আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অল-ক্লিয়ার নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ?- ২য় কিস্তি



নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তা, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা এবং প্রযুক্তিগত অদক্ষতা ছাড়াও বাংলাদেশের মতো একটি ইতোমধ্যেই বৈদেশিক ঋণ এবং তার সাথে যুক্ত শর্তের জালে আবদ্ধ দেশের জন্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাড়তি একটি বিপদ হলো এর আর্থিক দায়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় এককালীন বিনিয়োগের পরিমাণ বিপুল। আবার শুরুতে যে পরিমাণ অর্থের কথা বলা হয় তাও ঠিক থাকে না, দিন যত যায়, ততই বিনিয়োগের অর্থের পরিমাণ বাড়তে থাকে। দুনিয়ার যে দেশেই সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট কিংবা নানান ব্যাংক ও দাতা সংস্থার কাছ থেকে ঋণের মাধ্যমে এ ধরণের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, সেখানেই ক্ষমতাবান শাসক শ্রেণী ফুলে ফেপে কলাগাছ হয়েছে আর বিপরীতে জনগণ হয়েছে আরও বেশী ঋণগ্রস্থ। আর এর বিনিময়ে জনগণ যে নিরাপদ নিশ্চিত বিদ্যুৎ সর্বরাহ পেতে থাকে তাও নয়।

আমরা এখানে কয়েকটি কেস স্টাডির মাধ্যমে বিষয়টিকে পরিস্কার করার চেষ্টা করব। ব্রাজিল দিয়ে শুরু করা যাক। ব্রাজিল দুনিয়ার পঞ্চম বৃহত্তম দেশ এবং দক্ষিন আমেরিকার গোটা অর্থনৈতিক কার্যক্রমের শতকরা ৪০ ভাগ ব্রাজিলের দ্বারাই হয়ে থাকে। এহেন ব্রাজিলই আবার তৃতীয় বৃহত্তম ঋণগ্রহীতা দেশ। ১৯৭০ সালের দিকে ব্রাজিলের শাসকশ্রেণী প্রচার চালায় যে, কিছুদিনের মধ্যেই তারা প্রথম বিশ্বে উত্তীর্ণ হতে যাচ্ছে।

পরবর্তীতে যা ঘটে সেটা পাঠক আপনিও জানেন, আমিও জানি। এই সুযোগে হুড়মুড় করে পশ্চিমা বিশ্বের ঋণদানকারী সংস্থা ও ব্যাংকসমূহ সেখানে ঢুকে পড়ে। যোগাযোগ খাত, জ্বালানি খাত, টেলিফোন খাত ইত্যাদি নানা খাতে রাতারাতি শ’খানেকের মত প্রজেক্ট দঁড়িয়ে যায়। ১৯৯০ সালের মধ্যে ব্রাজিলের ঋণ দাঁড়ায় ১২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যার মধ্যে এক চতুর্থাংশ ছিল জ্বালানি খাতের অবদান। ব্রাজিল যদি ‘এনরন’ হতো তবে এক কথায় আপনি এখনই ব্রাজিলকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে পারতেন।

কিন্তু আন্তর্জাতিক ব্যাংক গোষ্ঠীগুলো একটু ভিন্ন চিন্তা ধারণ করে। তারা আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ইত্যাদি সহযোগে ঋণদাতা ব্যাংকগুলোকে বেইল আউট করে এবং ঋণ গ্রহীতা দেশকে ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য করে। এখন আসা যাক ব্রাজিলের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর আলোচনায়। ব্রাজিল রাজধানী রিও ডি জেনিরো থেকে ৮০ মাইল পশ্চিমে, স্থানীয়রা যাকে ইতারোমা (মানে বাজে পাথর) বলে থাকে, ব্রাজিল তিন তিনটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। প্রথমটির কাজ শুরু হয় ১৯৭০ সালের দিকে এবং এটির নাম ছিল ‘অ্যাংরা’ (Angra)।

