আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঊষা বললোঃ মদ খাবো

সত্যানুসন্ধিৎসু

পাবনা গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা লেগে গেলো। আগে বাসায় যাওয়ার কথা, কিন্তু তা না করে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা কাকরাইলের এসএ পরিবহণ অফিসে এসে নামলাম। এখানে গত দশ-বারদিন যাবত পড়ে থাকা তিন হাজার টাকা তুললাম। ঊষার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা ছিল সেই অফিসের নিচে, কাজ সেরে নেমে আসতেই ওর দেখাও পেলাম। ঊষা বললো, সাকুরায় চলো, মদ খাবো আর কথা বলবো।

ওর কণ্ঠ দৃঢ়। সাকুরায় যাওয়ার মত টাকা এখন আমার পকেটে আছে, কাজেই আমার সাহসের অভাব নেই। ওর আবদারের কোনো প্রতিবাদ না করে একটা স্কুটারে ত্বড়িৎ শেরাটন হোটেলের পাশে সাকুরা বারে পৌঁছালাম। সিঁড়ি বেয়ে দ্রুতই উঠে গেলাম দোতলায়, বারের গেট টপকে বসলাম সামনের দিককার একটা টেবিলে। বারের সদর দরজার সামনের টেবিলে এভাবে কোনো মেয়েকে নিয়ে বসে মদ খাবো কোনোদিন ভাবি নি।

মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি নাড়া দিচ্ছিল পরিচিত কেউ আমাকে এভাবে দেখে ফেলে কি-না। পেছনের দিককার সবগুলো টেবিলই লোকজনে ঠাসা। ঊষাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি খাবে, হুইস্ক নাকি বিয়ার? ঊষা সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল, হুইস্কি। স্টুয়ার্ডকে ডেকে হুইস্কির অর্ডার দিয়ে ওর দিকে তাকালাম। বার'র মৃদু আলোতে লক্ষ্য করলাম, সেই ঊষা আর আজকের ঊষার মধ্যে অনেক তফাৎ।

বিমর্ষ, মন মরা আর শীর্ণ শরীর যেন কতকাল রোগে ভুগে আজই বিছানা থেকে উঠেছে। ওকে এরকম অবস্থায় দেখে মনটা বড়ই বিষন্ন হয়ে উঠলো। স্টুয়ার্ড আমাদের হুইস্কি , মিনারেল ওয়াটার আর একপাত্র প্রোসেসড্ বাদাম দিয়ে গেলো। কিন্তু ঊষা এক নিঃশ্বাসে গ্লাসের সবটুকু পানীয় সাবাড় করে, গ্লাসটা টেবিলে খটাস্‌ করে রেখে দিয়ে বললো, গত পরশুদিন সন্ধ্যায় হাবিবের সঙ্গে হাতিরপুলের একটা বাড়িতে দেখা করেছি; ওকে সব কথা বলেছি। মদও খেয়েছি, সবই হয়েছে সেখানে।

আমার জীবনটাই গেলো মানুষের উৎপাত সইতে সইতে, বাড়িতেও যেমন, বাইরেও তেমন। বাবা-মার বাড়িতে থাকলেও ঘরটা দিন দিন আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। কারো নরম গরম কোনো কথাই আমার ভালো লাগে না। উঠতে বসতে কথা শুনতে হয়। কেউ ফোন করলে কে ফোন করেছে, কে সেই লোক, কি সম্পর্ক, সম্পর্ক যদি ভালো হয় তাহলে কেন এখনো বিয়ে করছি না।

