আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অল-ক্লিয়ার নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ ?



নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পরিকল্পনা করা হয় পাকিস্তান আমলে, ১৯৬১ সালের দিকে। ঐ সরকার বেশ কিছু পর্যালোচনার ভিত্তিতে পাবনার রূপপুরে ৭০ মেগাওয়াটের একটি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয় ১৯৬৩ সালে। তারপর ১৯৬৬ সালের দিকে একটি ১৪০ মেগাওয়াটের এবং ১৯৬৯ এ ২০০ মেগাওয়াটের একটি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয়। বাংলাদেশ আমলে অর্থাৎ একাত্তর পরবর্তী কালে এটা বেশ কিছুকাল ফাইলবন্দী থাকার পর আবারও গা ঝাড়া দেয় ১৯৭৮-৭৯ সালের দিকে। দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়, বেশ কিছু ফিজিবিলিটি স্টাডি বা সম্ভাব্যতা যাচাই রিপোর্ট তৈরির পর তারাও এটাকে শক্তি উৎপাদনের বেশ সুবিধাজনক উপায় মনে করে।

১৯৮০ তে তারা ১৪০ মেগাওয়াটের নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয়। এরপর আরেকটি ফলোআপ স্টাডি হয় ১৯৮৬-৮৭ সালে। ঐ স্টাডিও আমাদের জানিয়েছিল বাংলাদেশ নাকি সব দিক থেকেই এ ধরনের নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনায় সক্ষম। পর্যালোচকরা সেসময় বাংলাদেশ সরকারকে ৩০০ মেগাওয়াটের দুটি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সুপারিশ করে। এইরকম ফিজিবিলিটি স্টাডি চলতে থাকে আরও বেশ কিছুকাল।

১৯৯৯-২০০৩ হয়ে এবার আবার সেটা শুরু হল ২০০৯ এ। এবারও ঢাকা থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরত্বে পাবনার সেই রূপপুরকেই ঠিক করা হয়েছে। ২০০৯ থেকেই পত্রপত্রিকা মারফত আমরা খবর পেয়ে আসছি যে এই সরকার রাশিয়ার সঙ্গে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারক বা MOU (Memorendum of Understanding) স্বাক্ষর করেছে। অতি সম্প্রতি কালের কণ্ঠ (৫ বৈশাখ ১৪১৭) পত্রিকা থেকে জানা গেল যে অবশেষে আমরা সত্যি সত্যি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অধিকারী হতে যাচ্ছি। হ্যাঁ পাঠক আপনি ঠিকই পড়েছেন আমরা অধিকারী হতে যাচ্ছি, নির্মাণকারী নয়।

আর তাই নিয়েই দেখেন না আমাদের মন্ত্রী মহোদয় কতটা আহলাদিত- ‘নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্রজেক্ট করা একটি জাতির জন্য সম্মানের বিষয়। এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যাব। ' -মাননীয় বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান পাঠক গর্ববোধ করার আগে আমি আপনাদের আহবান জানাব এই গর্ববোধের গর্ভটাকে একটু পরীক্ষা করে দেখতে। এই নিবন্ধটাকে তাই সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার শুরু ধরতে পারেন। আমরা আপনাদেরও আহবান জানাব এই সংক্রান্ত তথ্যাদি নিয়ে পাঠ/আলোচনা/লেখালেখির মাধ্যমে বিতর্কে অংশ নিতে।

