থেমে যাবো বলে তো পথ চলা শুরু করিনি।
আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামকে হাইকোর্ট বহুল আলোচিত ডিবি সোর্স জালাল হত্যা মামলার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। সেশন জজ আদালতে ১৯৯৯ সালের সেশন কেস নম্বর ৩৭১২-তে সরকারি আইনজীবী বা পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে তখন দায়িত্ব পালন করছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমান আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। পিপি হিসেবে দায়িত্ব পালনে তখন তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদনে তার দায়িত্ব পালনে সততা ও আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।
বিচারপতি মোঃ আলী আজগর খান ও বিচারপতি এস কে সিনহার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ তখন অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগকে 'গুরুতর' হিসেবে অভিহিত করে রুল ইস্যু করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০০১ সালের ২৮ জানুয়ারি এক ঐতিহাসিক রায়ে রুল অ্যাবসলিউট ষোষণা করেন এবং তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে জরুরি বার্তাবাহক মারফত হাইকোর্টের আদেশের কপি আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর উইং ও ডিসির কাছে পাঠিয়ে দিয়ে সাতদিনের মধ্যে অন্য কাউকে পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয়ার নির্দেশ হয়।
ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে হাইকোর্ট অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে তখন এ সুয়োমোটো রুল ইস্যু করেছিলেন। ডেইলি স্টার বনাম রাষ্ট্র (বিচারপতি এস কে সিনহা) নামে পরিচিত মামলার রায় ৫৩ ডিএলআরে (২০০১) বিস্তারিত রয়েছে।
আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামকে গতকাল টেলিফোনে জালাল হত্যা মামলায় পাবলিক প্রসিকিউটরের দায়িত্ব থেকে তাকে বাদ দেয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি প্রথমে বলেন, কেউ বাদ দেয়নি।
আমার নিজের অনীহা ছিল, ফলে আমি নিজে থেকেই সরে পড়েছিলাম। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ের কপি আমার হাতে আছে, সেখানে ভিন্ন কথা লেখা রয়েছে বলার পরই তিনি পাল্টা জানতে চান, '১০ বছর আগের ব্যাপার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন কেন। আমার এত মনে নেই। নিউজ করবেন নাকি?' হ্যাঁ সূচক জবাব শুনে তিনি ক্ষেপে যান। বলেন, '১০ বছর আগের ঘটনা নিয়ে নিউজ করার কী হলো।
নিউজই যখন করবেন, তাহলে আমাকে ফোন করছেন কেন? যা কিছু মনে হয় তাই লিখে দেন। '
পাল্টা তাকে বলা হয়, আপনার বক্তব্য আমরা জানতে চাই এবং আপনার বক্তব্যসহ এ নিউজটি করতে চাই। একথা শুনে তিনি আরও রেগে যান, আক্রমণাত্মক ভাষায় খুবই উচ্চস্বরে কথা বলতে থাকেন। একপর্যায়ে একটি গালি দিয়ে ফোনের লাইন কেটে দেন।
জালাল হত্যা মামলায় পিপির দায়িত্ব পালনকারী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে তার সততা ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল।
এতে দেখা যায়, হাইকোর্ট তার রুলে বলছেন, পত্রিকায় প্রকাশিত গুরুতর অভিযোগগুলোর ভিত্তিতে রেকর্ডপত্র দেখার পর কোর্ট মনে করেন, এই ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট মামলায় পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে নিহত পরিবারের হয়ে তার দায়িত্ব পালনে আন্তরিক ও মনোযোগী নন। সুতরাং তার এ পদে থাকলে সংশ্লিষ্টরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। সংশ্লিষ্টদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য কামরুলকে এ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে দায়িত্বশীল কাউকে কেন নিয়োগ করা হবে না মর্মে রুল ইস্যু করা হয়। ২০০১ সালের ২৮ জানুয়ারি হাইকোর্টের রায়ে এ রুল অ্যাবসলিউট করে অতিরিক্ত পিপি কিংবা সহকারী পিপির মধ্য থেকে কাউকে সাতদিনের মধ্যে পিপি নিয়োগ করার নির্দেশ দেয়া হয়।
