অনেকের মাঝেও একা থাকা যায়, নি:সঙ্গতায় কারো অনুভব ছুঁয়ে যায় ...
অভ্র-বিজয় সংঘর্ষে কী-বোর্ড এখনো উত্তপ্তই। মোস্তফা জব্বার নাছোড়বান্দার মত আইনানুগ পথেই এগুলেন । অভ্রর দিকে অঙ্গুলি তুললেও মোস্তফা জব্বার আদতে ইউনিজয় নিয়ে ক্ষুব্ধ। বিজয় এবং ইউনিজয়ের কী-বোর্ড লে-আউটের সাদৃশ্যতা নিয়ে অভিযোগ কপিরাইট দপ্তর পর্যন্ত গড়িয়েছে। কারণ দর্শাও প্রকারের নোটিশ গেছে অভ্র টিমের কাছে।
কিন্তু অভ্র এখানে আইনের মুখোমুখি কেন? অভ্র ইউনিজয়কে যুক্ত করেছে বলে মোস্তফা জব্বারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তারা এখন জবাবদিহিতার মুখোমুখি। অভ্র আসলে কী? অভ্র মূলত একটি সফটওয়্যার। একটি ইন্টারফেস। যেখানে ইউনিজয় ছাড়াও রয়েছে ফোনেটিক, অভ্র ইজি, বর্ণনা এবং জাতীয় কী-বোর্ড নামক প্রতিটি আলাদা আলাদা কী-বোর্ড লে-আউট। একুশে প্রজেক্ট অন্যান্য কী-বোর্ড লে-আউটের (যেমন- মুনীর ইউনিকোড, প্রভাত, রূপালী) পাশাপাশি ইউনিজয় লে-আউট বিতরণ করেছিল।
প্রথম ইউনিকোড ভিত্তিক বাংলা কী-বোর্ড ইন্টারফেসের দাবিদার সৃষ্টি প্রজেক্ট বিজয় কী-বোর্ড লে-আউটকে ব্যবহার করেছিল। বিজয়ের ৯৫% অনুরূপ লে-আউটে করা ইউনিকোড ভিত্তিক কী-বোর্ড যুক্ত বলে সৃষ্টি ইন্টারফেসের বৈশিষ্ট্যের তালিকা থেকে জানা যায়। একুশে ও অমিক্রনল্যাবের সাইটে ইউনিজয়ের লে-আউটের ব্যাপারে বিজয়ের সাথে ৯৯% সাদৃশ্যতার কথা জানানো হয়।
জব্বার বিদ্মেষীরা কিংবা অভ্র-সমর্থনকারীরা ত্যাক্ত, বিরক্ত এবং চিন্তিন্ত এই ভেবে যে, কেবল জব্বার সাহেবের পক্ষ থেকে বিশেষ কোন প্রভাব বিস্তারের কারণে যদি অভ্র এই আইনি লড়াইয়ে হেরে যায় তাহলে আন্তর্জাল থেকে বুঝি অভ্র বিলুপ্ত হয়ে গেলো। নন-টেকি কেউ এভাবে ভাবলে খুব একটা অবাক হওয়ার জো নেই, তবে সামান্য হলেও প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন কেউ এই ভাবনার জোয়ারে গা ভাসালে তা তথ্যপ্রযুক্তির কী-বোর্ডগত গবেষণা, উদ্ভাবনকে ভুল ভাবে উপস্থাপন করার সামিল হয়।
উল্লেখ্য ’অভ্র ইজি’ লে-আউট নিয়ে মোস্তফা জব্বারের পক্ষ থেকে কোন অভিযোগ ওঠেনি। অভ্র সফটওয়্যারে ইউনিজয় কী-বোর্ড সংযুক্তকরণে অভ্রটিমকে আত্মপক্ষ সমর্থনে ইউনিজয় এবং বিজয়ের বৈসাদৃশ্য তুলে ধরতে হবে। লে-আউটের সাদৃশ্যতার কারণে বিজয়ের পেটেন্ট ভঙ্গ হয়েছে কি হয়নি তা নিয়ে তাদের যুক্তি দিতে হবে। সিদ্ধান্ত অবশ্যই শেষ পর্যন্ত আইন দেবে। তবে হেরে যাওয়া বা জিতে যাওয়া নিয়ে কথা বলার সুযোগ থেকে যায়।
