‘শালা, সাইকোলজিস্ট? মেয়েদের সাথে ফস্টিনস্টি করস, মেরে হাড়গোড় ভেঙে চুরমার করে দেবো। পঙ্গু হতে না চাইলে বল, অ্যাডভোকেট সাহেবের মেয়ে কোথায়?’-সাজ্জাদের নিতম্বে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সজোরে একটা লাথি মেরে আক্কেলপুর থানার ওসি মামুনের খেদোক্তি। ওসি’র লাথিতে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে সাজ্জাদ। আরেকটা লাথি পড়ার আগেই সাজ্জাদ ওসি সাহেবকে বলে উঠে, ‘আল্লাহ’র কসম, বিশ্বাস করেন, ফারজানা কোথায় আমি জানি না, ও আমার বন্ধু ছিল। আমি তাকে আপন বোনের মতো ভালোবেসেছি।
ওর মাও আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে জানতেন। আমি তাকে অপহরণ করবো কেন?’ ওসি আরো রেগে যায়, ‘একদম মিথ্যা বলবে না, ঠিকঠাক মতো স্বীকার কর তুই-ই ফারজানাকে অপহরণ করেছিস। নইলে স্ক্রু দিয়ে হাতের নখ উপড়ে ফেলবো, কারেন্টের শক দিলে ঠিকই গরগর কইরা স্বীকার করবি। ’ বিরক্তিকর ভঙ্গিতে ওসি বলেন, ‘শালার সব কেসই এক, সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠে না। কিন্তু পুলিশ চাইলে আঙ্গুল যে কত বাঁকা করতে পারে তা ক্রিমিনালরা প্রথমে বুঝে না।
আঙ্গুল বাঁকা করার মজা হাড়ে হাড়ে টের পাবি শালা। ’ এভাবে সাজ্জাদকে ভয়-ভীতি দেখাতে থাকে ওসি। কিন্তু তার এক কথা, ‘ফারজানাকে আমি অপহরণ করিনি, সে কোথায় আমি জানি না। ’ সাজ্জাদকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে অ্যাডভোকেট কাদেরের কন্যা ফারজানাকে অপহরণ করেছে।
সাধারণত রিমান্ডে থানার সাব-ইন্সপেক্টর পর্যায়ের কর্মকর্তারা আসামিকে জেরা করে তথ্য বের করেন। কিন্তু অ্যাডভোকেট সাহেব মানী মানুষ, তার মেয়ে অপহৃত হয়েছে, তিনি নিজেই বাদি হয়ে মামলা করেছেন বলেই কোন এসআইকে না দিয়ে রিমান্ডের দায়িত্বটি ওসি সাহেব নিজেই নিয়েছেন। প্রথম দফার তিনদিন রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত, এই তিনদিনে তথ্য বের করা না গেলে আরো রিমান্ড চাওয়া হবে। এই কেসটা নিজের পেশাগত জীবনের অনেকটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন ওসি মামুন। কারণ, ব্যাপারটি একটু ব্যতিক্রম।
এর আগে এরকম অপহরণের ঘটনায় সরাসরি অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি। ভিকটিমকে উদ্ধার করতে গিয়ে ঘটনার মূলহোতার কোন সহযোগীকে গ্রেফতার করতে পারলে তাকে রিমান্ডে নেয়া হত। তার কাছ থেকে তথ্য বের করে সেই সূত্র ধরে ভিকটিমকে উদ্ধারে অভিযান চালানো হয়। ওই সময়ে ভিকটিমকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও প্রধান আসামি ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। এখন যার বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ সেই ব্যক্তিকে আগেই গ্রেফতার করতে পেরেছে পুলিশ।
অবশ্য মাঝে মাঝে ওসি নিজেও সন্দিহান হয়ে পড়ে যে, এই ছেলে ফারজানাকে অপহরণ করলে সে তো মেয়েটিকে নিয়ে কোন নিরাপদ অবস্থানে চলে যেত। কিন্তু পুলিশ তাকে শহরের বাসা থেকে গ্রেফতার করেছে। অ্যাডভোকেট সাহেবের কন্যা ‘অপহৃত’ হওয়ার বিষয়টি ওসি মামুনের কাছেই রহস্যময় মনে হচ্ছে! সাজ্জাদের মা থানা হাজতে এসে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠেন। ওসি সাহেবের হাতে-পায়ে ধরে বলেন, ‘আমার ছেলে জীবনে একটি শব্দও মিথ্যা বলেনি, কোন মানুষকে কষ্ট দিতে চায়নি। আমার গুণী ছেলে, সে কখনো এই কাজ করেনি।
পরিবারের সবাইকে সে সদুপদেশ দেয়, কত ভালো ছেলে। ছোট থেকেই সে মানবিক অনুভূতিসম্পন্ন। আমার নিষ্পাপ ছেলেকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়ার বিচার আল্লাহ করবেন। ’ সাজ্জাদের মায়ের কান্না কিংবা অভিশাপ পুলিশের কাছে অর্থহীন। তাদের কাছে ‘আসামির মায়ের কান্না’ কেবল কিছু অপ্রাসঙ্গিক শব্দ।
কারো কান্না কিংবা অভিশাপে তাদের কিছু যায় আসে না। কারণ, পুলিশের পেশাগত জীবনে এ রকম ব্যাপার প্রায় প্রতিদিনই ঘটে। কোন পুরুষ গ্রেফতার হলেই প্রথমে দৌড়ে থানায় চলে আসেন তার মমতাময়ী মা। ছেলে দোষী না নির্দোষ তা ভাবে না, কান্না জুড়ে দিয়ে ছেলের মুক্তির জন্য পুলিশের হাত-পা ধরে। আসামি গ্রেফতারের পর ছেড়ে দেয়ার অধিকার যে পুলিশের নাই তা মায়েরা বুঝে না, অথবা বুঝেও মমতাময়ী তার মায়াকান্না ধরে রাখতে পারেনা।