শুরুতেই বলে রাখা ভাল আমরা নিউ-ক্লিয়ার(!) বিশেষজ্ঞ নই, তবুও কলম ধরলাম এই কারণে যে এই বঙ্গদেশে এই বিষয়ে কেউ খুব একটা কিছু বলছেন না দেখে। আমাদের অনেকেরই প্রিয় ব্যক্তিত্ব মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর নিয়মিত কলাম ‘সাদাসিধে কথা’য় ( প্রথম আলোয় প্রকাশিত) নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে একটি লেখা বেশ কিছুকাল আগে লিখেছিলেন। তাঁর লেখাটি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিষয়ে বুঝতে আমাদেরও বেশ সহায়তা করেছিল। কিন্তু দু:খের সঙ্গে বলতে হচ্ছে লেখাটিতে তিনি বেশ কিছু বিষয় উত্থাপন করেননি বিশেষত নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশপাশের এলাকায় ব্যাপকমাত্রায় পরিবেশ দূষণের কথা এবং তৎজনিত কারণে ঐ এলাকার জনস্বাস্থ্যের ভয়াবহ বিপর্যয়ের কথা । আরেকটি বিষয় হয়ত তাঁর নজর এড়িয়ে গেছে, সেটি হল এই প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়টি।

দু’টিকেই আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি এবং সেহেতু আমরা এই নিবন্ধে এই বিষয়গুলি একটু খূঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করব এবং সেইসাথে পাঠককে আহবান জানাব লেখাটি পড়াকালীন জ্বালানি নিরাপত্তার ব্যাপারটাকে একটু মাথায় রাখতে। বর্তমান আওয়ামী সরকারকে ক্ষমতায় আসতে অপরিসীম সহায়তা করেছিল বি.এন.পি’র তৈরী ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকট এবং আওয়ামী লীগ সেজন্য তার নির্বাচনী অঙ্গীকারনামায় এটা উল্লেখ করতে একদম ভুলেনি যে তারা ক্ষমতায় গেলে দেশবাসীকে বিদ্যুৎ সংকট থেকে মুক্ত করে ছাড়বেন। বেশ ভালোভাবেই ক্ষমতায় তারা গিয়েছেন এবং তার চেয়েও কত ভালোভাবেই যে আমাদের মুক্ত করেছেন সেটা আমরা প্রতি একঘণ্টা পরপর স্মরণ করতে বাধ্য হচিছ। আর এটাকেই অছিলা ধরে তারা আবারও সেই পুরনো ফাইল ঝেড়ে-পুছে আমাদের সামনে হাজির করেছেন নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মত একটি শ্বেতহস্তি মার্কা প্রজেক্ট। একে তো সাদা হাতি পালার এন্তার খরচ, তদুপরি এখনও আমরা সেই হাতির বিষ্ঠা কিভাবে এবং কোথায় সরাব তাও ঠিক জানি না।

যদিও সংবাদে ‘রাশিয়া নিজেই সেই পারমাণবিক বর্জ্য হিসেবে চিহ্ণিত ব্যবহ্রত জ্বালানি ফেরত নেবে’ এইরকম একটি ধারা বাংলাদেশ প্রস্তাবিত খসড়া চুক্তিতে থাকলেও সেটি তারা কিভাবে করবে, তার জন্য খরচাপাতি কেমন, বর্জ্য পরিবহন এবং স্থানান্তরের ঝুকি কার ইত্যাদির কোন উল্লেখ আমরা কোথাও পাই না। তাছাড়া পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদটি মূলত চুক্তির খসড়া নিয়ে একটি আলোচনা। মূল চুক্তিতে (যেটি শেখ হাসিনার রাশিয়া সফরকালে স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা) বিষয়টি আদৌ থাকবে কিনা এবং থাকলে বর্জ্যব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কার হাতে কিভাবে থাকবে তা আমরা কোনদিন জানতে পারব বলে মনে হয় না কারণ এইটা নিশ্চয়ই ‘অতীব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ’ অর্থাৎ প্রকাশ অযোগ্য হইবে। এইখানে প্রাসঙ্গিকতার খাতিরেই পাঠককে জানাচ্ছি যে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উপজাত হিসেবে যে বর্জ্য তৈরী হয় সেগুলো তেজস্ক্রিয় এবং এর তেজস্ক্রিয়তা কমে সহনীয় পর্যায়ে আসতে কমপক্ষে ১০,০০০ বছর(!) লাগবে। তার মানে নিউক্লিয়ার বর্জ্যকে সরিয়ে আমাদের এমন কোথাও রাখতে হবে যা ঝুঁকিহীন থাকবে টানা দশ হাজার বছর।

