আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বব ডিলানের গান: উন্মোচন

স্বপ্নে আমার ঘর বসত
আপনাকে প্রথম শুনি ষোলো বছর বয়সে। গিটার আর হারমোনিকা নিয়ে নাকি সুরে একলা একটা লোক গেয়ে যাচ্ছে "হাউ মেনি রোডস মাস্ট আ ম্যান ওয়াক ডাউন, বিফোর ইউ কল হিম আ ম্যান..দা অ্যানসার মাই ফ্রেন্ড ইজ ব্লোইং ইন দা উইন্ড" মাথার ভিতরে যেন বিস্ফোরণ ঘটল...এমন সুরের চলনে এমন কথার মিশেল তো এর আগে শুনিনি কখনো! রবীন্দ্রসংগীত আর আধুনিক বাংলাগানের সুগার কোটেড নির্মাণে অভ্যস্ত কান আছড়ে পড়ল বাস্তবের কঠিন জমিতে। পাগলের মতো শুনে গেলাম "দা টাইম দে আর আ-চেঞ্জিং",“মিঃ টামবুরিন ম্যান", "লাভ মাইনাস জিরো/নো লিমিট", “লে ডাউন ইওর ওয়্যারি টিউন" এবং আরো, এবং আরো, এবং আরো..সেই আমার আপনাকে শোনার শুরু। ততদিনে শুনে ফেলেছি সুমন চট্টোপাধ্যায়ের “কতোটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়” বা “আমি যাকে ভালবাসি” -র মতো সব অনুসারী গান। চেটেপুটে খেয়ে চলেছি আপনার সম্পর্কিত সবকিছু, হাতে চলে এসেছে আপনার লিরিক বই- আপনাকে নিয়ে আমার ঊন্মাদনা তখন চরমপন্থী।

তখন ক্যাসেট আর টেপ রেকর্ডারের যুগ। আপনার প্রথম যে ক্যাসেট-টি কিনেছিলাম, আমার ভালোবাসার অত্যাচারে কিছুদিনের মধ্যেই তা দেহ রাখলো। তখন হাতে এলো হাইওয়ে সিক্সটি-ওয়ান রিভিজিটেড... এবং অবধারিতভাবে, "লাইক আ রোলিং স্টোন"। বুঝলাম কিভাবে আপনি অত্যন্ত সচেতন ভাবে ফোক থেকে সরে যাচ্ছেন রক অ্যান্ড রোলের দিকে, কিভাবে ফোকের মেদুরতাকে গ্রাস করে নিচ্ছে রক অ্যান্ড রোলের উন্মাদনা। জানলাম, নিউপোর্ট ফোক ফেস্টিভালে কিভাবে আপনি অ্যাকুস্টিক গিটার-হারমোনিকা ছেড়ে চড়া আলোয়, চড়া সুরে হয়েছিলেন ‘ইলেকট্রিক’।

জানলাম, ফোক আন্দোলন কে কিভাবে নিজের ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন চিরকাল। তখন ব্যথিত হয়েছিলাম, ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম- ভেবেছিলাম এই আমার আপনাকে শোনার শেষ। সত্যি সত্যি শোনা বন্ধ করে দিয়েছিলাম নাকি আজ আর মনে নেই, বরং কি্ছুদিনের মধ্যেই আপনি আবার আমাকে চমৎকৃত করে দিলেন ন্যাশভিল স্কাইলাইন আর জন ওয়েসলি হার্ডিং দিয়ে। দেখলাম আপনি আপনার শিল্পীসত্বাকে নিয়ে গেছেন এক নতুন উত্তরণে, যার নাম কান্ট্রি-রক। গানের লিরিক হয়েছে আরও বিমূর্ত (হাইওয়ে সিক্সটি-ওয়ান রিভিজিটেড- এর “ডিজ়োলেশন রো” দিয়ে যার শুরু), গানের সুর নেমে এসেছে মাটির আরো কাছাকাছি।

