সভাপতি- বিক্রমপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ, সম্পাদক ঢেউ, সভাপতি- জাতীয় সাহিত্য পরিষদ মুন্সীগঞ্জ শাখা
বহুমাত্রিক সাহিত্য, দ্বিতীয় অংশ
হুমায়ুন আজাদ জনপ্রিয় ধারার কবিতা লিখেন নি। তবু তাঁর কাব্যের পাঠক কম নয়। কবিতায় তিনি ধরে রেখেছেন তাঁর সময়, তাঁর ভাবনা এবং তীব্রতম উপলব্ধি। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ 'যতোই গভীরে যাই মধু যতোই উপরে যাই নীল'। এখানে রয়েছে অনেক সৌন্দর্যতা।
লিখেছেন-
সৌন্দর্য যখন সরাসরি তাকায় তখন সুন্ধর / সৌন্দর্য যখন চোখ নত করে থাকে, তখনো সুন্দর।
পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ 'আমি বেঁচেছিলাম অন্যদের সময়ে'(১৯৯০)-এর রয়েছে তাঁর শ্রেষ্ঠ আবেগ উপলব্ধির প্রকাশ। তিনি লিখেছেন-
আমার খাদ্যে ছিল অন্যদের আঙ্গুলের দাগ / আমার পানীয়তে ছিল অন্যদের জীবানু / আমি দাঁড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো / আমি হাঁটতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো .. ..
তাঁর 'কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু' ((১৯৮০) অনেক কোমল ও গীতিময়, অনেক স্বপ্ন ও দীর্ঘশ্বাসে পূর্ণ। তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ 'পেরোনোর কিছু নেই' (২০০৪) অনেক বেশি পরিণত। তাঁর অনেকগুলো প্রিয় কবিতা রয়েছে এই কাব্যগ্রন্থে।
কবিতায় অন্তমিল ও ছন্দ ফিরিয়ে আনার ব্যাকুল স্বার্থক প্রচেষ্টা রয়েছে। এই ধারায় তিনি লিখতে চেয়েছিলেন। সুযোগ হয় নি। কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রটিও অসাধারণ ছন্দমিল কবিতা। কাব্যগ্রন্থের নামেই প্রথম কবিতাটি।
সত্যিই কি পেরোনোর কিছু ছিলা না বাকী। কবিতা যখন আরো গভীরভাবে ধরা দিচ্ছিল তখনই তাঁকে চলে যেতে হল।
আজ পেরোনোর কিছু নেই, ব'সে আছি- স্তব্ধ, শুনি শূন্য বাতাসের / শব্দ, দেখি অন্ধকার নেমে আসে মাঠে জলে, শস্যে শব্জিতে।
জনপ্রিয় ধারার তথাকথিত উপন্যাসগুলোকে হুমায়ুন আজাদ বলতেন অপন্যাস। এ কথা বলে তিনি বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় কয়েকজন লেখকের শত্রুতে পরিনত হয়েছিলেন।
তারা এখনো সুযোগ পেলে হুমায়ুন আজাদের বিরোধীতা করেন। পাঠকরা যাতে অপন্যাসেই মজে থাকে সেরকম অসৎ একটা উদ্দেশ্য নিয়েই তারা হুমায়ুন আজাদের বিরোধীতা করেন। তিনি উপন্যাসও বেশি লিখেন নি। যা লিখেছেন তা ভাবনা চিন্তার সুনির্বাচিত বুদ্ধিনিষ্ঠ প্রকাশ। তিনি উপন্যাস লিখে স্বস্তি পেতেন।
জনপ্রিয় হওয়ার জন্য তিনি উপন্যাস লিখেন নি। তাঁর স্ত্রী লতিফা কহিনুরের সাথে একটা চ্যালেঞ্জ থেকেই উপন্যাস লেখা শুরু করেন। তারপর অপন্যাসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য উপন্যাস লিখেন। জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকদের মানসিকতা তাঁর ছিল না। সস্তা ধারার জনপ্রিয় উপন্যাসকে প্রতিহত করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল।