অতএব এই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঝুঁকিটা কেবল আমাদেরই থাকছে না, ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে আমাদেও পরবর্তী প্রজন্মগুলোর জন্যও। নৈতিকভাবেই এটা তাই আমাদের কাছে অসমর্থনযোগ্য যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমন্ধে একটা কার্যকর স্থায়ী সমাধানে যেতে না পারছি। এবার আসা যাক পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে। নিউক্লিয়ার উদ্যোক্তারা সর্বদাই এই ধরনের একটা প্রোপাগান্ডা চালান যে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ বেশ পরিবেশবান্ধব কেননা এতে বর্তমানে ভিলেন হিসেবে চিহ্ণিত কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের নির্গমন হয় না। এটা ডাহা মিথ্যে।

আপনি যদি পুরো জ্বালানি চক্রটাকে হিসেবে নেন তাহলেও এটা বেশ ভালোভাবেই বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড এর বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ইউরেনিয়াম মাইনিং, নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর নির্মাণ, টাওয়ার শীতলীকরণ, নিউক্লিয়ার বর্জ্যরে পরিবহন ইত্যাদি বিষয়কে ধর্তব্যে আনলে এটাকে ধোয়া তুলসী পাতা দাবি কোনভাবেই ধোপে টেকে না। জন উইলিয়াম এবং ফিলিপ স্মিথ নামক দু’জন গবেষক ২০০৪ এর এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে একটি আধুনিক প্রাকৃতিক গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় একটি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ করে তিন ভাগের এক ভাগ। তাছাড়া নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড এর থেকে কয়েক হাজার গুণ ক্ষতিকর সিএফসি অর্থাৎ ক্লোরোফ্লোরোকার্বন নিঃসরিত হয় যাকে ‘মনট্রিল প্রটোকলে’ পরিবেশ দূষণের দায়ে আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর প্রতি বছর বায়ুমন্ডলে ও পানিতে প্রায় মিলিয়ন কুরি (তেজস্ক্রিয়তার একক) তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ছড়ায়।

এগুলোর নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করা হয় না কেননা উদ্যোক্তারা মনে করেন এরা পরিবেশ ও প্রাণসম্পদের জন্য হুমকিস্বরূপ নয়! এইসকল আইসোটোপের তালিকায় আছে ক্রিপ্টন, জেনন, আর্গনের মত নিস্ক্রিয় গ্যাসসমূহ যেগুলো চর্বিতে দ্রবণীয় এবং রিঅ্যাক্টরের আশেপাশে বসবাসকারী কোন লোক তার নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করলে তা তার ফুসফুসের মাধ্যমে প্রজনন অঙ্গসহ তার দেহের চর্বিযুক্ত টিস্যুতে স্থানান্তরিত হতে পারে। তদুপরি তেজস্ক্রিয় মৌলগুলি হতে নিঃসরিত গামা রশ্মি ডিম্বাণু ও শুক্রাণুতে আকস্মিক পরিবর্তন ঘটিয়ে সূচনা করতে পারে বংশানুসৃত রোগের। ট্রিটিয়াম নামক হাইড্রোজেনের একটি আইসোটোপও আমরা নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পেয়ে থাকি যা অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া মারফত তেজস্ক্রিয় পানি উৎপন্ন করে। এই পানি ত্বক, ফুসফুস এবং পরিপাকতন্ত্রের মাধ্যমে লোকজনের দেহে প্রবেশ করে তার ডি.এন.এ মলিকিউলে ঢুকে যেতে পারে যার পরিণাম বড় ধরনের বিপর্যয়। বছর দু’য়েক আগে অর্থাৎ ২০০৮ সালে জার্মান সরকার তার বাণিজ্যিক ১৬টি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশেপাশে বসবাসকারী শিশুদের উপর একটি গবেষণা চালায়।