পুলিশ নির্দয়ভাবে আসামির মাকেও অনেক সময় ভর্ৎসনা করে। আমাদের দেশের পুলিশ বোধহয় কোনোদিনও সভ্য হবে না। সাজ্জাদ মনোবিজ্ঞানে মাস্টার্স করা ছেলে, যে এখন ‘কমপ্লেক্স অব হিউম্যান সাইকোলজি’ নিয়ে এমফিল করছে। তার বিরুদ্ধে এখনও কোন অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি অথচ পুলিশ তুই-থুকরি আচরণ করছে, রিমান্ডে নিয়ে পাছায় লাথি দিচ্ছে। পুলিশ যে জনগণের সেবক এবং সেবাই যে পুলিশের ধর্ম-তা যেন তাদের মনেই থাকে না।
সেবকের সম্বোধন যে ‘শালা’ নয়, ‘স্যার’ এ শিক্ষা আমাদের পুলিশ কখনোই পায়নি। তাই তাদের কাছে গড়পড়তা সবাই ‘আসামি’ এবং সবাইকে ‘শালা’ সম্বোধন! দুই দফায় ছয় দিনের রিমান্ডে সাজ্জাদের ওপর চরম নির্যাতন চালিয়েছে পুলিশ। এতে তার শরীরের বিভিন্নস্থানে মারাত্মক জখম হয়েছে। তার মেরুদণ্ডে আঘাত লেগেছে। বেতের আঘাত ও লাথিতে হাঁটু-কনুই ফুলে গেছে।
শিক্ষিত মানুষ, বিনাকারণে পুলিশের হাতে এভাবে নির্যাতিত হলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারত কিন্তু সাজ্জাদ মনোবিজ্ঞানের ছাত্র। সব পরিস্থিতিতে নিজেকে শক্ত রাখার পাঠ তাকে মনোবিজ্ঞান দিয়েছে। দুই দফা রিমান্ডে নিয়েও ফারজানার ‘অপহরণ’ রহস্যের কূল-কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। তার শরীরে শক্তি নেই, এখন আর রিমান্ডেও নেয়া যাচ্ছে না। এ কারণে সাজ্জাদকে নিয়ে উল্টো বেকায়দার পড়ে তারা।
শেষমেষ তাকে আদালতে সোপর্দ করা হল। রিমান্ডে পাওয়া কিছু তথ্য পুলিশ আদালতে উপস্থাপন করেছে। সাজ্জাদ পুলিশকে জানিয়েছে : অ্যাডভোকেট কাদেরের কন্যা ফারজানা তার বন্ধু। ইন্টারমিডিয়েটে তারা একই সাথে পড়েছে। তাদের সম্পর্কের বিষয়টি ফারজানার মাও জানতেন।
ওর মা সাজ্জাদকে ছেলের মতো স্নেহ করেন, বাড়িতে বেড়াতে আসলে নিজের হাতে খাইয়ে দেন। ফারজানার জীবনে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। সে যে ছেলেটিকে জীবনের সবকিছু উজাড় করে দিয়ে ভালোবেসেছিল, যাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চেয়েছিল সেই ছেলেটি কথা রাখেনি। ফারজানাকে অকূলে ভাসিয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করেছে। বিশ্বাস ভেঙে যাওয়ার, প্রিয় মানুষটির কথা না রাখার এ কষ্টের দহনে দগ্ধ হতে হতে ফারজানা মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, বিষয়টি সে নিজেই জানে না।
অথচ তার আচার-আচরণে তা স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। মনোরোগের প্রথম স্তর হলো ‘সিজোফ্রেনিয়া’। কিন্তু ফারজানার মনোরোগ এখন চরম স্তরে, এর নাম ‘সাইকৌসিস’, যার অর্থ-সাংঘাতিকরূপে অস্বাভাবিক বা রুগ্ন মানসিক অবস্থা, মনোবৈকল্য। এ ধরনের রোগীর আত্মহত্যা করার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। বন্ধুর এ চরম মানসিক অস্থিরতার বিষয়টি সাজ্জাদকে ভাবিয়ে তুলে, সে প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় দিতে সিদ্ধান্ত নেয় ফারজানাকে বাঁচাতে হবে।
কারণ, বিপদেই প্রকৃত বন্ধুর পরিচয়, বন্ধুর বিপদের দিনে এগিয়ে আসা বন্ধুর কর্তব্য। সাজ্জাদ পুলিশকে আরো জানিয়েছে, ফারজানার সাথে ফোনে দুয়েকদিন কথা বলার পর তার মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয় যে, মেয়েটি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। সাইকোলজিস্টরা কারো সাথে দুয়েকবার কথা বললেই তার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পান। তরুণ সাইকোলজিস্ট হিসেবে এসব ব্যাপারে সাজ্জাদের আগ্রহ একটু বেশিই। পুরোপুরি পেশাজীবী হওয়ার আগে ইন্টার্নি করার মতোই কারো ভেতরে মনোরোগের লক্ষণ দেখলেই সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট দেয়ার চেষ্টা করে সাজ্জাদ।
ফারজানার কথাবার্তায় বেশ অসঙ্গতিও খুঁজে পাওয়া গেল। একদিন জানালো তার কাছে যে মোবাইল ফোন আছে তা তার ভাইয়া জানেন না, চুরি করে ফোন ব্যবহার করেন। আরেকদিন ফোন ব্যস্ত পেয়ে কে ফোন করেছে জিজ্ঞ্যেস করাতে বলল, ভাইয়া ফোন করেছে! এ রকম আরো অনেক ধরনের অসঙ্গতি তার আচার-আচরণে সাজ্জাদের কাছে ধরা পড়ে। মনোবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী, ‘সাইকৌসিস’ আক্রান্তকে স্বাভাবিক করার জন্য তার প্রতি বিপরীতে লিঙ্গের কাউকে গভীর ভালোবাসা দেখাতে হবে, তার সাথে এমন আচরণ করতে হবে যাতে সে মনে করে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার একটা সুন্দর অর্থ আছে। তার রূপ-গুণের প্রশংসা করতে হবে এবং কোন ব্যাপারে তার বিরুদ্ধাচরণ করা যাবে না।