১. ধরা যাক, ৯৯% মিল থাকার কারণে যদি পেটেন্ট ভঙ্গ হয়, এবং তা কোন রকম প্রভাব বিস্তার ছাড়াই সম্ভাব্য হারের কারণ হয়, তাহলে ইউনিজয় লে-আউট থেকে অভ্র ইন্টারফেস যদি মুক্ত হয়ে যায় তো আর কোন আইনি ঝামেলার সুযোগ থাকে না। ইউনিজয়মুক্ত অভ্র সফটওয়্যার সেই আগের মতই আমরা ব্যবহার করতে পারবো সফটওয়্যারটির অন্যান্য কী-বোর্ড লে-আউটগুলো দিয়ে।
২. যদি ৯৯% মিল থাকার কারণে ইউনিজয় অবৈধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে কি ইন্টারনেটে বাংলা টাইপিংয়ে বিশাল কোন ক্ষতি হয়? এর উত্তর না হতে পারে, আবার হ্যা -ও হতে পারে। ’না’ কিভাবে? ইউনিজয় হলো ইউনিকোড ভিত্তিক একটি কী-বোর্ড লে-আউট। ইউনিজয় কী-বোর্ড লে-আউট নিয়ে আপত্তি উঠতে পারে কিন্তু ইউনিকোড ভিত্তিক বাংলা টাইপিং সুবিধা নিয়ে কোন প্রকার বিরোধ নেই।
তাই ইউনিজয় না থাকলেও ভিন্ন একটি কী-বোর্ড লে-আউটকে ইউনিকোড-বান্ধব করলেই বিশেষত আন্তর্জালে বাংলা মুদ্রাকরদের সুবিধা বঞ্চিত হতে হয়না। আর ’হ্যা’ কিভাবে? যদি ব্যবহারকারীরা বিজয় কী-বোর্ড লে-আউটে অভ্যস্ত হয়ে থাকেন, কেবল তাহলেই ইউনিকোড ভিত্তিক হলেও একটি নতুন কী-বোর্ড লে-আউটে স্বাচ্ছন্দ আনতে আমাদের অসুবিধা হবে।
কাগজে মুদ্রন জগতে বিজয় এখনও বেশ জাঁকিয়ে থাকলেও সোস্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের কারণে আন্তর্জালে বিভিন্ন ওয়েব সাইটে বাংলা লিখতে ইউনিকোড পদ্ধতি প্রয়োজনীয়। আমরা যারা অভ্র সফটওয়্যারটি ব্যবহার করি সেই অভ্রপ্রেমীদের মধ্যে বলতে গেলে সবাই ফোনেটিক অথবা ইউনিজয় নির্ভর। অনেকেই জাতীয় কী-বোর্ড লে-আউটকে বাহবা দিলেও, অভ্রের মত একটি জনপ্রিয় সফটওয়্যারে এর সংযুক্তিস্বত্বেও জাতীয় কী-বোর্ড লে-আউটের সাথে আমরা অভ্যস্ত হয়নি।
এমনকি অভ্র ইজি লে-আউটটির সাথেও আমরা অভ্যস্ত না। বর্ণনা লে-আউটের কথা তো বাদই দিলাম। তাহলে দু’টি বিষয় দেখা যাচ্ছে; এক-ওয়েবে লেখার জন্য আমাদের ইউনিকোড পদ্ধতি প্রয়োজন এবং দুই- কী-বোর্ড লে-আউটের জন্য আমাদের বিজয় লে-আউট অনুরূপ কিছু প্রয়োজন।
১৯৮৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২০টিরও বেশী কী-বোর্ড সফটওয়্যার আবিষ্কৃত হয়েছে। লে-আউট এসেছে বিভিন্ন রকম।
প্রশ্ন হলো-
১. আমরা কি এখনো নতুন নতুন কী-বোর্ড লে-আউট আবিস্কার করেই যাবো?
