আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পৃথিবী যাদের ক্যানভাস: আমাজনের সদ্যআবিষ্কৃত জিওগ্লিফিক সভ্যতা

মেঘমুক্ত নীলাভ দিঘীর কবোষ্ণতা খুঁজছে মন!
আমাজনের জ্যামিতিক জিওগ্লিফ,ছবি-ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক আমাজন বেসিনের অভ্যন্তরে কোন সমৃদ্ধশালী অনাবিষ্কৃত সভ্যতা থাকতে পারে সে চিন্তা নতুন কিছু নয়, অনেক অভিযাত্রীই সে আশায় আমাজনের দুর্গম পথ মাড়িয়েছেন, প্রান খুইয়েছেন বিস্তর মানুষ। অনেকে বলেছেন, আমাজনের গভীরে আছে ভীষণ প্রাচুর্যময় এক নগরী-এল ডোরাডো। এল ডোরাডোর খোঁজে কত অভিযাত্রী পুরো দক্ষিণ আমেরিকা চষে বেড়িয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বিখ্যাত অভিযাত্রী পার্সি ফসিটও এদের একজন, যিনি আমাজনের কোথাও গিয়ে শেষমেষ আর ফিরে আসতে পারেন নি,জানা যায় আর্থার কোনান ডয়েল এ অভিযাত্রীর জীবন থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন ১৯১২ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত উপন্যাস লস্ট ওয়ার্ল্ড লিখবার সময়। প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযাত্রী কর্নেল পার্সি ফসিট, যিনি আমাজনের কোথাও গিয়ে আর ফিরে আসেননি, ছবি-উইকিপিডিয়া অবশ্য আমাজনের ভিতরে কোন সভ্যতা বা কোন সমৃদ্ধশালী শহরের অস্তিত্ব রয়েছে তা এতদিন পর্যন্ত লোককথা বা নিছক গালগল্প হিসেবেই জানত সবাই, সত্যিকারের কোন নগরীর খোঁজ তো আর কেউ দিতে পারে নি! আর প্রত্নতাত্বিক বা নৃতাত্ত্বিকরাও এসব উড়ো কথা আমলই দেননি কখনো, তারা সাফ জানিয়ে দিয়ে আসছেন যে, আমাজনের পরিবেশ কোন সভ্যতা বিকাশের জন্য একদমই উপযুক্ত নয়, যাযাবর শ্রেনীর কিছু আদিগোষ্ঠীই এখানকার একমাত্র জনগোষ্ঠী।

কিন্তু স্যাটেলাইট ইমেজিং উন্নত হওয়ার ফলে আর কৃষিকাজের জন্য বৃক্ষনিধনের মাধ্যমে আমাজন বেসিন ক্রমাগত উন্মোচনের কারনে ক্রমাগত আমাজনের অভ্যন্তরে যে এক জিওগ্লিফিক সভ্যতা সদর্পে বিরাজমান ছিল তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। আকাশ-কুসুম কল্পনাবিলাসীদের কথাই যেন টায়ে টায়ে সত্য হয়ে উঠছে এখন,আর এখন এল ডোরাডোর কথা কোন পাগলাটে অভিযাত্রী বলছে না, স্বয়ং নৃতাত্ত্বিক আর প্রত্নতাত্ত্বিকরাই এখন উঠে পড়ে লেগেছে এসব মুখরোচক গল্প শোনাতে। বছরের শুরুর দিকে তাই ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, গার্ডিয়ান সহ কয়েকটি প্রকাশনা ফলাও করে আমাজনের এসব খবর প্রচার করেছে, তবে পুরো বিষয়টা সম্পূর্ণ খোলাসা হতে আরো সময় লাগবে নি:সন্দেহে। কারন জিওগ্লিফ বা মাটিতে খোদাইকৃত যেসব নকশা দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছে ওখানে কোন সভ্যতা ছিল সেসবের সবে মাত্র দশভাগের একভাগ এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান, বাকিটা আমাজনের ট্রপিকাল রেইনফরেস্ট নিজ অভেদ্য গহ্বরে লুকিয়ে রেখেছে। জিওগ্লিফ কি ছোটদের চ্যানেলে মাঝে মধ্যে প্রচারিত নীল বিউক্যানান এর জনপ্রিয় আকাঁআঁকির অনুষ্ঠান আর্ট অ্যাটাক যারা দেখেছেন তারা জানেন এর অন্যতম জনপ্রিয় অংশ হচ্ছে বিগ আর্ট অ্যাটাক।