ঠিক সেই সূত্র অনুযায়ীই কাজ শুরু করে সাজ্জাদ, নানাভাবে ট্রিটমেন্ট দিতে থাকে ফারজানাকে। এর মধ্যে এক পর্যায়ে সাজ্জাদের ভালোবাসা পেয়ে ফারজানার ভেতরে এক ধরনের শক্তি তৈরি হয়, সে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। একদিন ফারজানা স্বীকারও করে, ‘মনে হয় আমি তোমার জন্যই বেঁচে আছি। ’ কিন্তু এরপর কী হয়েছে সাজ্জাদ কিছুই জানে না। হঠাৎ ফারজানার উধাও হয়ে যাওয়ার বিষয়টি তার কাছেও রহস্যজনক।
তবে পুলিশকে মনোবিজ্ঞানের একটি সূত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে সাজ্জাদ দাবি করেছে, ‘ফারজানা সম্ভবত সাইকৌসিস থেকে মুক্ত হয়ে গেছে। এ থেকে মুক্ত হয়ে যে কেউ নিজের ভেতরের শক্তি সম্পর্কে অবগত হয়। নিজের জীবনের জন্য সর্বোচ্চ ভালো বিষয়টি খুঁজে নিতে পারে, তার ভেতরে যৌক্তিকতা প্রাধান্য পায়, জীবনদর্শন-জীবনবোধ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা বাড়ে। ফারজানা সাইকৌসিস মুক্ত হয়ে বুঝতে পেরেছে তার জীবনের জন্য এই মুহূর্তের করণীয় কি। হয়তো সে কোন পুরুষকে নীরবে বিয়ে করেছে, বিষয়টি বাবা-মাকে জানিয়ে নতুন কোন ঝামেলা পাকাতে চায়নি।
সাজ্জাদের সন্দেহ, ফারজানার বেশ কয়েকজন বিবাহযোগ্য বন্ধু ছিল, তাদের কাউকেই সে নীরবে বিয়ে করেছে। ’-পুলিশের এই বক্তব্যকে আসামির জবানবন্দি হিসেবে গ্রহণ করতে পারেনি আদালত, কারণ ভিকটিম উদ্ধার হয়নি। এমনকি ‘অপহরণ’ রহস্যও ভেদ করা যায়নি। এ অবস্থায় আদালতও ফারজানার অবস্থান নিয়ে রহস্যে পড়ে যায়। শুনানি শেষে ‘ফারজানা উদ্ধার না হওয়া এবং তার সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত অভিযুক্ত সাজ্জাদকে কারাগারে বন্দি রাখা হোক’ মর্মে অন্তবর্তীকালীন রায় দেয় আদালত।
এরপর দুই বছর ধরে ফারজানার কোন সন্ধান মিলেনি। এই পুরোটা সময় সাজ্জাদ কারাগারে। এর মধ্যে তার মা বেশ কয়েকবার আদালতে জামিন নিতে এসেছিলেন। কিন্তু আদালত আবেদন নামঞ্জুর করে দিয়েছে। এর পেছনে অবশ্য ফারজানার বাবার প্রভাব কাজ করেছে।
তিনি নিজেও আইনজীবী, মামলার শুনানিতে আইনজীবী বন্ধুদের সবাইকে আদালতের দাঁড় করিয়ে দেন। ফলে প্রতিপক্ষের আইনজীবীরা যুক্তিতে পেরে উঠেনি। সাজ্জাদের মা ছেলের জন্য গভীর বেদনার কান্না বুকে চেপে আদালত ত্যাগ করেন, ফারজানার বাবার প্রভাবের কাছে তিনি অসহায়! সমাজের কিছু মানুষ এভাবে অযৌক্তিকভাবে প্রভাব খাটিয়ে অন্যকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়, তারা অপরের কষ্ট অনুভব করতে পারে না। পুরো ব্যাপারটির সাথে ফারজানার মায়ের কোন ভূমিকা নেই, যিনি সাজ্জাদকে নিজের হাতে খাইয়ে দিতেন, আদর করে বুকে জড়িয়ে নিতেন, তিনিও সম্ভবত সাজ্জাদকে ভুল বুঝেছেন, প্রতিপক্ষ ভাবছেন-এ কারণে তাকে একবার দেখতেও আসেন নি। কারাগারে সাজ্জাদকে তাও বেশ পীড়া দেয়।
আত্মপ্রয়োজনে মানুষ আশ্চর্যজনকভাবে বদলে যেতে পরে, এটা এক ধরনের সাইকোলজি। এই ভদ্র মহিলাও সম্ভবত বদলে গেছেন, তিনি একজন মা হয়েও আরেকজন মায়ের হৃদয়ের কষ্ট অনুভব করতে পারেন নি। তিনি একবারও অ্যাডভোকেট কাদেরকে বলেন নি, ‘ছেলেটা তো ভালো ছিল, সে হয়তো এ কাজ করেনি। ’ তার এটা বলার দরকার ছিল। কারণ, ভদ্র মহিলা জানতেন সাজ্জাদ ছিল ফারজানার ভালো বন্ধু, তাকে সবসময় সদুপদেশ দিয়েছে।
ফারজানাকে বিয়ে করার কোন মানসিকতা তার ছিল না। সুতরাং যার ভেতরে এই ধরনের মানসিকতা নেই সে কোন কারণে, কোন যুক্তিতে ফারজানাকে অপহরণ করবে? এ বিষয়টি শিক্ষিত মহিলা হিসেবে তার ভেতরে স্পষ্ট থাকারই কথা। অথচ, সাজ্জাদকে বিনা কারণে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে জেনেও তিনি মুখ খুলেন নি। কিছু পরিস্থিতিতে প্রকৃতি মানুষকে বোবা বানিয়ে দেয়! অবশেষে সাজ্জাদের মনোবিজ্ঞানের ব্যাখ্যাই সত্য হয়েছে, ফারজানাকে কেউ অপরহণ করেনি, সে তার ডাক্তার বন্ধুর সাথে পালিয়ে বিয়ে করেছে। তাদের সংসারে একটি ফুলও ফুটেছে।
