সোহানের বয়সটা আর কত হবে!এখনও যৌবনের মাঝ দুপুর পাড়ি দেয়নি । এরইমধ্যে যেন তার মনের মাঝে জমে গেছে জীবনের প্রতি এক ধরনের বিতৃষ্ণা, এক ধরনের হতাশা । তার সবকিছু কেমন এলোমেলো,কারো সাথে মিশে না,কারো সাথে কথা বলতে চায় না । কোন কিছু ভাল লাগে না,কোন কিছুতে মন বসাতে পারে না । দেখে মনে হতে পারে প্রেমে পড়েছে,সেরকম ও কিছু না ।
প্রেম তো দূরে থাক তার একটা মেয়ে বন্ধু পর্যন্তও নেই । ছেলে বন্ধুও হাতে গুনা কয়েকজন । এর মাঝে আমি একজন । তার চাল চলন আচার আচরণে মাঝেমাঝে মনে হয় জীবনের প্রতি প্রচন্ড রকম ক্ষোভ বুকে জমিয়ে রেখেছে । তাকে কেমন আছিস জিজ্ঞেস করলে প্রায়ই এক উত্তর দেয়,সেটা হল ভাল বললে ভুল হবে আবার ভাল নাই বললে সেটাও ভুল হবে ।
এই উত্তরের ব্যাখা কিংবা ব্যাক্তিগত কোন কিছু তার কাছে জানতে চাইলে সবসময়ি সে এড়িয়ে যায় । একদিন খুব করে ধরলাম আজ তোকে বলতেই হবে কেন সব সময় তুই এমন উদাসী হয়ে চলিস। তোর যদি কোন দুঃখ থাকে সেটা আজ আমার সাথে শেয়ার করতেই হবে । অনেক পীড়াপীড়ির পর সে মুখ খুলল -
আমরা পাঁচ ভাই তিন বোন । আমি সবার ছোট ।
পরিবারের সবার ছোট হলে শুনেছিলাম সবাই খুব আদর করে । আমার বেলায় হয়েছে ঠিক উল্টোটা । ছোটবেলা থেকে সংসারের অভাব অনটন ঝগড়াঝাঁটি এসব দেখেই বড় হয়েছি । নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে যেটা হয় আর কি । বাবা মা সব সময় বড়দের নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন ।
বাবা চাকরী করতেন শহরে । মাসে একবার বাড়িতে আসতেন । তাই বাবা সাথে একটু দুরত্ব ছিল । তাছাড়া বাবাকে কেন জানি ভয় পেতাম তাই বাবার কাছে প্রয়োজন ছাড়া যাওয়া হত না । বাবার গুরত্ব ভালভাবে বোঝার আগেই বাবা মারা গেলেন ।
এরপর মার উপর এসে পড়ল সংসারের ভার । মা অনেক কষ্ট করে বোনদের বিয়ে দিলেন,চার ভাইকে বিয়ে করালেন । সংসার চালাতে মা কত কষ্ট করেছেন তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না । তাছাড়া আত্নীয় স্বজন কারো কাছ থেকেও কোন রকম সাহায্য পাননি । উল্টো অনেকে অনেক ব্যঙ্গ করেছে,দুর্বলতার সযোগ নিতে চেয়েছে ।
ভাইয়েরা বিয়ের পর সবাই আলাদা হয়ে গেল । মায়ের দায়িত্ব আমার উপরে এসে পড়ল । আমি জাস্ট ইন্টার পাশ করে বি এ কোর্সে ভর্তি হয়েছি । একটা লাইব্রেরিতে কাজ নিলাম । সাথে সাথে পড়াটা ও চলল ।
রাতে যখন বাড়ীতে আসতাম তখন দেখতাম মা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে । আমাকে ভাত বাড়িয়ে দিত,মাঝেমাঝে মুখে তুলে খাইয়ে দিত । আর দুঃখ করে বলত সংসারের জন্যে যে সংগ্রাম করেছে তার ইতিহাস । এসব করতে গিয়ে কান্নাকাটি করত । মার কান্না দেখে মাঝে মাঝে আমার ও কান্না চলে আসত ।
আমি মাকে সান্তনা দিতাম,মা আমি তোমার অন্য ছেলেদের মত তোমাকে ছেড়ে যাব না। মা তুমি দেখ আমি একদিন অনেক বড় হব । তোমার সব দুঃখ কষ্ট মুছিয়ে দিব । আমি মায়ের দুঃখ কষ্ট মুছে দিবার সুযোগ পাওয়ার আগেই মা মারা গেলেন ।
মা মারা যাবার পর আমি পড়লাম আরও বিপদে ।
ভাইয়েরা সবাই মিলে সম্পত্তি ভাগ করে নিল । আমি আমার মেজ ভাইয়ের সাথে গিয়ে উঠলাম । প্রথমদিকে ভাই ভাবি দুজনে আমাকে সাদরে গ্রহন করলেন । হঠাৎ করে একদিন ভাই আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন - উনি আমাকে কিছু টাকা দিবেন আমি সে টাকা দিয়ে যেন ব্যবসা শুরু করি । তার বদলে আমি আমার সম্পত্তি তার নামে লিখে দেই ।
আমি প্রথমে রাজি হইনি । রাজি না হওয়ায় ভাই ভাবি দুজনে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করলেন । এমনও হয়েছে আমি বাহিরে গেছি বাড়ি এসে দেখি ভাই-ভাবিকে নিয়ে উনার বাবার বাড়িতে গেছেন । কিন্তু আমাকে ঘরের চাবি দিয়ে যান নি । আমাকে দিনের পর দিন মানুষের বাড়িতে থাকতে হয়েছে ।