অর্থাৎ নানা পদের জিনিসপত্র, হতে পারে তা জামাকাপড়,খেলাধূলার সরঞ্জাম এমনকি খাবার দাবার, সেগুলো কোন বিশাল চত্বরে বিছিয়ে নীল লেগে যান কোন বৃহৎ শিল্পকর্মে। তবে নীচ থেকে মোটেও বোঝার উপায় নেই ওখানে অর্থবহ কিছু হচ্ছে কি না, ক্রেন দিয়ে অনেক উপরে ক্যামেরা বসিয়েই কেবল বোঝা যায় নীচে চমৎকার কোন আঁকাআঁকি হচ্ছে। এসবের জন্য নীল বিউক্যানান এর যে বিশাল আয়োজন তা চোখে পড়ার মত, এক ক্রিসমাসের এপিসোডে আকাঁআকিঁর জন্য বেছে নিয়েছিলেন পুরো নিউ ইয়র্ক শহরটাকেই-বহুতল ভবনগুলোর অ্যাপার্টমেন্টগুলোর লাইট জ্বালিয়ে-নিভিয়ে তৈরি করেছিলেন বিশাল এক ক্রিসমাসের চিত্রকর্ম! আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষদের এমনই একধরনের মাটিতে,মালভূমিতে বা পাহাড়ে তৈরি চিত্রকর্মই হল জিওগ্লিফ,তবে সেসব দেখতে শুনতে এত বিশাল আকৃতির যে কোন বিগ আর্ট অ্যাটাক সেসবের ধারে কাছেও রাখা যায় না, আর এসবে মূলত জ্যামিতিক, জ্যোতিঃশাস্ত্রীয় বা ধর্মতাত্ত্বিক গুরুত্বসম্পন্ন ছবি বা নকশা বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। জিওগ্লিফ শব্দটি একটি প্রত্নতাত্ত্বিক শব্দ, গ্রিক গ্লিফ (glyph)শব্দের আভিধানিক অর্থ খোদাই করা বা চিহ্নিত করা; যেমন বহুল পরিচিত মিশরীয় লিখন পদ্ধতি হায়ারোগ্লিফ শব্দটি তৈরি হয়েছে গ্রিক হায়ারো (hiero,অর্থ পবিত্র বা ঐশ্বরিক) শব্দের সাথে এ শব্দ জুড়ে। একই ভাবে গ্রিক জিও (geo),যার অর্থ ভূমি বা পৃথিবী, এর সাথে গ্লিফ যুক্ত হয়ে তৈরি হওয়া এ শব্দের মানে দাঁড়ায় ভূমিতে খোদাইকৃত কোন নকশা বা আকিঁবুকি।

পেরুর জিওগ্লিফিক সভ্যতা আমাজনের জিওগ্লিফ সভ্যতা আলোচনার আগে একই মহাদেশে অবস্থিত পেরুরু জিওগ্লিফ গুলো একটু আলোচনা করা যাক। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় জিওগ্লিফিক সভ্যতা হল পেরুর নাজকা সভ্যতা, কিম্ভূতকিমাকার সব ফিগারের জন্য নাজকা অঞ্চলের সেসব একেকটা নকশা পেরুর অন্যতম দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। ১৯৩৯ সালের কোন এক রৌদ্দোজ্জ্বল দিনে পেরুর মরুময় মালভূমির উপর দিয়ে প্রথম কোন এক পাইলট ছোট এক প্লেনে করে উড়ে যাচ্ছিলেন, মাটি থেকে অনেক উঁচুতে উঠবার পর নীচে তাকিয়ে হঠাৎ তিনি ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন, তার পরিচিত নাজকা অঞ্চল উপরে থেকে এমন দেখাতে পারে তা তিনি স্বপ্নেও যে ভাবেন নি তা বলা বাহুল্য। শত শত মাইলব্যাপী মরুময় এই দক্ষিন পেরুকে যেন কেউ বেছে নিয়েছে তার আকাঁআকিঁর বিশাল ক্যানভাস হিসেবে, বিশাল হামিং বার্ড, তিমি মাছ, কনডোর বা বৃহৎ শকুন, মাকড়শা, কুন্ডলী পাকানো লেজ বিশিষ্ট বাঁদর,শত শত জ্যামিতিক ফিগার,নকশা আর নানা ধাচেঁর অদ্ভূত আর কিম্ভূত সব আঁকাআঁকিতে ভরপুর পুরো অঞ্চল। প্রায় দুহাজার বছর পুরনো এসব চিত্রকর্ম মানুষের কাছে এতদিন অজানাই থেকে গেছে কেননা মাটি থেকে অনেক উপরে না উঠলে এসবের অস্তিত্ব বোঝাটা একেবারেই অসম্ভব।

