রানা প্লাজা ভবনে গত মঙ্গলবার ফাটল ধরায় পোশাক কারখানা ছুটি হয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য কর্মীর মতো তরুণী রুবিও বাড়ি ফিরে যান। পরদিন আর কাজে যেতে চাননি। অশুভ কিছু ঘটার আশঙ্কায় মন টানেনি তাঁর। একজন সহকর্মী এসে বলেন, কাজে গেলে আজ (বুধবার) বেতন দেবে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেলেন রুবি। সেই যে কাজে গেছেন, আর ফিরে আসেননি।
ফরিদপুরের মেয়ে রুবি জীবিত না মৃত, জানেন না তাঁর স্বামী বরিশালের ছেলে মিজান। রুবির অপেক্ষায় এখন নিদারণ কষ্টে সময় কাটছে তাঁর। বাস-কন্ডাকটর এই যুবকের কথা, ‘আমি টাকা চাই না, স্ত্রীকে ফেরত চাই।
’
মিজানের মতো আপনজনকে খুঁজে পেতে এমন অনেক মানুষই এখন ভিড় করেছেন সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে। জীবিত না হোক, প্রিয় মানুষের মরা মুখটি দেখলেও যেন এই সান্ত্বনা—যাক, তবু তো পাওয়া গেল!
অপেক্ষারত কেউ কেউ কাঁদছেন অবিরত। কারও বিলাপে বুক ভেঙে যাচ্ছে কাছের মানুষের। কারও বা আবার চোখের জল শুকিয়ে গেছে। নির্বাক মানুষটির চোখের মণিতে কেবল ব্যাকুলতা—কখন পাব তারে? দানাপানিহীন তিনটি দিন হন্যে হয়ে খুঁজতে খুঁজতে তাঁরাও অনেকে অসুস্থ।
এমন একজন পোশাক কর্মী ইয়াসমিন আক্তারের স্বামী। ইয়াসমিনের ভাই ওবায়দুর রহমান জানান, ইয়াসমিন কাজ করতেন রানা প্লাজার সাততলায়। একটি পোশাক কারখানায় কোয়ালিটি কন্ট্রোল বিভাগে। বুধবার কাজে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। তাঁকে তিনদিন পাগলের মতো খুঁজে স্বামী অসুস্থ হয়ে বাসায় শয্যাশায়ী।
এখন ইয়াসমিনের ছবি নিয়ে বোনকে খুঁজে ফিরছেন ভাই ওবায়দুর।
ভাই কায়েস শেখের খোঁজে এসেছেন গোপালগঞ্জের শেফালি। ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করছেন আর চোখের জল ফেলছেন তিনি। জানালেন, এসএসসি পাস করার পর অর্থের অভাবে পড়াশোনা আর হয়নি তাঁর। কাজের খোঁজে এসে কায়েস চাকরি নেন রানা প্লাজার এক পোশাক কারখানায়।
পয়লা বৈশাখ শেষবার বাড়ি যান কায়েস। সেটাই আপনজনদের সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা।
একইভাবে নিখোঁজ হয়েছেন নওগাঁর আবদুস সালাম। তাঁর খোঁজে মান্দা উপজেলার গোঁসাইপুর থেকে এসেছেন তাঁর স্ত্রী। সঙ্গে এসেছেন বড় ভাই আলাউদ্দিন।
সালামের জন্য গ্রামে অপেক্ষা করছে তাঁর দুই শিশু সন্তান। স্ত্রী সে কথা বলে বিলাপ করে কাঁদছিলেন বিদ্যালয়ের মাঠে। ভাইয়ের ছবি দেখিয়ে আলাউদ্দিন বলেন, ভবনটিতে ফাটল ধরায় সালাম খুব ভয় পেয়েছিলেন। বুধবার তিনি কাজে যেতে চাননি। না গেলে চাকরি থাকবে না—কর্তৃপক্ষ এই ভয় দেখালে তিনি কাজে যেতে বাধ্য হন।
দরিদ্রের সংসারে অভাব-অনটনের বোঝা কিছু হালকা করতে রোজগারে নেমেছিলেন ১৭ বছরের তরুণ আনিস। কাজ নেন রানা প্লাজার পাঁচতলায় এক পোশাক কারখানায়। মেশিন অপারেটর হিসেবে করছিলেন তিনি। ভবন ধসে পড়ার ঘটনায় তিনিও নিখোঁজ। পরিবারের পক্ষ থেকে এক মামা এসেছেন তাঁর খোঁজে।
হাজারো মানুষের ভিড়ে ছবি হাতে এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করে ভাগনেকে খুঁজছিলেন তিনি।
এমন অনেক আনিস, সালাম আর মিজানেরা এখনো চাপা পড়ে আছেন রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে। সময় যত যাচ্ছে, তাঁদের জীবিত উদ্ধারের আশাও ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছে। অনেকেরই হয়তো সেখানেই রচিত হবে চিরশয্যা। সে শয্যার ওপর হয়তো একদিন গড়ে উঠবে নতুন কোনো ভবন।
সে ভবনের দেয়ালে নীরবে মাথাকুটে মরবে স্বজন হারানো মানুষের বুকচেরা হাহাকার। সে হাহাকার কি কখনো স্পর্শ করবে এসব ভবন-বিলাসী মানুষদের?।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।