আমি একটি অপদার্থ অলক্ষ্ণী হিসেবে প্রতিদিন চিহ্নিত হচ্ছি। আমার বাপ, শিল্পীর শ্বশুর, ওর জামাই জাকির সকলেই চায় আমার ওপর তাদের পুরুষত্ব জাহির করতে। ওদের বিরুদ্ধে উচিত কথা বলতে উচিত কাজ করতে আমার কেন এতো দ্বিধা থাকে, কেন এতো লজ্জা আমার, কেন আমি মুখ বুঁজে থাকি! মানুষ যখন চোখের সামনে অন্যায় করে, নিজের ওপর রাগ হয় আমার। নিজের এই মাথা নুইয়ে লজ্জাবতী লতার মতো পড়ে থাকার স্বভাবের প্রতি আমার রাগ হয় বড়। অনেক কিছুই আমার দ্বারা হয়ে ওঠে না, আমি লক্ষ্য করেছি।

বড় ফাঁকা লাগে সব কিছু। পুরুষের জগতে এভাবেই আমাকে গা বাঁচিয়ে চলতে হয়। ইচ্ছে করছিল ওদের ওই বাড়ি থেকে চলে যাই কোথাও। কোথাও আমি নিজের মত করে থাকি। কিন্তু আমি কিছুই পারছি না।

আমি ওর দিকে আরেকবার ভালোভাবে তাকালাম। ওর কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর বললাম, আমার মনে হয়, স্বামী-সংসার না থাকলেও একটা মেয়ে যে ভালো থাকতে পারে, তা প্রমাণ করার একটিই উপায়, কিছু অর্জন আর কিছু বর্জন, কিছু বাড়তি যোগ্যতা, কিছু বাড়তি দক্ষতা। আমার কথার কোনো উত্তর দেয়না উষা। সে নিজের হাতে থাকা ব্যাগে মগ্ন হয়ে কী যে খুঁজতে লাগলো।

ব্যাগ থেকে কিছু কাগজপত্র, এগারো শ টাকা আর চার প্যাকেট বেনসন সিগারেট বের করে আমার সামনে রেখে বললো, তুমি যে দু’এক শ করে টাকা আমার হাত খরচের জন্য দিতে এগুলো সেই টাকা, আমি জমিয়ে রেখেছিলাম মাটির ব্যাংকে। আজই বিকেলে ব্যাংকটা ভেঙেছি। বাড়িতে একটা চিঠি লিখে রেখে এসেছি ফ্রিজের ওপর। তাতে মা-বাবা, জাকির, জাহাঙ্গীর সবার কথা লেখা আছে। আমার গলার স্বর্ণের চেইনটা ছোট বাবুর গলায় পরিয়ে দিয়ে এসেছি।

কাপড়-চোপড় কিছুই আনি নি। আনার দরকারও মনে করি নি। আমি আর বাড়ি ফিরে যাবো না। এখন সবকিছুই নির্ভর করছে তোমার ওপর। তুমি যদি আমাকে গ্রহণ না করো তাহলে আমাকে এখন চিরদিনের জন্য চলে যেতে হবে পৃথিবী থেকে।

তুমি নিজেই আমার মৃত্যুটাকে স্বচক্ষে উপভোগ করবে! ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো ঊষা। ওর হঠাৎ কান্না দেখে বিব্রত হয়ে পড়লাম আমি। জিজ্ঞেস করলাম, এই টাকা, কাগজপত্র, সিগারেট এসব কী জন্য? -তোমার জিনিস তোমাকেই দিয়ে যাচ্ছি। তোমার দেওয়া কাপড়-চোপড়, জুতা, কসমেটিকস্‌, গয়নাগাটি সবই রেখে এসেছি। ভাবলাম, ঊষা আমাকে দেবে বলেই সিগারেটগুলো কিনেছে।

তসলিমা নাসরিনের ক-বইটা টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, বইটা রাখো। আমার আর কিছুই দরকার নেই। এখন আমাকে মদ কিনে দাও, আমি মদ খাবো। একজন সার্ভারকে ডেকে আমি আরো দু’পেগ হুইস্কি দিতে বললাম। পরে আরো এক পেগ।