বৃহৎ মাকড়শা বিশাল হামিং বার্ড কারা কি প্রেরণায় এসব বৃহৎ কর্মে নিজেদের নিয়োজিত করেছিল তা আজ পর্যন্ত প্রাচীন সভ্যতার একটি অন্যতম অমিমাংসিত রহস্য, এসব বৃহৎকাজের জন্য যে সুদক্ষ পরিকল্পনা ও যান্ত্রিক সহায়তা দরকার তা তারা কিভাবে অর্জন করল,তার উত্তর আজও প্রত্নতাত্ত্বিকরা খুঁজে ফিরছেন। ডিসকভারি চ্যানেলের এ বছর শুরু হওয়া ‘সলভিং হিসট্রি উইদ অলি স্টিড’ ডকুমেন্টরিটির দ্বিতীয় এপিসোডটি ছিল নাজকা লাইন নিয়ে, এতে অলিভার স্টিডের উপস্থাপনায় এসব লাইনের ব্যাখ্যার অনেক সম্ভাবনার মধ্যে যেটা অন্যতম হিসেবে প্রকাশ পায় তা হল এগুলো ভিনগ্রহবাসীদের কাজ! নভোচারী বা এলিয়েনের আকৃতির নাজকা জিওগ্লিফ জাপানি এন এইচ কে চ্যানেলের এক ডকুমেন্টরির ভাষ্যমতে এটা আর কিছুই নয়, বৃষ্টির প্রার্থনার জন্য তৈরি করা নকশা আর পানিপ্রবাহের খাড়ি। এছাড়া আরো অনেক তত্ত্ব চালু আছে,তবে কোনটা সত্য সেটা বোঝার সত্যিকারের কোন উপায় নেই। আমাজনের জিওগ্লিফ আমাজনের যেসব জিওগ্লিফ এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে সেসবের সাথে পেরুর নাজকা লাইনের কোন মিল নেই। অর্থাৎ একই মহাদেশে হলেও এ দুই সভ্যতার মধ্যে কোন আন্ত:সম্পর্ক ছিল না, আমাজনের মাটিতে আঁকা নকশাগুলো অধিকাংশই জ্যামিতিক ফিগার,বৃত্ত, পঞ্চভুজ,ষড়ভূজ আর একটার সাথে দীর্ঘ লাইন দ্বারা আরেকটার সংযুক্তি রয়েছে,এভাবে তৈরি হয়েছে বিশাল নেটওয়ার্ক, ছড়িয়ে গেছে তা আমাজনের উচ্চভূমি থেকে একেবারে জলাভূমিতে।

এরই মধ্যে তাদের গঠন-আদল দেখে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক আন্তর্জাতিক জার্নাল অ্যান্টিকুইটি ঘোষনা দিয়েছে এটি একটি অত্যাধুনিক প্রি-কলাম্বিয়ান মনুমেন্ট তৈরিকারি জনপদ। আমাজনের এই জিওগ্লিফিক সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করছেন ব্রাজিলের নৃতাত্ত্বিক ডেনিস স্ক্যান ,ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আমাজন সম্পর্কে এতদিন যে ধারনা ছিল তা পরিবর্তন হতে যাচ্ছে এসব আবিষ্কারের দরুন, কেননা এতদিন ভাবা হত আমাজনের মাটিতে কোন জনপদ টিকিয়ে রাখার মত কৃষিকাজ মোটেও সম্ভব নয়। আর এ আবিষ্কার যেন শেষ হবার নয়,প্রতিসপ্তাহেই তারা নতুন নতুন কাঠামোর সন্ধান পাচ্ছেন। গুগল আর্থ ইমেজ এ সভ্যতার বৃহৎ পরিসর দেখে অবাক হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট গবেষকরা, আমাজনের ভিন্ন ভিন্ন বাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশ সম্পন্ন নিম্নভূমি থেকে শুরু করে উচ্চভূমি পর্যন্ত বিরাট এর বিস্তৃতি। এসব জিওগ্লিফগুলোর আকার আকৃতিও একই রকম এবং একই ধাঁচের,তারমানে নি:সন্দেহে একই সভ্যতার মানুষের তৈরি।

