পরাজিত হতে হতে আমি উঠে দাড়িয়েছি এবার ফিরে যাবো না খালি হাতে, স্তব্ধতা আর সৌন্দর্যের পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই যে কবি সে কখনো খালি হাতে ফিরে যেতে পারে না ।
চট্রগ্রামে বিএনপির উপদলীয় কোন্দল নিরসনের লক্ষ্যে ২৯ মে সকালে পতেঙ্গা বিমান বিন্দরে পৌছলেন রাষ্ট্রপতি জিয়া । তার সফরসঙ্গী ছিলেন বি চৌধুরি, মহিবুল হাসান, নাজমুল হুদা, ড আমিনা , নৌ বাহিনীর প্রধান এম এ খান প্রমুখ । চট্রগ্রাম সার্কিট হাউজে হাল্কা নাস্তা সেরে বারান্দায় আলোচনা বসলেন বিএনপি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে । বেলা সাড়ে বারটার দিকে জুম্মা নামাজের বিরতি ।
সাদা পাঞ্জাবি -পায়জামা পরে চকবাজারের নন্দনপুরা মসজিদে নামাজ আদায় করেন জিয়া । নামাজ শেষে উপস্থিত মুসল্লীদের সাথে কুশল বিনিময় করে ফিরে আসলেন সার্কিট হাউজে । দলীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দুপুরের খাবার সেরে ঘন্টা দেড়েক বিশ্রাম নেন । বিকালে চবির ভিসি, অধ্যাপকবৃন্দ, আইনজীবি, সাংবাদিক প্রমুখ আগত অতিথীদের সাথে আড়াই ঘন্টা আলাপ করেন । তারপর স্থানীয় বিএনপির দুই উপদলের সাথে আলাদাভাবে রাত ৯ টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত আলোচনা করেন ।
এর মধ্যে চট্রগ্রামের ডিসি ও পুলিশ কমিশনারের সাথে আইন শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন । রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত চিকিৎসক লে কর্নেল মাহতাবুল ইসলাম তার খাবার পরখ করে শেষ করলে রাত ১১টার একটু পরে জিয়াকে রাতের খাবার দেয়া হয় । ডিনার শেষে ঢাকায় তার স্ত্রী খালেদার সঙ্গে টেলিফোনে মিনিট পনেরো কথা বলেন জিয়া । জীবনের আলো নিভে যাবার ৫ঘন্টা আগে ঘরের আলো নিভিয়ে ঘুমুতে গেলেন জিয়া । নিশ্চিন্তে বিছানায় নিদ্রায় গেলেন তিনি ।
ওদিকে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করতে এগিয়ে আসছে ঘাতক দল । বাইরে তখন তুমুল ঝড় বৃষ্টি আর বিদ্যুতের ঝলকানি ।
রাত আড়াইটার দিকে কালুরঘাটস্থ রেডিও ট্রানসমিটারের কাছে হাজির হল ঘাতক দল । ঘাতকদলের নেতৃত্ব দেয় লে. কের্নল মতিউর রহমান । ঘাতকদল তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে আক্রমন পরিচালনার পরিকল্পনা নেয় ।
মতি থাকল দ্বিতীয় দলে যারা প্রথমদলকে পেছন থেকে সহায়তা দিবে । রাত সাড়ে তিনটার সামান্য কিছু পরে দল তিনটি প্রচন্ড বৃষ্টির মাঝে আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে এগুতে থাকে । ঘাতকদল বিনাবাঁধায় সার্কিট হাউজে ঢুকে পড়ে । ভীতি সঞ্চার করতে রকেট ল্যান্সার থেকে ফায়ার ও গ্রেনেড চার্জ করা হয় আর মেশিনগানের গুলি চালানো হয় । পাহারারত ৪৪ জন পুলিশের ১ জন নিহত, ১২ জন আহত ও বাকিরা আত্মগোপন করেন ।
রাষ্ট্রপতির গার্ড রেজিমেন্টের সৈন্যরা তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল । যে দুজনের রাষ্ট্রপতির কক্ষের সামনে পাহারা দেবার কথা তাদের আগেই খতম করে দেয়া হয় । রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা কর্মকর্তা লে. কর্নেল আহসান ও ক্যাপ্টেন হাফিজ দুতলায় রাষ্ট্রপতির শয়নকক্ষের পেছনের কক্ষে ঘুমাচ্ছিলেন । রকেটের আওয়াজে তারা জেগে উঠে । রাষ্ট্রপতিকে বাচাতে তারা তাদের অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পাবার আগেই ঘাতকদের গুলিতে নিহত হন ।
ঘাতকদলটি ঐ সময় দুতলায় রাষ্ট্রপতির ৯ নম্বর কক্ষ খুজতে শুরু করে । ঘাতকদলের একজন ঐ কক্ষের দরজা ভেঙ্গে ফেলতেই ঘরে ড. আমিনাকে আবস্কার করেন । ফলে রাষ্ট্রপতির খোজে ওরা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে থাকে । তারা ইতিমধ্যে বুঝতে পারে রাষ্ট্রপতি আছেন ৪ নম্বর রুমে । ঘাতকদলের একজন ঐ কক্ষের বারান্দার দিকে দরজা লাথি দিতে ভাঙ্গতে চেষ্টা করে ।
গোলাগুলি আর চিৎকার চেচামেচিতে উঠে বসলেন চকিতে জিয়া ।
কি ব্যাপার ? ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে বেরিয়ে এলেন দরজা খুলে , পরনে রাতে শয্যার পোষাক । গভীর আত্মপ্রত্যয় আর অগাধ আস্থা নিয়ে বেরিয়ে এলেন ।
কি চাও তোমরা?
