্কৃতি কোন দিক থেকেই মাহমুদুর রহমান বা মিলন তার ধারেকাছে আসে না। বয়সের দিক থেকেও।

আগে সৌজন্যবশত বয়সীদের বা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিতদের রিমান্ডে নেয়া হতো না। বেগম জিয়া, বাবর আলী বা মওদুদ গং সেই প্রথা বিলোপ করেন। ড. আলমগীরই হলেন প্রথম বয়সী মান্যগণ্য ব্যক্তি যাকে বেগম জিয়ার নির্দেশে বাবর মিলন মওদুদ মাহমুদ গং রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার করেছিল। সে সময় একইভাবে ড. আলমগীর নিম্ন আদালতে যে জবানবন্দী দিয়েছিলেন তা উদ্ধৃত করছি_ দিন গেল। রাত এল।

থানার হাজতে আমি একা। মশার কীর্তন, পিপাসার আর্তি। রাত সাড়ে দশটার দিকে সেই এবড়ো-খেবড়ো কংক্রিটের ওপর শুয়ে আনমনা, অনেকটা অচেতন আমি। হঠাৎ ঝনাৎ করে তালা খোলার শব্দে সচেতন হয়ে দাঁড়ালাম। তিনজন কালো মুখোশ পরা লোক আমার সামনে দাঁড়িয়ে।

একজন, অন্য দু'জনের চেয়ে লম্বা, প্রায় র্৫-র্৭র্ । অন্য দু'জন খানিকটা খাটো, ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির মতো। খাটো দু'জনের পরনে কালচে ফুলপ্যান্ট, ধূসর বা সাদাটে শার্ট, আর পায়ে কালো অঙ্ফোর্ড জুতো। এদের মধ্যে একজনের কাঁধে ঝোলানো কালো ক্যাম্বিস বা রেকসিনের ব্যাগ। লম্বা জনের পায়ে মোটা সোলের ডার্ক টানের পাম্প।

এদের ভাষা অশ্রাব্য, দাঁড়ানোর ভঙ্গি আক্রমণাত্মক। কথা বা চেহারায় অফিসার মনে হলো না। আমাকে ও আওয়ামী লীগকে অশ্রাব্য গালিগালাজ দিতে লাগল তারা। চুপ করে রইলাম। গালিগালাজে হয়তবা ক্লান্ত হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি তাদের কথামতো কাজ করব কিনা।

জানতে চাইলাম, তারা কে, কারা তাদেরকে পাঠিয়েছে আর আমাকে দিয়ে কী করাতে চান তারা। বলল, নামের দরকার নেই, উপরের-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরও উপরের হুকুমে তারা এসেছে। বলল, আমাকে ছেড়ে দেয়া হবে যদি আমি তিনটি কাজ করে দিই_ আমাকে বিএনপিতে যোগ দিতে হবে, গত নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলতে হবে, আর ম্যাডামের জন্য বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট এনে দিতে হবে। বললাম, বিএনপিতে আমি কখনই যোগ দেব না। লুটপাট ছাড়া বিএনপির কোন আদর্শ আছে বলে আমি মনে করি না।

নির্বাচন সুষ্ঠু বা অবাধ হয়নি বলেই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, এই অভিজ্ঞতার বিপরীতে কোন কিছু আমি বলব না। আর বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রী আনা আমার সাধ্যের বাইরে। তা ছাড়া আমার জানামতে কোন স্বীকৃত বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এদেশের কোন ননম্যাট্রিককে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। উত্তর শুনে তারা খেপা কুকুরের মতো চিৎকার করে উঠল। বলল, বেয়াদবী ব্যবহারের জন্য আমায় অনুতাপ করতে হবে।

আমি শান্ত গলায় বললাম, আমি তাদের কাজ করব না। লম্বা লোকটা ব্যাগবাহী খাটো লোকটাকে হাত দিয়ে ইশারা করল। অশ্রাব্য গালি দিয়ে ও লোকটি আমার পাশে এগিয়ে এল, তার বাম হাত দিয়ে আমার ডান হাত ধরে মুখে সজোরে ঘুষি মারল। আমি তার দু'পায়ের মাঝ বরাবর লাথি মারলাম। ব্যথায় ককিয়ে সে পিছনে সরে গেল।

সাথে সাথে অশ্রাব্য গালি আর কিল ঘুষি লাথি নিয়ে আর দু'জন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিল-ঘুষি মুখে, পাঁজরের দুপাশে, বুকে, পিঠে ও ঘাড়ে মারতে লাগল। আমার এক কষা থাপ্পর পড়ল লম্বা লোকটির বাম গালে। তাদের লাথি পড়ল আমার তলপেটে, হাঁটুতে আর গোড়ালিতে। বিপর্যসত্ম, আহত আমি মেঝের ওপর ছিটকে পরলাম।

