একটা গাড়ী খুজছি , ব্যাক টু দ্য ফিউচারে যাওয়ার গাড়ীটা খুজছি / তথ্যের অংক , যুক্তির জ্যামিতি
আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ।
অবিভক্ত পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক বড় এবং সম্ভবত ইতিহাসের মোড় ঘোরানো ঘটনা যেহেতু আওয়ামী লীগই পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেয়।
কিন্তু আওয়ামী মুসলিম লীগ কিভাবে আওয়ামী লীগ হলো সেটা শুধু প্রচলিত জনশ্রতিতেই আটকে আছে। তার সত্য-মিথ্যা যাচাই বোধহয় খুবএকটা যাচাই হয়নি।
শোনা কথায় যেটুকু জানা যায় দেশবিভাগের মাত্র ৭ বছর পর হঠাৎ অসাম্প্রদায়িকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ তার নাম থেকে "মুসলিম" নামের ধর্মীয় লেবেলটি সরিয়ে ফেলে।
বিষয়টি এমনও ছিলো না যে বাংলাদেশে তখন বিশাল জনগোষ্ঠী অমুসলিম সম্প্রদায়ের। দেশবিভাগের পর এপার বাংলার হিন্দুদের বিশাল অংশ বাপ দাদার ভিটামাটি-বিষয় আশয় সম্পত্তি ছেড়ে ওপার বাংলায় চলে গিয়েছে।
সুতরাং সমাজে যে অসাম্প্রদায়িকতার রেনেসা তুল্য কিছু হয়েছিলো এমনটা নয়।
তাই আসলেই কি সেরকম কিছু ঘটেছিলো আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম পরিবর্তনে?
আমার বিশ্বাস হয়নি। বিশ্বাস হয়নি বলে জানার চেষ্টা করেছিলাম পেছনের কাহিনী।
আসলে কি ঘটেছিলো?
এর কান্ডারীই বা কে ?
ঢাকঢোল তো খুব পেটানো হয় মুজিববন্দনার - মুজিব ই নাকি এই "ঐতিহাসিক নাম পরিবর্তন" এর নায়ক।
সেই ১৯৫৪ তে মুজিব তখনো রাজনৈতিক অঙগনে ছাত্রনেতা থেকে মাত্র যুবনেতা পর্যায়ে এসেছে তখনই সে কিনা এতবড় একটা ব্যাপার কে সম্ভব করে ফেললো দেশবিভাগের মাত্র ৭ বছর পর!
সাম্প্রদায়িক দ্বেষের বিষাক্ত বাষ্প তখনও উপমহাদেশের বাতাসে ভারী হয়ে আছে।
আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম পরিবর্তন বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান দেখুনঃ "In the backdrop of this, in the initiative of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman"
আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম পরিবর্তন বিষয়ে আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটের বক্তব্য , পৃষ্ঠা ৩ এর শেষ ২ লাইন পড়ুন
শেখ মুজিব স্বয়ং অল ইন্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্ট ফেডারেশনের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে আসেন !
১৯৪৩ এ বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগ দেন , সেভাবেই সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন। দেশবিভাগের পর এই শেখ মুজিবই প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্ট'স লীগ।
অপরদিকে খোন্দকার মোশতাক যাকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া বানিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো পাকিস্তান পন্থী হওয়ার কারনে তিনিও মুসলিম তকমা বিহীন আওয়ামী লীগে ছিলেন জাদরেল নেতা হিসেবে!
এমনকি আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক হওয়ার পরও !
এমনকি যেই মাওলানা ভাসানী এই "ঐতিহাসিক নাম পরিবর্তন" এর সময় আওয়ামী মুসলিম লীগের পুরোধাব্যক্তি ছিলেন তাকেও নেংটি লেজের বর্তমান কিছু বামপন্থী আওয়ামী ঘেষা লোকজন (সৈয়দ বদরুল আহসান , সাংবাদিক , এরকম অসংখ্য ছুপা ভাসানীবিরোধী ইতর আওয়ামী লীগে এবং বামদল গুলোতে লুকিয়ে আছে ) সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিতে চায়!
হয়তো তার টুপি দাড়ির জন্যই !
তাহলে চলুন জানা যাক সেই অজানা কাহিনী !