হাইকোর্টর রায়ে বলা হয়েছে, ঢাকার মেট্রোপলিটন অতিরিক্ত সেশন জজের ৫ নম্বর কোর্টে ডিবির সোর্স জালাল হত্যা মামলাটি চলছিল।
জালালের গলিত মৃতদেহটি গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ডিসির ৩৬ মিন্টো রোডের অফিসের ছাদের ট্যাংকি থেকে ১৯৯৯ সালের ২৫ মার্চ উদ্ধার করা হয়। রমনা থানার এসআই আলী আজম ২৬ মার্চ এ হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে মামলা করেন। রায়ে ২০০১ সালের ১১ জানুয়ারি ডেইলি স্টারের রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, পুলিশ বলছে জালালের স্ত্রীকে খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ ডেইলি স্টার রিপোর্টার ৩ ঘণ্টার মধ্যে জালালের স্ত্রী হালিমাকে খুঁজে পেয়েছে। হালিমা ডেইলি স্টারের প্রতিনিধিকে বলেছেন, যখনই তিনি পাবলিক প্রসিকিউটরের (অ্যাডভোকেট কামরুল) কাছে গেছেন, তখন তিনি হালিমা ও তার সন্তানদের লুকিয়ে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
না ডাকা পর্যন্ত কোর্টে আসতে বারণ করেছেন। অন্যদিকে সাক্ষীদের পাওয়া যাচ্ছে না বলে কোর্ট থেকে পিপি বারবার সময় নিয়েছেন। এরই মধ্যে জালাল হত্যাকাণ্ডের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী কামালকে ১৬ আগস্ট তেজগাঁওয়ে খুন করা হয়। এসব বিষয়ে কামরুলকে পিনপয়েন্টেড করে ডেইলি স্টার প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
হালিমার উদ্ধৃতি দিয়ে আরও বলা হয়েছে, জালাল হত্যা মামলার মূল আসামি ইন্সপেক্টর জিয়াউল হাসান সাদা পোশাকে হালিমাদের বাড়িতে গিয়ে কেস তুলে নেয়ার জন্য চাপ দেন।
এ জন্য ১০ লাখ টাকা দিতেও আগ্রহ দেখান। এছাড়া ২০০১ সালের ১৩ জানুয়ারি প্রথম আলোতে প্রকাশিত চাঞ্চল্যকর জালাল হত্যা মামলায় বাদীকে অন্ধকারে রেখে পুলিশ কী করতে চায় শিরোনামে প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দেয়া হয়। এখানেও কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করা হয়।
সাক্ষীর অনুপস্থিতি ও নানা অজুহাতে সরকারি পিপির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সময় প্রার্থনার আবেদন মঞ্জুর করলেও পিপি ভূমিকায় অতিরিক্ত সেশন জজও তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
হাইকোর্টের রায়ে আরও বলা হয়, 'স্পর্শকাতর এ মামলায় যখনই জালালের স্ত্রী হালিমা খাতুন পিপি কামরুলের কাছে গিয়েছেন, তখনই তিনি তাকে দূরে থাকতে বলেছেন এবং সাক্ষীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে সময় নিয়েছেন।
তিনি একদিকে সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিত করেননি। অন্যদিকে যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া বারবার সময় নেয়ার বিষয়টিকে আদালত সঠিক ও সত্যনিষ্ঠ পথ বলে গ্রহণ করেননি। ' হাইকোর্ট বলছেন, 'পিপি হিসেবে অ্যাডভোকেট কামরুলকে তার দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছ থাকা উচিত ছিল। '
আদালত তার রায়ে আরও বলেছেন, পাবলিক প্রসিকিউটরের বিষয়ে সাধারণভাবে তারা ইন্টারফেয়ার করেন না। কিন্তু এক্ষেত্রে ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনায় তারা এটা করেছেন।
এদিকে একাধিক প্রধান আইনজীবী বলেছেন, অ্যাডভোকেট কামরুলের বিরুদ্ধে তার আইনগত দায়িত্ব পালনকালে হাইকোর্ট থেকে এ ধরনের পর্যবেক্ষণ ও রায় থাকার পর তাকে বর্তমানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়ার আগে পূর্বতন বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত কমিটির প্রধান হিসেবে তাকে দায়িত্ব প্রদান এবং এক্ষেত্রে তার বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।