লাথি খাওয়া খাটো লোকটি তখন ফিরে এসে ৯-১২ ইঞ্চি লম্বা একটি কাচ বা পস্নাস্টিকের বোতল কালো ব্যাগ থেকে বের করে আমার পিঠে ও পাছায় আঘাত করল। আমি যখন বাঁধা দিতে বা তাকে আঘাত করতে পারছি না তখন সে বোতলটি আমার পায়ুপথে ঢোকাতে চেষ্টা করল, আমি নিরুপায় হয়ে দু'হাত দিয়ে আমার লিঙ্গ ও অ-কোষ ঢেকে রাখতে চাইলাম। খানিক পরে আমি মেঝেতে ঘুরে পড়ে গেলাম। ওরা তিনজন মা-বাপ তোলা অশ্রাব্য গালি মুখে আমার সারা শরীরে লাথি মেরে থেঁথলে ফেলে ঘুরে দাঁড়াল, মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে আমার বিপর্যস্ত শরীর দেখল, পরের রাতে আবার আসবে বলে হাজত থেকে সদম্ভে বের হয়ে গেল। বেশ কতক্ষণ পরে আমি কষ্ট করে উঠলাম।

সারা শরীরে আমার বেদনা, দুটো দাঁত নড়ে গেছে, মাড়ি থেকে রক্ত বেরোচ্ছে, শরীরজুড়ে কিল-ঘুষির দাগ। কপট রাত্রির গোপন হিংসার বাহক নরকের কীটত্রয়ের আবার আগমন আশঙ্কায় রাত কাটল। " [জেলের কথা, মানুষের কথা, সুবর্ণ, ২০০৩] আরও আছে। উদ্ধৃতি আর দিলাম না। শাহরিয়ার কবিরকে দু'বার গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে যে অত্যাচার করা হয়েছে মওদুদ কি তা পড়েননি? সাংবাদিক সেলিম সামাদ আমাকে বলেছিলেন, ডিবির কোহিনূরের রুমে রোজার দিনে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাকে মাটিতে শুইয়ে কোহিনূর তার বুকের ওপর বুটজুতা তুলে দেয়।

আমি যখন রিমান্ডে তখন আমার সেলমেট বহু খুনের আসামি ব্যাঙ্গা বাবু বলেছিল, সেলিমকে মেরে রক্তাক্ত করে দেয়া হয়েছিল। শুনেছি কোহিনূর আমার সেলমেটকে দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল। সেই কোহিনূরকে পুলিশ খুঁজে পায় না। বর্তমান দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরও বোধহয় ফেবারিট কোহিনূর না হলে এই যে পুলিশ খুঁজে পায় না সে ব্যাপারে তাদের মাথাব্যথা নেই। বিএনপি আমল হলে এ রকম ঔদাসীন্য দেখান হতো না।

বিস্মিত হব না যদি একদিন এই কোহিনূর সাহারা খাতুন ও টুকুকে রিমান্ডে নেয়। এসব পত্রিকায় এসেছে। বিস্তারিতভাবে। মাহমুদ মওদুদ মিলন বাবর আনোয়ার দেলোয়ার খোকা পটল গং তখন একটি বাক্যও উচ্চারণ করেনি বরং নির্যাতন যাতে চালিয়ে যাওয়া হয় সে উৎসাহ দিয়েছে। আদালতে আমরা একইভাবে আর্জি জানিয়েছিলাম।

আর্জি ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। হাইকোর্টে অপরাধীদের শাস্তি ক্ষতিপূরণ ও রিমান্ড বন্ধের আবেদন জানিয়েছিলাম। যেদিন সিনিয়র জজ রায় দেবেন সেদিন মওদুদ আমলে নিযুক্ত জুনিয়র মহিলা জজ জানালেন তিনি অস্বস্তি বোধ করছেন। সিনিয়র জজ তাকে অনেক অনুরোধ উপরোধ করেছিলেন কারণ সেদিন ছিল রায় দেয়ার দিন। জুনিয়রের মন গলেনি কারণ কয়েকদিন পর তার কনফার্ম হওয়ার কথা।

এই মওদুদের হাতে ছিল তার কনফার্মের ব্যাপার। এই মওদুদের নির্দেশে/আদেশে তখন ১০ জন বিচারককে স্থায়ী করা হয়নি। শত দুষ্কর্মের হোতা মওদুদ এখন রিমান্ডের বিরম্নদ্ধে বলেন। তবে বলি আইনজীবীদের চরিত্র অদ্ভুতই বটে। রাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষতি করেছে যেসব আইনজীবী তাদের সঙ্গে এখনও তারা ওঠাবসা করে সখ্য বজায় রাখে।

অন্য কোথাও হলে মওদুদরূপী এই চরিত্ররা ফের আদালতে প্রবেশ করতে পারত না। মাহমুদের পরিবার ও মিলনের পরিবার তাদের দুজনকে রিমান্ডে নেয়ার আজাহারি করেছে। আমি অন্তত ব্যক্তিগতভাবে তাদের পক্ষে সমব্যথী। মিলনের পরিবারকে বলি, মিলন আমার ছাত্রতুল্য। কিন্তু কচুয়াতে সে যে ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছিল তার কি কোন তুলনা আছে? তার কন্যা ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনতাইয়ের উল্লেখ করেছে।

