আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ড. হুমায়ুন আজাদের জীবনী ১৭তম পর্ব

সভাপতি- বিক্রমপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ, সম্পাদক ঢেউ, সভাপতি- জাতীয় সাহিত্য পরিষদ মুন্সীগঞ্জ শাখা

নিজের সাহিত্য নিয়ে তাঁর ভাবনা, দ্বিতীয় অংশ দ্বিতীয় উপন্যাস 'সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে' প্রকাশিত হওয়ার পরে একটি দৈনিক প্রত্রিকায় প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, উপন্যাসকে আবার উপন্যাস করে তোলার জন্যই আমি উপন্যাস লিখছি। আমার উপন্যাস যে পাঠকের কাছে প্রিয় হবে আগেবাগেই এমন কোনো নিশ্চয়তা ছিলো না। আমার উপন্যাস দুটি পাঠকের কাছে প্রিয় হয়েছে এবং বিনোদন ধারার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ধারার প্রতিষ্ঠা করেছে। আমার উপন্যাস থেকে আনন্দ আহরণ করার জন্য উন্নত জীবন ও শিল্পবোধ থাকা দরকার। আমার উপন্যাস-দুটি, উপন্যাসকে আবার উপন্যাস করে তুলছে বলে আমার মনে হয়।

তিনি অন্যত্র বলেছিলেন, ৫০ বা ৬০ পৃষ্ঠার একটা করে উপন্যাস আমি প্রতি সপ্তাহেই লিখতে পারি। কিন্তু তা আমার কাজ নয়। জনপ্রিয়তা বা অর্থ আমার ইচ্ছা নয়। বরং বলা যায়, এখনকার জনপ্রিয় ধারার সস্তা উপন্যাসকে প্রতিহত করার জন্যই আমি উপন্যাস লিখছি। গত দেড় দশকে বিনোদনধর্মী যে সব উপন্যাস লেখা হচ্ছে সেগুলোর কোনো সাহিত্য ম–ল্য নেই।

আমি সেগুলোর নাম দিয়েছি অপন্যাস। হুমায়ুন আজাদ উপন্যাস লিখেছেন তাঁর স্ত্রী লতিফা কহিনুর এর চ্যালেঞ্জ থেকে এবং অনেকের অনুরোধে- তারা বলেছেন, আপনি উপন্যাস লিখুন, অপন্যাস থেকে উপন্যাসকে উদ্ধার করুন। তাই তিনি অনেকটা মধু সূদনের মতো পরিস্থিতিতে পড়েই উপন্যাস লিখেন। তিনি বলেছেন, আমার উপন্যাস সম্পুর্ণ ভিন্ন রকম; বিস্ময়কর যে এগুলো জনপ্রিয় হয়। তবে আমি সিরিয়াল করতে যাই নি, আমার উপন্যাসতো সম্পূর্ণ আপত্তিকর।

আমার প্রথম উপন্যাস 'ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল' অসাধারণ সাড়া জাগিয়েছে, এখন বাঙলাদেশের অন্য নাম হয়ে উঠেছে 'ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল'। এটি কোনো বিশেষ চরিত্র নিয়ে লেখা গল্প নয়, এটি তৃতীয় বিশ্বের সামরিক অভ্যুত্থানগ্রস্থ অবস্থা- একটি দেশের শোচনীয় অবস্থার গদ্যশিল্প। এর আঙ্গিকও ভিন্ন দেখতে প্রবন্ধের মতো, সারাটি উপন্যাসে একটিও সংলাপ নেই। আমি মানুষের প্রেমের উপন্যাস লিখেছি 'সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে'। এতে আছে তীব্র প্রেম, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের বিপর্যয়; এর পরিবার বা বিবাহ প্রথার শোচনীয়তার উপস্থাপন।

'শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার' কী করে একজন ধর্ম প্রবর্তকের উৎপত্তি ঘটে সামাজে এবং কী ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে এর শিল্পিত উপন্যাস এটি। 'মানুষ হিসাবে আমার অপরাধসমূহ'ও এক অভিনব উপন্যাস। 'রাজনীতিবদিগণ' জনগণের মুখের ভাষায় লেখা। আমাদের রাজনীতিবিদদের পাশবিকতা চিত্রিত হয়েছে এটিতে। এর ভাষাটা আমার নয়, জনগণের ও রাজীতিবিদদের; এটা একটা নিরীক্ষাও- এর মধ্যে সাধু, চলতি, আঞ্চলিক, ইংরেজি, ভুল বাঙলা বা ভুল ইংরেজির একটি কুৎসিত ভাষারূপ তৈরি করা হয়েছে, যা আমাদের রাজনীতিবিদদের মতোই নোংরা।

আমার ঐ উপন্যাসের চরিত্রগুলো কোনো বাস্তব চরিত্রের অবিকল উপস্থাপন নয়, তবে অনেক বাস্তব চরিত্রকে ভেঙ্গেচুরে আরো বেশি বাস্তব করা হয়েছে। 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' উপন্যাসটি পড়ে মানুষ মৌলবাদীদের ভয়াবহ জীবন বর্ণনা দেখে আঁতকে উঠেছিল। পরবর্তীতে এ উপন্যাসটি তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ উপন্যাসটি নিয়ে তিনি বলেছেন, এটি গত আড়াই-তিন বছরের ঘটনা নিয়ে লেখা (উপন্যাসটি ২০০৪ সালে একুশে গ্রন্থ মেলায় বই আকারে প্রকাশিত হয়)। আমি রাজাকার ও আলবদরদের ভেতরের ঘটনা উপস্থাপন করতে চেয়েছিলাম।

