আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেষ দৃশ্যে এরশাদ কার?

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক নাকি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দোরগোড়ায় হাজির হওয়া জাতীয় নির্বাচন- এ প্রশ্নে রাজনীতিতে যখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যার যার অবস্থানে অনড়, শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা ছড়াচ্ছে, অন্দরে বইছে গুমোট হাওয়া, সমঝোতার পথ খুঁজতে তৎপর আন্তর্জাতিক মহল, সকাল-বিকাল আসছে বান কি-মুনের টেলিফোন তখন মাঝখানে দাঁড়িয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ নাটক জমিয়ে সুখেই আছেন। আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি বিভক্ত রাজনীতির দুই বৃহৎ শক্তিই চাইছে সাবেক সেনাশাসক এরশাদ তাদের পরিকল্পনার সঙ্গে পায়ে পায়ে হাঁটুন। ক্ষমতার অংশীদারিত্ব কে কতটা দেবেন সেই হিসাবের খাতা না খুলেই তারা তা চাইছে। উভয় পক্ষের ধারণা, এরশাদ শেষ পর্যন্ত যেদিকে ঝুঁকবেন সেদিকেই পাল্লা ভারী হবে। কিন্তু প্রশ্ন- নাটকের পর্দা মাত্র উঠতে শুরু করেছে, শেষ দৃশ্যে এরশাদ কার হবেন তা জানার এখনো ঢের বাকি।

এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে মহাজোটের অংশীদার। তার অনুজ জি এম কাদের সরকারের মন্ত্রী। তিন বছর ধরে তিনি বলে আসছেন মহাজোট ছাড়ছেন, ছাড়বেন। দলের প্রেসিডিয়াম থেকে তৃণমূল পর্যন্ত মহাজোটের সঙ্গ ত্যাগ করার চাপটিও কম নয়। তবুও এরশাদ ছাড়ছি, একক নির্বাচন করছি বলে সরকারের মেয়াদ পার করে দিয়েছেন।

'৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে টানা ছয় বছরের জেল-নির্যাতন ও পার্টির ওপর দমন-পীড়ন কম আসেনি। '৯৪ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে ইমানি পরীক্ষা দিয়ে '৯৬ সালে ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনার সরকারের কাছ থেকে কারামুক্তি লাভ করেন। পার্টি ভেঙেছে দুবার। অনেকেই দল ছেড়ে চলে গেছেন। তবুও তার ইমেজের ওপর জাতীয় পার্টি দেশের তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি।

যদিও রংপুর হলো তার রাজনীতির দুর্গ। এবার প্রথম সেখানে সিটি মেয়র নির্বাচনে তার পার্টির বিপর্যয় দেখতে হয়েছে। ২২ বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি যখন যারা ক্ষমতায় এসেছে তারাই এরশাদকে মামলার জালে ফেলে সামলে রেখেছে। চলমান মহাজোট সরকারও ব্যতিক্রম নয়। সর্বশেষ গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এরশাদের সঙ্গে গণভবনে বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সমর্থন আদায় করতে পারেননি।

জাপা কর্মীরা যখন বিএনপি জোটের মান্নানের জন্য মরণ লড়াই লড়ছেন ঠিক তখন শেষ মুহূর্তে এরশাদ তার অবস্থান থেকে সরে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হন। ফলাফল দেখার পর বলেন, এবার তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে সুবিধা হবে। অতিসম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ তার অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই নির্বাচন। সংবিধান থেকে তিনি একচুল নড়বেন না।

অন্যদিকে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সাফ বলে দিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না এবং করতে দেওয়া হবে না। বিরোধীদলীয় নেতার বক্তৃতার আগেই এরশাদ বলে বসেন, জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় একতরফা নির্বাচনে অংশ নিয়ে দালাল হয়ে মরতে চান না। বিরোধী দল না এলে তিনিও নির্বাচনে অংশ নেবেন না। এদিকে বেগম খালেদা জিয়া তার বক্তৃতায় মহাজোটের প্রধান শরিক এরশাদের এই অবস্থান উল্লেখ করে পরিষ্কার বলেন, অবশ্য তিনি কথা ঠিক রাখতে পারেন না। হাসিমুখেই খালেদা জিয়া বলেছেন, জনগণের সামনে কথা দিলে তা রাখতে হয়।

আশা করি রাখবেন। এরপর এরশাদ আরেক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন বিতর্কিত। এই ইসির অধীনে কোনো নির্বাচনে তিনি যাবেন না। এরশাদের পার্টির ঘনিষ্ঠ স্বজনরাও বলেছেন, তিনি গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা হতে নারাজ। এমন নেতা হয়ে মৃত্যু তার কাম্য নয়।