৬২৬ মেগাওয়াট এর এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের দায়িত্ব পায় ‘ওয়েস্টিংহাউজ’ ও ‘বেকটেল’ নামের দুটি প্রতিষ্ঠান। এদেরকে অর্থায়ন করে যুক্তরষ্ট্রের ‘এক্সিম ব্যাংক’। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সময় এর পরিকল্পনায় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ১৯৭৫ সালেই এটা অপারেশনে চলে যাওয়ার কথা অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করার কথা। অথচ নির্ধারিত সময়ের ৮ বছর পরে ১৯৮৩ সালে যখন এটি বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে তখন দেখা গেল এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে !!! এতেই ক্ষান্ত না হয়ে চালু হওয়ার সময় থেকেই এটি কিছু সময় পরপর ‘অফ’ এবং ‘অন’ হওয়ার এমন একটা অভ্যাস রপ্ত করে ফেলে যাতে করে সবাই একে ‘firefly’ বা ”জোনাকি” নামে ডাকা শুরু করে। এই সাধের ‘অ্যাংরা’ এখনও চালু আছে- তার যাবতীয় রোগ ব্যাধিসহ।

কিছুদিন পরপর যন্ত্রপাতি বিকল তো হয়ই তার উপর ২০০০ সালের মে মাসে হাজার হাজার গ্যালন তেজস্ক্রিয় নোনাপানি প্ল্যান্ট থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে এবং আপনারা শুনে আশ্চর্য হতে পারেন যে খোদ ব্রাজিলে এই খবর চার মাস অপ্রকাশিত ছিল অর্থাৎ তারা এটা জানতই না ! ‘ওয়েস্টিংহাউজ’ এবং ‘এক্সিম ব্যাংক’ এরকম প্ল্যন্টে শুধু ব্রাজিলেই নয় ফিলিপাইনে, স্পেনে, সুইডেনে এবং যুগোশ্লাভিয়াতেও তৈরী করেছে। এখানেই শেষ না, এরপর ব্রাজিল শুরু করে ‘অ্যাংরা-২’ নামে আরেকটি প্রজেক্ট যেটার বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয়েছিল ১২২৯ মেগাওয়াট। এটার কাজ শুরু হয় ১৯৭৫ সালের শেষের দিকে। কিন্তু এবার কাজ পায় ব্রাজিলের বৃহত্তম কনস্ট্রাকশন কোম্পানী ‘নর্বের্তো ওদব্রেখত’ (Norberto odebrecht)। পারমাণবিক বিদু্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই ‘নর্বের্তো ওদব্রেখত’ কাজ পায় বিনা প্রতিযোগিতায়।

তাদের সাথে প্রযুক্তি সরবরাহকারী হিসেবে ছিল ‘সিমেন্স’ এবং ঋণদাতা হিসেবে ছিল ‘ডয়েশে ব্যাংক’, ‘হার্মিস’ এবং‘জার্মান এক্সপোর্ট ডেভেলাপমেন্ট ব্যাংক’। কিন্তু এদের জন্য কাজটা ‘নর্বের্তো ওদব্রেখত’ পেয়েছে ব্যাপারটা এরকম নয় বরং তৎকালীন অনির্বাচিত জার্মানভাষী রাষ্ট্রপ্রতি জেনারেল এর্নেস্তো গেইজেলের সাথে ‘নর্বের্তো ওদব্রেখত’ এর বেশ ভালো বোঝাপড়াই কাজটা হাসিল করতে তাদের সহাযতা করেছে। পুরস্কারস্বরূপ ‘নর্বের্তো ওদব্রেখত’ তাকে অবসরের পর তাদের কোম্পানির প্রেসিডেন্ট বানিয়েছিল। যাহোক ‘অ্যাংরা-২’ প্ল্যান্টের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৯৮৩তে এবং এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু এর কাজ কবে শেষ হয়েছিল শুনবেন ? নির্ধারিত সময়ের ১৮ বছর পরে, অর্থাৎ ২০০১ সালে এবং ততদিনে এর নির্মাণ ব্যয় গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে ! এই ১৮ বছরের রিও’র প্রকট বিদ্যুৎ ঘাটতির ‘অপরচুনিটি কস্ট’ আমলে না নিয়েই !!! ‘অ্যাংরা-২’ শুধু এর দেরীর জন্যই রেকর্ড করেনি।

