আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জ্যোৎস্না-কুয়াশার জাল



‘এইখানে এলে মনে হয় তুমি সবচেয়ে বেশি নেই তোমাকে ণিক পাওয়ার জন্য এইখানে তবু আসি মুগ্ধ পরান যতোদূর চায় ততোদূর ভালোবাসি’। জলে পা দু’খানি ডুবিয়ে বসে আছে সে। পাশের মাঠে, আম-নারকেলের গাছের মাথায় দুপুরের ভর রোদ দাঁড়িয়ে। পাড় ছুঁই ছুঁই পুকুরের পানি। চেনা বাতাসে জলজ গন্ধ।

চোখ বুঁজে বুক ভরে সে গন্ধ টেনে নিলে গোপনে কি যেন পাওয়া হয়ে যায়। তার কানের নীল দুলখানি আনন্দে সে হাওয়ায় স্পষ্ট দুলছে। একটা মোড় ঘুরতেই চকিত দেখে নিয়ে সে নিমিষে পালিয়ে গেলো। তখনো বকুলতলার পথে তার নগ্ন ভিজা পায়ের ছাপ। ঘাটের ওপর একখানি নূপুর, একটা চুলের কাঁটা।

আমার বোধহয় একটু ভুল হয়ে গেছে। ভারী লজ্জা হলো। তাই পাড় ছাড়িয়ে সোনালু গাছের নিচ দিয়ে বড় আইলটা ধরে দণি দিকে বেরিয়ে গেলাম। যেতে যেতে পেছন বাড়ির আউলির মধ্যে নারী কন্ঠের কলহাস্য কানে এলো । দুপুরের রোদের তেজ কমে যেতে থাকলে চারদিকে একটা অলস হাওয়া বয়।

মানুষকে ঘরে বেঁধে রাখার সময়ের মোহ টুটে যেতে থাকে। খোলা মাঠ, মুক্ত আকাশ, পথ পানে পানে ডেকে যায় গভীর গোপনে। সে ডাকে জরাগ্রস্ত মানুষ গৃহ আঁধারে ছটফটায়। ঘর আগলানো বন্দিবৎ নারীটি দাঁড়ায় আকাশের তলায়। নিঝুমতায় লেগে যায় মনুষ্য কোলাহল।

আমিও অনুভব করি সে ডাক। তবে তার পট খণ্ডিত বিকেল নয়, চিরকালীন আবহে। তাই আকাশের আদিগন্ত সামিয়ানার আদিম গৃহটিই আমার বেশি প্রিয়। স্বপন, এই স্বপন কাঁঠাল তলায় দাঁড়িয়ে কুসুম ডাকে। রাস্তা ছেড়ে কাঁঠাল তলায় আসলাম।

কুসুম আঙ্গুল নাড়িয়ে মুখ শক্ত করে বললো, দুপুরের সময় ঘাটের দিকে আস কেন! টুপ করে আমার লজ্জাটা ভেসে ওঠে। যেমন তা খানিক সময়ে তলিয়ে গিয়েছিলো। ফের যদি দেখি........। কথা অসমাপ্ত রেখেই কুসুম হাঁটা ধরে। আমি অবাক।

তার পরনে শাড়ি। হয়তো ভিন্নতায় মুগ্ধ করার হিসেবী ছল। নারী তোমার জীবনটাই ব্যাপক ছলের সমারোহ। ছল করে তুমি জীবন মধুর করো। ছল করে তুমি জীবন পোড়াও।

কিন্তু অনিপুণ জড়ানো খয়েরী শাড়িটা গতি থামিয়ে দেয় উদাসী বৈরিতায়। টলে উঠে কুসুমের একহারা শরীরটা। যন্ত্রের মতো দু’হাতে আগলে নেই। মুহূর্তে এক ঝলক ঘ্রাণ আমার অনুভব মাতিয়ে যায়। আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি, তার নিজস্ব ঘ্রাণটাকে আরাধ্য করে নেই।

স্বপ্নের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলি। কুসুম শীতল কন্ঠে বললো, ছাড়ো। তারপর শিথিল বাহু ছাড়িয়ে শাড়িটা একটু গুছিয়ে নিয়ে পা বাড়ালো। কেবল একবার পিছনে ফিরে এতোণের সবকিছুর মাশুল দেয়ার মতো লজ্জা মিশিয়ে একটু হাসলো। কিছু মানুষ আছে যারা আপন করে ভালোবেসেই শুধু প্রিয় হয় না, আপন করে না।

তাদের বিরুদ্ধতা, শাসন, দূরে ঠেলাও যেন কাছে টানার উপল্য। কুসুম যদি একটু নাও হাসতো, অনুরাগের ুদ্রতম চিহ্নও না ফেলতোÑ তবু আমি বুঝতাম সে আমায় বকে, মেরে, শাসন করে ভালোবাসতেই চায়। দুই ‘এখনো বাসিনি ভালো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রেখেছি কিছু প্রেম অপূর্ণ রেখেছি কিছু অন্তরঙ্গ প্রেমের বাসনা’। কুসুম একটা কুল বাড়িয়ে দিলো। অন্যহাতে আধখাওয়া আরেকটা।

