বলুন! ইহাই আমার পথ। আমি এবং আমার অনুসারীগণ মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে এবং আমি অংশীবাদীদের অর্ন্তভূক্ত নই (আল-কুরআন)
এক জাপানী যুবকের ইসলাম গ্রহণ
[পূর্ব প্রাচ্যের দেশ জাপানে জন্মগ্রহণকারী ৩০ বছর বয়সী মিশ্র জাপানী-আমেরিকান বংশোদ্ভূত যুবক ইউয়ামা কেনজী। সদা প্রাণচঞ্চল, সোজাসাপ্টা বাক্যালাপে অভ্যসত্ম এই যুবকের ইসলাম গ্রহণ ছিল স্বতস্ফূর্তভাবেই। ৩ বছর আগে (২০০৬ইং) তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। বর্তমানে দুবাইয়ে অবস্থানকারী কেনজী আমার অনুরোধে তাঁর পরিবর্তিত হওয়া এবং পরিশেষে ইসলাম গ্রহণের হৃদয়গ্রাহী কাহিনীটি লিখে পাঠান।
সেটি অনুবাদ করে এখানে দিলাম]
‘আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি কেবল কেবলই আমার জন্য। অন্য কারো প্রভাবে নয়। আমি কখনই নিজেকে ‘revert’ (যে অমুসলিম অবস্থা থেকে ইসলামের দিকে ফিরে এসেছে) বা ‘convert’ (যে অন্য ধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছে) বলি না। আমি মনে করি এর কোনটাই আমি ছিলাম না। কেননা আমার বদ্ধমূল বিশ্বাস যে, মায়ের কোল থেকেই যেন আল্লাহকে চিনতাম।
জন্ম থেকেই আমি ছিলাম আধ্মাতিকতাবোধসম্পন্ন। শৈশবের অবচেতন দিনগুলোতেও আমার মনে সবসময় একটা অনুভূতি জাগ্রত ছিল যে, আমি যেন কোন একজনের পর্যবেক্ষণে রয়েছি আর আমি তাতে নির্ভার ও প্রশামিত্ম বোধ করতাম। যেহেতু জাপানের গ্রাম্য এলাকায় আমি বড় হয়েছি, তাই তখন উন্মুক্ত প্রান্তরে একাকী খেলাধুলা করতাম সে সময়ও আমার মাঝে এই অনুভূতি কাজ করত। আমি মনে করি না বর্তমান যুগের শিশুদের যেমন অনেক কিছু থেকে বাধা দেয়া হয় তার চেয়ে আমাকে বেশী কিছু করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। তারপরও আমার মনে ‘অদৃশ্য পর্যবেক্ষণ’ অনুভূতিটা সবসময় কার্যকর ছিল যা আমাকে সবসময় এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত রাখত যে কোন কিছুই আমাকে ক্ষতি করতে পারবে না।
কিন্তু বড় হতে হতে এই ধারণা একসময় আমি হারিয়ে ফেললাম। কেন তা বলতে পারব না তবে আমার ধারণা ধীরে ধীরে বাচ্চারা যখন আশপাশের প্রতিকুল চিত্র দেখে অভ্যসত্ম হয়ে উঠে তখন এ অনূভূতি সে হারিয়ে ফেলতে থাকে।
আমার মাতা বৌদ্ধ আর পিতা ছিলেন খৃষ্টান পরিবার থেকে আসা। ধর্মচর্চায় তারা তেমন অভ্যসত্ম ছিলেন না। আমি আমার মায়ের সাথে মাঝে মাঝে বৌদ্ধ ধর্মসভায় যেতাম।
যদিও তার ধর্মে আমার বিশ্বাস ছিল না। আমার কাছে এটা ছিল এমন যে, কতিপয় নারী-পুরুষ একটি সাধারণ লোকের পিছনে একত্রিত হয়ে মিলিত স্বরে কিছু মন্ত্র সুরসহযোগে পাঠ করা। আমি সেগুলো বোঝার চেষ্টা করতাম কিন্তু আমার কানে এটা বিরক্তিকর কোলাহলের মত ঠেকত। এজন্য আমি বাইরে এসে উচু পাহাড়ের চুঁড়ায় অবস্থিত মঠের বিড়ালগুলোর সাথে খেলতাম অথবা সাকুরা গাছে চড়তাম, কখনওবা গভীর খাদে ঢিল ছুড়ে নিবিষ্ট চিত্তে পর্যবেক্ষণ করতাম।
অন্যদিকে আমার পিতার পরিবার থেকে আমি খৃষ্টান ধর্মও শিখেছিলাম।