বিষয়টি এতদিন গোপন রাখার কারণ হিসেবে ফারজানার যুক্তি হলো, ‘ঘরে বিয়ের প্রস্তাব আসলেই প্রতিবেশী ও পরিচিত কিছু কুচক্রী হীন চরিত্রের মানুষ পাত্রপক্ষের কাছে ফারজানার কুৎসা রটাতো। সবকিছু ঠিকঠাক, পাত্রী পছন্দও হতো কিন্তু কী একটা কারণে পাত্রপক্ষ হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদলে নিত। আর বিয়ে হতো না। এ কারণে ফারজানা সিদ্ধান্ত নেয়, গোপনে বিয়ে করবে এবং সন্তানের মা না হওয়া পর্যন্ত কাউকেই জানাবে না। ’ সাইকৌসিস থেকে মুক্তির পর যে কেউ নিজের সর্বোচ্চ ভালো দিকটি বেছে নিতে পারে-এ যুক্তিটি ছিল সাজ্জাদের, ফারজানার সিদ্ধান্ত তারই প্রমাণ বহন করে।
ফারজানা সংসার করছে, আর তাকে সাইকৌসিস থেকে মুক্তি দেয়ার ‘পাপ’ করে সাজ্জাদ কারাগারে দিন কাটাচ্ছে! মানুষের নিয়তি মাঝে মাঝে এমন বৈপরিত্য হয়, নিয়তির লীলা মানুষ বুঝে উঠতে পারে না। আক্কেলপুর থানার ওসি মামুন বদলি হয়ে গেছেন। তিনিই অপহরণ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন। ফারজানা অপহৃত হয়নি এটা তিনি জানলে সাজ্জাদের ওপর নির্যাতনের জন্য অনুশোচনা করতেন হয়তো। মেয়ে ফিরে আসার পর অ্যাডভোকেট কাদেরের বোধোদয় হলো, তিনি আদালতে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন জানালেন।
এ ধরনের ক্ষেত্রে আসামির উল্টো মানহানি মামলা করার ঝুঁকি থাকে কিন্তু অ্যাডভোকেট সাহেব নিশ্চিত যে সাজ্জাদের মা তা করবেন না। কারণ, মহিলা ইতোমধ্যে বুঝে গেছেন অ্যাডভোকেট কাদেরের প্রভাব আদালতে অনেক বেশি। কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি পৌঁছে সাজ্জাদ মাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। এতদিন পর ছেলেকে পেয়ে আবেগে তার মায়ের কণ্ঠ স্তব্ধ। অনেকক্ষণ ধরে দু’জনার কেউই কোন কথা বলতে পারল না।
অমাবশ্যার নিকশ কালো অন্ধকারে ঢেকে গেছে চারিদিকের পৃথিবী। পাশে বসা মানুষটিকেও দেখা যাচ্ছে না। শব্দহীন-অদৃশ্যভাবে বসে আছে সাজ্জাদ ও তার মা। শেষে নীরবতা ভেঙে মা বললেন, ‘বাছাধন, কী পাপ করেছিলে? কার পাপে, কিসের পাপে তোমাকে এমন কষ্ট পেতে হলো?’ সাজ্জাদ বলল, মা, একজন সাইকোলজিস্ট হিসেবে আমি তাদের মেয়েটাকে ‘সাইকৌসিস’ থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলাম। তার ভাঙা হৃদয়ের কষ্ট মুছে দিয়ে নতুন শক্তিতে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলাম, কোন অন্যায় করিনি।
মনোবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী, ঠিক ওই সময়ে আমি ফারজানাকে ট্রিটমেন্ট না দিলে সে এর কিছুদিনের মধ্যেই জীবন-যন্ত্রণায় নীরবে পুড়তে পুড়তে আত্মহত্যা করে বসতো। কারণ, সে যে বেদনা বয়ে বেড়াত তা শেয়ার করার কেউ ছিল না, কাউকে বুঝাতে পারত না হৃদয়ের যন্ত্রণা-দহন। আমি তার ভেতরে বেঁচে থাকার শক্তি তৈরি করে দিয়েছিলাম। ফারজানাকে ভালোবেসে, সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট দিয়ে আত্মঘাতী কোন চরম দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করাটা কি আমার পাপ? বলো মা, এটা কি আমার পাপ?-এসব কথা বলতে বলতে সাজ্জাদ ভয়ংকর হয়ে উঠে। তার চোখে-মুখে হিংস্রতা প্রশ্রয় পেতে থাকে, ক্ষোভে কাঁপতে থাকে পুরো শরীর।
অন্ধকারের ভেতরেও সাজ্জাদের ক্ষোভের উত্তাপ কতটা প্রবল তা বুঝতে পারেন তার মা। উন্মত্ত সাজ্জাদ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। মাকে বলে উঠে, ‘রিমান্ডে আমার শরীর ভেঙে গেছে, কারাগারে দুটি বছর আমার জীবন থেকে হারিয়েছে, আমার এমফিল-পিএইচডির স্বপ্নও ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে। আমি এর প্রতিশোধ নেব। ’ অন্ধকারে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়ে প্রচণ্ড ক্ষিপ্তকণ্ঠে সাজ্জাদ বলেন, ‘আমি খুন করবো মা, আমি তাদের খুন করে ফেলবো!’ ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে সাজ্জাদের মা বলে উঠেন, ‘ওরা তোমার ওপর অন্যায় করেছে, তুমি তাদের ওপর কোন অন্যায় করতে যেও না, বাবা।