২. প্রচলিত কী-বোর্ড লে-আউটগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে কতটা মান সম্মত তা নিয়ে কী কোন গবেষণা হয়েছে?
৩. ওয়েবে ইউনিকোড ভিত্তিক বাংলা টাইপিং সুবিধা থাকলেও মুদ্রণ মাধ্যমকে ইউনিকোড বান্ধব করা হচ্ছে না কেন?
কী-বোর্ড সফটওয়্যারের ফিচার আর কী-বোর্ড লে-আউটের মান যাচাই দুটো খানিকটা ভিন্ন বিষয়। একটি কী-বোর্ড ডিজাইন করতে যে রীতিমত আকণ্ঠ গবেষণা করতে হয়, তা হয়ত আমরা সাধারণ ব্যবহারকারীরা, এমনকি হয়ত যারা ইতিপূর্বে, এখন ও আগামীতে বাংলা কী-বোর্ড নিয়ে কাজ করতে চান তারাও মনে হয় ক্ষেত্রবিশেষে গুরুত্বসহকারে বুঝতে চাননা। এই যেমন অভ্র-টিম বা সমর্থকরা বলছেন, পেটেন্ট এড়ানোর জন্য কিছু কী-স্ট্রোকের অবস্থান পরিবর্তন করা হয়। আমাদের খুব স্পষ্ট করে জানা উচিৎ, একজন কী-বোর্ড নকশাকারী গবেষক কী-স্ট্রোকের অবস্থান নির্ণয় করবেন ব্যবহারকারীর স্বাচ্ছন্দ্য চিন্তা করে এবং টাইপিং গতিকে আরামদায়ক, তরান্বিত করার জন্য। যদি গানিতিক সংখ্যা ৭ চিহ্নিত কী-স্ট্রোকে থাকা চন্দ্রবিন্দুকে গানিতিক সংখ্যা ২ চিহ্নিত কী-স্ট্রোকে বসানোর কারণ কেবল মাত্র যদি পেটেন্ট/কপিরাইট আইন ঝামেলা এড়ানোর জন্য হয় তবে এরকম উদ্বাবন হয়ত তথ্যপ্রযুক্তিগত মান বাড়ানোর চেয়ে মান কমিয়ে দিতে পারে।
আরো বিষদে যাওয়ার আগে জেনে নেই কী-বোর্ড লে-আউটের কারিগরি পর্ব। কী-বোর্ড লে-আউট দর্শনে তিনটি পর্যায় রয়েছে- মেকানিক্যাল লে-আউট, ভিজ্যুয়াল লে-আউট, ফাংশনাল লে-আউট।
মেকানিক্যাল লে-আউটঃ আমরা ’এ’ কী-স্ট্রোকে চাপ দিলে কী-বোর্ড বার্তা পাঠায়। তাতে ব্যবহারকারী কর্তৃক ’এ’ চাপ দেয়া হয়েছে বলা থাকেনা, বরং বলা থাকে হোম-রো এর সর্ববামের প্রধান কী-স্ট্রোকে চাপ দেয়া হয়েছে। এটা সাধারণভাবে বোঝার জন্য একটা উদাহরণ।
মূলত প্রতিটি কী এর জন্য একটি আভ্যন্তরীণ রেফারেন্স নাম্বার থাকে এবং সেই নাম্বারটিই গনকযন্ত্রকে বার্তার মাধ্যমে জানানো হয়।
ভিজ্যুয়াল লে-আউটঃ আমরা কী-বোর্ডে যেভাবে বর্ণমালা ও বিভিন্ন আনুষাঙ্গিক চিহ্ন আঁকা দেখি তাই হলো ভিজ্যুয়াল লে-আউট। এটি ভাষা, দেশ এবং ব্যবহারকারীর উপর নির্ভর করে বিভিন্ন হতে পারে। কম্পিউটার বা অপারেটিং সিস্টেম ভিজ্যুয়াল লে-আউট পড়তে পারেনা। মেকানিক্যাল লে-আউট বুঝতে পারে।