গবেষণাটি ‘কিক স্টাডি’ (The KiKK Study) হিসেবে পরিচিত। গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায় নিইক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকে যতই যাওয়া যায় শিশুদের দেহে ক্যান্সার বিশেষত লিউকেমিয়ায় আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। কিক স্টাডি থেকে জানা যায় নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫ কিমি ব্যাসার্ধের মাঝে বসবাসকারী শিমুদের লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তার বাইরে বসবাসকারী শিশুদের তুলনায় অন্ততপক্ষে দ্বিগুণ। অন্য আরেকটি গবেষণায় দেখা যায় নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের আশেপাশে অবস্থিত লোকালয়গুলিতে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার প্রতি লক্ষে ২৬-২৮ জন যেখানে গড়পড়তা স্তন ক্যান্সারজনিত মৃত্যুহার হচ্ছে প্রতি লক্ষে ২০-২২ জন। এই গবেষণাটি হয়েছে যুক্তরাষ্টে যারা বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।

যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ডিপার্টমেন্ট দেখতে পায় তাদের সবচেয়ে পুরনো নিউক্লিয়ার কেন্দ্রগুলির আশেপাশে স্তন ক্যান্সারজনিত মৃত্যুহার ১৯৫০-৫৪ থেকে ১৯৮৫-৮৯ সময়কালে বেড়েছে ৩৭% যেখানে পুরো আমেরিকা জুড়ে গড়ে তা বেড়েছে মাত্র ১%। তারপরও কি পাঠক আপনাদের কাছে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে আকর্ষণীয় সমাধান মনে হচ্ছে? রাশিয়া এবং নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র পাশাপাশি বসালে যে আরেকটি শব্দের অভাব অনুভুত হয় সেটি চেরোনবিল। ২৬ এপ্রিল, ১৯৮৬ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কিয়েভ শহরের চেরোনবিলে একটি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারটি রিঅ্যাক্টরের একটি বিষ্ফোরিত হয় এবং তেজস্ক্রিয় মৌল ছড়িয়ে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপ, স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের বেশ কিছু অঞ্চলে। আজও চেরোনবিল শহর পরিত্যক্ত এবং এই ক্ষতি পরিমাপনকারী কোন সূত্র কিংবা যন্ত্র কোনটাই আমাদের হাতে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ার থ্রি মাইল আইল্যান্ডে ১৯৭৯ সালের ২৮ মার্চ কাছাকাছি মাত্রার এক দূর্ঘটনা ঘটে।

এই দূর্ঘটনার পর এখন পর্যন্ত নতুন কোন নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেনি যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৮০ সালে থ্রি মাইল আইল্যান্ড ঘটনার পরপরই সুইডেন রেফারেন্ডামে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা হয়। ১৯৮৬ সালের চেরোনবিল দূর্ঘটনার পর সবাই ধরে নিয়েছিল নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিন বুঝি এবার ফুরালো। জার্মানী কেবল নতুন নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান বন্ধই করেনি সেইসাথে একে একে বন্ধ করে দিচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ কেন্দ্রগুলো। বেলজিয়াম, তাইওয়ান, জাপানও ক্রমে সরে আসছে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে।