শুরুতেই দেখাযাক আওয়ামী মুসলিম লীগ কিভাবে গঠিত হয়েছিলো ।
১৯৪৯ এর ২৩ শে জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় নারায়নগন্জ্ঞর কে এম দাস লেনের রোজগার্ডেনে ১ শ্রমিক সমাবেশে মুসলিম লীগের দম্ভের জবাব দেয়ার জন্য।
মুসলিম লীগ দাবি করেছিলো তারাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার নেতৃত্বদান কারী একমাত্র বৈধ রাজনৈতিক দল।
এর প্রেক্ষিতে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী যিনি আসাম মুসলিম লীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন মহাসমাবেশ আহ্বান করেন।
সেই মহাসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান
এবং সেই সমাবেশেই সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হ্য়।
মাওলানা ভাসানী হন দলের প্রেসিডেন্ট , আতাউর রহমান ভাইস-প্রেসিডেন্ট , সামসুল হক সাধারন সম্পাদক , শেখ মুজিবুর রহমান ও খোন্দকার মোশতাক আহমেদ হন যুগ্ম সম্পাদক এবং ইয়ার মোহাম্মদ হন কোষাধক্ষ্য।
ছবিঃ রোজ গার্ডেন
যাইহোক এটুকু অনেকটা ভূমিকার মত বলে নিলাম ।
আসল কাহিনীতে এবার যাচ্ছি।
পাকিস্তানবাসী হিন্দু সম্প্রদায়ঃ
অবিভক্ত পাকিস্তানের মোট হিন্দুর বড় সংখ্যক অংশের বাংলাদেশে বসবাস দেশভাগের পর থেকেই । সংখ্যালঘুদের প্রতি ১৪ জনে ১৩ জন হিন্দু। লোকসংখ্যার অনুপাতে সংখ্যালঘু হলেও অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক পরিমন্ডলে হিন্দুরা মোটেই প্রভাব লঘু ছিলোনা।
তবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মুসলিম সত্ত্বা এবং দেশ বিভাগের পর সাম্প্রদায়িক তিক্ততা (কলকাতায় হিন্দু - মুসলিম দাঙ্গা) এসব কারনে হিন্দুরা পাকিস্তানে নিরাপত্তা বোধ করতো না।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি হিন্দুদের অবস্থান হিসেবে দেশবিভাগ পুর্ববর্তী পূর্ববঙ্গ কংগ্রেস নেতা প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ী র মন্তব্য কে উল্লেখ করা যেতে পারে।
স্বাধীনতার প্রথমদিনের স্মৃতিচারন করে প্রভাস লাহিড়ী তার নিজ শহর রাজশাহীতে শোকাতর ভাবে বলেনঃ
" আমি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলাম । দুঃখজনক ভাবে আমি আর ভারতীয় নই , আমি এখন পাকিস্তানি , আমাকে এই অপমান মেনে নিতে হচ্ছে। "
কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলী অব পাকিস্তানে বিরোধী কংগ্রেস পার্টির নেতা কিরণ শংকর রায় (সম্ভবত তেওটার জমিদার , তার ভাতিজা কুমার শংকর রায় ও রাজনীতিবিদ ছিলে)স্বীকার করেন যে ভারত এবং বাংলার বিভক্তি নিয়ে তারা খুশী নন।
এছাড়া এস সি চট্টোপাধ্যায়ের মত কংগ্রেস নেতা কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলী অব পাকিস্তানে জয়েন্ট ইলেকটোরেট দাবী করেছিলেন।
এছাড়াও আমাদের মহান মাতৃভাষার দাবী ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলীতে ১৯৪৮'র ২৩ শে ফেব্রুয়ারী তুলেছিলেন কুমিল্লার ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত।
এভাবে রাজনৈতিক , সামাজিক , অর্থনৈতিক -সাংস্কৃতিক সবক্ষেত্রেই হিন্দুরা সচেতন ছিলো যাতে ধর্মীয় চেতনার পাকিস্তানে তারা যাতে টিকে থাকতে পারে।
এটিই আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম পরিবর্তনের সবচেয়ে বড়প্রেক্ষিত।
তাই বলে নিলাম আগেই।
এবার আসল অংশে যাওয়া যাক।
কিভাবে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে " মুসলিম " বিয়োগ হয়ে আওয়ামী লীগ হলো ?