কাছে দন্ডায়মান লে. মোসলেহউদ্দিন রীতিমত ঘাবরে যান । সে জিয়াকে আশ্বস্ত করে-‘‘স্যার আপনি ঘাবরাবেন না ।
এখানে ভয়ের কিছু নেই । ’’ মোসলেহউদ্দিনের ঠোট থেকে জিয়ার প্রতি আশ্বাসবানী মিলিয়ে যাবার আগেই লে. কর্নেল মতিউর রহমান তার এসএমজি থেকে অতি কাছ থেকে ব্রাশ ফায়ার করেন জিয়ার শরীরের ডানদিক একেবারে ঝাঝরা করে ফেলে । দরজার কাছেই মুখ থুবরে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন জিয়া । এরপর মতি তার বন্দুকের নল দিয়ে জিয়ার প্রাণহীন দেহ উলটিয়ে নেয় । তারপর ক্ষিপ্তপ্রায় মতি জিয়ার মুখমন্ডল আর বুকের উপর তার এসএমজির ট্রিগার টিপে রেখে ম্যাগাজিন খালি করে তার খুনের নেশা মেটায় ।
আনুমানিক চার থেকে সাড়ে চারটায় জিয়ার মর্মান্িতক মৃত্যু ঘটে । জিয়াকে খুন করে ঘাতকদল ঝটপট সার্কিট হাউজ ছেড়ে চলে যায় ।
জিয়ার ব্যক্তিগত ডাক্তার লে. কর্নেল মাহতাব তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে । ঘাতকদলের প্রস্থানের অনেক পরে খরগোশের ন্যায় দুতলায় অবস্থানরত জিয়ার সফরসঙ্গীরা তাদের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে । সংকটময় মুহুর্তে এরা কেউই জিয়াকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি ! জিয়ার লাশ বারান্দার মেঝেতেই পড়ে থাকে ।
একটা লোকও তার ধারে কাছে আসেনি ! সফরসঙ্গী নেতারা জিয়ার লাশ ডিঙ্গিয়ে চট্রগ্রামস্থ বিএনপির দুটি উপদলের কারো সাথে যোগাযোগ না করে পরবর্তী দুদিন আত্মগোপন করে থাকে । বিএনপির কেউই জিয়ার লাশ দেখতে আসেনি । জনতাও এগিয়ে আসেনি তাদের নেতাকে দাফন করতে ।
রাষ্ট্রপতি জিয়ার লাশের সদগতির কোন ব্যবস্থাই গ্রহন করা হয়নি । ঐ সময় যারা সার্কিট হাউজ পরিদর্শন করে তারাও এনিয়ে সামান্যতম মাথা ঘামায়নি ! দেশের রাষ্ট্রপতির লাশ একটি খাটের উপর উঠানোর সম্মানটুকুও দেখায়নি কেউ ! নৌবাহিনী প্রধান সাড়ে পাচটায় সার্কিট হাউজে আসেন ।
নিচে কর্মকর্তাদের সাথে কথাবার্তা বলেন । দুতলায় জিয়ার লাশ দেখার আনুরোধ করা হলেও তিনি রাজি হননি ! সেসময় চট্রগ্রামের ডিসি সাইফুদ্দিন আহমদ সেখানে উপস্থিত থাকলেও রাষ্ট্রপতির লাশের প্রতি সম্মান দেখাতে ও তা’ সংরক্ষনের ব্যবস্থা গ্রহন করেননি ! সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে সকল কর্মকর্তা সার্কিট হাউজ ছেড়ে চলে যান । জিয়ার লাশ মেঝেতেই পড়ে থাকে !
সকাল সাড়ে আটটায় ৩ জন বিদ্রোহী মেজর ১২ জন সিপাহি নিয়ে সার্কিট হাউজে আসে । একটি পুরনো সুটকেসে জিয়ার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ঢুকিয়ে নেয় । তারপর তারা জিয়ার লাশ একটি সাদা বিছানার চাদরে মুড়ে ফেলে ।
কর্নেল আহসান ও ক্যাপ্টেন হাফিজের লাশও তারা একইভাবে মুড়ে তিনটি লাশ একত্র করে ভ্যানে উঠিয়ে কবর দেয়ার জন্য চলে যায় । ১ জুন বিদ্রোহের অবসান ও পরিস্থিতি শান্ত হলে সামরিক -বেসামরিক কর্তৃপক্ষ জিয়ার লাশ খুজে বের করে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করে । ইদুরের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসেন জিয়ার সফরসঙ্গী নেতারা !
রেফারেন্স:
১. Bangladesh: A Legacy of Blood, by Anthony Mascarenhas, Hodder and Stoughton, 1986
২.তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, লে. কর্নেল এম এ হামিদ, মোহনা প্রকাশনী, ১৯৯৫
৩.কামরুদ্দীন আহমদ, স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর , নওরোজ কিতাবিস্তান ,১৯৮২
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।