একই মেকানিক্যাল লে-আউটে ভিন্ন ভিন্ন ভিজ্যুয়াল লে-আউট হতে পারে।
ফাংশনাল লে-আউটঃ এটি সফটওয়ার অংশ যেখানে মূলত কী-ম্যাপ থাকে। ভিজ্যুয়াল লে-আউটের চিহ্নগুলোকে ফুটিয়ে তোলা হয় ফাংশনাল লে-আউটে। তাই ’এ’ চাপ দিলে ’এ’ পাই আমরা।
আগের কথার খেই ধরি আবার- নতুন নতুন, অজস্র কী-বোর্ড লে-আউটের প্রয়োজনীয়তা/অপ্রয়োজনীয়তা এবং কী-বোর্ড লে-আউটের মান যাচাই করা।
ইংরেজী কী-বোর্ডে যে ক’টি নাম শোনা যায় সেগুলো হলো- QWERTY, QWERTZ, AZERTY, QZERTY এবং Non-QWERTY কী-বোর্ডের তালিকায় পাওয়া যাবে Dvorak, Colemak, Neo। QWERTY ইউএস প্রধান এবং পরবর্তীতে সার্বজনীন লে-আউট হলেও এই সারির অন্যান্য লে-আউটগুলো দেশ ভিত্তিকভাবে প্রচলিত ছিল বা আছে। যেমন, জার্মানী ও মধ্য ইউরোপে QWERTZ বেশ প্রচলিত। ফ্রান্স, বেলজিয়াম এবং আফ্রিকার কিছু দেশে AZERTY প্রচলিত। ইতালীতে কমপিউটার কী-বোর্ডে QWERTY ব্যবহৃত হলেও, টাইরাইটারে QZERTY লে-আউট প্রচলিত।
মূলত টাইপরাইটারের কী-জ্যাম এড়াতে বিকল্প হিসেবে উদ্ভাবিত QWERTY লে-আউট জনপ্রিয় হলেও Non-QWERTY হিসেবে Dvorak লে-আউট পরিচিত ছিল এর টাইপিং দ্রুততার জন্য।
কী-বোর্ড ব্যবহারকারীদের সম্পর্কে জনাব ডিভোরাকের বক্তব্য ছিল, একটি অর্ধেক পৃষ্ঠার অফিসিয়াল চিঠি টাইপ করতে আমাদের আঙ্গুল কতটা পথ হাঁটে তা আমরা কল্পনাও করিনা! কিছু সাধারণ কিন্তু চমকপ্রদ পরীক্ষা ভেতর দিয়ে আমরা ডিভোরাক এবং কোয়ের্টি কী-বোর্ডের তুলনা দেখি বরং।
১. ৬২ শব্দের একটি প্যারাগ্রাফ এবং একটি অফিসিয়াল চিঠি টাইপ করতে কোয়ার্টি কী-বোর্ডের তুলনায় ডিভোরাক কী-বোর্ডে ৩৫-২০% কম আঙ্গুল চালনা করতে হয়, যা আঙ্গুলকে অন্তত ৬ ফুটের মত দূরত্ব অতিক্রম থেকে বাঁচিয়ে দেয়, যেখানে কোয়ের্টি কী-বোর্ডে প্রায় ১৬ ফুট দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়। কম দূরত্ব অতিক্রম শুধু সময়ই বাঁচিয়ে দেয় না বরং আরামদায়ক টাইপিংয়ের কারণে কার্পাল টানেল (Carpal Tunnel, এই রোগের লক্ষণ সমূহ হলো বৃদ্ধাঙ্গুল, মধ্যমা, তর্জনী অথবা হাতের কব্জিতে অবশ অনুভব, তীব্র স্নায়ুবিক যাতনা অথবা দূর্বল অনুভব করা, ক্রণিক কার্পেল টানেলের ক্ষেত্রে নার্ভ ড্যামেজের আশংকা থাকে) বা আরএসআই ইনজুরি(Repetitive strain injury, পুনরাবৃত্তি কাজের চাপে বাহু অথবা হাতের পেশী, অপেক্ষাকৃত নরম টিস্যুতে অতিরিক্ত ব্যাথ্যা অনুভব করা) জাতীয় স্বাস্থগত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকেও অনেকটা রেহাই পাওয়া যায়।