এমনকি নিজস্ব বিদ্যুতের শতকরা ৭৭ ভাগ নিউক্লিয়ার শক্তি থেকে পাওয়া ফ্রান্সও সেদেশের নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো একে একে বন্ধ করে দেয়ার জন্য সে দেশের জনগণের চাপের মধ্যে রয়েছে। সবাই যখন একের পর এক নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে যাচ্ছে আমাদের মন্ত্রী মহোদয়েরা কিনা সেখানে উল্টো নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে সম্মানিত হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন! তাও বোঝা যেত যদি তারা এখানে দক্ষ জনসম্পদ তৈরীর মাধ্যমে নিজস্ব প্রযুক্তিতে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসানোর চেষ্টা করতেন। সেই জাতীয় সক্ষমতা অর্জন কোন উদ্যোগ গ্রহন না করেই নিউক্লিয়ার প্রযুক্তিকে সাবান-শ্যাম্পু-ফ্রিজ-টেলিভিশনের মতো আর দশটা পণ্যের সাথে গুলিয়ে ফেলে স্রেফ আমদানি করার মধ্যে দিয়ে তারা কিভাবে সম্মানিত বোধ করেন আমাদের মাথায় সেটা খেলে না(আমরা তো সন্মানিত বোধ করার বদলে উল্টো আতংকিত বোধ করছি!)। আমাদের মাথায় খেলে না নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ নির্মাণের জ্বালানি ইউরেনিয়ামের উৎস এবং সেই ইউরেনিয়াম কাচামাল প্রক্রিয়াকরণ সামর্থ না থাকা সত্ত্বেও কেন আমরা নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে যাব। কেন আমরা পরনির্ভরশীল প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করে জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টিকে তুলে দেব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের হাতে।

এইদিকে দুনিয়ার চারিধারে ইউরেনিয়াম প্রচুর পরিমাণে ছড়িযে ছিটিয়ে আছে এমনও নয়। হাই গ্রেড ইউরেনিয়ামের মজুদ আছে বর্তমানে প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন টন। বর্তমানে প্রতি বছর ইউরেনিয়াম ব্যবহ্রত হচেবছ প্রায় ৬৭,০০০ টন। অতএব এই হারে ব্যবহ্রত হতে থাকলে বর্তমান মজুদ দিয়ে চলবে আরো বছর পঞ্চাশ। আর যদি দুনিয়ার বর্তমান বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় সবটাই যোগাতে হত নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকে তবে তা দিয়ে চলত আর মাত্র নয় বছর! হাই গ্রেড- লো গ্রেড মিলিয়ে এই মূহুর্তে ইউরেনিয়ামের মোট মজুদ প্রায় ১৪.৪ মিলিয়ন টন যার বেশিরভাগ থেকেই উত্তোলন করা ক্রমশ ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে।

অনেকগুলোকে খনি আবার ইতোমধ্যে পরিত্যক্তও হয়ে গেছে। আবার আমরা যদি আমাদের ভৌগলিক ও জনসংখ্যাগত অবস্থান দেখি তবে তা কোনভাবেই এখানে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। জনমংখ্যার ঘনত্বের দিক দিয়ে শীর্ষে অবস্থনকারী বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের এক দেশে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কোন একটি দূর্ঘটনা যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সূচনা করবে তা কল্পনা করার সাধ্য আমাদেও নেই। চেরোনবিল, থ্রি মাইল আইল্যান্ড এর মত বড় বড় দূর্ঘটনাগুলো ঘটেছে প্রযুক্তির দিক দিয়ে শীর্ষে অবস্থানকারী দেশগুলোতে । যারা নিজস্ব দক্ষতাকে কেন্দ্র করে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছিল।

আর আমাদের মত দেশে যেখানে গ্যাস-কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো দু’দিন পর পর বিকল হয়ে যায় এবং মেরামতের অভাবে পড়ে থাকে দিনের পর দিন সেখানে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মত একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল প্রযুক্তি সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে বেশ ভালোভাবে চলবে এটা ভাবতে একটু কষ্টকল্পনা করতে হয়। চেরোনবিল দূর্ঘটনায় সবকিছু মিলিয়ে ব্যয় এখন পর্যন্ত ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে শাট-ডাউন করতেই লেগেছিল ৪ বিলিয়ন ডলার(!)। এর পরের কিস্তিতে আমরা নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অর্থায়নের বিষয়টিকে একটু বোঝার চেষ্টা করব। সেজন্য আমরা ব্রাজিল ও ফিলিপাইনের দু’টি কেস স্টাডি নিয়ে আলোচনা করব।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।