আমি তাদের সাথে রবিবারের প্রার্থনা সভাতে যেতাম। সেখানেই আমি প্রথম শিখেছিলাম গড, ইবরাহীম, ইউসুফ, দাঊদ, সোলায়মান প্রভৃতি নামগুলো এবং অবশ্যই যিশুর নাম। আমি প্রার্থনাসভার শিক্ষকদের দেখতাম গড, যিশু এবং পবিত্র আত্মা শব্দগুলো একই অর্থে ব্যবহার করতে। এতে আমি ঐ ছোট বয়সেও বেশ ধাঁধাঁয় পড়ে যেতাম। মনে হত কোথাও ভুল হচ্ছে।
একদিন রবিবারে প্রার্থনার পূর্বে পাদ্রী আমাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছিলেন। বলছিলেন ঈসা (আঃ) ও তার সঙ্গী-সাথীদের গল্প। কিভাবে ঈসা (আঃ) সামান্য কিছু মাছ ও রুটি দিয়ে উপস্থিত সকলকে পরিতৃপ্ত করেছিলেন ইত্যাদি। বক্তব্যের মাঝে কোন এক প্রসঙ্গক্রমে আমি হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলাম, ‘যিশু কেন এই বন্যা সৃষ্টি করলেন?’ পাদ্রী বললেন, ‘এ প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক নয়, কেননা আমরা এখন যিশু সম্পর্কে কথা বলছি। ’ জবাবে বললাম ‘কিন্তু যিশু তো নিজেই গড, গডই যিশু।
অতএব যিশুই বন্যা সৃষ্টি করেছেন। ’ পাদ্রী থতমত খেয়ে ইতসত্মতভাবে বললেন, ‘না, যিশু সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। ’ আমি আবার পূর্বের ন্যায় প্রশ্ন করলাম। কিন্তু আমার চাচাতো ভাইরা প্রার্থনার কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য আমাকে সেখানেই থামিয়ে দিলেন। যাহোক বয়স বাড়ার সাথে সাথে এসব প্রশ্ন আমাকে আরো বেশী ধাক্কা দিতে লাগল।
আমি পাদ্রীদের প্রায়ই এসব প্রশ্ন করে নিশ্চুপ করে দিতাম। ফলে অধিকাংশই আমাকে বলত যে, আমার এসব ধৃষ্টতাপূর্ণ প্রশ্নের কারণে আমি নরকের দিকে ধাবিত হচ্ছি। আমি ভাবতাম, এই সাধারণ নিষ্পাপ প্রশ্নগুলোর কারণে আমাকে নরকে যেতে হবে কেন? প্রশ্নই তো শিক্ষার দুয়ার খুলে দেয়, আর তাতে বিশ্বাসও পোক্ত হয়। তাহলে এরা প্রশ্ন করতে বাধা দেয় কেন? যাহোক তারা সবাই এ কারণে আমাকে খুব অপছন্দ করত।
জীবনের প্রথম ধাপেই আমি পড়াশুনার বিষয়টি রপ্ত করে ফেলেছিলাম।
ইতিহাস, জীবনী, আত্মজীবনী ইত্যাদি বিষয়গুলো আমার খুব ভাল লাগত। আমি যখন ক্রসেড সম্পর্কে পড়া শুরু করি তখনই প্রথম ইসলাম শব্দটির সাথে পরিচিত হই। শব্দটি উচ্চারণ করতাম ‘ই-স্লাম’, ‘ইস-লাম’, ‘ইসল-আম’ ইত্যাদিভাবে। পরে একদিন গ্রন্থাগারিককে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন উচ্চারণটি হবে ‘ইজলাম’। যুদ্ধের ইতিহাস পড়ার শুরুতেই আমি দেখলাম একপক্ষ গড, যিশু ও পবিত্র আত্মার নামে যুদ্ধ করছে।
আমি চিন্তা করলাম গড তো মানুষ হত্যা করতে নিষেধ করেছেন, অথচ এই পক্ষটি বলছে এটা গডের ইচ্ছারই প্রতিফলন! আরেক পক্ষ যারা মুসলিম তারাও বলছে তারা মানুষ হত্যা করছে আল্লাহর জন্যই। এটা আমার কাছে বিস্ময়কর লাগছিল যে, এসব মুসলিম কেন যুদ্ধ করছে এমন লোকদের বিরুদ্ধে যারা বলছে তারাও স্রষ্টার জন্যই যুদ্ধ করছে?। আমার পড়া বইগুলোতে মুসলিমদের দেখানো হয়েছিল যে তারা মরু থেকে আসা একদল অসভ্য বর্বর লোক, যারা খৃষ্টান ধর্মকে ধবংস করতে চায়। আর যারা ইসলাম গ্রহণ করে না তাদেরকে তারা শিরচ্ছেদ করে দেয়। এ চিত্র মুসলমানদের সম্পর্কে আমাকে ভয়ংকর বিরূপ ধারণা দিয়েছিল।