২. একটি পরীক্ষামূলক প্যারাগ্রাফের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ডিভোরাক কী-বোর্ডে বাম হাতের অনামিকা যখন ৭ ১/৪ ইঞ্চি অতিক্রম করে, তখন ১৫ ৩/৮ ইঞ্চি অতিক্রম করতে হয় কোয়ের্টি কী-বোর্ডে।
৩. দি, অফ, এন্ড, টু, এ, ইন, দ্যাট, ইজ, আই, ইট, ফর, এ্যাজ (The, of, and, to, a, in, that, is, I, it, for, as) গিনিজ বুক রেকর্ড থেকে প্রাপ্ত এমন বহুল ব্যবহৃত জনপ্রিয় ১২টি শব্দাবলী দিয়ে একটি চার্ট তৈরী করা হয়। চার্টে কোয়ের্টি এবং ডিভোরাক কী-বোর্ডে আঙ্গুলের দূরত্ব অতিক্রমের তুলনা দেখানো হয় বরাবরের মতই। নন-হোমরো'তে আঙ্গুল চালনার জন্য স্কোর ধরা হয় ১, এবং স্কোর ১/২ ধরা হয় কেন্দ্রের কী-স্ট্রোকে (জি, এইচ হলো কোয়ের্টি কী-বোর্ডের জন্য, আই, ডি ডিভোরাক কী-বোর্ডেও জন্য) তর্জনী চালনা করার জন্য। এভাবে ’দি’ লিখতে গেলে কোয়ার্টি কী-বোর্ডের স্কোর দাঁড়ায় ২ ১/২ এবং ডিভোরাকের ক্ষেত্রে ০। ইজ লিখতে গেল কোয়ের্টি কী-বোর্ডের স্কোর যখন ১, তখন ডিভোরাকের স্কোর ১/২ ।
এভাবে কোয়ের্টি কী-বোর্ডের স্কোর দাঁড়ায় মোট ১৭ এবং ডিভোরাকের মোট ৫ ১/২ । এর অর্থ এই ১২টি শব্দের ক্ষেত্রে ডিভোরাকের তুলনায় কোয়ের্টিতে প্রায় ৩ গুণ বেশী আঙ্গুল চালনা করতে হয় বিভিন্ন দূরত্বে।
অগাস্ট ডিভোরাক মনস্তত্ববিদ ছিলেন বলেই বোধহয়, কী-বোর্ডের লে-আউট নকশা নিয়ে তার বিশ্লেষণ এবং এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে বিভিন্ন পরীক্ষা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে একটি কী-বোর্ডের মান যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তাকে সফলভাবেই তুলে ধরেছেন। মূলত একারণেই ডিভোরাক কী-বোর্ড QWERTY কী-বোর্ডের অভ্যস্ততার কাছে হেরে গেলেও এখনও সবাই এক বাক্যে ডিভোরাক কী-বোর্ড লে-আউটকে মান সম্মত বলতে দ্বিধা করেনা।
প্রশ্ন হলো, এই রকম বৈজ্ঞানিক তুলনামূলক পরীক্ষা কি আমরা পরিচালনা করেছি আমাদের দেশে উদ্ভাবিত জনপ্রিয়, অজনপ্রিয়, প্রচলিত কী-বোর্ডগুলোর মধ্যে?