১৯৫৪ এর মার্চে ঐতিহাসিক প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সাবেক পুর্ব পাকিস্তানে।
১৯৫৩ 'র ১৪ ই নভেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব তোলা হয় সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী এবং শেরেবাংলার মধ্যকার নির্বাচনী ঐক্যের ভিত্তিতে।
এই নির্বাচন হয় ২১ দফার উপর ভিত্তি করে যেখানে প্রতিরক্ষা , পররাষ্ট্র এবং মুদ্রানীতির অটনোমী দাবী করা হয় পুর্ব পাকিস্তানের জন্য এবং রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি দাবী করা হয়।
নির্বাচনে জয়লাভ করে যুক্তফ্রন্ট যেখানে শেরেবাংলার কেএসপি (কৃষক শ্রমিক পার্টি ১৯৫৩ 'র ২৩ শে জুলাই প্রতিষ্ঠিত , তবে এর ভিত্তি ছিলো ১৯৩৭ এ গঠিত শেরেবাংলার কৃষক প্রজা পার্টি , কেপিপি নামের দল) এবং ভাসানী , সোহরাওয়ার্দী ও আরো অন্যান্য দল একজোট ছিলো।
শেরেবাংলা এবং সোহরাওয়ার্দী এর মধ্যে রাজনৈতিক স্বার্থগত বিরোধ ছিলো এটা সর্ববিদিত।
এই নির্বাচনেই যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে "নৌকা" কে প্রথমবারের মত ব্যবহার করে।
এইজোট ছিলো মুলত পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর দাপুটে মুসলিম লীগার দের জন্য চ্যালেন্জ্ঞ।
যাইহোক প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জেতে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২২৭ টি আসন এবং মুসলিম লীগ জেতে মাত্র ৯টি আসন। ২৩৭ টি আসনের ভেতরে ৯ টি ছিলো মুসলিম মহিলা আসন।
এডিশন ২ : ৩রা মে , ২০১০:
সূত্রঃ পাকিস্তানের ঘটনাপন্জ্ঞী , খুররম আলী।
নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদে আসন ছিলো মোট ৩০৯ টি।
৩০ টি ছিলো হিন্দু আসন ,
১ টি ছিলো হিন্দু মহিলা আসন ,
৩৬ টি ছিলো Scheduled caste (বাংলা শব্দার্থ খুজে মনে হলো নিম্নবর্ন সম্প্রদায় বা দলিত এই রকম কিছু , নিশ্চিত নই ) আসন ,
২টি ছিলো Scheduled caste মহিলা আসন ,
১টি খ্রীস্টান আসন এবং
২ টি বুদ্ধ আসন।
সর্বমোট অমুসলিম আসন ছিলো ৭২ টি। যাদের নেতৃত্ব দিতো মূলত পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস যেটি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের পাকিস্তান ভার্সন।
১৯৫৪ প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের এই সংখ্যাতত্ত্বটি জানিয়ে রাখলাম কারন এটিই এই ব্লগের Key Information / Turning point.
সুতরাং খুব পরিষ্কার ভাবেই বোঝা যাচ্ছেঃ অমুসলিম আসন গুলো খুব সহজেই সরকার গঠনে নির্নায়ক ভূমিকায় থাকবে যদি যুক্তফ্রন্টের ভেতরে বিরোধ তৈরী হয় এবং শেরেবাংলা বা সোহরাওয়ার্দী কোন ফ্রন্ট এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ না হয়।
এই নির্বাচনে কোমর ভেংগে যাওয়া মুসলিম লীগ আর কোনদিন পুর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে সোজা হয়ে দাড়াতে পারেনি।
সোহরাওয়ার্দী এবং ভাসানী নির্বাচনে অংশ নেননি এবং নির্বাচন বিজয়ের পর শেরেবাংলাকে সরকার গঠনের আহ্বান জানান।
শেরেবাংলা - সোহরাওয়ার্দী সমঝোতার পর ১৪ সদস্যের কেবিনেটে ৫ জন নেয়া হয় সোহরাওয়ার্দী মনোনীত।
১৯৫৪ 'র এপ্রিলে শেরেবাংলা কে মুখ্যমন্ত্রী করে প্রাদেশিক সরকার গঠিত হয় এবং সেই মন্ত্রীসভায় শেখ মুজিব কে প্রাদেশিক বানিজ্য মন্ত্রী (মতান্তরে কৃষি এবং বন মন্ত্রী) করা হয়।
শেরেবাংলার সেই কেবিনেটে ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ও ছিলেন।
কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকরা যুক্তফ্রন্টের এই বিজয় মেনে পারেনি এবং তারা সরকার গঠনের ২ মাসের মাথায় ২৯ শে মে ১৯৫৪ তে যুক্তফ্রন্ট সরকার কে ডিসমিস করে আর্টিকল 92A এর অজুহাত তুলে।
শেরেবাংলা কে অভিযুক্ত করা হয় "পাকিস্তান বিভক্তির ষড়যন্ত্রকারী বিশ্বাসঘাতক " হিসেবে।
ছবিঃ শেরেবাংলা মন্ত্রীত্ব গ্রহনের শপথ পাঠ করাচ্ছেন ধীরেন্দ্র নাথ দত্তকে।