- এটা থাক। আধ খাওয়াটাই দাও। - ওটা কেন? ও যে আমার এঁটো করা। - তাতেই ও অমৃত হয়ে গেছে। লজ্জার বিভায় কুসুম মুহূর্তে আরো পুষ্পিত হয়ে ওঠে।

মেয়েরা ব্যথায় সুন্দর হয়, আনন্দে সুন্দর হয়, সুন্দর হয় লজ্জায়। তারপর হয়তো তার মানানসই বাধাটা ফুটে উঠবে। তাই আমার প্রি হাতখানার মধ্যে তার এঁটো কুলের হাতখানা বন্দি হয়ে পড়লো। কিন্তু হাতের মধ্যে হাত কথা কয়ে ওঠে না। বরং তার অন্য হাত আমার বাঁ হাতের কনুইয়ের নিচে মাংস খামছে ধরে।

তখন তার আঙ্গুলের নড়াচড়া কি এক সুরে যেন বাঁধা হয়ে গেছে। তবু কুলটা নিতে পারেনি। চকিত মুখে পুরে দিলাম। অমনি প্রচণ্ড তেজে তার নখগুলো মাংসে ডুবে গেলো। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম।

খানিক পর চোখ মেলে দেখলাম কুসুম আর নেই। তার আঙ্গুলগুলো চেতনায় ভাসছে। বাঁ হাতের তিনটি স্থান থেকে রক্ত সর্পিল গতিতে এগিয়ে গিয়ে আঙ্গুল বেয়ে টপটপ মাটিতে পড়ছে। কুসুম আবার আসলো। অসীম বিহ্বলতা তার চোখে।

আমার রক্তাক্ত হাতখানি জড়িয়ে ধরে তীব্র আবেগে কেঁদে উঠলো। কত নিষ্ঠুর আমি, কথাটি বলে বলে রণের স্থানগুলো চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলো। কুসুমের ঠোঁট, গাল ছোপ ছোপ রক্তের দাগে চিত্রিত হয়ে যায়। আমি চোখের জলে ভেজা তার মুখখানি একটু তুলে ধরলাম। এখন বলার মতো কি কথা আছে।

সারাটা জীবনভর আমার বুকের কয়টা অনুভব ভাষায় বুঝিয়ে দেই। বেশির ভাগই বুকে নিয়ে নীরবে মরে যাই। মনে মনে ভাবি, কুসুম তুমি আমায় ভালবাসতে এসেছ, আমিও তোমায় ভালবাসা দিয়েছি। তুমি পূর্ণ হয়ে গেছ। এ অনন্য লেনদেনে নারী অপার্থিব সুন্দর হয়ে যায়, শ্রেষ্ঠ হয়ে যায়।

আমার নীরব মুখে তাকিয়ে কুসুম বলে, স্বপন যেদিন বুঝেছি আমি নারীÑ নারীত্বের সেই প্রথম উপলব্ধিতেই তোমায় ভালবেসেছি। এ আমার জীবনব্যাপী বড়ো আলোময় সত্য। আশ্চর্য! পৃথিবী জুড়ে প্রয়োজনীয় কথা বলার অপ্রয়োজনীয়তারও কমতি নেই। মনের সাথে মনের অনিবার্য বোঝাপড়ায় কথারা যে বড়োই বাহুল্য। কুসুম তোমার সুরভিত ভাবখানি আর অগোচর কি।

তোমার চোখের পলকের ভঙ্গিতে, হাতখানা নাড়ানোর মুদ্রায়, নুয়ে পড়া কৃষ্ণচূড়ার ডালখানা ছুঁয়ে দেয়ার চাঞ্চল্যে, চুল ওড়ার উদাসীনতায়, কপালে কোমল ঘামে তোমার বাসনার অতল নিংড়ে কবেই তোমার মরণে মন সঁপেছি। কুসুম তুমি টেনে নেয়া নিঃশ্বাসের বাতাসে জীবনানন্দ ছড়িয়েছ। নারী তুমি পৃথিবীর প্রাণকাব্য। বিধাতার সৃষ্টির পূর্ণতা। তোমার লাবণ্যময় হাতখানা মেলে ধরো।

তার মাধুর্যে অনিত্যপৃথিবীর অনিবার্য মৃত্যু দুয়ার বেখেয়ালেই উৎরে যাবো। হায়! প্রেমিক জীবন। প্রেমময় ক’টি অতৃপ্ত মুহূর্ত। সৃষ্টিকর্তার নারী কাব্যের ভেদহীন রহস্য বিশ্বাসীদের প্রার্থনার কপাল পবিত্র পদতলে লুটাতে কিনে নেয় কৃতজ্ঞতার মূল্যে। কুসুম তার ওড়নার একটা প্রান্ত আমার হাতে বেঁধে দেয়।

