আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঐশী সমাচার



ইসলাম ধর্মে সবার আগে আল্লাহ। তারপরে নবীজি(সাঃ)। তারপরেই বাবা মার স্থান। একটি শিশু যখন জন্ম নেয়, তখন সে মুসলমান থাকেনা, সে হিন্দুও থাকেনা। আল্লাহকে সে দেখতে পায়না, নবীজি(সাঃ) সম্পর্কেও তার কোন জ্ঞান থাকেনা।

তার কাছে বাবা মাই ঈশ্বর। বাবা মা যা বলেন, শিশু তাই করে। বাবা মা যা শেখান, শিশু তাই শিখে। মানব শিশু খুব দ্রুত বড় হতে থাকে। শুধু বাবা মার পক্ষে তখন তাকে সব কিছু শেখানো সম্ভব হয় না।

তাকে স্কুলে পাঠাতে হয়। তখন শিক্ষকরা তার পথপ্রদর্শক হন। ইসলাম ধর্মে তাই মা বাবার পরেই শিক্ষকের স্থান। আমার জীবনেও ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। আমি আমার জীবনের প্রাথমিক শিক্ষা আমার পরিবারের কাছ থেকেই পেয়েছি।

আমার নানা ছিলেন চেইন স্মোকার। আমার মামারাও পিতার অভ্যাস ধরে রেখেছেন। আমার বাবা অধূমপায়ী ছিলেন। তাই নানুর বাসায় গিয়ে এত এত ধূমপায়ী দেখার পরেও মনে কখনো সাধ জাগেনি সিগারেটে টান দেয়ার। কারন আমার বাবা বলেছেন, "সিগারেট খেলে ক্যান্সার হয়।

" "ক্যান্সার হলে কি হয়?" "ক্যান্সার হলে মানুষ মারা যায়। " আমি কম বয়সে মরতে চাইনি। আমি জীবনে মোট তিনটা স্কুলে পড়াশোনা করেছি। প্রথমগুলো ছিল ইংলিশ মিডিয়াম, এবং সেসব ক্লাস ফোর পর্যন্ত। যে স্কুলে আমি বেড়ে উঠেছি, সেটি সিলেটের ব্লু বার্ড হাইস্কুল।

জীবনের আদর্শের অনেক কিছুই সে স্কুলেই শেখা। আমাদের হেড মিস্ট্রেস ছিলেন শ্রদ্ধেয়া রাবেয়া খান। এই মহিলাটিকে স্কুলের প্রতিটা ছেলে মেয়ে যমের মত ভয় পেত, আবার মায়ের মত শ্রদ্ধাও করতো। কেন করবে না? একদিন স্কুলে অ্যাসেম্ব্লিতে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের স্কুলের যাবতীয় অ্যাকশন ঐ পনেরো মিনিটের মধ্যেই ঘটতো।

আমরা নিত্যনতুন অ্যাকশন দেখার অপেক্ষায় অ্যাসেম্ব্লিতে দাঁড়াতাম। হঠাৎ প্রিম্সিপাল টিচার ক্লাস নাইন পড়ুয়া এক বড় ভাইকে সামনে ডেকে আনলেন। ভয়ে বেচারা বড় ভাইয়ের মুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে। প্রিন্সিপাল টিচারের সামনে পৌছুতেই টিচার শুরু করলেন চড়! আহারে! আমরা সেই দূর থেকেও ঠাস ঠাস শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কেউ কোন কথা বলছে না।

টিচার মারছেন আর বকে যাচ্ছেন, "বেয়াদব ছেলে! বেশি স্মার্ট হয়ে গেছিস? বম্বের নায়ক হবার ইচ্ছে হয়েছে? বের করছি তোর নায়কগিরি!" টিচার মারতে থাকেন। আমরাও ভাবতে থাকি বেচারা নায়কোচিত কি এমন কাজ করেছে যে সকাল সকাল এরকম ধোলাইর শিকার হতে হলো? টিচার নিজেই একসময়ে খোলাসা করলেন। গতদিন বিকেলে তিনি জিন্দাবাজার দিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ দেখেন কোন এক দোকানের সামনে এই ছেলেটা সিগারেট খাচ্ছিল। সে টিচারকে দেখতে পায়নি, টিচারও তখন কিছু করেননি। তিনি অপেক্ষা করেছেন পরেরদিনের।

তিনি অপেক্ষা করেছেন ছেলেটিকে উদাহরন হিসেবে ব্যবহার করে স্কুলের আর বাকি সব ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষা দিতে। আমি এমনিতেও পারিবারিকভাবেই শিক্ষা পেয়েছিলাম। সেদিন আরেকবার রিভিশন হলো। আরেকটা শিক্ষা পেলাম ক্লাস টেনে পড়ার সময়ে। "ফ্রেন্ডশিপ ডে"র দিন।

যেহেতু স্কুলের শেষ বছর, তাই ক্লাসের কারও কারও মাথা খারাপ হয়ে গেল। কে যেন প্রস্তাব করলো ফ্রেন্ডশিপ ডে পালন করার। পাগলামি একটি সংক্রামক ব্যাধি। মুহূর্তেই সেটা সংক্রমিত হলো ক্লাসের সবার মাথায়। চাঁদা তোলা হলো।

