মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানীদের আস্থা অর্জনকারী ৮৮ এমএনএ'র তালিকায় সাজেদা চৌধুরীও
বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সেকেন্ড ইন কমান্ড সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর কাছে একজন আস্থাভাজন কিংবা পাকিস্তানের আস্থা অর্জনকারী নেত্রী ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী এবং সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচিতদের মধ্য থেকে ৮৮ জনকে পাকিস্তানের সামরিক সরকার আস্থাভাজন এমএনএ (মেম্বর অব ন্যাশনাল এসেম্বলী) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ৭ আগস্ট ১৯৭১ তারিখে পাকিস্তানের তথ্য অধিদফতর থেকে প্রকাশিত ঐ তালিকায় সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নামও ছিল। জেনারেল রোয়েদাদ খান ঐদিন ইসলামাবাদে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই তালিকা প্রকাশ করেন যাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যাওয়া অন্তত ৭/৮ জন সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর আস্থাভাজন কিংবা বিশেষভাবে আস্থা অর্জনকারী সেই সাজেদা চৌধুরী এখন যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে নানা কটাক্ষপূর্ণ বক্তব্য রাখছেন।
সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ফরিদপুর-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমানে তিনি সংসদ উপনেতা। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের সবচেয়ে বর্ষিয়ান নেত্রী তিনি। সংসদেও যেমন সংসদ নেতার পরেই তার অবস্থান তেমনি দলের মধ্যেও সভানেত্রী শেখ হাসিনার পরেই তার অবস্থান। দলীয় সভানেত্রী দেশের বাইরে থাকলে বা তার অনুপস্থিতিতে সাজেদা চৌধুরীই ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি আশির দশকে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে দুর্দিনের সময় দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তথা দেশের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালনের কারণে দলের পক্ষ হয়ে অনেক কিছুই বলতে পারেন না বা বলেন না। কিন্তু দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কর্মকান্ডের জবাব প্রদান এবং নীতি নির্ধারণী বক্তব্য দিয়ে থাকেন। গত ২১ মে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতাকালে বলেন, এই দুঃসময়ে বিএনপির হরতাল ডাকা ঠিক হয়নি। হরতালে দ্রব্যমূল্য আরো বাড়বে।
এ হরতাল জনতার হরতাল নয়। পাকিস্তানীদের কথা শুনে এই হরতাল ডাকা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত করতে পাকিস্তানীদের ইশারায় ২৭ জুন হরতাল ডাকা হয়েছে। অথচ সাজেদা চৌধুরীই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর কাছে কতটা বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন ছিলেন দলীল পত্রেই তার প্রমাণ রয়েছে। ১৯৭১ সালের ৭ আগস্ট ইসলামাবাদে এক সাংবাদিক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত ৮৮ জন আওয়ামী লীগ নেতাকে এমএনএ নিশ্চিত করা হয় যারা পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করেছিলেন।
অথচ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে বিজয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। পরে সংরক্ষিত মহিলা আসনে আরো কয়েকজন নির্বাচিত হন যাদের মধ্যে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীও একজন ছিলেন। আস্থাভাজনদের তালিকা প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকা থেকে ৭/৮ জন সিনিয়র সাংবাদিক ইসলামাবাদ যান ৫ আগস্ট। ৭ আগস্টের ঐ সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা থেকে যাওয়া পাকিস্তান অবজার্ভারের সাংবাদিক নজরুল ইসলাম, মর্নিং নিউজের সম্পাদক জনাব বদরুদ্দীন, দৈনিক আজাদের শাহাদাত হোসেন, দৈনিক ইত্তেফাকের ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আখতার ফারুক, দৈনিক আজাদীর প্রফেসর খালেদ ও আব্দুল মালেক। পাকিস্তান সরকারের পক্ষে জেনারেল রোয়েদাদ খান সাংবাদিক সম্মেলনে এমএনএদের তালিকা প্রকাশ করেন।
পরে পাকিস্তানের তথ্য অধিদফতর থেকে তালিকাটি সব সংবাদপত্র ও সংবাদ মাধ্যমের অফিসে সরবরাহ করা হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হয়নি। এ নিয়েই অসহযোগ আন্দোলন, ৭ই মার্চের ভাষণ তারপর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে শেখ মুজিবের সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার পর ২৫ মার্চের কালো রাতে নিরস্ত্র মানুষের ওপর পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণের পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানীরা দেশদ্রোহী কর্মকান্ড হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। ফলে নির্বাচিত হওয়ার পরও আওয়ামী লীগের এমএনএ রা সবাই পাকিস্তানীদের কাছে এমএনএ হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন না।
যারা তলে তলে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে তাদের আস্থা অর্জন করেছিলেন তাদেরকেই এমএনএ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। বাকীদেরকে বিদ্রোহীই বলা হয়। জেনারেল রোয়াদাদ খান ৮৮ জনের তালিকা প্রাকশ করে বলেছিলেন, বিশ্বস্ত প্রমাণ হলে পরবর্তীতে আরো তালিকা প্রকাশ করা হবে। ৮৮ জনের তালিকায় মিসেস সাজেদা চৌধুরীর নাম রয়েছে ৮৪ নম্বরে। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা এবং চাঁদপুর মহকুমার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমএনএ হিসেবে তার নাম প্রকাশ করা হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে পাকিস্তানীদের কাছে বিশ্বস্ত এমএনএদের এই তালিকায় অনেক বড় বড় নেতার নাম রয়েছে যারা মুক্তিযুদ্ধের বড় বড় সংগঠকই নন পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের বড় বড় পোস্টে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশ্বস্ত এই তালিকায় রয়েছেন মরহুম মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ, সালাহউদ্দিন ইউসুফ, আব্দুল মালেক উকিল, সৈয়দ কামাল বখত, আসাদুজ্জামান খান (৩য় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা), একে ফাইজুল হক, শওকত আলী খান, টাঙ্গাইলের আজমত আলী সিকদার, হাতেম আলী, কফিল উদ্দিন চৌধুরী (বি চৌধুরীর পিতা), সিলেটের ওবায়দুর রাজা চৌধুরী, নোয়াখালীর ওবায়দুল্লাহ মজুমদার প্রমুখ।
আওয়ামী লীগ নাস্তিক কমিউনিস্টসহ দেশী-বিদেশী প্রভুদের নির্দেশনায় তথাকথিত যুদ্ধাপরাধের বা মানবতার বিরুদ্ধে বিচারের জিগির তুলছে। অথচ নিজ ঘরেই কত কত যুদ্ধাপরাধী রয়েছে তা আগে খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন অনেকেই। উপরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আর ভিতরে পাকিস্তানীদের বিশ্বস্ত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন যারা তাদেরকে কোন অপরাধী বলা হবে আর তাদের বিচার হবে কিনা সে প্রশ্নেরও জবাব হয়তো দাবি করবে মানুষ ক্ষমতাসীনদের কাছে।
নিরপেক্ষ তথ্যানুসন্ধান করতে গেলে দেখা যাবে ক্ষমতাসীনদের নিজ দলেই রয়েছে সর্বাধিক ব্যক্তি যারা পাকিস্তানীদের সহযোগিতা করেছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।