soroishwarja@yahoo.com
কোনো কোনো দিন আমার কেবলি কান্না উথলে ওঠে। সেদিন খুব রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে ইচ্ছে করে। বাঁশি ও বেহালা শুনতে ইচ্ছে করে। লোকজনকে ফোন করতে ইচ্ছে করে। কাউকে কাউকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে হাউমাউ করে বলতে ইচ্ছে করে, আমি তোমাকে ভালবাসি, আমি তোমাদের ভালোবাসি।
সেদিন আমার বড় আপন মানুষগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে আমার বিষণ্ন নানার মুখ। মনে পড়ে আমার প্রিয় বোনের মুখ। তাদের মতো আর যারা আমাকে এই পৃথিবীতে রেখে চলে গেছেন তাদের মনে পড়ে। যেসব জীবিত স্বজন থেকে দূরে আছি তাদের মনে পড়ে।
তখন বানের জলের মতো কান্না আসে।
যতই দিন যাচ্ছে ততই আমি একা হয়ে পড়ছি। আমার বন্ধুদের মুখ ক্রমশ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। একদিন যাদের হৃদয়ে আমার ঠাঁই ছিল এখন আমি তাদের হৃদয় আর ছুঁতে পারি না। যে বন্ধুর গলা জড়িয়ে একদিন হেঁটেছি, সে বন্ধুর সামনে আমি আর আমার সামনে সে বন্ধু আর আগের মতো সহজ হতে পারি না।
পুরনো আন্তরিকতার আগুন ও স্মৃতি আমাদের দুজনের বুকেই হয়ত দাউদাউ করে, কিন্তু আগের সেই ভাব ও ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আমরা যেন আমাদের সর্বস্ব হারিয়েছি, এমনভাবে পরস্পর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। তারপর চলে যাই যে যার পথে।
মানুষের বয়স বাড়ছে। বাড়ছে আমারও।
আমার বাবাকে আমার এখন বড় একা মনে হয়। আমার মাকে আমার বড় একা মনে হয়। একদিন আমিও কি তাদের মতো একা হয়ে যাব? বিশাল ভয়ঙ্কর এই একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতার কথা ভেবে আমার গা শিউরে ওঠে।
ছোটবেলায় নদীতে ও পুকুরে ডুব ও সাঁতার আমার বড় প্রিয় ছিল। ডুব দিয়ে একেবারে জলের তলায় গিয়ে চুপ করে বসে থাকতাম।
ঠাণ্ডায় ও জলের ধাক্কায় কানের পর্দা কনকন করত। কেমন একটা ছমছমে ভয় কাজ করত। এই বুঝি কোনো একটা কুমির, কোনো একটা জলদানব আমাকে টেনে ধরবে! আমাকে আর উঠতে দেবে না। এ রকম মনে হতে হতে এক সময় মারাত্মক ভয় পেয়ে যেতাম। তখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জলের ওপর ভেসে উঠার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাতাম।
ভুস করে ভেসে উঠতাম। বিরাট এক নিঃশ্বাস নিতাম। মনে হত এ যাত্রা বেঁচে গেছি!