এভাবে যদি আপনই করবে তবে আরো রক্ত ঝরাও। ভালোবাসা ছুঁয়ে জীবন বড়ো গৌরবময়, বড়ো ছোট। আনমনে উঠতে গিয়ে কুসুমের ওড়নায় টান পড়ে। আর তো যাওয়া চলে না। গাঁটছড়া যে বাঁধা হয়ে গেছে।

লজ্জা! লজ্জা! কুসুম মুখ লুকিয়ে নেয়। বাঁধনটা আলগা করে দেই। রক্তাক্ত প্রান্তটা মুঠো করে কুসুম বুকে চেপে রাখে। বলি, কুসুম কান পাতো। কানে কানে আজ একটা কথা বলব, কোনোদিন আর বলবো না।

তবে সারাজীবন ভর তা তুমি জানবে, অনুভব করবে। কুসুম কান এগিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। আমি হাওয়ায় ভেসে প্রথম বললাম, কুসুম ভালবাসি, ভালবাসি। তিন ‘হয়তো তোমারে সে পরশ করি’ আসে, হে প্রিয়া মনে মনে ভাবিয়া তাই সকল অঙ্গেতে সে বায়ু মাখি লয়ে পরশ তব যেন তাহাতে পাই’ সন্ধ্যা উৎরে গেছে। সামনে একটা ছোট্ট ব্রিজ পেরিয়ে নদী।

পেছনে সবুজের কালো দেয়াল ছুঁয়ে উঠেছে দশমীর চাঁদ। নদীর বাতাসে মাঝারি শীতের টান। সময়ে-অসময়ে তীব্র ভালো লাগায় এখানেই আসি আমি। দূরে হৈ-হুল্লোড় শোনা যায়। কোন জন-মানুষ নেই।

তবু ভয় লাগে না। কুসুম এতোণে হয়তো পুকুরের ঠাণ্ডা জলে পা দু’খানি ধুয়ে পড়তে বসেছে। উত্তরে বাতাসের জ্বালাতনে বন্ধ জানালা। আর ওপাশে ফুলেল শতমুখে হেসে উঠেছে গন্ধরাজ গাছটা। তার তীব্র সুবাস জানালার ওপাশে কুসুমকে খুঁজবে।

আর পড়তে পড়তে হঠাৎই কুসুমের মন খারাপ হবে। আমার কথা তাকে ব্যথা দেবে। আমাকে কেউ ভাবে, আমার জন্য কেউ কষ্ট পায়- যে যাই বলুক পৃথিবীতে এটা বড়ো সুখের। জীবনে মূলত নারীরাই বেঁধে দেয় এ সুখের সুতোটি। তারা মা হয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ত্যাগী, বোন হয়ে স্নেহের নির্ঝরণী আর প্রণয়ী হয়ে করে ত্যাগ ও ভালোবাসায় স্বপ্ন সৌধ নির্মাণ।

আর এসব যেন অনিত্যের ভিতে স্থায়িত্বের বিনির্মাণ। আমি একেবারে নদীর জলের কাছে চলে আসি। তখন হঠাৎই মনে খুব করে দুলে উঠে, অনিশ্চিত নিয়তির অসহায় জীবন। কুসুম কি জানে যে এক নিমিষে মুছে যেতে পারে সব। তীরের ভেজা মাটিতে ছোট ছোট ঢেউয়ের কলধ্বনিতে আমার ভাবনায় ভেসে উঠতে থাকে কুসুমের চোখ, নাক, চুল, হাত, খোলা পা, কপাল, ঠোঁট।

আমার বুক ভরে কান্না আসে। নিঃসীম আকাশের দিকে তাকিয়ে বলি, হে সৃষ্টিকর্তা তোমাকে আমি বিশ্বাস করি। এমন মহিমান্বিত খেলা তোমাকেই মানায়। জীবনের সীমাবদ্ধতায়ই হয়তো প্রেমকে অমন ঐশ্বর্যময় করেছ। কিন্তু তার প্রকৃতি বোঝার মনের তাৎণিক স্বচ্ছতাটুকু কই! সংশয়িত ভাঙনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে তা যে হাতড়ে খুঁজে ফিরি।

তখন চাঁদটুকু মাঝ আকাশে। বেড়েছে আলোর তীব্রতা। চকমকিয়ে উঠছে নদীর জল। দিগন্তের দিকে বহু তারা । চোখ মুছে চারপাশে তাকাই।

কেউ নেই চারপাশে কেবল জ্যোস্না-কুয়াশার জাল। রানা মুহম্মদ মাসুদ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।