. আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া...
দেখতে দেখতে তেত্রিশ বছর কেটে গেলো। অবাক হয়ে ভাবি, তেত্রিশটা বছর এই মানুষটার সাথে আমি আছি কি করে? তাও হাত-পা, ঘাড়-মুন্ডু অক্ষত রেখে বহাল তবিয়তে। চিন্তা-চেতনা, মন মানসিকতা, রুচি কিছুরই মিল নেই। দুজন সম্পুর্ন দুই মেরুর মানুষ এক ছাদের নিচে, বড় ধরনের অশান্তি ছাড়াই এতোটা বছর কাটিয়ে দেয়া যে সে কথা নয়। এ ধরনের কর্ম কান্ডের জন্য সরকার থেকে পদক ঘোষনা করা উচিত।
“গৃহ শান্তি” পুরস্কার। আর এ শান্তি বজায়ের জন্য স্বামী স্ত্রী’র মাঝে যার অবদান সবচাইতে বেশী, তাকেও পুরস্কৃত করা উচিত। সামান্য কারনে পৃথিবীতে অশান্তির আগুন জ্বলে উঠে। দেশে দলের মিল নেই? লাগাও আগুন। মতের মিল নেই? ফাটাও মাথা।
পছন্দ হচ্ছেনা? ঝাপিয়ে পড়ো দা কিরিচ নিয়ে। বইয়ে দাও রক্তের গঙ্গা। প্রস্তাব গৃহিত হয়নি? এসিডে ঝলসে দাও তাকে। এই সব ঘটনার মাঝে কোন ঘটনার জন্ম না দিয়ে ৩৩ বছর কাটানো কি কম বড় কথা? বিয়ের আগে কত তুলতুলে নরম নরম কথা, যা শুনে আমি পালকের মত ভেসে গিয়েছিলাম। তখন কি জানতাম, ওগুলো ছিলো গল্পের বইর ডায়লগ? অতি কল্পনা-প্রবন আমি তাতেই তো গলে গিয়েছিলাম।
এখন কথা শুনলে তো মনে হয় তিতা করলা ছাড়া জিভ আর কিছুর স্বাদই গ্রহন করেনি। আর যত বয়স বাড়ছে, পিঁপড়ের মত হুল ফোটানোও বেড়ে গেছে। একটা বিষয় পেলেই হলো, ওটাকে চটকিয়ে ভর্তা না করা পর্যন্ত শান্তি নেই। বাসায় কেউ এলে সহজে তার সামনে পড়তে চায়না।
রাত বারোটা বাজার আগে থেকে মোবাইলে পিড়িং পিড়িং শব্দে শুভেচ্ছা বার্তা আসা শুরু হলো।
আমি তখন মাথা ব্যাথায় কাতর হয়ে শুয়ে কুইকুই করছি। বার্তা পড়েই মনে পড়লো দিবসটির কথা। আমার কাছে যেমন মেসেজ আসছে, তেমনই তার কাছেও তো আসছে। উনি আবার কোন বার্ষিকীই মনে রাখতে পারেন না। ইচ্ছে করেই মনে রাখেনা আর কি! পাঁজির পা-ঝাড়া হলে যা হয় আর কি! মনে মনে ভাবলাম থাক! এই দিনটিতে আর কোন রকম খোঁচাখুঁচিতে যাবোনা।
যদিও আমি খোঁচা দিতে পারদর্শী নই। কুম্ভকর্নের মত খোঁচা মারতে আজো শিখতে পারলাম না। তবুও মাঝে মাঝে ঢোড়া সাপের মত ফোঁস করে উঠে এটাই হয়তো প্রমান করি, আমি এখনো জীবিত আছি। সকালে উঠেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেলো। “এতোক্ষনে ঘুম ভাঙ্গলো”? “রাত জেগে নেটে বসে ছিলে”? রাগে দুঃখে মুখ দিয়ে কোন কথা বের হলোনা আমার।
শূধু দৃষ্টির খোঁচা মেরে সরে গেলাম। জানে, আমি মাথা ব্যাথায় কষ্ট পেয়েছি। একগাদা ওষূধ তার সামনেই তো গিললাম। তারপরও এই খোঁচা! বেশ ক’বছর যাবত কাজের লোকের হাতের রান্নাই খেয়ে আসছে, ইদানিং নতুন বাতিক হয়েছে, খেতে বসে রান্নার হাজারটা খুঁত বের করা, অর্ধেক খেয়ে প্লেট ঠেলে উঠে যাওয়া। কি? না, ঐ অখাদ্য রান্না খেতে পারা যায়না।
কি আর করা? রান্না করি। আর তার ফলশ্রুতি প্রায়দিন মাথাব্যাথা। সে যা যা খেতে পছন্দ করে তাই রান্না করলাম। দেশী মুরগি, ইলিশের মাথা দিয়ে কঁচুর লতি, করলা ভাজি, টাকি মাছের ভর্তা, শুটকি ভর্তা। টেবিল সাজিয়ে বসে আছি।
দুটো, আড়াইটে, তিনটা বেজে গেলো, কোন পাত্তা নেই। ফোন করলাম, “আমি ব্যাস্ত, খেয়ে নাও’। আমার পেটে ছুঁচোর কেত্তন শুরু হয়ে গিয়েছিলো। তাই খেয়ে নিলাম। পৌ্নে চারটার সময় “উনি” এলেন।