বর্তমান সময়ে বিনোদনধর্মী যে সব উপন্যাস লেখা হচ্ছে সেগুলোর কোনো সাহিত্য মূল্য নেই বলেই তিনি মনে করতেন। তাঁর উপন্যাস সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। তাঁর 'ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল' প্রথম বড়দের জন্য উপন্যাস। এর আগে একটি কিশোর উপন্যাস লিখেছিলেন কিশোরদের জন্য উপন্যাস- 'আব্বুকে মনে পড়ে'। প্রথম উপন্যাস 'ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল(১৯৯৪) অসাধারণ সাড়া জাগিয়েছিল, এরপর বাঙলাদেশের অন্য নাম হয়ে উঠেছে 'ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল'।
এটি কোনো বিশেষ চরিত্র নিয়ে লেখা গল্প নয়, এটি তৃতীয় বিশ্বের সামরিক অভ্যুত্থানগ্রস্থ অবস্থা- একটি দেশের শোচনীয় অবস্থার গদ্যশিল্প। এতে কোন সংলাপ নেই। দেখতে প্রবন্ধের মতো। এতে আছে তীব্র প্রেম, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের বিপর্যয়; এর পরিবার বা বিবাহ প্রথার শোচনীয়তার উপস্থাপন।
দ্বিতীয় উপন্যাস 'সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে'।
এর উৎস তাঁর শৈশব। কিভাবে একে একে ভেঙ্গে পড়ে সব। উপন্যাসে এক দার্শিনিক সত্য- 'সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে’ প্রামাণ করেছেন। 'মানুষ হিসাবে আমার অপরাধসমূহ' আবার ভিন্ন কাঠামোর। ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্য- অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা মিলে এক উপন্যাস।
এক আমলার কষ্ট, বিয়ে এবং একাকিত্ব নিয়ে উপন্যাসটি লিখেছেন। 'শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার'কী করে একজন ধর্ম প্রবর্তকের আবির্ভাব ঘটে সামাজে এবং কী ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে এর শিল্পিত উপন্যাস এটি। যিশুখৃষ্টের সুসমাচার প্রতীক নিয়ে উপন্যাসটি লিখেছেন। উপন্যাসটি বদ্ধ সমাজ থেকে মুক্তির জন্য রচিত একটি বিশাল উপন্যাস। এখানে তিনি একজন ধর্ম প্রবর্তককে নায়ক হিসাবে নিয়েছিলেন যে ক্রমশ তার উন্মত্ততার মধ্য দিয়ে এক বিধাতার সন্ধান পায় এবং সমস্ত সমাজ রাষ্ট্রকে তার বিশ্বাসের অনুগত করতে চায় এবং একটি মৌলবাদী সমাজ স্থাপন করতে চায়।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার প্রতিষ্ঠিত সমাজে রাষ্ট্রে তারও দম বন্ধ হয়ে আসে এবং সে ঘোষণা করে যে, বিধাতা তার মনেরই সৃষ্টি। তখন ক্ষমতা ও ধনলিপ্সু সেনাপতিরা তাকে হত্যা করে এবং দেশের পর দেশ জয় করতে বেরিয়ে পড়ে। এটি একটি মহৎ উপন্যাস। 'রাজনীতিবীদগণ' জনগণের মুখের ভাষায় লেখা সম্পূর্ণভাবে এক রাজনৈতিক উপন্যাস। আমাদের রাজনীতিবিদদের হিংস্রতা, প্রতারণা, পাশবিকতা চিত্রিত হয়েছে এটিতে।
এর ভাষাটা লেখকের নয়, জনগণের ও রাজীতিবিদদের; এটা একটা নিরীক্ষাও- এর মধ্যে সাধু, চলতি, আঞ্চলিক, ইংরেজি, ভুল বাঙলা বা ভুল ইংরেজির একটি কুৎসিত ভাষারূপ তৈরি করা হয়েছে, যা আমাদের রাজনীতিবিদদের মতোই নোংরা। উপন্যাসের চরিত্রগুলো কোনো বাস্তব চরিত্রের অবিকল উপস্থাপন নয়, তবে অনেক বাস্তব চরিত্রকে ভেঙ্গেচুরে আরো বেশি বাস্তব করা হয়েছে। তিনি আধুনিক কবিদের নিয়েই লিখেন- 'কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ'। চরিত্র বিশ্লেষণ করলেই বাংলাদেশের বাস্তব কবিরা বেরিয়ে আসেন। 'নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু' উপন্যাসে আবারো আমারা রাড়িখালের এক কিশোরকে খুঁজে পাই।