কিন্তু বিএনপিই প্রথম (যখন মিলন মন্ত্রী)। প্রাক্তন নৌপ্রধানের বিরুদ্ধে ঘড়ি ছিনতাই এবং সাবের হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্লেট চুরির মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে এবং তাদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল। আদালত তখন তাদের আর্জিও শোনেনি। ধর্মে কাফফারা বলে একটি শব্দ আছে। আজ কেন কেউ মিলনের পৰে কলম ধরছে না কারণ তার অপকীর্তি সবার জানা।

মাহমুদুর রহমান যদি উদ্ধত, অশালীন ব্যবহার না করতেন তার প্রতিও অনেকে সমব্যথী হতেন। এখন হবেন না। মৌলবাদীদের সমর্থক মাহমুদুর তো আমাদের চেয়েও মুসলমান, নিশ্চয় কাফফারা শব্দটির অর্থ তার জানা। বেগম জিয়ার মনে রাখা উচিত কি ত্রাসের রাজত্ব তিনি চালিয়েছিলেন। আজ তিনি বলছেন প্রতিপৰকে নিশ্চিহ্নের রাজনীতি শুরম্ন করেছে সরকার (আ. সময় ১৪.৬.১০)।

ভুল রাজনীতি তিনিই শুরু করেছিলেন, ঐক্যবদ্ধ জাতিকে তার স্বামী বিভক্ত করেছিলেন, তিনি তা আরও প্রশস্ত করেছেন। সে জন্য তিনি সাড়া পাচ্ছেন না। লন্ডনের ইকোনমিস্ট পত্রিকা লিখেছে এবারেই প্রথম বাংলাদেশের সামনে দারিদ্র্য জ্বালানি সঙ্কট, সন্ত্রাসবাদ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো চারটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে এসব চ্যালেঞ্জ বিরোধী দলকে ৰমতায় আনার জন্য যথেষ্ট হবে না। রাজনীতিতে খালেদা জিয়া খুব একটা স্বস্তিতে নেই।

তার দুই পুত্রের বিরুদ্ধেই রয়েছে দুনর্ীতির গুরুতর অভিযোগ। বড় পুত্র তারেক রহমান রয়েছেন লন্ডনে। ৰমতায় থাকাকালে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যাকে দুর্নীতির প্রতীক হিসাবে দেখত। ... বিএনপির মিত্র জামায়াতে ইসলামী। কট্টর ইসলামপন্থী দলটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিপৰে অবস্থান নেয়ার কারণে বর্তমানে বেকায়দায় রয়েছে (জনকণ্ঠ ১ আষাঢ় ১৪১৭)।

আরও বলি মাহমুদুর বা মিলন তো রাজনীতিবিদ নানা কর্ম-অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, কিন্তু বেগম জিয়া বা মওদুদ বলুন তো শাহরিয়ার কবির, সেলিম সামাদ, এনামুল হক (আরও অনেকের নাম ভুলে গেছি) তারা কি অপকর্ম করেছিলেন? কোন খারাপ রাজনীতি করেছিলেন? কী লুট করেছিলেন? আঙুল উঁচিয়ে কথা বলতে পারবেন কিন্তু জবাব দিতে পারবেন না। রিমান্ডের অত্যাচারের বিষয়টি একেবারেই নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। মওদুদ গংয়ের এখন বলা উচিত, আমরা ভুল করেছি, আদালতের নির্দেশনা শুনিনি, রিমান্ডে নিয়ে রাষ্ট্রের গণ্যমান্যদের ওপর অত্যাচার করেছি, মিথ্যা মামলা দিয়েছি_ এ পথ পরিহার করলাম। আসুন দুপৰ মিলে সংসদে রিমান্ড নিয়ে একটি আইন প্রণয়ন করি। মওদুদকে বিশ্বাস করা অবশ্য মুশকিল।

বেগম জিয়াকেও। মেজর হাফিজকে কেমন বলির পাঁঠা বানালেন। সে জন্য বলি বেগম জিয়ার কথা মনে হলে শুধু একটি ছোট কাহিনী মনে রাখবেন। আরও জানবেন মওদুদরা আবার ৰমতায় এলে আইন ভেঙ্গে সবাইকে রিমান্ডে নেবেন। প্রশাসনে যারা উচ্চপদে আছেন তাদের চাকরিচু্যত করে বিভিন্ন মামলা দেয়া হবে, আদালতের বিচারকদের দুর্দশার শেষ থাকবে না, প্রতিপৰকে তখন আর গ্রেফতার বা রিমান্ড নয়, হত্যাই করা হবে।

২০০১-০৬ সালের রিমান্ডের কথা বারবার স্মরণ করুন। আর সেই সত্য ঘটনাটা মনে রাখুন। নিভৃত পল্লী। ঘরে বিধবা ও তার কিশোরী কন্যা। গভীর রাত।

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলে হারিকেনের আলোয় দেখলেন বিধবা মা যে, বেগম জিয়ার কয়েকজন 'সোনার ছেলে' দাঁড়িয়ে আছে। মা তো, সোনার ছেলেদের উদ্দেশ্যে বুঝলেন। হাত জোড় করে শুধু বললেন, বাবারা আমার মেয়েটা ছোট, তোমরা এক সঙ্গে না, একজন একজন করে এসো।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।