সে টাকায় পিৎজা কেনা হবে, ভার্জিন (ড্রিংকসের কথা বলছি। তখন ভার্জিন ড্রিংকসেই 'ভাব' ছিল। ) কেনা হবে, পার্টি করা হবে। স্কুল জীবনের শেষ ফ্রেন্ডশিপ ডে গ্র্যান্ড সেলিব্রেট করার সব রকম প্রস্তুতি সম্পন্ন। আমরা ছিলাম ক্লাস টেন 'এ' সেকশন।

সেকশন 'বি' কি কারনে যেন একদিন আগে পার্টি করে ফেলল। আমরা করবো পরেরদিন। পার্টির খাবার দাবার এবং ভার্জিন যথাসময়ে উপস্থিত। অ্যাসেম্ব্লিতে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া শেষে আমরা ঢাকের বাদ্যের তালে তালে ক্লাসে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ প্রিন্সিপাল টিচার মাইকে ঘোষনা দিলেন, "ক্লাস টেন বি সেকশন ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে।

" সবার রক্ত হিম হয়ে গেল। আমরা সহপাঠীদের আসন্ন দূর্যোগের মুখে রেখে ক্লাসে ফিরে আসলাম। তবে কৌতূহল দমাতে পারলাম না। করিডোর থেকে ঠিকই উকি দিতে লাগলাম। তারপরের আধ ঘন্টা আমাদের সহপাঠীরা চোখের সামনে কেয়ামত দেখে ফেলল।

আমরা শুধু দেখলাম প্রিন্সিপাল টিচার সপাং সপাং করে ঝড়ের বেগে বেত চালাচ্ছেন। বেত মারতে মারতে হাপিয়ে উঠে তিনি হাত চালানো শুরু করলেন। মুখ সেই কখন থেকেই চলছে, "পাখা গজিয়েছে? ফ্রেন্ডশিপ ডে পালন করবি! ছেলে মেয়েতে একসাথে নাচানাচি? কালকে কি ভ্যালেনটাইন ডেও পালন করবি তোরা? এত শখ তোদের! আয় শখ মেটাচ্ছি। " টিচার বি সেকশনকে শায়েস্তা করার পরে আমাদের ক্লাসে তল্লাসী চালালেন। ততক্ষনে ম্যাজিকের মত আমাদের পার্টির সরঞ্জাম গায়েব করে ফেলা হলো।

টিচার এসে কিছুই পেলেন না। আমরা বেঁচে গেলাম। তবে জন্মের শিক্ষা সবাই পেয়ে গেলাম। আমরা কেউ বাড়াবাড়ি করার সাহস কখনও দেখাইনি। আমাদের প্রিন্সিপাল টিচার আমাদের সবাইকে নিজের সন্তানের মতই দেখতেন।

তিনি আমাদের তেমনই শাসন করতেন, ঠিক যেমনটা নিজের ছেলেদের করতেন। নিজের ছেলেদের কাছে যেমন তিনি কোন উশৃংখলতা আশা করতেন না, আমাদের থেকেও তেমনই। আমাদের এক সহপাঠির মোটর সাইকেল দূর্ঘটনায় মৃত্যুতে টিচারের হাউমাউ করে কান্নার দৃশ্য এখনও চোখে ভেসে আছে। আমরা পারিবারিক এবং স্কুলের শিক্ষা কলেজ ও ইউনিভার্সিটি জীবনেও বয়ে নিয়ে গেছি। আমার বেড়ে ওঠা সিলেটে।

ছোট শহর। সাধারণ জীবন যাপন। আধুনিক ঢাকা নগরীর চেয়ে অনেক পিছিয়ে পড়া সমাজ। রাজধানীতে আসার পরে নিজের চোখে দেখলাম আমরা কতটা পিছিয়ে ছিলাম। আধুনিক ছেলেদের কাছে সিগারেট খাওয়াটাও ব্যাক ডেটেড হয়ে গেছে।

ওরা খায় গাঁজা। ভার্জিন কোলায় 'ভাব' নেই, সবাই 'মাল' খায়। "ভার্জিনিটিরও" মূল্য অনেকের কাছে নেই। যেখানে সেখানে যার তার কাছে সে সম্পদ খোয়াতে খারাপ লাগেনা। ওদের দেখে আমার আধুনিক হতে ইচ্ছে করেনা।

আমি ক্ষ্যাত আছি, সেই ভাল। ক্ষ্যাত হিসেবেই জীবনের অনেক খানি বছর পার করে দিলাম। আফসোস হয়না একটিবারের জন্যও। বরং গর্ব হয়, যখন দেখি মাদকাসক্ত মেয়ের হাতে খুন হওয়া বাবা মায়ের নাম আশরাফ এবং আয়েশা চৌধুরী না। খুনি সন্তানের নাম মঞ্জুর চৌধুরী না।