তুর্কী কী-বোর্ডের উদ্বাবন কাহিনীতে একটা দূর্দান্ত গবেষণার গন্ধ পাওয়া যায়।
এই প্রক্রিয়ায়, টার্কিশ ল্যাংগুয়েজ এ্যাসোসিয়েশনের সাহায্যে তুর্কী বর্ণমালার অক্ষর ফ্রিকোয়েন্সি নির্নয় করা হয়। প্রাপ্ত তথ্যগুলো কাজে লাগানো হয় অস্থি এবং পেশী এ্যানাটমি গবেষণায়। অতঃপর ১৯৫৫ সালে তুর্কী জাতীয় কী-বোর্ড, টার্কিশ এফ কী-বোর্ড, উদ্ভাবিত হয়। এই কী-বোর্ডের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো টাইপিংয়ে দুই হাতের ভারসাম্য রক্ষা। ৪৯% কী-স্ট্রোক বাম হাতের জন্য এবং ৫১% কী-স্ট্রোক ডান হাতের জন্য।
এই রকম একটি বৈজ্ঞানিক বৈশিষ্টতার কারণেই বোধহয় টার্কিশ কী-বোর্ড ১৯৫৭ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত টাইপিং প্রতিযোগীতায় মোট ১৪ বার বিশ্ব রেকর্ড ভঙ্গ করে!
টার্কিশ ল্যাংগুয়েজ এ্যাসোসিয়েশনের ন্যায় আমারদেরও ভাষা গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে- বাংলা একাডেমী। আমরাও আমাদের এনাটমিস্টদের কাজে লাগাতে পারি। এমনকি আমাদের দেশীয় মনস্তত্ববিদদের কাজে লাগাতে পারি। এবং তাতে বোধকরি একটি স্বীকৃত, মানসম্মত কী-বোর্ড দিয়ে আমরা টাইপ করতে পারি আরামে। প্রশ্ন হলো,
১. কোন বাংলা কী-বোর্ড লে-আউটের নকশা নিয়ে এখন পর্যন্ত এই পর্যায়ের গবেষণা হয়েছে কি?
২. এখন পর্যন্ত প্রচলিত জনপ্রিয় কী-বোর্ডগুলো (যেমন, বিজয়, অভ্র ইজি, এমনকি ৮টি কী স্ট্রোকের পার্থক্যে তৈরী ইউনিজয়) কি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোন টাইপিং প্রতিযোগীতায় দারুণভাবে টক্কর দেয়ার যোগ্যতা রাখে?
৩. তুর্কীতে নিজস্ব কী-বোর্ড লে-আউটের পাশাপাশি কোয়ের্টির পরিমার্জিত সংস্করণ ব্যবহৃত হয় ।
আমরা বাংলা কী-বোর্ড লে-আউট নকশা করলেও মূলত কোয়ের্টি কী-বোর্ডের ভিজ্যুয়াল লে-আউটের নির্দিস্ট ছকেই আমাদের বাংলা বর্ণমালাগুলোকে বসাই। আমাদের কি একেবারেই নিজস্ব বাংলা কী-বোর্ড লে-আউট প্রয়োজন টার্কিশ কী-বোর্ডে মত নাকি কোয়ের্র্টি কী-বোর্ডের উপরেই বাংলা কী-বোর্ড লে-আউট ডিজাইনই আমাদের জন্য সুবিধাজনক?