অন্যদিকে যখন আমি পড়লাম মোঙ্গলদের ইতিহাস যেখানে তারা বোখারা, সমরকন্দ, বাগদাদ, পারস্যের মুসলমানদের উপর নির্মম, নৃশংস আক্রমণ চালিয়েছিল, তখন কিছুটা সহানুভূতিশীল দৃষ্টিতে ভাবছিলাম এখানে মুল কারণটা কী? এরা প্রত্যেকেই কেন মুসলমানদের এত ঘৃণা করে? গড বা যিশুও কি এদের প্রতি এমন ক্রোধন্মত্ত? ত্রিত্ববাদের প্রতি বিশ্বাসটা আমার কখনই ছিল না সেই শৈশবের প্রশ্নের উত্তর না পাওয়ার পর থেকে। এ ইতিহাস পড়ার পর সে বিষয়টি আমার সামনে আবার আসল সাথে আরো কিছু প্রশ্নসহ। শেষপর্যন্ত আমার মনে হল গড এবং যিশুই ছিলেন মূল কারণ যে কারণে এসব নৃশংস যুদ্ধ হয়েছিল।
হাইস্কুলে থাকতে আমি ধর্ম সম্পর্কে মানুষের কাছ থেকে কিছু শোনা বাদ দিয়েছিলাম, আর নিজেও কারোর সাথে এ সম্পর্কে কথা বলতাম না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম একজন স্রষ্টা রয়েছেন এবং কোন একটি ধর্মকে অবশ্যই সঠিক হতে হবে।
কিন্তু সেটা কোনটা? ইহুদী (আমি তাদের সম্পর্কে ও তাওরাত সম্পর্কে পড়েছিলাম এবং বাইবেলের সাথে তার বিবরণ তুলনা করেছিলাম)? না খৃষ্টান (কিন্তু তারা বলে যিশুই হলেন গড, আবার বলে তিনি মানুষ, একটু দাড়াও...তিনিই হলেন, পবিত্র আত্মা। খুবই বিভ্রামিত্মকর!)? না মুসলিম (নাহ! তারা তো খুব ভয়ংকর। কিভাবে স্রষ্টা তাদের সাথে থাকতে পারেন তরবারী নিয়েই যাদের কাজ?)?। এ তীব্র সংশয়ের মাঝে আমি স্রষ্টা সম্পর্কে কথা বলা বন্ধই করে দিলাম। কেননা এ কথা শুনতে শুনতে আমি এতই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম যে, অপরিণামদর্শী ও সমস্যাসৃষ্টিকারী প্রশ্ন উত্থাপনের জন্য আমাকে নরকেই যেতে হচ্ছে।
এরপর আমি কয়েকমাস স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস পর্যন্ত ত্যাগ করেছিলাম। তখন কে ভুল আর কে ঠিক এটা নিয়ে আমি আর চিন্তা করতাম না। আমি শুধু চাইতাম, সবাই নিজেদের মধ্যে এসব নিয়ে গন্ডগোল করুক কিন্তু আমাকে আমার নিজস্ব চিন্তাধারার উপরে ছেড়ে দিক।
জাপানে আমি টোকিওর দ্রুতগতির জীবনে বসবাস করতাম। সপ্তাহ জুড়ে কাজ অতঃপর শুক্র ও শনিবার নাইট পার্টি এবং রবিবার সারাদিন ঘুম এই ছিল আমার জীবন।
আমার দেশী-বিদেশী অনেক বন্ধু ছিল। কেননা টোকিও বিদেশীদের জন্য বেশ আকর্ষণীয় স্থান। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র একজনই ছিল মুসলিম, যে ছিল মিশ্র টার্কিশ-জাপানী। তবে সে আমাকে ইসলাম সম্পর্কে কিছুই বলত না। আমি মুসলিম বলতে বুঝতাম কিছু পাকিসত্মানী বা ইন্দোনেশীয়দেরকে যারা খাওয়ার পর আমার সঙ্গী-সাথীদের মত লাইভ কনসার্ট বা ইজেকায়া দেখতে বসে না, লাঞ্চ ব্রেকের সময় ফেমিরেসু (ফ্যামিলি রেস্ট্যুরেন্ট)-তে মেয়েদের মোবাইল নাম্বার সংগ্রহে ব্যসত্ম হয় না।
