আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লাল ফ্রক



আজ এপ্রিলের চব্বিশ তারিখ। খুকুর জন্মদিন। তিন শেষ করে চারে পা দিল সে। আজকের দিনটি যে তার জন্যে একটু আলাদা রকমের তা বুঝার মতো পরিপক্ব সে হয়েছে। আজকে ভোরবেলাতে খুকুর বাবা বাজারে গেছেন।

তরিতরকারি, দুধ, চিনি কিনে দিয়েই অফিসে ছুটতে হবে। অফিসের স্যারের সময় হেরফের হলে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু ছা-পোষা পিয়ন কাম অফিস এসিস্ট্যান্ট জাতীয় পদে যারা কাজ করেন তাদের সময়জ্ঞান বাড়াবাড়ি রকমের ভালো রাখার অভ্যাস করতে হয়। খুকুর বাবার সে অভ্যাস হয়ে গেছে। খুকুও খুব ভোরে উঠে বসে আছে। গত সন্ধ্যা থেকেই তার ভিতরটা ছটফট করছে, নতুন লাল ফ্রকটা পরার জন্য।

কেনার পরও সে গতরাতে একবারও পরতে পারেনি, তবে মাথার কাছে নিয়ে ঘুমিয়েছে। লাল ফ্রকটায় মাঝে মাঝে হাত বুলিয়েছে। রাতের বেলাতেই পরতে ইচ্ছা করেছে। আবার দ্বিধাও লাগছে। জন্মদিনের দিনটিতে নতুন পোশাক পরবে আগে পরলে তো তা পুরানো হয়ে যাবে।

গতকাল অফিস ফেরতা সময় খুকুর বাবা লাল ফ্রকটি কিনেছেন। হলিডে মার্কেটের দিনে ফুটপাথে দামাদামি করেও তিনি দামটা খুব কমাতে পারেননি। মাস শেষ হতে আরো কয়েকদিন বাকি, তার মানে বেতন পেতে আরো কয়েকদিন। খুকুর বাবা অফিসের স্যারের কাছে এক হাজার টাকা ধার চেয়েছেন, বারেবারে বলেছেন যে বেতন পেলে ফেরত দিয়ে দেওয়া হবে। আজ টাকাটা পেতে পারেন।

খুকুর মা সকাল সকাল ফ্রকটি কেচে দিয়েছেন। রোদ উঠেছে, ঝুলিয়ে রাখলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শুকিয়ে যাবে। খুকু একটু পর পর দড়িতে ঝুলানো ফ্রকটি ধরে ধরে দেখছে ভেজা কাপড় শুকিয়েছে কি না? ভিতরে ভিতরে ছটফটানি হচ্ছে। খুকুর বাবা বাজার রেখে মুখে একটু নাস্তা গুঁজেই অফিস ছুটছেন। ঘুপচি গলির একপাশের নর্দমা পেরিয়ে মূল সড়কে উঠতে যাচ্ছেন।

গলির মাথাতে বিশাল শপিং কমপ্লেক্সের কন্সট্রাকশন চলছে। দ্রুত বেগে রড বোঝাই ট্রাক ঢুকছে, ভিতরে না আঁটা লম্বা রডগুলি পিছনে বেরিয়ে আসছে। যেকোন সময়ে খোঁচা লাগার ভয়ংকর ধরনের আশংকা হচ্ছে খুকুর বাবার মনে। তার বুকে ধাক্কা লাগল, বাচ্চারা এখানে সারাক্ষণই দৌড়াদৌড়ি করে, কবে যে কেউ ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে? তবে বেশিক্ষণ ভাববার ফুরসত নেই, দৌড়ে ধাক্কাধাক্কি করে বাসে উঠতে হবে। সকালের এই সময়টায় বাসে চাপাচাপি ভিড় হয়।

পাদানিতেও চার-পাঁচজন মানুষ। কোণার মানুষটি হাতল ধরে ঝুলছে শরীরের প্রায় অর্ধেকটা বাসের বাইরে। খুকুর বাবা বাসের ভিতর রড ধরে দাঁড়িয়ে আছেন মাথায় চিন্তা হচ্ছে, আজকে স্যার এক হাজার টাকা দিলে খুব উপকার হয়। টাকাটা পেলে বাড়ি ফেরার সময় খুকুর জন্মদিনের কেক কিনে নেয়া যাবে। মাসের বাকি কয়েকটা দিনও টেনে নেয়া যাবে।

খুকুর মা ঠিক করে রেখেছেন ফিরনি বানাবেন। সাথে চানাচুর। আর কেক কিনতে পারলে কেকও খাওয়ানো যাবে। খুকুর মা চিন্তা করছেন দুধ ঠিকমতো ঘন হবে তো? খুকুর চিন্তা কখন লাল ফ্রকটি পরবে। দু’হাতের তালু কাপড়ের ওপর ঘষছে।

তালুতে ঠাণ্ডা লাগছে। ফ্রকটি হাতড়ে হাতড়ে দেখে এখনও শুকায়নি। আজকে ওর বন্ধুদের সামনে লাল ফ্রকটি পরে যাবে। ফ্রকটা কখন শুকাবে? অফিসে এসেই খুকুর বাবা স্যারের ঘরে ঢুকলেন। স্যারের টেবিল মুছলেন, গ্লাসটা ধুয়ে পানি ঢাললেন।

ফাইলগুলোর ধুলা ঝেড়ে গুছিয়ে রাখলেন। এখন স্যারের গাড়ির হর্নের জন্য অপেক্ষা করছেন। খুকুর মা দুধ জ্বাল দিয়েছেন। কয়েকবার বলগ উঠবার পর ঘন দুধে চাল আর চিনি ছিটিয়ে দেবেন। খুকুর লাল ফ্রকটি পুরোপুরি শুকানো পর্যন্ত ত্বর সইছে না।