কারণ, প্রকৃতি অন্যায় সহ্য করে না। ধীরে ধীরে এর প্রতিশোধ নেয়। প্রকৃতি একদিন এর প্রতিশোধ নেবে, প্রকৃতির প্রতিশোধ বড়ই নির্মম!’ ‘শালা, সাইকোলজিস্ট? মেয়েদের সাথে ফস্টিনস্টি করস, মেরে হাড়গোড় ভেঙে চুরমার করে দেবো। পঙ্গু হতে না চাইলে বল, অ্যাডভোকেট সাহেবের মেয়ে কোথায়?’-সাজ্জাদের নিতম্বে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সজোরে একটা লাথি মেরে আক্কেলপুর থানার ওসি মামুনের খেদোক্তি। ওসি’র লাথিতে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে সাজ্জাদ।
আরেকটা লাথি পড়ার আগেই সাজ্জাদ ওসি সাহেবকে বলে উঠে, ‘আল্লাহ’র কসম, বিশ্বাস করেন, ফারজানা কোথায় আমি জানি না, ও আমার বন্ধু ছিল। আমি তাকে আপন বোনের মতো ভালোবেসেছি। ওর মাও আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে জানতেন। আমি তাকে অপহরণ করবো কেন?’ ওসি আরো রেগে যায়, ‘একদম মিথ্যা বলবে না, ঠিকঠাক মতো স্বীকার কর তুই-ই ফারজানাকে অপহরণ করেছিস। নইলে স্ক্রু দিয়ে হাতের নখ উপড়ে ফেলবো, কারেন্টের শক দিলে ঠিকই গরগর কইরা স্বীকার করবি।
’ বিরক্তিকর ভঙ্গিতে ওসি বলেন, ‘শালার সব কেসই এক, সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠে না। কিন্তু পুলিশ চাইলে আঙ্গুল যে কত বাঁকা করতে পারে তা ক্রিমিনালরা প্রথমে বুঝে না। আঙ্গুল বাঁকা করার মজা হাড়ে হাড়ে টের পাবি শালা। ’ এভাবে সাজ্জাদকে ভয়-ভীতি দেখাতে থাকে ওসি। কিন্তু তার এক কথা, ‘ফারজানাকে আমি অপহরণ করিনি, সে কোথায় আমি জানি না।
’ সাজ্জাদকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে অ্যাডভোকেট কাদেরের কন্যা ফারজানাকে অপহরণ করেছে। সাধারণত রিমান্ডে থানার সাব-ইন্সপেক্টর পর্যায়ের কর্মকর্তারা আসামিকে জেরা করে তথ্য বের করেন। কিন্তু অ্যাডভোকেট সাহেব মানী মানুষ, তার মেয়ে অপহৃত হয়েছে, তিনি নিজেই বাদি হয়ে মামলা করেছেন বলেই কোন এসআইকে না দিয়ে রিমান্ডের দায়িত্বটি ওসি সাহেব নিজেই নিয়েছেন। প্রথম দফার তিনদিন রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত, এই তিনদিনে তথ্য বের করা না গেলে আরো রিমান্ড চাওয়া হবে।
এই কেসটা নিজের পেশাগত জীবনের অনেকটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন ওসি মামুন। কারণ, ব্যাপারটি একটু ব্যতিক্রম। এর আগে এরকম অপহরণের ঘটনায় সরাসরি অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি। ভিকটিমকে উদ্ধার করতে গিয়ে ঘটনার মূলহোতার কোন সহযোগীকে গ্রেফতার করতে পারলে তাকে রিমান্ডে নেয়া হত। তার কাছ থেকে তথ্য বের করে সেই সূত্র ধরে ভিকটিমকে উদ্ধারে অভিযান চালানো হয়।
ওই সময়ে ভিকটিমকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও প্রধান আসামি ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। এখন যার বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ সেই ব্যক্তিকে আগেই গ্রেফতার করতে পেরেছে পুলিশ। অবশ্য মাঝে মাঝে ওসি নিজেও সন্দিহান হয়ে পড়ে যে, এই ছেলে ফারজানাকে অপহরণ করলে সে তো মেয়েটিকে নিয়ে কোন নিরাপদ অবস্থানে চলে যেত। কিন্তু পুলিশ তাকে শহরের বাসা থেকে গ্রেফতার করেছে। অ্যাডভোকেট সাহেবের কন্যা ‘অপহৃত’ হওয়ার বিষয়টি ওসি মামুনের কাছেই রহস্যময় মনে হচ্ছে! সাজ্জাদের মা থানা হাজতে এসে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠেন।
ওসি সাহেবের হাতে-পায়ে ধরে বলেন, ‘আমার ছেলে জীবনে একটি শব্দও মিথ্যা বলেনি, কোন মানুষকে কষ্ট দিতে চায়নি। আমার গুণী ছেলে, সে কখনো এই কাজ করেনি। পরিবারের সবাইকে সে সদুপদেশ দেয়, কত ভালো ছেলে। ছোট থেকেই সে মানবিক অনুভূতিসম্পন্ন। আমার নিষ্পাপ ছেলেকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়ার বিচার আল্লাহ করবেন।
’ সাজ্জাদের মায়ের কান্না কিংবা অভিশাপ পুলিশের কাছে অর্থহীন। তাদের কাছে ‘আসামির মায়ের কান্না’ কেবল কিছু অপ্রাসঙ্গিক শব্দ। কারো কান্না কিংবা অভিশাপে তাদের কিছু যায় আসে না। কারণ, পুলিশের পেশাগত জীবনে এ রকম ব্যাপার প্রায় প্রতিদিনই ঘটে। কোন পুরুষ গ্রেফতার হলেই প্রথমে দৌড়ে থানায় চলে আসেন তার মমতাময়ী মা।
ছেলে দোষী না নির্দোষ তা ভাবে না, কান্না জুড়ে দিয়ে ছেলের মুক্তির জন্য পুলিশের হাত-পা ধরে। আসামি গ্রেফতারের পর ছেড়ে দেয়ার অধিকার যে পুলিশের নাই তা মায়েরা বুঝে না, অথবা বুঝেও মমতাময়ী তার মায়াকান্না ধরে রাখতে পারেনা। পুলিশ নির্দয়ভাবে আসামির মাকেও অনেক সময় ভর্ৎসনা করে। আমাদের দেশের পুলিশ বোধহয় কোনোদিনও সভ্য হবে না। সাজ্জাদ মনোবিজ্ঞানে মাস্টার্স করা ছেলে, যে এখন ‘কমপ্লেক্স অব হিউম্যান সাইকোলজি’ নিয়ে এমফিল করছে।