একদিন ভাবি আমাকে সরাসরি বলে দেন অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্যে । তারপর আমি আমার মেজ বোনের সাথে গিয়ে উঠলাম । উনার ছেলেমেয়েদের পড়াতাম তার বদলে উনি আমাকে থাকতে আর দুবেলা খাইতে দিতেন । একদিন দুলাভাই আমাকে ডেকে নিয়ে বলেন - উনি চাচ্ছেন আমাকে উনার সাথে ব্যবসায় শেয়ার করতে । উনার এই অফার শুনে আমিও খুশিতে রাজি হলাম ।
ঐদিন রাতে আমার মেজ বোন আমাকে যেটা বললেন তাতে আমি আর খুশি থাকতে পারলাম না । কারণ আমার দুলাভাইও আমার ভাইয়ের মত ব্যবসায় শেয়ার করার বদলে আমার সম্পত্তি চান । আমি রাজি না হওয়ায় আমার বোন আর দুলাভাই আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে লাগলেন । একসময় আমার বোন আমার খাবার দাবার নিয়েও হিসাব শুরু করলেন । আমার খুব খারাপ লাগত যখন আমার বোন ওরা সবাই খাওয়ার শেষে আমাকে খাবার দিতেন ,তাও হিসাব করে।
আমি বোঝলাম আমাকে আর এখানে থাকা হবে না । আমি গিয়ে উঠলাম আমার বড় ভাইয়ের সাথে । সেখানেও আমি ভাল ছিলাম না । একবার আমি অসুস্থ হয়ে সাতদিন বিছানায় ছিলাম । কিন্তু আমার ভাই ভাবি কেউই আমাকে একটা প্যারাসিটামল এনে দেয়নি।
আমি এভাবে এক এক করে সব ভাই বোনদের সাথে গিয়ে রয়েছি । কেউই আমাকে তাদের সাথে রাখতে চায়নি । আমি সবার কাছে অতিরিক্ত অবাঞ্চিত ছিলাম । অথচ আমার সামান্য সম্পত্তির দিকেই সবার চোখ ঠিকই ছিল । তাই অবশেষে আমি আমার সম্পত্তি আমার মেজ ভাইকে দিয়ে উনার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে আমি শহরে চলে আসি ।
শহরের আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমার পরিবারের কেউই আমার কোন রকম খোজ খবর নেয় নি । কেউ জানতে চায়নি আমি কোথায় আছি কেমন আছি,বেঁচে আছি না মারা গেছি ।
আমার চোখের জল এখনও লবনাক্ত আছে,শরীরে চিমটি কাটলে এখনও ব্যাথা অনুভব করি । তাই হয়ত আমারও মাঝেমাঝে ইচ্ছা করে ঈদের দিনে পরিবারের মানুষদের সাথে একটু লাচ্চা সেমাই খাই । বৈশাখীতে আমার পান্তা ভাতের প্লেটে কেউ তুলে দিক ফ্রাই করা ইলিশ মাছ ।
আমার জন্মদিনে রাত বারটা এক মিনিটে কেউ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে মেসেজ সেন্ড করুক । কত অজানা অচেনা প্রশ্ন মনে নিয়ে আমি প্রতিদিন বেঁচে থাকি । মাঝেমাঝে মায়ের কবরে কাছে গিয়ে বলে আসি "মা আমি বড় হতে পারিনি"।
এখন তুই আমাকে বল আমি ভাল আছি না ভাল নেই? প্রশ্ন করে সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে । অপেক্ষা করে আমি উত্তরে কি বলি।
আমিও ভ্যাবলা চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। তাকে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করলেও কোন কিছু বলতে পারিনা । অনেক্ষণ নিরব থাকার পর আমি তাকে জড়িয়ে ধরে বলি" তুই ভাল নেই দোস্ত" । এভাবে কেউ ভাল থাকে না !
তারপর অনর্গল সে বলে যেতে লাগল - প্রতিদিন সূর্য ডুবার পর ভাবি হয়ত দেখা হবে না আগামীকালের সূর্য দ্বয় । সূর্য দ্বয়ের পর ভাবি এই বুঝি শেষবারের মত সূর্যকে স্বাগত জানালাম ।
কখনই আগামীর স্বপ্নগুলোকে সাজাবার সাহস পাইনা । কখনই কল্পনার আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে পরিপাটি করে সাজাবার কল্পনা করতে পারিনা । ভয়ংকর অনিশ্চয়তার ভিতর আমার দিনযাপন। জানিনা এভাবে আর কতকাল আমার এই পথচলা । প্রতিনিয়তই বিস্মৃতির অন্ধকার মহলে ঢুকে পড়ার দোদুল্যমান সময়ের পথ পাড়ি দেই ।
প্রতিমুহূর্তেই অনুভব করি মূত্যু যেন ঘুরঘুর করে আমার চারপাশে । আর আমি আমার শরীরকে কড়া পাহারায় রাখি যেন মৃত্যু জীবন নিয়ে পালিয়ে না যায় । এরপর সে কিছুক্ষণ থেমে বলল - বন্ধু সাত রাঙা পাপড়িতে জীবন সাজাব বলে আমি বাঁচতে চাই-অনেক দিন বাঁচতে চাই ।
উৎসর্গ -রাজসোহান আপনাকে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।