হাতে বিশাল একটা ফুলের তোড়া। শুধুই লাল গোলাপ। হাতে দিয়ে কিছুই বল্লোনা দেখে আমিই বললাম, এটা আবার কেনো? বোকা বোকা মুখে বল্লো, কেনো আবার? এমনি আনলাম তোমার জন্য। খেতে বসে বল্লো, বাহ! আজ দেখি সব আমার প্রিয় আইটেম, হঠাত কি মনে করে? মুখ ঝামটা দিয়ে বললাম, মনে করা টরা কিছু না, ইচ্ছে হলো তাই রান্না করলাম। সন্ধ্যার আগে হই-হই করতে করতে বড় পরীকে নিয়ে মেয়ে এলো, ভাতিজি এলো তার মেয়েকে নিয়ে, ছোট জা এলো তার বিচ্ছুকে নিয়ে।
মুহুর্তে বাসা গরম। একগাদা ফুল, আর বড় একটা গিফট বক্স টেবিলে রেখে আমাদের দুজনকেই ধরে আনলো সামনে। আমার রাগ, ভ্রুকুটিকে সে মুহুর্তে তারা পরোয়াই করলোনা। অনেকদিন যাবত অভেনটা নষ্ট হয়ে ছিলো। একটা সুন্দর মাইক্রোয়েভ অভেন, রংচঙ্গে ফতুয়া, সার্ট, আকাশী রঙের জামদানী।
গুচ্ছের টাকা খরচ করে আনন্দ কেনা, যা কিনা আমার খুব অপছন্দের, কিন্তু ওদের আনন্দ মাটি করে দিতে ইচ্ছে হলোনা বলেই চুপ করে ছিলাম। সবজি পাকোড়া বানালাম, পিঁয়াজু, সামোসা আনালাম সামনের দোকান থেকে, ফ্রিজ থেকে খেজুরের গুড়ের পায়েস বের করলাম। এর মাঝে বড় পরী ঘোষনা দিলো, সে এসব কিছুই খাবেনা। ঘরে গিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়লো। সাধ্য সাধনা করে জানা গেলো, নুডুলস নেই কেনো? সে নুডুলস খাবে।
নুডুলস বানানো হলো। সবাই মিলে একসাথে খাওয়া। সময়টা যেনো ফুড়ুত করে উড়ে গেলো। এর পর ফটো-সেসন। যেমন ছিলাম তেমন সাজেই ফটো তোলা হলো।
ওদের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে খারাপ লাগছিলো না। রাত আটটার দিকে ওরা চলে গেলো।
এই যে আমরা দুই মেরুর মানুষ, এতো অমিলের মাঝেও বসবাস করছি, তার পেছনের কারনটা হলো। ভালবাসা, শ্রদ্ধা-বোধ, দুজন দুজনকে সম্মান করা, উভয়ের কাজের প্রতি উভয়ের সম্মান বোধ। মুখে ভালবাসার প্রকাশ না করেও আমরা দুজনেই খুব ভাল করে জানি, আমরা দুজন দুজনকে কতটুকু ভালবাসি।
আমরা কখনোই কারো কাজকে কটাক্ষ বা বিদ্রুপ করিনি। তার কাজকে আমি যেমন উৎসাহ দিয়েছি, তেমনি উৎসাহ পেয়েছি আমার কাজে। সন্তানের কাছে আমরা কেউ কখনো কারো সম্পর্কে বিষোদগার করিনি। ঠাট্টার ছলেও নয়। হাজার অমিলের মাঝে একটি জায়গায় আমাদের দুজনের মিল।
তা হলো, “ভালবাসা”। আমরা দুজনেই মানুষকে খুব ভালবাসি। মানুষের দুঃখ কষ্ট দেখলে ছুটে যাই, প্রানপন চেষ্টা করি মানুষের ভালো করার। আর একটি বিষয় আমরা দুজনেই সযত্নে এড়িয়ে চলি, তা হলো, পরচর্চা। এই বিষয়টি আমার সংসারে অনুপস্থিত।
কেউ যদি আমাদের সামনে করতেও যায়, তাকেও আমরা নম্র ভাষায় থামিয়ে দেই। তার মুখে কখনোই কারো বদনাম শুনেছি বলে আমার মনে পড়েনা। কখনোই বলেনি এটা করোনা, ওটা করোনা। যখন চিঠির যুগ ছিলো, তখনও সে কোন দিনও আমার চিঠি খুলেনি। এই ছোট ছোট বিষয়গুলো আসলেই যে অনেক বড়, তা চারি দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি।
পরস্পরের প্রতি এই বিশ্বাষ, যা দাম্পত্য জীবনে খুব প্রয়োজন। তাই হাজার অমিলের মাঝেও আমাদের এমন মিলন বাঁশী বেঁজে চলেছে। ভালবাসার সাথে যোগ হয়েছে, স্নেহ, মায়া, মমতা, বিশ্বাষ, সম্মানবোধ। মুখ ফুটে না বল্লেও আমরা অনুভব করি, আমাদের ঘিরে রেখেছে যে গান, তার সুর, বানী। “ভালবাসি ভালবাসি, এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়, বাজায় বাঁশী ভালবাসি ভালবাসি”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।