একবার এভাবে নদীতে ডুবে থাকতে গিয়ে লোককথার কমলা সুন্দরীর কথা মনে পড়ে। কমলা সুন্দরীর স্বামী একটা বিরাট ও গহীন পুকুর খনন করেছিলেন। সেই পুকুরে কিছুতেই পানির দেখা মিলছিল না।
কমলার স্বামী ছিলেন বাদশাহ। তিনি স্বপ্ন দেখলেন। তার স্ত্রী যদি ওই পুকুরের তলায় বসে নামাজ পড়ে তাহলে পানিতে পুকুর ভরে যাবে। কমলা সেই পুকুরের তলায় নেমে নামাজ পড়ছিলেন। এমন সময় পানিতে পুকুরটা ভরে গেল।
কমলা পানিতে তলিয়ে গেলেন। তার স্বামী তাকে পাওয়ার জন্য আকুল হলেন। কমলার শিশু সন্তান মায়ের দুধের জন্য আকুল হল। স্বপ্ন দেখলেন পুকুরের পানির ওপর একটা জলটু্ঙ্গির মতো বানিয়ে তাতে বসে থাকলে কমলা আসবেন। তাই করলেন।
কমলা সেখানে আসতেন। সন্তানকে স্তন্যদান করতেন। শর্ত ছিল কমলাকে তার স্বামী ছুঁতে পারবেন না। ছুঁয়ে দিলে কমলা চিরতরে পানিতে ডুবে যাবেন। আর ভাসবেন না।
এভাবে কয়েক মাস কাটল। একদিন কমলার স্বামী আর সইতে পারলেন না। প্রিয় স্ত্রীর আঁচল টেনে ধরলেন। আর সর্বনাশ হয়ে গেল। কমলা সেই যে কাঁদতে কাঁদতে গহীন পুকুরে ডুবলেন আর ভাসলেন না।
নদীতে ডুব দিয়ে জলের তলায় বসে থাকতে গিয়ে যেদিন আমার এই কথা মনে হয়েছিল, সেদিন আমি ডুবে মরতে বসেছিলাম। ভয়ে ও কান্নায় পানির নিচে আমার দম আটকে যাচ্ছিল। গায়ের সবটুকু শক্তি দিয়েও আমি পানির ওপর ভেসে উঠতে পারছিলাম না। জলের তলায় আমার সেই কান্না কারো চোখে পড়েনি। নদীর জলে মিশে গিয়েছিল চোখের জল।
তারপর থেকে আমি আর কোনোদিন ওভাবে ডুবিনি। তীরে দাঁড়ানো সেদিনের সেই বন্ধুরা যেমন সেদিন আমার চোখের জল দেখেনি, আমার বুকের জল দেখেনি, জলের তলায় আমার নিঃসঙ্গতা দেখেনি, তেমনি এখন। এখনো বন্ধুরা, স্বজনরা, পরিচিতরা আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তারা কেউ টের পাচ্ছে না যে আমি কাঁদছি।
আজ যখন সে রকম কান্নায় বুক ভেসে যাচ্ছে তখন যাত্রাদলের নাচনেওয়ালি একটি মেয়ের কথা মনে পড়ছে। মেয়েটির বয়স ১৬/১৭ হবে।
গায়ের রং ও চোখ-মুখ দেখতে ভালো। একটা অপাপ ব্যাপার ছিল তার চোখেমুখে। মেয়েটি একটু মাতাল ছিল। যাত্রাপালার এক একটি অঙ্ক শেষ হওয়ার পর সে মঞ্চে নাচতে ও গাইতে উঠছিল। গান ও নাচের ফাঁকে ফাঁকে সে মাতলামি করছিল।
দর্শকদের নাচতে ডাকছিল। আর কাঁদতে কাঁদতে কাঁদতে গাইছিল, "আজ আমি......একা হয়ে গেছি/ ভালবাসার মানুষ আমি হারিয়ে ফেলেছি/ আজ আমি......একা হয়ে গেছি। " গাইতে গাইতে সেই কিশোরী ডুকরে কেঁদে উঠেছিল।
সেই কিশোরী আজ কোথায় আমি জানি না। তবে খুব ইচ্ছে করছে তাকে খুঁজে বের করতে।
তাকে বলতে ইচ্ছে করছে, কাঁদিস না বোন। এই দেখ তোর মতো কত মানুষ একা হয়ে গেছে। একেবারে প্রান্তরের বুড়ো গাছটির মতো একা, দল থেকে হারিয়ে যাওয়া সন্ন্ধ্যাবেলার হাঁসের ছানাটির মতো একা, নিঝুম অরণ্যের বিরল বনরুইটির মতো একা। "একা, একা, একা, একা, একা, একা, একা, একা, একা, কা কা কা কা কা কা কা কা আ আ আ আ আ আ আ আ আ....." নির্জন পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়া এই প্রতিধ্বনির মতো একা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।