তার বিরুদ্ধে এখনও কোন অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি অথচ পুলিশ তুই-থুকরি আচরণ করছে, রিমান্ডে নিয়ে পাছায় লাথি দিচ্ছে। পুলিশ যে জনগণের সেবক এবং সেবাই যে পুলিশের ধর্ম-তা যেন তাদের মনেই থাকে না। সেবকের সম্বোধন যে ‘শালা’ নয়, ‘স্যার’ এ শিক্ষা আমাদের পুলিশ কখনোই পায়নি। তাই তাদের কাছে গড়পড়তা সবাই ‘আসামি’ এবং সবাইকে ‘শালা’ সম্বোধন! দুই দফায় ছয় দিনের রিমান্ডে সাজ্জাদের ওপর চরম নির্যাতন চালিয়েছে পুলিশ। এতে তার শরীরের বিভিন্নস্থানে মারাত্মক জখম হয়েছে।
তার মেরুদণ্ডে আঘাত লেগেছে। বেতের আঘাত ও লাথিতে হাঁটু-কনুই ফুলে গেছে। শিক্ষিত মানুষ, বিনাকারণে পুলিশের হাতে এভাবে নির্যাতিত হলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারত কিন্তু সাজ্জাদ মনোবিজ্ঞানের ছাত্র। সব পরিস্থিতিতে নিজেকে শক্ত রাখার পাঠ তাকে মনোবিজ্ঞান দিয়েছে। দুই দফা রিমান্ডে নিয়েও ফারজানার ‘অপহরণ’ রহস্যের কূল-কিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
তার শরীরে শক্তি নেই, এখন আর রিমান্ডেও নেয়া যাচ্ছে না। এ কারণে সাজ্জাদকে নিয়ে উল্টো বেকায়দার পড়ে তারা। শেষমেষ তাকে আদালতে সোপর্দ করা হল। রিমান্ডে পাওয়া কিছু তথ্য পুলিশ আদালতে উপস্থাপন করেছে। সাজ্জাদ পুলিশকে জানিয়েছে : অ্যাডভোকেট কাদেরের কন্যা ফারজানা তার বন্ধু।
ইন্টারমিডিয়েটে তারা একই সাথে পড়েছে। তাদের সম্পর্কের বিষয়টি ফারজানার মাও জানতেন। ওর মা সাজ্জাদকে ছেলের মতো স্নেহ করেন, বাড়িতে বেড়াতে আসলে নিজের হাতে খাইয়ে দেন। ফারজানার জীবনে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। সে যে ছেলেটিকে জীবনের সবকিছু উজাড় করে দিয়ে ভালোবেসেছিল, যাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চেয়েছিল সেই ছেলেটি কথা রাখেনি।
ফারজানাকে অকূলে ভাসিয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করেছে। বিশ্বাস ভেঙে যাওয়ার, প্রিয় মানুষটির কথা না রাখার এ কষ্টের দহনে দগ্ধ হতে হতে ফারজানা মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, বিষয়টি সে নিজেই জানে না। অথচ তার আচার-আচরণে তা স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। মনোরোগের প্রথম স্তর হলো ‘সিজোফ্রেনিয়া’। কিন্তু ফারজানার মনোরোগ এখন চরম স্তরে, এর নাম ‘সাইকৌসিস’, যার অর্থ-সাংঘাতিকরূপে অস্বাভাবিক বা রুগ্ন মানসিক অবস্থা, মনোবৈকল্য।
এ ধরনের রোগীর আত্মহত্যা করার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। বন্ধুর এ চরম মানসিক অস্থিরতার বিষয়টি সাজ্জাদকে ভাবিয়ে তুলে, সে প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় দিতে সিদ্ধান্ত নেয় ফারজানাকে বাঁচাতে হবে। কারণ, বিপদেই প্রকৃত বন্ধুর পরিচয়, বন্ধুর বিপদের দিনে এগিয়ে আসা বন্ধুর কর্তব্য। সাজ্জাদ পুলিশকে আরো জানিয়েছে, ফারজানার সাথে ফোনে দুয়েকদিন কথা বলার পর তার মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয় যে, মেয়েটি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। সাইকোলজিস্টরা কারো সাথে দুয়েকবার কথা বললেই তার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পান।
তরুণ সাইকোলজিস্ট হিসেবে এসব ব্যাপারে সাজ্জাদের আগ্রহ একটু বেশিই। পুরোপুরি পেশাজীবী হওয়ার আগে ইন্টার্নি করার মতোই কারো ভেতরে মনোরোগের লক্ষণ দেখলেই সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট দেয়ার চেষ্টা করে সাজ্জাদ। ফারজানার কথাবার্তায় বেশ অসঙ্গতিও খুঁজে পাওয়া গেল। একদিন জানালো তার কাছে যে মোবাইল ফোন আছে তা তার ভাইয়া জানেন না, চুরি করে ফোন ব্যবহার করেন। আরেকদিন ফোন ব্যস্ত পেয়ে কে ফোন করেছে জিজ্ঞ্যেস করাতে বলল, ভাইয়া ফোন করেছে! এ রকম আরো অনেক ধরনের অসঙ্গতি তার আচার-আচরণে সাজ্জাদের কাছে ধরা পড়ে।
মনোবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী, ‘সাইকৌসিস’ আক্রান্তকে স্বাভাবিক করার জন্য তার প্রতি বিপরীতে লিঙ্গের কাউকে গভীর ভালোবাসা দেখাতে হবে, তার সাথে এমন আচরণ করতে হবে যাতে সে মনে করে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার একটা সুন্দর অর্থ আছে। তার রূপ-গুণের প্রশংসা করতে হবে এবং কোন ব্যাপারে তার বিরুদ্ধাচরণ করা যাবে না। ঠিক সেই সূত্র অনুযায়ীই কাজ শুরু করে সাজ্জাদ, নানাভাবে ট্রিটমেন্ট দিতে থাকে ফারজানাকে। এর মধ্যে এক পর্যায়ে সাজ্জাদের ভালোবাসা পেয়ে ফারজানার ভেতরে এক ধরনের শক্তি তৈরি হয়, সে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। একদিন ফারজানা স্বীকারও করে, ‘মনে হয় আমি তোমার জন্যই বেঁচে আছি।
’ কিন্তু এরপর কী হয়েছে সাজ্জাদ কিছুই জানে না। হঠাৎ ফারজানার উধাও হয়ে যাওয়ার বিষয়টি তার কাছেও রহস্যজনক। তবে পুলিশকে মনোবিজ্ঞানের একটি সূত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে সাজ্জাদ দাবি করেছে, ‘ফারজানা সম্ভবত সাইকৌসিস থেকে মুক্ত হয়ে গেছে। এ থেকে মুক্ত হয়ে যে কেউ নিজের ভেতরের শক্তি সম্পর্কে অবগত হয়। নিজের জীবনের জন্য সর্বোচ্চ ভালো বিষয়টি খুঁজে নিতে পারে, তার ভেতরে যৌক্তিকতা প্রাধান্য পায়, জীবনদর্শন-জীবনবোধ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা বাড়ে।
ফারজানা সাইকৌসিস মুক্ত হয়ে বুঝতে পেরেছে তার জীবনের জন্য এই মুহূর্তের করণীয় কি। হয়তো সে কোন পুরুষকে নীরবে বিয়ে করেছে, বিষয়টি বাবা-মাকে জানিয়ে নতুন কোন ঝামেলা পাকাতে চায়নি। সাজ্জাদের সন্দেহ, ফারজানার বেশ কয়েকজন বিবাহযোগ্য বন্ধু ছিল, তাদের কাউকেই সে নীরবে বিয়ে করেছে। ’-পুলিশের এই বক্তব্যকে আসামির জবানবন্দি হিসেবে গ্রহণ করতে পারেনি আদালত, কারণ ভিকটিম উদ্ধার হয়নি। এমনকি ‘অপহরণ’ রহস্যও ভেদ করা যায়নি।
এ অবস্থায় আদালতও ফারজানার অবস্থান নিয়ে রহস্যে পড়ে যায়। শুনানি শেষে ‘ফারজানা উদ্ধার না হওয়া এবং তার সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত অভিযুক্ত সাজ্জাদকে কারাগারে বন্দি রাখা হোক’ মর্মে অন্তবর্তীকালীন রায় দেয় আদালত। এরপর দুই বছর ধরে ফারজানার কোন সন্ধান মিলেনি। এই পুরোটা সময় সাজ্জাদ কারাগারে। এর মধ্যে তার মা বেশ কয়েকবার আদালতে জামিন নিতে এসেছিলেন।
কিন্তু আদালত আবেদন নামঞ্জুর করে দিয়েছে। এর পেছনে অবশ্য ফারজানার বাবার প্রভাব কাজ করেছে। তিনি নিজেও আইনজীবী, মামলার শুনানিতে আইনজীবী বন্ধুদের সবাইকে আদালতের দাঁড় করিয়ে দেন। ফলে প্রতিপক্ষের আইনজীবীরা যুক্তিতে পেরে উঠেনি। সাজ্জাদের মা ছেলের জন্য গভীর বেদনার কান্না বুকে চেপে আদালত ত্যাগ করেন, ফারজানার বাবার প্রভাবের কাছে তিনি অসহায়! সমাজের কিছু মানুষ এভাবে অযৌক্তিকভাবে প্রভাব খাটিয়ে অন্যকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়, তারা অপরের কষ্ট অনুভব করতে পারে না।
পুরো ব্যাপারটির সাথে ফারজানার মায়ের কোন ভূমিকা নেই, যিনি সাজ্জাদকে নিজের হাতে খাইয়ে দিতেন, আদর করে বুকে জড়িয়ে নিতেন, তিনিও সম্ভবত সাজ্জাদকে ভুল বুঝেছেন, প্রতিপক্ষ ভাবছেন-এ কারণে তাকে একবার দেখতেও আসেন নি। কারাগারে সাজ্জাদকে তাও বেশ পীড়া দেয়। আত্মপ্রয়োজনে মানুষ আশ্চর্যজনকভাবে বদলে যেতে পরে, এটা এক ধরনের সাইকোলজি। এই ভদ্র মহিলাও সম্ভবত বদলে গেছেন, তিনি একজন মা হয়েও আরেকজন মায়ের হৃদয়ের কষ্ট অনুভব করতে পারেন নি। তিনি একবারও অ্যাডভোকেট কাদেরকে বলেন নি, ‘ছেলেটা তো ভালো ছিল, সে হয়তো এ কাজ করেনি।
’ তার এটা বলার দরকার ছিল। কারণ, ভদ্র মহিলা জানতেন সাজ্জাদ ছিল ফারজানার ভালো বন্ধু, তাকে সবসময় সদুপদেশ দিয়েছে। ফারজানাকে বিয়ে করার কোন মানসিকতা তার ছিল না। সুতরাং যার ভেতরে এই ধরনের মানসিকতা নেই সে কোন কারণে, কোন যুক্তিতে ফারজানাকে অপহরণ করবে? এ বিষয়টি শিক্ষিত মহিলা হিসেবে তার ভেতরে স্পষ্ট থাকারই কথা। অথচ, সাজ্জাদকে বিনা কারণে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে জেনেও তিনি মুখ খুলেন নি।