উপন্যাস তত্ত নয়, কারণ তা জীবনের ভৌত কাঠামোকে উপস্থাপন করে। উপন্যাসটির বর্ণনার মধ্যে অনেক রূপক ও প্রতীক রয়েছে। উপন্যাসতো জীবনের অবিকল উপস্থাপন নয়। কিন্তু এখানে যা বর্ণনা করা হয়েছে তা সত্য শৈল্পিকভাবে সত্য, বস্তবেও সত্য। যেমন ভৈরবের যে নাম সেটা বদলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

বাস্তবে সেটা ঘটে নি, কিন্তু বাঙলাদেশ জুড়ে এ ধরনের রূপান্তর ঘটানো হচ্ছে। সরকারের আশ্রয়ে এই উগ্র মৌলবাদ আরো শক্তিশালী হয়ে উঠলে এক সময় হয়তো সাভারের স্মৃতিসৌধটিও ভেঙ্গে ফেলা হবে। ‘পাক সার জমিন সাদবাদ’ এর সমাপ্তি নিয়ে অনেক ভেবেছি; একবার মনে হয়েছিল ভয়াবহভাবে এর সমাপ্তি করবো। ভেবেছি চরম হতাশা ও ব্যাপক ধ্বংসলীলার মধ্যে এর সমাপ্তি ঘটাই; কিন্তু এই কথা ভেবেই আমি দুঃখ পেয়েছি, কষ্ট পেয়েছি। সেজন্য আমি বেছে নিয়েছি মৌলবাদ ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তির সমাপ্তি।

সমাপ্তি ঘটিয়েছি প্রেম ও সবুজের মধ্যে লাল সূর্য ওঠার প্রতীকের মধ্যে। এখানে অত্যন্ত খন্ডকালীন মৌলবাদ নায়কটি সে যে আবার মনুষ্যত্বে ফিরে এসেছে এবং সে সমস্ত পাপের জগৎ, অপরাধের জগৎ ত্যাগ করে সমুদ্র তীরে এসেছে, বিশালতার কাছে, ভোরবেলা যখন সবুজের মাঝখানে একটি লাল সূর্য উঠেছে। এটি প্রতীকী উপস্থাপনা। এই যে লাল সূর্য উঠা, সবুজের মাঝখানে- এটা প্রতীক রয়েছে, এ উপন্যাস ভরেই কিন্তু নানা প্রতীক রয়েছে, নানা রূপক রয়েছে। সেগুলো বুঝতে হবে এবং যৌনতার যে বর্ণনা রয়েছে সেগুলোর মধ্যেও নানা রূপক ও প্রতীক রয়েছে, সেগুলো বুঝতে হবে।

এগুলো কাম হিসাবে না, প্রতীক হিসাবে এসেছে, এগুলো প্রতীক। তিনি যে বইগুলি লিখেছেন, যা লিখেছেন তা প্রথাগত চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে খাপ খায় না। তিনি মানুষের জন্য মুক্ত জীবন চেয়েছেন, যে জীবন উদার, সৃষ্টিশীল যা মানুষকে বিকশিত করে। এই বইগুলো এই বদ্ধ সমাজ থেকে উত্তরণের জন্যই লেখা হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, চারপাশে যে প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখতে পাচ্ছি এবং এক সম্প্রদায় আরেক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হিংস্ত্র হয়ে উঠেছে এবং কিছু বদ্ধ মানুষ কিছু মুক্ত মানুষকে হনন করার জন্য উদ্যত হয়েছে।

এ ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করার জন্যই 'প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে' বইটি লিখেছি। শুভব্রত ও তার স¤ক্সর্কিত সমাচার উপন্যাসটি বদ্ধ সমাজ থেকে মুক্তির জন্য রচিত একটি বিশাল উপন্যাস। এই একজন ধর্ম প্রবর্তককে নায়ক হিসাবে নিয়েছি যে ক্রমশ তার উন্মত্ততার মধ্য দিয়ে এক বিধাতার সন্ধান পায় এবং সমস্ত সমাজ রাষ্ট্রকে তার বিশ্বাসের অনুগত করতে চায় এবং একটি মৌলবাদী সমাজ স্থাপন করতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার প্রতিষ্ঠিত সমাজে রাষ্ট্রে তারও দম বন্ধ হয়ে আসে এবং সে ঘোষণা করে যে, বিধাতা আমার মনেরই সৃষ্টি। তখন ক্ষমতা ও ধনলিপ্সু সেনাপতিরা তাকে হত্যা করে এবং দেশের পর দেশ জয় করতে বেরিয়ে পড়ে।

এটি একটি মহৎ উপন্যাস। এই বইগুলো আমি লিখেছি একটি মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন থেকে এবং শিল্প সৃষ্টি করার জন্য। অন্ধ মৌলবাদীদের হাতে নিহত হওয়ার জন্য নয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।