এডিশন ১: ২রা মে , ২০১০:
সূত্রঃ পাকিস্তানের ঘটনাপন্জ্ঞী , খুররম আলী।
শেরেবাংলাকে মুখ্যমন্ত্রীত্ব চ্যুত করার কারন হিসেবে দেখানো হয় ২৩শে মে ১৯৫৪ তে " নিউইয়র্ক টাইমস " এ প্রকাশিত একটি মন্তব্যকে যেখানে " আমার মন্ত্রীসভার ১ম কাজ হবে পূর্ববাংলার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা " বলে শেরেবাংলাকে উদ্ধৃত করা হয়।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন নিউইয়র্ক টাইমস প্রতিনিধি জন পি ক্যালাগান (John P Callaghan)।
শেরেবাংলা এই বক্তব্য তার নয় বলে জোর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং তার বক্তব্যকে বিকৃতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে বলে দাবী করেছিলেন।
ব্যক্তিগতভাবে আমার সন্দেহ- পাকিস্তানী মুসলিম লীগাররা জন পি ক্যালাগানকে দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত সংবাদ ছাপিয়েছিলো যাতে শেরেবাংলার কেবিনেটকে বাতিল করার ছুতা পাওয়া যায়।
কারন যুক্তফ্রন্টের ভুমিধ্বস বিজয় আর ইস্ট বেংগল মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় পশ্চিম পাকিস্তানী মুসলীম লীগারদের জন্য ছিলো ১টি চরম অপমানকর চপেটাঘাত।
মূল ঘটনাটি ছিলোঃ
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ৩ এপ্রিল , ১৯৫৪ তে শেরেবাংলা মেডিক্যাল চেকআপের জন্য কলকাতা যান তার প্রিয় বন্ধু ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের কাছে। বিমানবন্দরে "হক সাহেব অভ্যর্থনা কমিটি" তাকে বিপুল জনসমাগম এবং সম্বর্ধনার সাথে স্বাগত জানায়। শেরেবাংলা কলকাতায় আসতে পেরে কিছুটা আবেগ আপ্লুত হয়ে যান।
তিনি বলেন- চিকিৎসা তার কলকাতা আগমনের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। কলকাতায় তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কেটেছে।
তিনি এসেছেন দেশবিভাগের শরনার্থীদের উন্নত অবস্থার নিশ্চয়তা দিতে যাতে করে তারা (হিন্দুরা) তাদের ফেলে আসা বাসভূমিতে ফিরে যান। তিনি চান যাতে ২ বাংলার মধ্যকার বুদ্ধিবৃত্তিক , সাংস্কৃতিক আর শিক্ষাগত সম্পর্ক স্থাপন হয়।
এটি পাকিস্তানীদেরকে ক্ষুব্ধ করে সবচেয়ে বেশী। কারন জুলফিকার আলী ভুট্টো সবসময় বলতেন পূর্ব বাংলার মুসলিমরা হিন্দু শিক্ষক - বুদ্ধিজীবিদের কাছে শিক্ষা লাভ করে।
এটাকে তিনি পাকিস্তানের অখন্ডতার জন্য হুমকি মনে করতেন।
ভুট্টো এটাকে বলতেন "হিন্দু ইন্টেলেসিয়া" বা "ফিফথ কলামিস্ট"।
এছাড়া বাংলাদেশে বসতবাড়ি ফেলে আসা শরনার্থী হিন্দুদের কে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য শেরেবাংলার উদারতাকে পাকিস্তানীরা ভালো চোখে দেখেনি। কেননা দেশবিভাগের পর হিন্দুদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি অবাঙালী (বিহারীদের )মাঝে বন্টন করা হয়।
এটি ১ টি কারন যেজন্য ১৯৫৮ তে ইস্ট বেঙ্গল নামটি বদলে ইস্ট পাকিস্তান নামকরন করে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির দন্ড মুন্ডের কর্তারা।
এর মধ্যেই শেরেবাংলা জন পি ক্যালাগানের কাছে সাক্ষাৎকারটি দিয়ে ফেলেন যা বিকৃতভাবে প্রকাশ করা হয়।
এছাড়া মে ১৯৫৪'র ৩য় সপ্তাহে আদমজী জুট এবং পূর্ববাংলা জুড়ে অন্যান্য মিলে বাঙালী - অবাঙালী শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় যেখানে প্রচুর অবাঙালী শ্রমিক হতাহত হয়।
শেরেবাংলাকে নিউইয়র্ক টাইমস এ তার মন্তব্যের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য প্রাইম মিনিস্টার মোহাম্মদ আলী বোগড়া এবং গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ সামন জারী করেন।
শেরেবাংলা করাচী যান তার ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য , কিন্তু তারা ঐ ব্যাখ্যা সন্তুষ্ট হয়নি।
৩১ মে , ১৯৫৪ তে গভর্নর রুল জারী করেন এবং প্রাইম মিনিস্টার মোঃ আলী বোগড়া রেডিওতে ভাষন দেন শেরেবাংলাকে "ট্রেইটর টু ইস্ট বেংগল" ঘোষনা করে।