কিছু পরিস্থিতিতে প্রকৃতি মানুষকে বোবা বানিয়ে দেয়! অবশেষে সাজ্জাদের মনোবিজ্ঞানের ব্যাখ্যাই সত্য হয়েছে, ফারজানাকে কেউ অপরহণ করেনি, সে তার ডাক্তার বন্ধুর সাথে পালিয়ে বিয়ে করেছে। তাদের সংসারে একটি ফুলও ফুটেছে। বিষয়টি এতদিন গোপন রাখার কারণ হিসেবে ফারজানার যুক্তি হলো, ‘ঘরে বিয়ের প্রস্তাব আসলেই প্রতিবেশী ও পরিচিত কিছু কুচক্রী হীন চরিত্রের মানুষ পাত্রপক্ষের কাছে ফারজানার কুৎসা রটাতো। সবকিছু ঠিকঠাক, পাত্রী পছন্দও হতো কিন্তু কী একটা কারণে পাত্রপক্ষ হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদলে নিত। আর বিয়ে হতো না।
এ কারণে ফারজানা সিদ্ধান্ত নেয়, গোপনে বিয়ে করবে এবং সন্তানের মা না হওয়া পর্যন্ত কাউকেই জানাবে না। ’ সাইকৌসিস থেকে মুক্তির পর যে কেউ নিজের সর্বোচ্চ ভালো দিকটি বেছে নিতে পারে-এ যুক্তিটি ছিল সাজ্জাদের, ফারজানার সিদ্ধান্ত তারই প্রমাণ বহন করে। ফারজানা সংসার করছে, আর তাকে সাইকৌসিস থেকে মুক্তি দেয়ার ‘পাপ’ করে সাজ্জাদ কারাগারে দিন কাটাচ্ছে! মানুষের নিয়তি মাঝে মাঝে এমন বৈপরিত্য হয়, নিয়তির লীলা মানুষ বুঝে উঠতে পারে না। আক্কেলপুর থানার ওসি মামুন বদলি হয়ে গেছেন। তিনিই অপহরণ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন।
ফারজানা অপহৃত হয়নি এটা তিনি জানলে সাজ্জাদের ওপর নির্যাতনের জন্য অনুশোচনা করতেন হয়তো। মেয়ে ফিরে আসার পর অ্যাডভোকেট কাদেরের বোধোদয় হলো, তিনি আদালতে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন জানালেন। এ ধরনের ক্ষেত্রে আসামির উল্টো মানহানি মামলা করার ঝুঁকি থাকে কিন্তু অ্যাডভোকেট সাহেব নিশ্চিত যে সাজ্জাদের মা তা করবেন না। কারণ, মহিলা ইতোমধ্যে বুঝে গেছেন অ্যাডভোকেট কাদেরের প্রভাব আদালতে অনেক বেশি। কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি পৌঁছে সাজ্জাদ মাকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
এতদিন পর ছেলেকে পেয়ে আবেগে তার মায়ের কণ্ঠ স্তব্ধ। অনেকক্ষণ ধরে দু’জনার কেউই কোন কথা বলতে পারল না। অমাবশ্যার নিকশ কালো অন্ধকারে ঢেকে গেছে চারিদিকের পৃথিবী। পাশে বসা মানুষটিকেও দেখা যাচ্ছে না। শব্দহীন-অদৃশ্যভাবে বসে আছে সাজ্জাদ ও তার মা।
শেষে নীরবতা ভেঙে মা বললেন, ‘বাছাধন, কী পাপ করেছিলে? কার পাপে, কিসের পাপে তোমাকে এমন কষ্ট পেতে হলো?’ সাজ্জাদ বলল, মা, একজন সাইকোলজিস্ট হিসেবে আমি তাদের মেয়েটাকে ‘সাইকৌসিস’ থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলাম। তার ভাঙা হৃদয়ের কষ্ট মুছে দিয়ে নতুন শক্তিতে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলাম, কোন অন্যায় করিনি। মনোবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী, ঠিক ওই সময়ে আমি ফারজানাকে ট্রিটমেন্ট না দিলে সে এর কিছুদিনের মধ্যেই জীবন-যন্ত্রণায় নীরবে পুড়তে পুড়তে আত্মহত্যা করে বসতো। কারণ, সে যে বেদনা বয়ে বেড়াত তা শেয়ার করার কেউ ছিল না, কাউকে বুঝাতে পারত না হৃদয়ের যন্ত্রণা-দহন। আমি তার ভেতরে বেঁচে থাকার শক্তি তৈরি করে দিয়েছিলাম।
ফারজানাকে ভালোবেসে, সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট দিয়ে আত্মঘাতী কোন চরম দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করাটা কি আমার পাপ? বলো মা, এটা কি আমার পাপ?-এসব কথা বলতে বলতে সাজ্জাদ ভয়ংকর হয়ে উঠে। তার চোখে-মুখে হিংস্রতা প্রশ্রয় পেতে থাকে, ক্ষোভে কাঁপতে থাকে পুরো শরীর। অন্ধকারের ভেতরেও সাজ্জাদের ক্ষোভের উত্তাপ কতটা প্রবল তা বুঝতে পারেন তার মা। উন্মত্ত সাজ্জাদ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। মাকে বলে উঠে, ‘রিমান্ডে আমার শরীর ভেঙে গেছে, কারাগারে দুটি বছর আমার জীবন থেকে হারিয়েছে, আমার এমফিল-পিএইচডির স্বপ্নও ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে।
আমি এর প্রতিশোধ নেব। ’ অন্ধকারে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়ে প্রচণ্ড ক্ষিপ্তকণ্ঠে সাজ্জাদ বলেন, ‘আমি খুন করবো মা, আমি তাদের খুন করে ফেলবো!’ ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে সাজ্জাদের মা বলে উঠেন, ‘ওরা তোমার ওপর অন্যায় করেছে, তুমি তাদের ওপর কোন অন্যায় করতে যেও না, বাবা। কারণ, প্রকৃতি অন্যায় সহ্য করে না। ধীরে ধীরে এর প্রতিশোধ নেয়। প্রকৃতি একদিন এর প্রতিশোধ নেবে, প্রকৃতির প্রতিশোধ বড়ই নির্মম!’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।