বরং সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে এককভাবে অংশগ্রহণ করে হারতেও রাজি। সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, এখন পর্যন্ত এরশাদ তাদের সঙ্গেই আছেন। তবে শেষ মুহূর্তে তিনি তার মুরুবি্বদের ইঙ্গিতেই নাটকের শেষ দৃশ্য মঞ্চস্থ করবেন। সেই দৃশ্যে কারা তালি দেবে আর কারা গালি দেবে তা এখনই নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চিত, তিনি সাংবিধানিকভাবে যে জাতীয় নির্বাচনের কথা বলছেন তা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে আন্তরিকতার ঘাটতি নেই।

কিন্তু তিনি জানেন এই নির্বাচনে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া আসছেন না। আর তার পরিকল্পনা এ ক্ষেত্রে এরশাদসহ অন্যদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এরশাদের কথার ওপর যারা আস্থা রাখতে পারছেন না তারা বলছেন, এরশাদ একদলীয় বিতর্কিত নির্বাচনে যাবেন না বলে যে ঘোষণা দিচ্ছেন তা বিএনপিকে বাইরে রেখে সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের কৌশল নিয়েছেন মাত্র। তার ডান দিকে সরকারের আস্থাভাজন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও বাম পাশে থাকা জিয়াউদ্দিন বাবলুকে রেখে এবং সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ব্যাংকের মালিকানা নিয়ে এবং ছোট ভাইকে সরকারে ঠাঁই দিয়ে আর যাই হোক আওয়ামী লীগ জোট ছেড়ে বিএনপি জোটের দিকে ঝোঁকা যায় না। কিন্তু পার্টির অনেকেই বলছেন, নানা চাপের মুখে এরশাদ কথা বদল করলেও তিনি জনগণের মনোভাব বুঝেই তার অবস্থান খোলাসা করছেন।

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগেও তিনি চারদলীয় জোটের অন্যতম শরিক হিসেবে ভূমিকা রেখেছিলেন। তার জন্য ৩ কোটি টাকা জরিমানা, কিছু দিনের জেল, পার্টি ভেঙে আলাদা নির্বাচন এবং ভোটের পর দিনই দেশ ত্যাগ করতে হয়েছিল। ২০০৬ সালের বাতিল ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি জমানার গোধূলিলগ্নে বিএনপির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে কিছু মামলা থেকে মুক্ত হয়ে চাপের মুখে আত্দগোপন থেকে সোজা পল্টনে উঠেছিলেন মহাজোট মঞ্চে। সেই সময়ে এরশাদ জনমতকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের ভাষায়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করে এ পর্যন্ত বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে যত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা তিনি তার মুরুবি্বদের কথায়ই নিয়েছেন।

ক্ষমতার রাজনীতির হিসাব-নিকাশ ভালো গুনতে পারা গণঅভ্যুত্থানে পতিত সেনাশাসক এইচ এম এরশাদ ২২ বছর ধরে রাজনীতির ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। এত ভাঙা-গড়া, এত সমালোচনায়ও ফুরিয়ে যাননি। পৃথিবীর আর কোথাও গণঅভ্যুত্থানে পতিত সেনাশাসক তার মতো জায়গা করে নিতে পারেননি। বয়স তাকে ৯০-এর দিকে টানলেও মাঝেমধ্যে ইতিহাসের চাকাকে উল্টে দিয়ে ক্ষমতায় ফেরার স্বপ্নেও বিভোর হয় তার কবিমন। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অক্টোবরে রাজনীতির আকাশ আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে।

এরশাদ তখন সরকারের একতরফা নির্বাচনের গৃহপালিত বিরোধী দলের আসনের দিকে হাঁটবেন, নাকি বিএনপি জোটের আন্দোলনে গণজাগরণ ঘটলে সেদিকেই ছুটবেন; তা এখনই কেউ নিশ্চিত বলতে পারছে না। তার কাছে থাকা নেতারাও মনে করেন ব্রিটিশ আবহাওয়া বোঝা যায়, তাদের নেতাকে এতটা বোঝা যায় না। সেই সঙ্গে এরশাদের মুরুবি্বরা রাজনীতির শেষ দৃশ্য মঞ্চায়ন বা দাবার শেষ চালটি দেওয়ার আগে তাকে কোন দিকে ঝুঁকতে বলবেন তা-ই বড় ফ্যাক্টর। আওয়ামী লীগ জোট মনে করে বিএনপি আন্দোলনে সুবিধা করতে না পারলে তারা নির্বাচনের বাইরে যেমন ছিটকে পড়বে, তেমনি জাতীয় নির্বাচনে এরশাদই ইন করবেন না, বিএনএফের ব্যানারে বিএনপির অনেকেও শরিক হয়ে যাবেন। এ ক্ষেত্রে এরশাদ যেদিকে ঝুঁকবেন সেই পাল্লাই লাভবান হবে।

কেউ কেউ আবার বলছেন, সবার অংশগ্রহণ ছাড়া একতরফা জাতীয় নির্বাচন '৯৬ সালে সুখ দেয়নি। ২০০৭ সালের ইতিহাস সবার জানা। এবার সুখের হবে এমনটি ভাবা ভুল।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।