সবই ঊষা খেলো। ওকে খুবই বিধ্বস্ত আর ম্রিয়মান মনে হচ্ছিলো। সে বললো, আমি আজ দশদিন কিছু খাইনি, শুধু পানির ওপর চলছে আমার জীবন। আজ বিকেলে একটা রেস্টুরেন্টে বসে প্রথম এক প্লেট রাইস আর চিকেন খেয়েছি। -তুমি যে এসব করছো, কেন করছো? কী লাভ হবে? হাবিবকেও বলেছো; সেখানে কী লাভ হয়েছে? -সবাই সুখে থাক, আমি চলে যাই।

আমাকে আরো মদ দাও। সব টাকার মদ খাবো আজ। -তোমাকে এতো মদ এখানে খেতে দেবে না কেউ। দোকানিরাও দেবে না। আমরা উঠলাম।

ঊষা টলছিলো। কথায় জড়তা। বার'র বাইরে এসে রেলিং-এর পাশে দাঁড়ালাম। সেখানে একটা ডাস্টবিনে ওর কাগজপত্রগুলো একবার পরখ করে করে ফেলে দিলাম। সেগুলোর প্রায় সবই লাল-সবুজ ডোরাকাটা ইনভেলপে ভরা ওর প্রবাসী পত্রমিতাদের চিঠি।

আর কয়েকটা আছে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, বিভিন্ন সময়ে ইন্টারনেটে বন্ধুদের সঙ্গেকার কথোপকথনের প্রিন্ট। সিঁড়ি বেয়ে নামতেই ও পেছনে পড়ে যাচ্ছিলো, আমি দাঁড়িয়ে আবার ওকে সঙ্গে করে নিচ্ছিলাম। মান্না আশরাফীর কাছে মোবাইলে কথা বললাম, সে যেতে বললো। বারের বাইরে এসে ঊষা বললো, আমি আর হাঁটতে পারছি না। কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাকে? কোনো গাড়িই পাওয়া যাচ্ছিলো না।

আমরা তখন হেঁটে শাহবাগ মোড়ের দিকে এলাম। মোড় থেকে রিকসায় প্রথমে কাকরাইল এবং পরে রামপুরার দিকে। রিকসায় ঊষা বললো, তার বাথরুমে যেতে হবে এক্ষণই। যেকোনো সময় কাপড় নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মদের নেশায় সে জানতে পারলো না কোথায় বা কোনদিকে যাচ্ছি।

ব্যস্ত শহরের ভিড় পার হয়ে অরেকদূর পথ পাড়ি দিয়ে আমরা মান্নার বাড়ি পৌঁছলাম। মান্না বাড়িতে ছিলো না। তার স্ত্রী ও বাচ্চাদের দেখা গেলো। ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়ামাত্রই ওকে টয়লেটের দিকে পাঠিয়ে দিলাম। বের হয়ে ঊষা ‘বড্ড গরম লেগেছে’ বলেই প্রথমে গায়ের ওড়না, সোয়েটার খুলে মেঝের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিলো।

বললাম, যদি খুবই খারাপ লাগে তাহলে না হয় গায়ের কামিজটাও খুলে ফেলো। কিন্তু সে আমার কথায় কান দিল না। বিছানায় পড়ে বিড়বিড় করে কী সব আবোল-তাবোল কথা বলে যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে ঊষা কাঁদতে কাঁদতে বললো, ওরা তোমাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে চায়। আমি কি নিয়ে বাঁচবো! বুকে বুকে জড়াজড়ি করে কিছুক্ষণ শুয়ে রইলাম।

শুকনো ডাল-পুরির মতো মনে হচ্ছিলো ঊষার দেহটাকে। কতক্ষণ ওইভাবে রইলাম কে জানে! দেয়ালে ঘড়ির কাটা টিকটিক করে সরে যাচ্ছিল, আর আমার বুকের মধ্যে কী এক টেনসনে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলাম। মনে হচ্ছিল, অদ্ভুৎ ধরণের ঘোরের মধ্যে আমি আটকে আছি যেখানে পৃথিবীর কোনওকিছুর সঙ্গে সম্পর্ক নেই। এক সময় ঊষা জানতে চাইলো, আমরা এখন কোথায় যাবো? -কোথাও না। দু'জনই বাসায় যাবো।