যে সন্তানকে তার পিতা মাসিক হাত খরচ হিসেবে পাঁচ লক্ষ টাকা দিতেন, সেই সন্তান মাদকাসক্ত হবে না তো কে হবে? পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের কর্মকর্তা, যার কাজই অপরাধ দমন, তিনি কেমন অপরাধ দমন করেছেন সেটা তার দুই কোটি টাকার ফ্ল্যাট, মেয়ের জীবন যাপন পদ্ধতিই চিত্কার দিয়ে ঘোষনা দেয়। অন্যের ঘরে লাগা আগুন যারা নেভায় না, তাদের নিজেদের ঘরে সেই আগুন লাগতে বেশি দেরী হয়না। দেশের ঘরে ঘরে এখন মাদকাসক্তের ছড়াছড়ি, পুলিশের ইন্ধন ছাড়া এ আগুন এতদূর ছড়াতে পারতো? যিনি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের লোক, তিনি ভালভাবেই জানার কথা দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে। তারপরেও তিনি কি করে নিজের মেয়েকে সাপ্তাহিক এক লক্ষ টাকা দেয়ার চিন্তা ভাবনা করেন? মেয়ে রাতের পর রাত দেরী করে বাড়ি ফিরে আসে, কেন তিনি বাঁধা দেন না? যখন বাঁধা দিলেন, তখন মেয়ে আর তাঁর নিজের সন্তান নয়, মাদকের দাস হয়ে গেছে। বুঝিনা।

মডার্ন যুগের পিতামাতাদের কাজকর্ম আমার মাথায় ঢুকেনা। আমার আশির দশকের সেকেলে পিতামাতাই ভাল ছিলেন। যারা নিশ্চিত করতেন সন্ধ্যার নাস্তায় পরিবারের প্রতিটা সদস্য উপস্থিত থাকবে। বাবা মার কাছে টাকার জন্য হাত পাতলে টাকা দেয়ার আগে জিজ্ঞেস করতেন কি উদ্দেশ্যে টাকা চাচ্ছি। পড়ালেখা করেছি, গান করেছি, ছবি একেছি, সিনেমা দেখেছি, গল্পের বই পড়েছি; নষ্ট করার মত সময় ছিল কোথায়? খুব কি খারাপ গিয়েছে আমাদের জীবন? আমাদের জীবন বদলাচ্ছে।

আমরা আধুনিক হচ্ছি। আধুনিক ছেলে মেয়েরা অ্যামেরিকায় এসে ইনিয়ে বিনিয়ে আমাদের কাছে জানতে চাচ্ছে ক্রিস্টাল (শুনেছি এক ধরনের ড্রাগস্) কোথায় পাওয়া যাবে। এক্সটেসির সন্ধান কে দিতে পারবে? গাঁজা নাকি অ্যাভেইলেবল, কোথায় পাওয়া যাবে? আমরা অবাক হয়ে ভাবি, এইসব ছেলে মেয়েরা এক দুই বছর আগেও স্কুলে যেত! তারা নাকি স্কুল জীবন থেকেই এসব খেয়ে অভ্যস্ত। আমার তখন মনে পড়ে, একদিন অ্যাসেম্ব্লিতে আমাদের প্রিন্সিপাল টিচার ক্লাস নাইনের এক বড় ভাইকে ডেকে এনে সিগারেট খাবার অপরাধে চড় মেরেছিলেন। আমাদের সহপাঠীদের শাসন করেছিলেন ক্লাসরুমে "উশৃংখল" আচরনের জন্য।

খুব বেশিদিন আগের ঘটনা নয় কিন্তু। দুইহাজার সালের অগাস্ট মাসে ঘটেছিল ঘটনাটি। উদ্বেগের বিষয়, এরকম প্রিন্সিপাল টিচারের সংখ্যা এখন দিন দিন শুধুই কমছে। আমাদের বাবা মা আমাদের হাতে অঢেল টাকা পয়সা তুলে দেননি, তবে এটাও ঠিক যে আমাদের কোন প্রয়োজনিয়্তাও অপূর্ণ রাখেননি। আমাদের বাবা মাকে তাই আমরা সম্মান করেছি, স্রেফ টাকা সাপ্লাইয়ের মাধ্যম মনে করিনি।

আমরা আল্লাহকে দেখতে পারিনি কখনও, নবীজিকেও (সাঃ) সম্মান করি। এবং তারপরেই আমাদের বাবা মা....ছোট বেলা থেকেই যারা আমাদের কাছে ঈশ্বর তুল্য। মা বাবা শাসন করেছেন। তবু কখনও তাঁদের ক্ষতি হয়, এমন কিছু চিন্তাও করিনি। আমরা ব্যাক ডেটেড পোলাপান।

আধুনিক ছেলে মেয়েদের স্মার্টনেসের সাথে পাল্লা দিতে পারব না। আমরা পাল্লা দিতে চাইও না। আমরা আমাদের সেকেলে পারিবারিক শিক্ষা নিয়েই খুশি আছি। যদি আধুনিক ছেলে মেয়েরাও সে শিক্ষার আলো পেতো!

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।