আমি তাদের চিনতাম সাইতামা বা সিজোকা এলাকার কিছু ফ্যাক্টরী শ্রমিক হিসাবে। জাপানে মুসলমানদের সাথে পরিচিতি বলতে আমার এতটুকুই।
অতঃপর আমি বাহরাইনে চাকুরীর প্রসত্মাব পাই। বাহরাইন সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। তবুও আমি যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিলাম।
আমার গার্লফ্রেন্ডও আমার সাথে বাহরাইনে এল। আমরা ছিলাম এখানে নব আগন্তুক প্রাণীর মত। আর দেশটিও ছিল আমাদের কাছে নতুন গ্রহের মত। জাপানের সুপার ফাস্ট, অতি আধুনিক লাইফস্টাইলের তুলনায় এখানকার জীবনযাত্রা সবকিছু খুবই ধীরগতির। আমরা দু’জনই খুব বিরক্ত বোধ করতাম।
তবুও আরো কিছুদিন দেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা থেকে গেলাম। এক ছুটির দিনে আমরা ‘আল-ফাতেহ’ মসজিদে বেড়াতে গেলাম। এই মসজিদেই প্রথমবারের মত আমি ইসলামের সরাসরি সংস্পর্শে আসলাম। সেখান থেকে আমি ইংরেজী ও জাপানী ভাষায় অনূদিত কুরআনের কপি সংগ্রহ করলাম। আমার গার্লফ্রেন্ডও সে সময় এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠে।
সেখানকার মুসলিম তরুণীদের বোরকা আর পরিধেয় বস্ত্রাদি তাকে মুগ্ধ করে। ছুটির দিনগুলোতে আমরা আশপাশে প্রচুর বেড়াতাম, দুবাইতেও গিয়েছিলাম অনেকবার। আটমাস সেখানে অবস্থানের পর আমরা জাপান চলে আসার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু চুক্তির মেয়াদ আরো একবছর বর্ধিত হওয়ায় তা সম্ভব হল না। অবশ্য বেশ কিছুদিন পর ছুটি পেয়ে আমরা জাপান যাই।
কিছুদিন থাকার পর পুনরায় বাহরাইন ফেরৎ আসার সময় আমার গার্লফ্রেন্ড আমার সাথে আর এল না। সেখানেই তার সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। আমি অবশ্য এতে খুশিই হলাম। কারণ আমার মনে পড়ে একদিন কোরআন হাতে নিয়ে পড়ার সময় সে আমার হাত থেকে কেডে নিয়ে বলেছিল ‘তুমি এটা পড় না আর প্রতিজ্ঞা করো কোনদিন পড়বে না’ বললাম, ‘কেন? এটা তো শুধুমাত্র একটি বই’। সে বলল, ‘না, আমার ভয় হয় তুমি মুসলিম হয়ে যাবে।
’
যাহোক আমি বাহরাইনে এসে আবার কাজে যোগ দিলাম। এখানে বাহরাইনী যুবকদের সাথে আমার একটা বন্ধু সার্কেলও গড়ে উঠল। আমরা কফি শপ এবং শিসা জয়েন্টগুলোতে একত্রিত হতাম এবং শিসা, কফি, মিন্ট চা ইত্যাদি পান করার ফাঁকে বিবিধ আলোচনায় মত্ত হতাম। ধর্ম নিয়েও মাঝে মধ্যে আলোচনা আসত। তারা ধর্মের বিভিন্ন প্রসঙ্গে যখন বলত, আমি বলতাম যে আমিও এটা জানি।
তারা অবাক হয়ে জানতে চাইতো আমি এটা জানলাম কিভাবে? আমি বলতাম বাইবেল ও তাওরাতেও এর বর্ণনা আছে। তারা অভিভূত হত যে পূর্ব প্রাচ্যের এই জাপানীও বাইবেল ও তাওরাত, খৃষ্টান ও ইহুদী ধর্ম সম্পর্কে জানে। সাথে সাথে আমিও বর্ণিত ঘটনাগুলো যখন কুরআনে আছে জানলাম তখন কুরআনের প্রতি আমার আগ্রহ নিবদ্ধ হল। আমি বাসায় যেয়ে কুরআন নিয়ে বসলাম এবং পড়তে শুরু করলাম। চমৎকার! আমি যেন এক অসাধারণ ইতিহাস বইয়ের মুখোমুখি হলাম।