ঊষা বললো, যেখান থেকে চলে এসেছি সেখানে আর আমি যাবো না। তুমি যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাবো। বললাম, তুমি এখানেই থাকবে। আমি বাসায় ফিরে যাবো। কাল আবার তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে।

ঘরের বন্ধ দরজা খুলে আমি মান্না আর মান্নার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বললাম যাতে করে আজকের রাতটা ঊষাকে এখানেই রাখা যায়। কিন্তু তারা বললো, দেশের বাড়ি থেকে মান্নার বাবা এসেছে, তিনি হাঁপানীর রোগী। তাকে একটা রুম ছেড়ে দিতেই হবে। তাছাড়া মান্না একথাও বললো, বাসায় রাগারাগি করে যেহেতু এসেছে সেহেতু খোঁজাখুঁজি করে আমার বাসা থেকে যদি তাকে পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে বড় রকমের কোনো ঝামেলার সৃষ্টি হয় কিনা সেটাও ভাববার বিষয়। সুতরাং থাকবার মতো জায়গার বন্দোবস্ত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

আমার ধারণা ছিলো যে করেই হোক না কেন ঊষাকে তারা গ্রহণ করবে এবং রাত্রিবাসের একটা ব্যবস্থা হবে। কিন্তু আমার বারংবার অনুরোধের পর তাদের আপত্তির মাত্রা বাড়তেই লাগলো। শেষপর্যন্ত এক রকম হতোদ্যম হয়েই মান্নার বাড়ি থেকে বের হলাম। রাত তখন এগারোটা পাঁচ। ভাবলাম, ঊষাকে অন্তত ওর বাড়ির কাছাকাছি কোনো জায়গায় নামিয়ে দেবো যাতে সে বাধ্য হয়েই বাড়ি ফিরে যায়।

কিন্তু আমাদের রিকসা যতোই ওর বাড়ির কাছাকাছি আসতে লাগলো ঊষা ততই আমার গা খামচাতে লাগলো, সে বাড়ি ফিরে যাবে না। কোনোমতেই না। অবিরাম খামচানি আর রিকসা থেকে নেমে যাওয়ার প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে গিয়ে কনুই দিয়ে ওর বুকের পাঁজরে স্বজোরে বার দুই আঘাত করলাম। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হলো না। ওর ঔদ্ধত্যপুর্ণ মনোভাবে আমার খুবই রাগ হচ্ছিল।

ঊষা যা চাইছিল তা করা যে আমার দ্বারা কোনও দিন সম্ভব হবে না তা হয়তো সে ধারণা করতে পারে নি। মধুবাগের রাস্তায় ওকে নামিয়ে দিতেই সে রিকসায় ভ্যানিটি ব্যাগটা ফেলে দিয়ে ওদের বাড়ির বিপরীত দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলো। আমি নেমে ব্যাগটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে অন্য আরেকটা রিকসায় দ্রুত স্থান ত্যাগে উদ্যত হলাম। এই রাত দুপুরে একটা মাতাল মেয়ের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলাটা আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর ও বিপদজনক হয়ে উঠলো। ঠাহর করতে পারছিলাম না এখন আমার কী করা উচিত! যেন ঊষা মদ খায়নি, খেয়েছি আমি।

কিন্তু এদিকটায় এতো রাতে কোনও লোকজনকে দেখা গেলো না। রাতের গলিপথে যেন শুনশান নীরবতা! রিকসাওয়ালা অবাক হয়ে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল আর কাণ্ডকীর্তি চেয়ে চেয়ে দেখছিল। আর তখন আমি এক অন্ধকার অরণ্যের সীমাহীন গভীরে হারিয়ে যেতে থাকি, যেখান থেকে হয়তো আর কোনদিন ফিরে আসতে পারবো না। ---

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।