ব্যয়ের দিক থেকেও সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ব্রাজিলিয়ন এক প্রকৌশলীর জবানিতেই শুনুন- “ আপনি যদি ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারকে ১৩০০ মেগাওয়াট দিয়ে ভাগ করেন সেটা ডায়মন্ড কিংবা কোকেইন” । এরপর বেশি কিছু বলার দরকার পড়ে না। আখ্যান এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু এতকিছুর পরেও ব্রাজিলের শাসকশ্রেণীর সাধ মেটেনি। তারা শুরু করে ‘অ্যাংরা-৩’।

এটাও ১২২৯ মেগাওয়াটের এবং এটির কাজও পায় ‘নর্বের্তো ওদব্রেখত’ । আর ‘নর্বের্তো ওদব্রেখত’ এর সাথে এবারও ঋণদাতা হিসাবে থাকে উপরিউক্ত জার্মান ব্যাংকগুলো। কাজ শুরু হয় ১৯৮৬ সালে। শতকরা ৩৫ ভাগ কাজ করতেই এর পেছনে খরচ হয়ে যায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মাঝে জার্মানীতে ‘গ্রিন পার্টি’র প্রভাব প্রতিপত্তি ব্যাপক বৃদ্ধি পায় এবং জার্মান সরকার নিজেদের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো তো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেই সেই সাথে বাইরের দেশেও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অর্থায়ন করতে অস্বীকৃতি জানায়।

এবার আসা যাক ফিলিপাইনের দিকে। ১৯৭৩ সালে ফিলিপাইনের ন্যাশনাল পাওয়ার কর্পোরেশন রাজধানী ম্যানিলা থেকে ৩০ মাইল দূরে সিনিক মোরং (Scenic morong) এ ৬২০ মেগাওয়াটের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ হাতে নেয়। তাদের লক্ষ্য ছিল এরকম আরো ছয়টি প্ল্যান্ট স্থাপনের যাতে করে আমদানী করা তেল এর উপর তাদের নির্ভরশীলতা কমে এবং ভ্র“ত বর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ হয়। ১৯৭৪ এর শুরুর দিকে ‘জেনারেল ইলেকট্রিক’ (GE) ৭০০ মিলিয়ন ডলার খরচে দুটি ৬২০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দেয় তৎকালীন ফিলিপাইন সরকারকে। এই সময়েই রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয় ‘ওয়েস্টিংহাউজ’।

ওয়েস্টিংহাউজের ফিলিপাইনের ডিস্ট্রিবিউটরের সাথে পরিচয় ছিল হারমিনিয়ো দিসিনি নামের মার্কোসের এক গলফ পার্টনারের যার স্ত্রী আবার ছিল ফাস্ট লেডি ইমেলদা মার্কোসের ফার্স্ট কাজিন এবং গভর্নেস। তারই মাধ্যমে ‘ওয়েস্টিংহাউজ’ দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয় এবং ঐ একই বছরের মে মাসে তারা ফিলিপাইন সরকারকে প্রস্তাব দেয় যে তারা দুটো ৬২৬ মেগাওয়াটের নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে দেবে ৫০০ মিলিয়ন ডলারে অর্থাৎ ‘জেনারেল ইলেকট্রিক’ এর চেয়ে ২০০ মিলিয়ন ডলার কমে। মার্কোস ন্যাশনাল পাওয়ার কর্পোরেশানের জেনারেল ম্যানেজারকে প্রস্তাবটি গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। জেনারেল ইলেকট্রিক এই খবরটি পায় মার্কোসের ব্যক্তিগত সহকারী থেকে। এরপর ওয়েস্টিংহাউজের আসল নাটক শুরু হয়।