বাংলা কী-বোর্ড লে-আউট এবং লে-আউটের ভিন্নতা, অভিন্নতা নিয়ে কথা যখন হচ্ছেই তখন এক নজর প্রচলিত কিছু লে-আউটের দিকে নজর বুলিয়ে দেখা যায়।
প্রভাত লে-আউট-সাধারণ ভিউ
অভ্র ইজি লে-আউট-সাধারণ ভিউ
জাতীয় কী-বোর্ড লে-আউট-সাধারণ ভিউ
বিজয় লে-আউট-সাধারণ ভিউ
মুনীর লে-আউট-সাধারণ ভিউ
মুনীর লে-আউট-শিফট ভিউ
ইউনিজয় লে-আউট- সাধারণ ভিউ
ইউনিজয় লে-আউট -AltGrl ভিউ
১. প্রভাত কী-বোর্ড লে-আউট বহুলব্যবহৃত না হলেও এখনও অনেকে এই লে-আউটে কাজ করেন। অভ্র সফটওয়্যারের জনপ্রিয়তা থাকা স্বত্বেও অভ্র ইজি কিন্তু ব্যবহারকারীদের মধ্যে তেমন প্রচলিত নয়। কেবল মাত্র ঠ+ট, ফ+প, ঝ+জ, খ+ক, ভ+ব, ণ+ন কীস্ট্রোকগুলো ছাড়া এই দুই কী-বোর্ডের মধ্যে আপাত দৃষ্টিতে ষ্পষ্টতই তেমন মিল পাওয়া যাবেনা।
২. অভ্র-ইজি আর বিজয়ের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া বেশ দুস্কর। ঠ+ট ছাড়া অন্য কোন কী-স্ট্রোকের মিল দেখা যায় না। প্রভাত আর বিজয়ের মাঝেও কেবলমাত্র ঠ+ট কী-স্ট্রোকের মিলটিই চোখে পড়ে।
৩. অনেকেই বলেন জাতীয় কী-বোর্ড ভাল ছিল। কিসের ভিত্তিতে বলেন সেটা খুব পরিস্কার না হলেও, জাতীয় কী-বোর্ড আর বিজয়ের লে-আউট অনেকাংশে কাছাকাছি।
কিউ থেকে পি(Q-P) সারিটি দুই কী-বোর্ডের বেলাতেই এক। এ থেকে এল (A-L) সারিটিতে ৯টির মধ্যে ৬টি কী-স্ট্রোকে মিল দেখা যায়। জেড থেকে এম(Z-M) সারিতে ৭টির মধ্যে ৪টিতে মিল দেখা যায়।
৪. মুনীর কী-বোর্ডকে পথিকৃৎ বলা যায়। টাইপরাইটারের জন্য নকশাকৃত মুনীর কী-বোর্ডের লে-আউট সাথে পরবর্তীতে উদ্ভাবিত বিজয়ের মিল খুঁজে বার করা খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মত হতে পারে।
৫. প্রথম দর্শনেই বিজয় এবং ইউনিজয়ের সাদৃশ্য ধরা পড়বে বৈকি। কিউ থেকে পি সারি একই রকম। এ থেকে এল সারি একই। জেড থেকে এম সারিতে একটি কী-স্ট্রোকে আপাত পার্থক্য চোখে পড়বে- ও ’এর জায়গায় ’ে া’ । বিজয়ে AltGrl এর সুযোগ নেই।
যেটা অভ্র-ইউনিজয়ে রাখা হয়েছে। এই মুডে ইউনিজয়ে এ থেকে এফ সারিতে ঋ, উ+ঊ, ঈ+ই, অ+আ এবং এর নীচের সারিতে ঔ+ও, ঐ+এ সরাসরি লেখার সুবিধা আছে। বিজয়ে চন্দ্রবিন্দু ১ থেকে ০ সারিতে ৭ কী’তে, কিন্তু ইউনিজয়ে চন্দ্রবিন্দু ২ কী’তে রাখা হয়েছে। বিজয়ে খণ্ড-ত’কে ব্যাক-স্ল্যাশ কী’তে রাখা হয়েছিল, ইউনিজয়ে তা ৭ কী’তে রাখা হয়েছে।
৬. ’ও’ অক্ষরের অবস্থান মূলত বিজয়-ইউনিজয়ে একই থাকলেও ইউনিজয় AltGrl মুডে ’ও’কে লে-আউটে প্রদর্শন করে।
৭. অভ্র-ইজি, ইউনিজয় (এবং বর্ণনা) কী-বোর্ডে ব্যাক-স্ল্যাশের কী’তে পেট-কাটা ব এবং র রাখা হয়েছে, বর্তমান বাংলা চর্চাতে আমাদের দেশে এই দুটি অক্ষরের সংযোজন কতটা তাৎপর্যপূর্ণ তা ঠিক বোধগম্য হয়না।