তাঁর শৈশব এখানে জীবন্ত হয়ে ফিরে এসেছে। 'ফালি ফালি করে কাঁটা চাঁদ' এক অধ্যাপিকার পাহাড়ী বাংলোয় এক ভদ্রলোকের সাথে দু'রাত্রী যাপন এবং এতে তার বদলে যাওয়ার কাহিনী। নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এক লেখকের অসাধারণ উপন্যাস। এরপর তিনি লিখেছেন 'শ্রাবণের বৃষ্টি রক্তজবা', '১০০০০ এবং আরো একটি ধর্ষণ' এবং 'একটি খুনের স্বপ্ন’ নামে চমৎকার তিনটি উপন্যাস। তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস 'পাক সার জমিন সাদ বাদ(২০০৪)' পড়ে মানুষ মৌলবাদীদের ভয়াবহ জীবন বর্ণনা দেখে আঁতকে উঠেছিল।
পরবর্তীতে এ উপন্যাসটি তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখানে মৌলবাদীদের জীবন উপস্থাপন করা হয়েছে। উপন্যাসটির বর্ণনার মধ্যে অনেক রূপক ও প্রতীক রয়েছে। কিন্তু এখানে যা বর্ণনা করা হয়েছে তা সত্য- শৈল্পিকভাবে সত্য, বাস্তবেও সত্য। যেমন ভৈরবের যে নাম; সেটা বদলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
বাস্তবে সেটা ঘটে নি, কিন্তু বাংলাদেশ জুড়ে এ ধরনের রূপান্তর ঘটানো হচ্ছে। নারায়নগঞ্জের নাম ন–রানীগঞ্জ ও ময়মনসিংহের নাম মোমেনশাহী করার চেষ্টা হয়েছে। এই উগ্র মৌলবাদ আরো শক্তিশালী হয়ে উঠলে এক সময় হয়তো সাভারের স্মৃতিসৌধটিও ভেঙ্গে ফেলা হবে। 'পাক সার জমিন সাদবাদ' এর সমাপ্তি নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন। হুমায়ন আজাদ চরম হতাশা ও ব্যাপক ধ্বংসলীলার মধ্যে এর সমাপ্তি ঘটাতে পারতেন; কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছেন মৌলবাদ-ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তির সমাপ্তি।
সমাপ্তি ঘটিয়েছেন প্রেম ও সবুজের মধ্যে লাল স–র্য ওঠার প্রতীকের মধ্যে। এখানে অত্যন্ত খন্ডকালীন মৌলবাদ নায়কটি মৌলবাদীদের অজ্ঞতা, ভণ্ডামি, মূর্খতা ও অর্বাচিনতার সুযোগে সহজেই শক্তিশালী নেতা হয়ে উঠেছিলেন। সে আবার মনুষ্যত্বে ফিরে এসেছে এবং সে সমস্ত পাপের জগৎ, অপরাধের জগৎ ত্যাগ করে সমুদ্র তীরে এসেছে, বিশালতার কাছে; ভোরবেলা যখন সবুজের মাঝখানে একটি লাল সূর্য উঠেছে। এটি প্রতীকী উপস্থাপনা। যৌনতার যে বর্ণনা রয়েছে সেগুলোর মধ্যেও নানা রূপক ও প্রতীক রয়েছে।
এগুলো কাম হিসাবে না, প্রতীক হিসাবে এসেছে ।
তিনি যে বইগুলি লিখেছেন, যা লিখেছেন তা প্রথাগত চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে খাপ খায় না। তিনি মানুষের জন্য মুক্ত জীবন চেয়েছেন, যে জীবন উদার, সৃষ্টিশীল যা মানুষকে বিকশিত করে। এই বইগুলো এই বদ্ধ সমাজ থেকে উত্তরণের জন্যই লেখা হয়েছে। উগ্র মৌলবাদীরা প্রগতিশীল মানুষের উপর যে প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে হিংস্ত্র হয়ে উঠেছে এবং কিছু বদ্ধ মানুষ কিছু মুক্ত মানুষকে হনন করার জন্য উদ্যত হয়েছে।
এ ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করার জন্যই তিনি 'প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে' বইটি লিখেছেন। এই বইগুলো তিনি লিখেছিলেন, একটি মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন থেকে এবং শিল্প সৃষ্টি করার জন্য। কোনো অন্ধ মৌলবাদীর হাতে নিহত হওয়ার জন্য নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।