বিভিন্ন স্থানে আমি এমন অনেক বিষয় পেলাম যার সাথে আমি পূর্ব থেকেই পরিচিত। আমি অন্য দু’টি ধর্মের সাথে ইসলামের গভীর আন্তঃসম্পর্ক খুঁজে পেলাম। এ ঘটনার পর কোন সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই আমি একদিন শৈশবে শেখা সেই প্রার্থনা করা আবার শুরু করলাম। কাজে যাওয়ার সময়, লাঞ্চ ব্রেকের সময়, বাড়িতে ফিরে যখন-তখন আমি প্রার্থনা করতাম। এটা ছিল অনেকটা এখনকার দো’আ করার মত।
দিনে দিনে ইসলাম সম্পর্কে জানার প্রতি আমার আগ্রহ বাড়তে লাগল।
কাঙ্খিত সেই দিনটি- একদিন আমার এক বন্ধুর সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে বললাম, চল আমরা আল ফাতেহ মসজিদ থেকে ঘুরে আসি। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন?’ আমি বললাম, ‘সেখানকার কারো সাথে আমি একটু কথা বলব। ’ সে বলল, ‘তুমি কি নিশ্চিত যাচ্ছ?’ ‘অবশ্যই! আমি বললাম। ’ খানিকবাদে আমরা মসজিদে যেয়ে পৌছলাম এবং সোজা পাঠ কক্ষে প্রবেশ করলাম।
সেখানে পাঠরতদের উদ্দেশ্য করে বললাম, আপনাদের কোন একজনের সাথে আমি একটু কথা বলতে চাই। এই আহবানে সাড়া দিয়ে আমাদের কাছে যে আসলো তার নাম ছিল ফাহদি। আমরা তার সাথে পরিচিত হবার পর সে জিজ্ঞাসা করল আমরা কী জানতে চাই। আমি তাকে বললাম, ‘আমাকে আপনি এমন একটি কমন বিষয়ের কথা বলুন যেটা ইসলাম এবং আহলে কিতাবীদের মাঝে সম্পর্ক নির্দেশ করে। ’ প্রশ্নের উত্তরটি আমার মাথায় আগে থেকেই ছিল; আমি কেবল বুঝতে চেয়েছিলাম যে, সে বিষয়টি কিভাবে ব্যাখ্যা করে।
ফাহদি বলল, ‘নবীদের ধারাবাহিক আগমণই এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ, যদিও ইহুদী ও খৃষ্টানরা কয়েকজন নবীকে অস্বীকার করে। প্রত্যেক নবীই মানুষের নিকট উপস্থিত হয়েছেন এই দা’ওয়াত নিয়ে, তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে এ বার্তা নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন যে, প্রত্যেক মানুষকে আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে, আর এজন্য তাদেরকে মূর্তিপূজা বা আল্লাহর সাথে কারো শরীক স্থাপন করা থেকে বিরত থাকতে হবে নতুবা তাদেরকে জাহান্নামের মুখোমুখি হতে হবে। ’ আমার চক্ষু যেন নতুনভাবে উন্মোচিত হল। হ্যা! তাওরাতের যিশুর মত আমিও যেন বলে উঠলাম, ‘আমি পেয়ে গেছি আমার পথ!’ ‘আমার পিতার কাছে পৌছানোর পথ আমার সামনে উপস্থিত। ’ ঠিক যেভাবে রাসূল (ছা.) বলেছিলেন, ‘আমি পথ পেয়ে গেছি’...‘হ্যা, এটাই সেই পথ’.. ‘আমি আমার পথ পেয়ে গেছি’।
এই সেই পথ যার দিকে মুহাম্মাদ (ছাঃ) সকল জ্ঞানবান নারী-পুরুষকে আহবান জানিয়েছিলেন, ‘হে মানুষ! তোমরা আল্লাহর দিকে ফিরে এস এবং একমাত্র তারই ইবাদত কর। একমাত্র তার কাছেই আত্মসমর্পণ কর। তোমাদের সামনে রয়েছে চিরস্থায়ী এক জীবন। যদি তোমরা তোমাদের প্রভুর আনুগত্য করতে অস্বীকার করে তবে তোমাদের জন্য প্রস্ত্তত রয়েছে জাহান্নামের মর্মন্তুদ শাসিত্ম। ’
অতঃপর ফাহদি আমাকে নিশ্চিত করল যে আমি সত্যিই আমার সেই পথ আবিষ্কার করে ফেলেছি এবং নিজ থেকেই আমি বুঝে ফেলেছি যে, ইসলামই গড তথা স্রষ্টাকে উপাসনা করার সেই কাঙ্খিত সত্য পথ।