ডেনিস স্ক্যান এর ভাষ্যমতে,আমাজনের প্রত্নতাত্ত্বিক-প্রেক্ষিতে কারো মনে হওয়াটা স্বাভাবিক যে বিভিন্ন ইকোসিস্টেমে ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠী বিরাজমান থাকবে,তাই এটা খুবই তাৎপর্যময় যে একই সংস্কৃতির লোকজন সবধরনের ইকোসিস্টেমে অভ্যস্ত হয়ে এত বৃহৎ এক পরিসরে নিজেদের ব্যাপ্তি ঘটিয়েছিল। কোন কোন নৃতাত্ত্বিক আবার তাদের জিওগ্লিফগুলো তৈরির কারিগরি দিক বিবেচনা করে তাদের মিশরের পিরামিড নির্মানকারী সভ্যতার সমকক্ষ মনে করছেন। জিওগ্লিফ নেটওয়ার্ক, ছবি-জার্নাল অ্যান্টিকুইটি তারমানে ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকার মাটিতে পা দেওয়ার বহু আগেই এই মহাবনে এক সমৃদ্ধ সভ্যতার উপস্থিতি ছিল, ধারনা করা হচ্ছে এ সভ্যতার পত্তন হয় খ্রিস্টের জন্মের অন্তত ২০০ বছর আগে। তবে তারা আবার কিভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেল সেটাই ভাবনার বিষয়, ইউরোপীয় উপনিবেশের আমলেই তারা কোন কারনে বিলুপ্ত হয়ে যায়,হতে পারে কোন মহামারি বা ইউরোপ থেকে আসা নতুন কোন রোগের প্রকোপে । সবচেয়ে বিস্ময়কর যে ব্যাপারটা তা হল এত বৃহৎ এক জনগোষ্ঠী এতদিন কিভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেল, ডেনিশ স্কান এর টিম জার্নাল অ্যান্টিকুইটিতে যে রিপোর্ট দিয়েছেন, তাতে তারা হিসাব করে দেখিয়েছেন আমাজনের উচ্চভূমিতে অন্তত ৬০ হাজার লোকের বসবাস ছিল,যা মধ্যযুগের যে কোন ইউরোপীয় শহরের চেয়ে বেশি ঘনবসতি সম্পন্ন, অথচ এতদিন নাকি নৃতাত্ত্বিকগন জানতেন আমাজনের ওসব এলাকায় কোন জনবসতি থাকার সম্ভাবনাই নেই! দক্ষিন আমেরিকায় নাজকাদের পরে নতুন করে এই জিওগ্লিফিয় সভ্যতার খোঁজ প্রাচীন সভ্যতা আর ইতিহাস প্রেমীদের জন্য আগ্রহ আর আলোচনার নতুন কিছু হয়ে উঠতে পারে, বিশ্বব্যাপী চমকপ্রদ খবরদাতা পত্রিকা আর চ্যানেলগুলোও তাই কড়া নজর রাখছে এসব অনুসন্ধানের সর্বশেষ হালনাগাদের দিকে , কারন এমনটা হতে পারে যে পুরো দক্ষিন আমেরিকার ইতিহাসই হয়তো নতুন করে লিখতে বসতে হচ্ছে কিংবা ইনকাদের গুপ্ত শহর মাচোপিচুর মত হয়তো বেড়িয়ে আসতে পারে অন্য কোন শহরের বা জনপদের খোঁজ! তথ্যসূত্র: 1. গার্ডিয়ান 2. ন্যাশনালজিওগ্রাফিক 3. Click This Link এবং অন্যান্য নিউজসাইট ও ব্লগ (আজকে কালের কন্ঠের সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র 'অবাক পৃথিবী'র মূল প্রতিবেদন ছিল লেখাটি, পৃথিবী যাদের ক্যানভাস - এই শিরোনামে।

তবে পত্রিকার স্থান সীমিত হওয়ায় পুরো লেখাটা ফিচারে দেয়া সম্ভব হয় নি, তাই ব্লগে মূল লেখাটি দিচ্ছি)
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।