সেপ্টেম্বর ১৯৭৪এ ওয়েস্টেংহাউজ সেই একই প্রকল্পে খরচ দেখায় ৬৯৫ মিলিয়ন ডলার। ফেব্র“য়ারী ১৯৭৬ এ যখন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তখন সেই একই খরচ বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৭২২ মিলিয়ন ডলার এ এবং সেটাও কেবল একটি পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য! এখানেই শেষ নয়, ঐ ৭২২ মিলিয়ন ডলারের সাথে ৩৮৭ মিলিয়ন ডলারের সুদও যোগ হয়। ১৯৯২ এর শেষে সবকিছু মিলিয়ে এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে খরচ দাঁড়ায় ২.৫ বিলিয়ন ডলারে!!! এমনকি চরম দুর্নীতিগ্রস্ত মার্কোস সরকার নিয়োজিত একটা কমিশনও এতে ৪০০০ এর কাছাকাছি ত্র“টি খুঁজে পায় এবং একে অপারেশানে যাওয়ার জন্য উপযোগী নয় বলে ঘোষণা দেয়। বাতান পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ শেষ হয় ১৯৮৫তে, কিন্তু নিরাপত্তা ও ব্যয়জনিত কারণে এর পরিচালনা স্থগিত করা হয়। তৎকালীন ফিলিপাইন সরকারের ৫০ বিলিয়ন ডলার ঋণে এই প্রকল্পটিই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল যাতে করে ফিলিপাইন এর জনগণের কাঁধে সুদের বোঝা চেপেছিল দৈনিক ১৭০০০ ডলার, ২০০৩ এর বছর শেষে যা গিয়ে দাঁড়ায় ১.২ বিলিয়ন ডলারে।

এই বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে ফিলিপাইন সরকার ও ওয়েস্টিংহাউজ শেষ পর্যন্ত আদালতে মুখোমুখি হয়। এক পর্যায়ে ১৯৯৫ সালে ফিলিপাইন সরকার ওয়েস্টিংহাউজকে ১০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ এবং এর সাথে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সকল প্রকার দায়-দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হয়। আদালতে ওয়েস্টিংহাউজকে অভিযুক্ত করা হলে তারা দাবি করে যে তারা কোনভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক দুর্নীতি সংক্রান্ত নীতিমালা লঙ্ঘন করেনি কেননা ফিলিপাইনের দুর্নীতি এমন স্তরে পৌঁছেছিল যাতে করে প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতা নাকি নিতান্তই মামুলি ব্যাপারে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সে সময় ফিলিপাইনে ক্ষমতায় ছিল ফিদেল রামোস। রামোস বাতান বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে গ্যাস চালিত কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টে রূপান্তরের নির্দেশ দেন।

কিন্তু সেটা করতেও তৎকালীন সময়ে খরচ পড়ত ৬০০ মিলিয়ন ডলার, অতএব সেটাও বাস্তবায়িত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের একটি উদাহরণ দেয়া যাক। ১৯৭০ এর দিকে ২২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ‘ডায়াব্লো ক্যানিয়ন’ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ডিজাইন করা হয়েছিল এবং এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫০০ মিলিয়ন ডলার। অথচ শেষমেষ এর ব্যয় দাঁড়িয়েছিল ৮ বিলিয়ন ডলারে। এমনকি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদনও শুরু করেছিল নির্ধারিত সময়ের ১০ বছর পরে!!! ডিজাইন ও নির্মাণ প্রক্রিয়ায় ত্র“টি, অপর্যাপ্ত তথ্যাদি, যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণাভাব ইত্যাদিকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।