সূত্রঃ বাংলাদেশে হিন্দুদের দুর্দশার কাহিনী - রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী
এই সূত্রের লেখক নিজেও ১ জন হিন্দু।
সুতরাং পরিষ্কার বোঝাযাচ্ছে কলকাতায় এবং প্রমিনেন্ট হিন্দু সমাজের কাছে শেরেবাংলা কতটা সমাদৃত ছিলেন। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দীর এই অবস্থান একেবারেই ছিলোনা। বরন্চ্ঞ ব্রিটিশ রাজের অধীনে সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালেই ১৯৪৬ এর ভয়াবহ কলকাতা দাঙ্গাটি ঘটে।
শেরেবাংলা যখন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখনো তিনি কলকাতার তথা পশ্চিম বাংলার হিন্দু সমাজের কাছে অত্যন্ত সমাদৃত ছিলেন। ১৯৫৪ এর নির্বাচন বিজয়ের পর কলকাতা সফরে তার প্রাপ্ত অভ্যর্থনাই তা প্রমান করে।
এই অংশটুকু আরেকটি " মূল বিষয় " আওয়ামী মুসলীম লীগের নাম পরিবর্তনে।
১৯৫৪ 'র অক্টোবরে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলী অব পাকিস্তান ডিসলভড করেন এই কারন দেখিয়ে যে গত ৭ বছরেও সংবিধান রচিত হয়নি।
যুক্তফ্রন্ট নেতারা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান , কারন তাতে তাদের কেন্দ্রীয় সরকারে অংশীদারিত্বের সম্ভাবনা ছিলো।
এরইমধ্যে শেরেবাংলা এবং সোহরাওয়ার্দীর মধ্যকার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দীতাকে গোলাম মোহাম্মদ কাজে লাগান একের বিরুদ্ধে অন্যকে খেলিয়ে।
ইস্ট বেংগল ল অ্যাসেম্বলীর পুনর্চালু করা এবং 92A উইথড্র করার সম্ভবনা দেখা দেয় তখন।
শেরেবাংলার ফ্রন্ট এবং সোহরাওয়ার্দীর ফ্রন্ট উভয়ই কেন্দ্রীয় সরকারে প্রধানমন্ত্রীত্বের জন্য প্রতিদ্বন্দীতা করছিলো।
সোহরাওয়ার্দীর ফ্রন্ট প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ (১৪৩ টি মুসলিম আসন) ছিলো এবং তার জোরে মুখ্যমন্ত্রীত্ব দাবী করেছিলো যুক্তফ্রন্ট সরকারে।
শেরেবাংলার ফ্রন্টের ছিলো ৪৮টি আসন এবং নিজাম-ই-ইসলামর ২২ টি ও গনতন্ত্রী দলের ছিলো ১৩ টি আসন যারা শেরেবাংলাকে সমর্থন দিয়েছিলো। স্বতন্ত্র ৮ জন অ্যাসেম্বলী মেম্বারও শেরেবাংলাকে সমর্থন দিয়েছিলো।
সেই প্রেক্ষিত থেকে সোহরাওয়ার্দী ফ্রন্ট শেরেবাংলার বিপক্ষে অনাস্থা প্রস্তাব করে , তবে পরিষদের হিন্দু সদস্যদের শেরেবাংলার প্রতি সমর্থনের কারনে সেই প্রস্তাব পাস হয়নি।
কেননা হিন্দু প্রভাবিত পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস অ্যাসেম্বলীর অমুসলিম ব্লকের ৭২ জন মেম্বারের নেতৃত্ব দেয়।
এসময় আরেক রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ আলী বোগড়া (বগুড়ার নবাব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত) রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আসেন এবং যুক্তফ্রন্টের এই বিরোধ কে কাজে লাগান।
মোহাম্মদ আলী বোগড়া এই রাজনৈতিক মারপ্যাচে যোগ দেয়ার মূল উদ্দেশ্য তার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রীত্ব টিকিয়ে রাখা।
গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ খাজা নাজিমউদ্দীন কে প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে ডিসমিস করার পর এপ্রিল ১৭ , ১৯৫৩ তে মোহাম্মদ আলী বোগড়া পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
১৯৫৪ তে গোলাম মোহাম্মদ কনস্টিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলী অব পাকিস্তান ডিসলভড করার পর যুক্তফ্রন্টের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা দেখা দেয় সেটা আগেই বলেছি।
১৯৫৪ তেই মোহাম্মদ আলী বোগড়া প্রাইম মিনিস্টারের অফিসে রিসিউম করেন এবং "মিনিস্ট্রী অব ট্যালেন্ট" নামে তার মন্ত্রীসভা গঠন করেন।
তাই মোহাম্মদ আলী বোগড়া চাইতেন শেরেবাংলা এবং সোহরাওয়ার্দীর ভেতরকার বিরোধ চলতে থাকুক এবং যুক্তফ্রন্ট কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসতে না পারুক।