অনুভব করলাম, কত অকারণ ছিল আমার অভিমান। অনুভব করলাম, আপনার মত শিল্পীরা শুধুমাত্র একটি ধারায় আটকে থাকার জন্য জন্মান না। সমস্ত রকম গানের শী্র্ষবিন্দু ছোঁয়াই তাদের সঙ্গীত-পরিক্রমার মহানির্বাণ। এভাবেই বাড়তে থাকে আমার ভালবাসার বয়স, ইতিমধ্যে এক-এক করে শোনা হয়ে গেছে আপনার প্রায় সবকটি অ্যালবাম। দেখেছি কি অবলীলায় আপনি কান্ট্রি-রক থেকেও সরে গেলেন আরো ভিন্নতর ধারার দিকে, ইংরাজিতে যাকে বলে "মুভিং অ্যাওয়ে টু দি নিউয়ার প্যাসচার"।

দেখেছি ৮০-র দশকের প্রথমে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পর আপনার গান কিভাবে গসপেল মিউজ়িকের কিছু এলিমেন্ট আহরণ করে হয়ে উঠলো গসপেল-রক। বেরোলো স্লো ট্রেন কামিং, এবং আলোড়ন ফেলে দিলো। এই অ্যালবামের আপনি আবার কুসুমকোমল, ঈশ্বরবিশ্বাসী। জগতের যা কিছু ভালো, তার উপর পরম আস্থাশীল। আপনাকে যেন কোনোভাবেই মেলানো যায় না ৬০-এর দশকের সেই প্রতিবাদী, বজ্রকঠিন গায়কীর সাথে! এরপর এলো ৯০-এর দশক, যে দশকের পরতে-পরতে জড়িয়ে আছে আমাদের বড় হয়ে ওঠা।

এই দশকে আপনি যেন অনেকটাই নিষ্প্রভ, অতীতের ছায়া। আর সবাই যখন আপনার সাংগীতিক জীবনের এপিটাফ রচনা করে ফেলেছে, মিস্টার ডিলান, কোনোদিন কি জানবেন ষোলো-আঠারো বছরের একটা ছেলে কিভাবে শবরীর প্রতীক্ষায় ছিলো আপনার ফিরে আসার? আপনি স্বমহিমায় ফিরে এলেন, ১৯৯৭-এর টাইম আউট অফ মাইন্ড দিয়ে। ১২ বারে বাঁধা ব্লুজ যে এত রোমাঞ্চক হতে পারে আপনাকে শুনেই ত তা প্রথম জানলাম। এই অ্যালবামে আপনি আবার নিজেকে ভাঙলেন। “লাভ সিক”, “ডার্ট রোড ব্লুজ”, “নট ডার্ক ইয়েট” শুনে থমকে গেলো সব্বাই।

ব্লুজ-রকের জগতেও আপনার সদর্প উপস্থিতি ঘোষিত হল। আর তারপর? তারপর তো ইতিহাস! “লাভ অ্যান্ড থেফট”, মডার্ন টাইমস, টুগেদার থ্রু লাইফ দিয়ে সম্পুর্ণ হল আপনার ব্লুজ রকের বৃত্ত। ২০০৫ সালে “লাভ অ্যান্ড থেফট” আর ২০০৬ সালে মডার্ন টাইমস নিয়ে, প্রায় ৬৫ বছরের আপনি ফের ফিরে এলেন বিলবোর্ড মিউজিক চার্ট এর শীর্ষে। যা এই বয়সে প্রায় অভাবনীয়! আপনার চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিকতা, অতিমানবিক মিথ ও মিথ্যে কথা, সমস্ত ফোক জগতের সাথে আপনার বিখ্যাত বিশ্বাসঘাতকতা, কিচ্ছু মনে রাখিনি আমি, মিস্টার ডিলান। মনে রাখতেও চাই নি, কারণ কি জানেন?কারণ, আপনার গানের পরাবাস্তবতা আমার যাবতীয় যুক্তি-তক্ক-গপ্পো ভাসিয়ে নিয়ে গেছে চিরকাল।

সাধে কি আর অ্যালান গিনসবার্গের মত কবি আপনাকে অভিহিত করেন, “আমাদের প্রজন্মের গীতিকার” বলে? নোবেল পুরষ্কারের জন্য অনেকবার উঠেছে আপনার নাম, হয়তঃ যে কোনোদিন পেয়েও যাবেন, কিন্তু আপনার মাপের কবি র কাছে সেটা কিই বা এমন আর? এখন সময় আবার নতুন গান শোনার, আবার নতুন করে আপনাকে চেনার। আপনি যে নতুন রূপে বারে বার ফিরে আসতে বড় ভালোবাসেন!
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।