আমি তখনই কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করলাম (আলহামদু-লিল্লাহ)। সেদিন থেকে এ পবিত্র পথে আমার যাত্রা শুরু। ইনশাআল্লাহ কখনো এ পথকে আমি হারাব না।
হা হা...বন্ধু! অনেকে বলে, মুহাম্মাদ (ছা.) যা কিছু জেনেছেন তা নাকি ছিল ইহুদী ও খৃষ্টানদের সাথে তার মেলামেশার ফলশ্রুতি। এটা কোন যুক্তির কথা? নাহ্...চিন্তুা করুন, একজন মানুষ সুস্থ মাথায় শুধুমাত্র একটা খেয়ালের পিছনে ছুটতে যেয়ে জীবনের সবকিছু ত্যাগ করে? শুধুমাত্র মানুষকে বোকা বানিয়ে নতুন একটি ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য কোন মানুষ চূড়ান্তভাবে তার মানসিক, শারীরিক পরিশ্রম ব্যয় করতে পারে? কে এমন রয়েছে যে দিনের পর দিন নিজের প্রতি এভাবে আবর্জনা ও উচ্ছিষ্ট নিক্ষেপকে সহ্য করে যাবে? কোন মানুষ নিজেকে নিজের বাসস্থান থেকে, নিজের শহর থেকে বিতাড়িত হওয়া ও রুক্ষ মরুভূমিতে খাদ্য-পানীয় বিহীন অবস্থায় নির্বাসিত হওয়াকে স্বেচ্ছায় বরণ করতে পারে? আর একই ভাগ্য বরণ করার নিশ্চিত সম্ভবনা দেখেও কোন মানুষই বা এমন একটা লোকের অনুসরণ করতে যাবে?
যদি কারো মানুষের মনসত্মত্ব সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান থাকে, সে নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে ফেলেছে এর উত্তর মোটাদাগে ‘না’।
কোন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষ নিজেকে এই কঠিন, অসহনীয় পরীক্ষার মধ্যে ফেলতে পারে না যেভাবে আমাদের রাসূল (ছা.) ফেলেছেন, যতক্ষণ না এই বিশ্বাস তার বুকে বদ্ধমূল হয় যে তিনি যা কিছু নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েছেন, যা কিছুর প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন, যা কিছু জেনেছেন তার সমসত্মকিছুই সত্য সত্যই মহান স্রষ্টা আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত।
এই হল আমার ইসলাম গ্রহণের পর্বটি। ও হ্যা, আমার সেই জাপানী বন্ধুকে বিয়ে করার সুযোগ আমার হয়নি। তবে বিনিময়স্বরূপ সে আমার জন্য সবচেয়ে বড় একটা কাজ করেছে। আর তা হল সে আমাকে যা কিছু বলে কুরআন থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিল তার মাধ্যম দিয়ে আল্লাহ আমাকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন তাকে খুঁজে বের করার।
আলহামদুলিল্লাহ আমি আজ তাকে খুঁজে পেয়েছি...যিনি এই বিশ্বচরাচরের মহান স্রষ্টা, সকল প্রভুর প্রভু, সকল রাজার রাজা। সমগ্র সৃষ্টিরাজি তার কাছে মাথানত করে। তিনি ‘হও’ বলা মাত্রই সকল কিছু হয়ে যায়। হে প্রভু! আমরা কেবলমাত্র তোমারই ইবাদত করি। কেবল তোমার কাছেই আমাদের ফিরে যেতে হবে।
তোমার উর্ধ্বে আর কেউ নেই। তোমার সার্বভৌমত্বে কারো অংশীদারী নেই। তুমি আমাদের সকলকে তোমার পথে অটল রেখে জান্নাতের সুমহান নে‘আমতের অধিকারী হওয়ার তাওফীক দান কর। আমীন!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।