তবে শেষ রক্ষা হয়নি। গোলাম মোহাম্মদের পরবর্তী গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা মোহাম্মদ আলী বোগড়াকে ১৯৫৫ তে প্রধানমন্ত্রীত্ব চ্যুত করেন এবং পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত করে পাঠান।
যাইহোক শেরেবাংলা- সোহরাওয়ার্দীর বিরোধের মারপ্যাচ সত্ত্বেও
শেষপর্যন্ত শেরেবাংলা মনোনীত আবু হাসান সরকার কে মুখ্যমন্ত্রীত্ব দেয়া হয়।
প্রাদেশিক পরিষদের হিন্দু সদস্যরা গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করেন আবু হাসান সরকার মন্ত্রীসভা গঠনে।
প্রাদেশিক পরিষদের সংখ্যালঘু ব্লকের ৭২ জন সদস্যের (পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ছিলো ২৪ টি আসন) সমর্থন ছাড়া আবু হাসান মন্ত্রীসভা গঠিত হতে পারতোনা কিছুতেই।
পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্বে অমুসলিম ব্লকের শেরেবাংলাকে সমর্থন প্রাসংগিকতায় ২টি কথা জানিয়ে রাখা দরকার ১৯৩৫ এ শেরেবাংলা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রসের সমর্থনে কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হন এবং দেশবিভাগের পর জিন্নাহ শেরেবাংলাকে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করেন।
যাইহোক আবু হাসান সরকারের সেই মন্ত্রীসভায় ৩ জন ছিলো অমুসলিম ব্লক থেকে।
মন্ত্রীসভাটি ছিলো নিম্নরূপ:
১.আবু হোসেন সরকার - মুখ্যমন্ত্রী
২.সৈয়দ আজিজুল হক
৩.আশরাফউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী
৪.সৈয়দ মোস্তাগাউসুল হক
৫.গিয়াস উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী
৬.গিয়াসউদ্দিন আহমেদ
৭.হাজী মোঃ নবী চৌধুরী
৮.আহমেদ হোসেন
৯.প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ী
১০.মধুসূদন সরকার
১১.মনোরন্জ্ঞন শিকদার
হিন্দুরা সোহরাওয়ার্দী কে সমর্থন না দেয়ার একটা কারন তারা এএমএল নেতাদের কে (বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দী) ১৯৪৬'র কলকাতা দাঙ্গার হোতা মনে করতো।
এই কুখ্যাত দাঙ্গায় ভয়াবহ ধরনের হত্যাযজ্ঞ চলে কলকাতার হিন্দুদের উপর।
কলকাতার সেই ভয়াবহ দাঙ্গার সময় অবিভক্ত বঙ্গ প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সোহরাওয়ার্দী যদিও দাঙ্গা দমনের জন্য তিনি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ঘাম ঝরানো থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত শিয়ালদহ রেস্ট ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনী ডেকে আনা সব চেষ্টাই করেন।
কলকাতা দাঙ্গা বিষয়ে উইকিপিডিয়া
উপরন্তু শেরেবাংলা হিন্দুদেরকে কে আশ্বস্ত করেন সেক্যুলার ডেমোক্রেটিক সংবিধানের ব্যাপারে এবং জয়েন্ট ইলেক্টোরেটের জন্য।
আর এগুলোই ছিলো সেইসব নেপথ্যের ঘটনা যার ভেতর দিয়ে সুপেরিওরিটি অব পলিটিক্যাল ডমিনেন্সের স্ট্র্যাটেজী থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতারা (ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী) বুঝতে পারেন হিন্দুদের সমর্থন (প্রাদেশিক পরিষদের অমুসলিম ব্লক এবং জয়েন্ট ইলেক্টোরেট) ছাড়া এএমএল কেএসপিকে লড়তে পারবেনা।
অসাম্প্রদায়িকতার রোমান্টিক বুলি আওড়ানোর আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই প্রভাবক ঘটনাগুলোই আওয়ামী মুসলিম লীগের নামপরিবর্তনের আসল সমীকরন।
নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত এবং ১৯৫৪ 'র নির্বাচন: আফটার ম্যাথ / এর পর কি ঘটলো ? :
কেবল নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্য কখনোই পুরোপুরি ফলপ্রসু হবেনা যতক্ষননা জয়েন্ট ইলেক্টোরেট চালু হচ্ছে।
কারন জয়েন্ট ইলেক্টোরেট ছাড়া আওয়ামী লীগ কেবলই মুসলিম আসন গুলোতে নির্বাচনী প্রতিদন্দ্বীতা করতে পারবে যেটা হয়েছিলো ১৯৫৪ এর ৮ই মার্চের নির্বাচনে।
