কত আজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই দূরকে করিলে নিকট,বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।
সেদিন বের হয়েছিলাম আদন্দ ভ্রমনে। কত দিন পর বিনা কাজে, বিনা প্রয়োজনে বের হলাম শুধু বেরাবার জন্য। বাচ্চারা বার বার জজ্ঞাস করছে আমরা কোথায় যাচ্ছি, উত্তরে শুধু বলছি --বেরাতে যাচ্ছি,বেরাতে যাচ্ছি। আজ শুধু বেরাবার দিন।
বিকালে রোদ পশ্চীমাকাশে হেলে পরবার সাথে সাথে আমরা বরিয়ে পরলাম। কোন গন্তব্য নেই।
হাইওয়ের পাশে যেখানে থামতে ইচ্ছে করব, সেখানেই নেমে পরবো। যদি চা খেতে ইচ্ছে করে, তবে রাস্তার পাশে আছেইতো চায়ের দোকান। এখানে রাস্তার পাশের চা অসাধারণ।
দুধ চা তো মুখে দিলেই বোঝা যায় এ মালাই চা। দুধ আর চিনিতে ভর্তি । আর র চা সেও অসাধারন। তাতে আদা থাকে আর থাকে চিনির সাথে লবন। আমার বড় মেয়ের ভাষায় স্যালাইন চা।
গাড়ি ছুটে চলছে আপন গতিতে । হিন্দি গান বাজছে গাড়িতে । রাস্তার পাশে বট গাছ দেখে থামলাম । সেই গাছের ঝুল ধরে বাচ্চারা দোলাদুলি করবার চেষ্টা করলো কিছুক্ষন। ওদের হাহা হিহি আমাদের ভুলিয়ে দিল কর্মব্যাস্ত হতাশায় পূর্ন জীবন ক্ষনিকের তরে।
দিগন্ত বিস্তৃত ধানের সবুজ মাঠ আমাদের আবারও গাড়ি থেকে নামতে বাধ্য করল। এরই মাঝে এই দোকান থেকে কেনা শক্ত শক্ত পিঁয়াজু আর এক দোকানের রাবারের মত পুরী সেই সাথে ব্রম্মতালু জলে যাবার মত ঝাল দিয়ে তৈরী আলুর চপ ও মরিচের মরিচি (বেগুনের বদলে এখানে মরিচ ব্যাবহার করা হয়েছে তাই মরিচি) মিষ্টি সিঙ্গারা ও এক দোকানের মালাই চা এক ফ্লাক্স আমাদের ভান্ডারে জমা হয়েছে।
এক জায়গায় কয়েকজন বললো --আপনারা এই রাস্তা দিয়ে যান তা হলে সিঙ্গীমারী দিঘী দেখতে পাবেন। এই দিঘীর পাড়ে অনেক বড় বড় গাছ আছে, সুন্দর মাঠ আছে। অনেক বড় বড় অফিসার ঢাকা থেকে টি, এন, ও অফিসে এসে এই পুকুর দেখতে যায়।
এই পুকুর রামসাগর এর চেয়ে ও বড়।
যেমন কথা তেমন কাজ। আমাদের গাড়ি ছুটলো সিঙ্গীমারী দিঘীর উদ্দ্যেশে। সুর্য তখন পশ্চীমাকাশে প্রায় ডুবে যাচ্ছে। পাখিরা ব্যাস্ত তাদের নীড়ে ফিরবার জন্য।
হয়ত তাদের কারও কারও বাড়ি অনেক দূরে। মাঠ থেকে দলে দলে পাখি উড়ে যাচ্ছে তাদের বাড়িতে। আমাদের চলন্ত গাড়ির গতিও যেন ওদের সাথে গতি মিলিয়েছে।
হঠাৎ একঝাক চড়ুই পাখি কি জানি কি খেয়ালের বশে ছুটে এল হাইওয়ের পানে। হয়তোবা তাদের বাড়ি রাস্তার এপাড়ে কোন বট বা আম গাছে।
আমাদের গাড়িও রাস্তায়। কিভাবে যে কি হল আমাদের গাড়ি সাথে ধাক্কা খেল পাখিগুলি।
আমাদের সমস্বরে আর্তনাদ -এটা কি হল। গাড়ি থামাও, গাড়ি থামাও। গাড়ি থেকে নেমে দেখি পাঁচটি পাখি পরে আছে কাল পীচ ঢাকা রাজপথে- নিস্তব্ধ, নিথর হয়ে।
কোনটার ঠোঁট চুইয়ে লাল রক্ত পরছে কালপথে।
আমার ছোট্ট ছেলেটা তার বাবার হাত ধরে পাখিদের দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো- বাবা বাবা ওরা কি মারা যাচ্ছে,বাবা এই পাখিটা না নিশ্বাঃস নিচ্ছে। বাবা চল হাসপাতালে নিয়ে যাই, বাবা ওরা তো মারা যাচ্ছ্ , বাবা ওরা তো মরে গেল।
ছেলেকে কোলে টেনে নিলাম। দুই হাত দিয়ে আমাকে মেরে চলছে আর চিৎকার করে কাঁদছে- ওরা কেন মরে গেল? ওরা কেন আমাদের গাড়ি দেখলো না।
কত বড় বড় গাড়ি আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে আমরা পাখিদের কাছ থেকে বাচ্চাদের সরাতে পারছিলাম না।
এক সময় ভাবলাম অন্য গাড়ি পাখিগুলিকে চাপা দেবে, এই দৃশ্য দেখার আগেই আমাদের এই স্থান ত্যাগ করতে হবে। তা না হলে বাচ্চারা মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পরবে। তাড়াতাড়ি ছেলে মেয়েদের নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। ছেলের কান্না কিছুতেই থামছে না।
ছোট মেয়েটা শক্ত করে ওর বাবার প্যান্ট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখ ঠিকরে বেড় হয়ে আসছে মনের ক্ষোভ।
অনিচ্ছা সত্বেও গাড়িতে এসে বসলো সবাই। গাড়ি ছাড়বার আগ মুহূর্তে বড় মেয়েটা আবার নেমে গেল গাড়ি থেকে। পাঁচটা পাখি হাতে করে নিয়ে ফিরে এল।
ওর বাবা ওর হাতে একটি পলিথিনের ব্যাগ দিল তাতে সে পাখিগুলি রেখে দিল। আর কোথাও নয় এবার বাড়ি চল। গাড়ি ধীরে ধীরে বাড়ির পথ ধরলো। বাড়িতে এসে ওরা তিন ভাই বোন আর ওদের বাবা মিলে পাখিগুলিকে বাগানে মাটি চাপা দিল।
আমার বাচ্চারা জানে না এই পৃথিবীটা অনেক অনেক নিষ্ঠুর।
এই পৃথিবীতে মানুষ মানুষকে বিনা কারনে খুন করে। অনেকে মৃত্যুর পর সামান্য সম্মানটুকুও পায় না। এই পৃথিবীতে ক্ষমতার লড়াই চলে। এই লড়াই ধর্মের লেবাসে, এই লড়াই রাজনীতির লেবাস্ এই লড়াই জাতীয়তার লেবাসে। এই লড়াই অস্বিত্তের লড়াই, এই লড়াই লালসার লড়াই, এই লড়াই অর্থের লড়াই।
এই পৃথিবী মানুষের রক্তেই সবচেয়ে বেশি স্নাত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।