লে-আউট নিয়ে গবেষণা, বাদানুবাদ এর পাশাপাশি আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে আমাদের সবার দৃষ্টিপাত করা উচিৎ। আন্তর্জালে আমরা যখন ইউনিকোড নির্ভর হয়ে উঠেছি, তখন মুদ্রনমাধ্যম এখনো ASCII কোড নির্ভর। আমরা যখন ফেসবুকে বাংলায় স্ট্যাটাস লিখতে পেরে অভ্র নিয়ে তুষ্ট হয়ে যাই, তখন মুদ্রণমাধ্যমকে প্রকাশনার কাজে বিজয় নির্ভর হতেই হয়। অথচ বিজয় এবং অভ্রের চেয়ে মূলত আমাদের ইউনিকোড নির্ভর হতে হবে সার্বজনীন ভাবে - মুদ্রণ এবং আন্তর্জাল মাধ্যমে।
পুরনো লেখাগুলোকে ইউনিকোডে রূপান্তর করা নিয়েও অনেক সমস্যা হয়েছিল। বিজয় কনর্ভাটার তৈরী হলেও বিনামূল্যে ছিলনা, অন্যদিকে অভ্র কনভার্টার থাকলেও তা বেশ ধীরগতিসম্পন্ন ছিল। এই প্রেক্ষিতে ২০০৮ সালে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন থেকে নিকস (nikosh) কনভার্টার প্রকাশ করা হয়। ইউনিকোড নির্ভর ৫টি ফন্টও প্রকাশ করা হয় যেগুলো ওপেন সোর্স ও ফ্রিওয়্যার ছিল।
মুদ্রণ মাধ্যমে ইউনিকোড পদ্ধতি চালু করতে প্রধান সমস্যা বোধকরি ফন্ট এবং ইউনিকোডবান্ধব ফন্টগুলোর জন্য যথাযথ মুদ্রণযন্ত্র।
মুদ্রণে বিজয় যতটা প্রফেশনাল লুক দেয়, অভ্র কিন্তু তা দেয় না এটা অনেকেরই অভিমত। বর্তমানে অভ্র-ইউনিজয় ছাড়াও আনন্দ কমপিউটার্সের বিজয়ও এখন ইউনিকোডবান্ধব। বিজয় ৫২ সফটওয়্যারে বিজয় ইউনিকোড সংযোজিত হয়েছে। কিন্তু আনন্দ কমপিউটার্স এবং ওমিক্রণল্যাব মুদ্রণমাধ্যমে আধুনিকতার ছাপ রাখতে উদ্যোগী হয়নি। কেউ কেউ বলেন, ফন্ট তৈরীতে শ্রম এবং অর্থ বিনিয়োগের অভাবে কাজটি শুরু বা এগিয়ে নেয়া সম্ভব হচ্ছেনা।
নিকস ফন্টগুলো যেহেতু ওপেন সোর্স তাই একে নিয়ে পরবর্তী প্রয়োজনীয় গবেষণা করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় আমাদের ডেভেলপারদের। আর আইটিখাতে সরকার থেকে যে বাজেট বরাদ্দ হয়, তা কি আমাদের মুদ্রণমাধ্যমকে উন্নত করতে ব্যবহৃত হতে পারেনা?
আইনগত দিক থেকে "৯৯%" বিতর্কে যেই জিতুক তাতে আসলে কী-বোর্ড ব্যবহারকারীদের কি লাভ হবে? আমাদের প্রয়োজন-
১. একটি সার্বজনীন, বৈজ্ঞানিক মান সম্মত কী-বোর্ড লে-আউটের প্রচলন
২. মুদ্রণ মাধ্যমকে ইউনিকোড বান্ধব করে তোলা
৩. মুদ্রণ মাধ্যমের জন্য ইউনিকোড নির্ভর মান সম্মত ফন্ট
আর তাই পক্ষপাতিত্বে কালক্ষেপন না করে, দু’পক্ষকেই চাপে রাখতে পারি আমরা বাংলা কী-বোর্ড ব্যবহারকারীরা। এবং যারা সরাসরি আইটি ডেভেলপিংয়ে আছেন, আইটি ব্যবসায় আছেন, মুদ্রণমাধ্যমে জড়িত আছেন তারা চাপে রাখতে পারেন সরকারকে।
বাংলা কমপিউটিংয়ের জয়জয়কার হোক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।