জয়েন্ট ইলেক্টোরেট ছাড়া নির্বাচনে মুসলিম ভোট মুসলিম আসনের জন্য এবং অমুসলিম ভোট অমুসলিম আসনের জন্য।
নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রাথমিকভাবে যে সুবিধাটি পেতে চেয়েছিলো সেটি হলো অমুসলিম ব্লকের অ্যাসেম্বলী মেম্বারদের সাথে অলিখিত মিত্রতা তৈরী করা(Giving a signal of amity to bag their support) যাতে করে যুক্তফ্রন্টের লাগাম তাদের হাতেই থাকে।
নাম পরিবর্তনের সত্যিকার ক্যাপিটালাইজেশন হিসেবে হিন্দু ভোট নিজেদের ব্যালটে পাওয়ার একটাই রাস্তা।
সেটা হলো জয়েন্ট ইলেক্টোরেট সাংবিধানিক ভাবে চালু করা।
প্রাদেশিক পরিষদের হিন্দু সদস্যরাও জয়েন্ট ইলেক্টোরেটের দাবীতে একাট্টা ছিলেন। তাদের সমর্থন পাওয়াও আরেকটি প্রত্যক্ষ কারন যেজন্য আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের নতুন সংবিধানে জোরালোভাবে জয়েন্ট ইলেক্টোরেট দাবী করে।
হিন্দু সদস্যরা এটা জোরালো ভাবে চাইতেন কারন এতে নির্বাচনের মুসলিম প্রার্থীরা সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দুদের ভোটের উপর জোর দিতে বাধ্য হতেন,প্রাদেশিক বা কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় যাওয়াটা অমুসলিম ভোটের উপর নির্ভরশীল হত, ফলশ্রুতিতে তাদের প্রতি দায়বদ্ধতা আসতো। এর ফলে আওয়ামী লীগ খুব দ্রুত হিন্দুদের সমর্থন লাভে সফল হয়।
প্রাদেশিক পরিষদের অমুসলিম ব্লক আবু হাসান সরকারের মন্ত্রিসভার উপর থেকে সমর্থন তুলে নেয় এবং যুক্তফ্রন্ট সরকার ব্যর্থ হয়।
এখানে অনেক বড় ১ টি সত্য যেটি আওয়ামী লীগ ধামাচাপা দেয় সেটি হলো - নামপরিবর্তনের সিদ্ধান্ত ১৯৫৩ 'র ২১-২৩ অক্টোবর রূপমহল সিনেমা হলের দলীয় কাউন্সিলে নিলেও সেটি তখনো কার্যকর হয়নি। শুধুমাত্র অ্যাসেম্বলীর অমুসলিম ব্লকের সাথে মিত্রতা তৈরী করাই ছিলো সেই সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা।
আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে "মুসলিম " শব্দটি পুরোপুরি ভাবে ছেটে ফেলা হয় ১৯৫৫'র অক্টোবরে , নাম পরিবর্তন সিদ্ধান্তের ২ বছর পর , ২৩ মার্চ ১৯৫৬ ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানের সংবিধান রচিত হওয়ার ৬ মাস পূর্বে।
সূত্রঃ বাংলাদেশে হিন্দুদের দুর্দশার কাহিনী , রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী।
আমি যেটা ধারনা করি এমনটা করার উদ্দেশ্য ছিলো পরিস্থিতি যাচাই করা, শেরেবাংলার প্রতি হিন্দুদের যে আস্থা সেটা কখন দুর্বল হবে সেটা লক্ষ্য করা এবং ঝোপ বুঝে কোপ মারা।
এরপরপরই আওয়ামী লীগ হিন্দু প্রভাবিত পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস এর সাথে ৫ দফা চুক্তিতে উপনীত হয়। শেখ মুজিব কংগ্রেস- আওয়ামী লীগের এই ঐক্যকে বলতেন "পন্চ্ঞশীল ঐক্য"। এই চুক্তির উল্লেখযোগ্য ২ টি হলোঃ
১. আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় সরকারে যেতে পারলে সংবিধানে জয়েন্ট ইলেক্টোরেট অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জোর চেষ্টা চালাবে।
২. সরকারী চাকুরীতে হিন্দুদের জন্য ২৩% কোটা সংরক্ষন করা হবে।
প্রাসঙ্গিক ভাবে বলতে হয় জয়েন্ট ইলেক্টোরেটের রাজনৈতিক চাহিদা থেকেই আওয়ামী লীগ "বাঙালী " জাতীয়তাবাদ অ্যাডপ্ট করে , নৃতাত্ত্বিক বা সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে নয়।
জয়েন্ট ইলেক্টোরেটের জন্য আওয়ামী লীগ জিন্নাহর ১৯৪৭ এর ১৪ আগষ্ট (১১ই আগষ্ট) প্রথম কনস্টিটিউয়েন্ট অব পাকিস্তানে দেয়া বক্তব্য উদ্ধৃত করে লীফলেট , পত্রিকা , প্রোপাগান্ডা সবভাবে চেষ্টা চালাতে থাকে।
জিন্নাহর যেই বক্তব্যটিকে আওয়ামী লীগ তাদের জয়েন্ট ইলেক্টোরেট প্রচারনায় ব্যবহার করে সেটি ছিলোঃ
" আজ থেকে হিন্দু আর হিন্দু নন , মুসলিম আর মুসলিম নন , কোন ধর্মীয় অর্থে নয় , রাজনৈতিক অর্থে সকলেই এই রাষ্ট্রের (পাকিস্তানের) নাগরিক । "