ফিনল্যান্ডের ‘অলকিলিওতো’তে (olkiluoto) একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়ে এখনও চলছে। এটি নির্মাণ করছে একটি ফ্রান্সের বৃহৎ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কোম্পানি ‘আরেভা’। ফিনিশ সরকারের নিকট ‘আরেভা’ এর পূর্ব নির্ধারিত ব্যয় দেখিয়েছিল ২.৫ বিলিয়ন ডলার যা এরই মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এরই মধ্যে ‘আরেভা’ অতিরিক্ত ব্যয় অনুমোদন না করলে কাজ বন্ধ করার হুমকিও দিয়েছে। এসব আমলে নিলে এটা আমরা বলতেই পারি যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন বাংলাদেশের জন্য আক্ষরিক অর্থেই একটি শ্বেতহ¯তী মার্কা প্রজেক্ট।

এমনকি আমরা যদি ধরেও নেই যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে কোন ধরনের যান্ত্রিক ত্র“টি হবে না এবং নির্ধারিত সময়েই কেন্দ্রটি বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেতে পারবে (যদিও এটা মোটামুটিভাবে অসম্ভব কেননা পরিকল্পনা করতেই লেগেছে ৪৫ বছর) তবুও এটি আমাদের দিক থেকে কোনভাবেই একটি টেকসই প্রযুক্তি হতে পারে না। জনস্বাস্থ্যের ব্যাপার তো রয়েছেই, তদুপরি এটি নির্মাণে শুরুতেই যে খরচাপাতি লাগে তাতে করে বাংলাদেশ আরো বেশি করে আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংন্থাগুলির জালে জড়িয়ে পড়বে। বরাবরের মত যন্ত্রাংশ, যন্ত্রপাতি, ডিজাইন, নিরাপত্তা ইত্যাকার সংক্রান্ত কারণে বিদেশী বিশেষজ্ঞদের উপর নির্ভরশীলতার কথা না হয় নাই তুললাম। আরো দু’টি প্রসঙ্গের অবতারণা করে এই কিস্তির ইতি টানব। পারমাণবিক ব্যবসায়ীরা প্রায়শই দাবি করে থাকেন যে পারমালবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে প্রাথমিক খরচটা একটু (?) বেশি হলেও দীর্ঘকালীন মেয়াদে এটি গ্যাস ও কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে অনেক বেশি মূল্য সাশ্রয়ী।

এটা নিয়ে আমরা পরবর্তী কোন এক কিস্তিতে আলোচনা করার আশা রাখি। তারপরও ছোট্ট একটি তথ্য পাঠককে দিয়ে রাখি ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (IEA) ২০০১ সালের এক সমীক্ষায় (Nuclear Power in OECD) দেখিয়েছিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি কিলোওয়াটে যেখানে ব্যয় দাঁড়ায় ২০০০ ডলার (নির্মাণকালীন সময়ে ঋণ নেয়া সুদের হিসেব নিলে অংকটা আরো বড় হবে) সেখানে কয়লাতে পড়ে ১২০০ ডলার এবং কম্বাইন্ড সাইকেল গ্যাস প্ল্যান্টে পড়ে ৫০০ ডলার। আরেকটি তথ্য, যারা মনে করেন এবং প্রচার চালান যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য একটা কার্যকর সমাধান তাদেরকে এখানে একটা ছোট্ট খবর দেই যে, ১৯৯৭ সালে কিয়োটো প্রটোকলে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে Clean Development provision থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বৈশ্বিক উষ্ণতার ব্যাপারটি নিয়েও পরবর্তীতে আলোচনার ইচ্ছে রইল। অল-ক্লিয়ার নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ ? এর প্রথম কিস্তি এখানে Click This Link তথ্যসূত্র: ১) The Blood Bankers by James S Henry ২) http://www.olkiluoto.info/en ৩) Click This Link ৪) Click This Link


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।