জিন্নাহর এই বিখ্যাত উক্তির পর মহাত্না গান্ধি ঘোষনা দেন: তিনি পাকিস্তানে বসবাস করবেন এবং পাকিস্তানে প্রবেশের জন্য কোন ভিসা চাইবেননা।
যাইহোক পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্বে অ্যাসেম্বলীর অমুসলিম ব্লক সমর্থন প্রত্যাহার করলে ১৯৫৬ এর ৬ ই সেপ্টেম্বর আবু হাসান সরকার মন্ত্রীসভার পতন ঘটে , আওয়ামী লীগ- কংগ্রেস জোট ক্ষমতায় আসে হিন্দু পারিষদ দের সমর্থন নিয়ে এবং আতাউর রহমান খান হন মুখ্যমন্ত্রী।
শেখ মুজিব হন শিল্প , বানিজ্য এবং শ্রম - এই ৩ পোর্টফোলিওর মন্ত্রী।
ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত হন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
আতাউর রহমান খান প্রথমেই যে কাজটি করেন সেটি ছিলো জয়েন্ট ইলেক্টোরেটের ব্যাপারে একটি রেসোলিউশন পাস করেন ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলী এবং প্রভিন্সিয়াল অ্যাসেম্বলীর নির্বাচনের জন্য।
অন্যদিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৫৬ এর ১২ই সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসেন। ১০ই অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলীর প্রথম অধিবেশনেই সোহরাওয়ার্দী জয়েন্ট ইলেক্টোরেট বিল উত্থাপন করেন।
সোহরাওয়ার্দী ১৫ ই অক্টোবর চীন সফরের আগেই বিলটি পাস হয়।
আর এভাবেই নাম পরিবর্তন এবং হিন্দুদের রাজনৈতিক দাবীর পক্ষে প্রচেষ্টা চালিয়ে হিন্দু ভোটারদের কে নিজেদের দিকে টেনে নেয় আওয়ামী লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তানের সব সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ লাভ করে।
শেষ মন্তব্য হিসেবে কথাটি না বললেই নয়ঃ বাঙালীত্ব এবং বাংলাদেশীত্ব নিয়ে আমার নিজেরও একটি পোস্ট আছে।
বাঙালিত্ব বনাম বাংলাদেশীত্ব
কিন্তু আওয়ামী লীগ ঠিক যেভাবে বাঙালী জাতীয়তাকে অ্যাডপ্ট করেছিলো সেটি ছিলো জয়েন্ট ইলেক্টোরেটের উদ্দেশ্যে একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ।
শেখ মুজিব কে আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম পরিবর্তনের নায়ক বলা এবং জয়েন্ট ইলেক্টোরেটের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বাঙালী জাতীয়তাবাদ গ্রহন করার কথা আওয়ামী লীগের ওয়েব সাইটেই উল্লেখ করা আছে:
আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম পরিবর্তন বিষয়ে আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটের বক্তব্য , পৃষ্ঠা ৩ এবং ৪
মূলসূত্রঃ একটি সংকলিত প্রবন্ধ অবলম্বনে যার রেফারেন্স হিসেবে ছিলো নিম্নোক্ত বইগুলো :
1. Lawrence Ziring, Bangladesh From Mujib to Ershad: An interpretive Study ( Karachi:Oxford University Press, 1992), 16.
2. M. Rafique Afzal, Political Parties in Pakistan (1947-1958) (Islamabad: National Commision on Historical and Cultural Research , 1976) , vol1.87
3. Abdul Wadud Bhuiyan, Emergence of Bangladesh and Role of Awami League (Delhi:Vikas Publishing House, 1982),22.
4. Rounaq Jahan, Pakistan: Failure in National Integration (Dacca: Oxford University Press , 1973),38.
5. Feroz Ahmed, “Alliances and the Break-up of Pakistan” Pakistan Forum 2, no. 7/8 (April to May , 1972): 10
6. W.Godfrey, Pakistan, Economic and Commercial Conditions in Pakistan (London: TomStacy, 1951), 65.
7. Y.V.Gankovsky, L.R.Gordon Polonskaya, A History of Pakistan (1947-1958) (Lahore: People's Publishing House
1964), 149.
8. Muhammad Ghulam Kabir, Minority Politics in Bangladesh (Delhi: Vikas Publishing House , 1980), 2.
9. Keith Callard, Pakistan: A Political Study ( New York: The Macmillan Co., 1957), 265.
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।