হালকা ভিজা অবস্থাতেই খুকু ক্লিপ খুলে ফ্রকটি নামাল। শরীরের ওপর ফ্রকটি ধরল। ধরে একটু ঘুরছে। মনটা চনমন করে উঠছে, একটা শীতল স্রোত শরীর বেয়ে নামছে। হালকা ভিজা থাকা অবস্থাতেই সে মাকে জানিয়ে দিল যে ফ্রকটি শুকিয়েছে।

খুকুর বাবা হাফ ছাড়লেন। স্যারের কাছ থেকে এক হাজার টাকা পাওয়া গেছে। টাকাটা হাতে পেয়ে খুকুর বাবা বারেবারে বলেছেন, “স্যার, বেতন পেলেই আপনার টাকা দিয়ে দিব। ” স্যার অবশ্য বলেছেন যে তাড়া নেই, সুবিধামত ফেরত দিলেই চলবে। ফিরনির দুধ ঘন হয়েছে, চিনি ঠিকমত হয়েছে।

খুকুর মা চেখে দেখলেন। স্বাদ ঠিক আছে। তিনি খানিকটা নিশ্চিন্ত। খুকুর মুখ দেখেই মা বুঝে ফেলেছেন যে খুকুর ত্বর সইছে না, এখনই ফ্রকটা পরতে চায় সে। খুকুর মা একটু কৃত্রিম বিরক্তির মুখ করে বলছেন যে একটু ধৈর্য নেই।

দাওয়াতের সময় যখন খুকুর বন্ধুরা আসবে তখন নতুন কাপড় পরবে তা না এখনই পরতে হবে। আরও যোগ করেন যে খুকু একেবারে বাপের স্বভাব পেয়েছে। এতকাজ পড়ে আছে, ভাল্লাগে না। বলার শেষে নিজেই হাসেন। তারপরে খুকুর চুল আঁচড়ে দেন, খুকু একটু সুর করে বলে, “লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া ধরেছে সে বায়না...”, বলে হাসে, মা-ও ফিক করে হাসেন।

বলেন, “দুষ্টুরে, মাথা ভরতি শয়তানি। ” মনে মনে ঠিক করেছেন আজ রাতে খুকুর বাবাকে এ ঘটনাটি বলবেন। খুকু খুব খুব খুব বেশি খুশি। লাল ফ্রকটি পরে ফেলেছে। সারাদিন পরে থাকবে, জন্মদিন শেষ হলে তারপর খুলবে।

তবে লাল ফ্রকটিকে সাথে নিয়ে ঘুমাবে। খুকু মায়ের পাশে ঘুর ঘুর করছে। খুকুর মনটা খুশিতে লাফাচ্ছে। লালফ্রক পরে চুলের ঝুঁটি করেছে হলুদ ফিতা দিয়ে। ঠোঁটে লিপস্টিক পরে কপালে লাল টিপ দিয়েছে।

সাথে পায়ে দিয়েছে ঈদে কেনা লাল জুতা। খুকু কোনোমতেই আর ঘরে আটকে থাকতে পারছে না। একটু বাইরে যেতেই হবে। আবার, একটু দ্বিধাও লাগছে Ñ সবাই যদি আগেই দেখে ফেলে! কিন্তু লাল ফ্রকটা পরে না দেখিয়েও থাকতেও পারছে না। ছটফট লাগছে।

খুকুর বাবার অস্থিরতাটা কেটেছে। বাসায় ফেরার পথে কেক কিনে নিয়ে যাবেন। টাকার সমস্যাটা আপাতত মিটেছে। দুধটা ঘন হয়েছে। খুকুর মা ফিরনি চেখে দেখলেন।

মিষ্টি ঠিকঠাক হয়েছে। বাড়ির বাইরে রাস্তার উপরে ইটের খোয়া ছড়ানো। ঢাস্,ঢাস্, ক্রিচ, ক্রিচ আওয়াজ হচ্ছে। জায়গাটা দেখে কারো বোঝার সাধ্য নেই এইখানে কয়েক মাস আগে ঝিল ছিল। জলাশয় ভরাট করে খুব দ্রুত বিল্ডিং উঠছে।

জমির এক তিল জায়গাও ছাড়া হয়নি, বরং উপরে উঠে নিজের সীমা অতিক্রম করে খানিকটা বেরিয়ে গেছে। ইটের পর ইট বসানো হচ্ছে, ভাঙচুর চলছে। কনস্ট্রাকশনের চারপাশের টিনে ঘেরা বাউন্ডারি ঘেঁষে খুকু হাঁটছে। ইটের গুঁড়া ছড়িয়ে আছে। খুকু আগের মতো দ্রুত ছুটতে পারছে না।

জুতায় লাগা ইটের গুঁড়া বারবার ঝাড়ছে, কিন্তু বেশি ভয় লাল ফ্রকটায় যদি কোনো দাগ লাগে? খুকুর মাথায় অনেক আশংকা আর চিন্তা। খুকুর মা ঘর গোছগাছ করছেন, ধুলা ঝেড়ে এখন পানি ভরতি বালতি নিয়ে এসেছেন ঘর মুছতে। খুকুর বাবার খুব নিশ্চিত নিশ্চিত লাগছে। শরীরে কেমন আরামদায়ক শীতল ভাব হচ্ছে। খুকু সাবধানে পা ফেলছে।

জুতার ভিতর ঠিকই ইটের ছোট ছোট গুঁড়া ঢুকে গেছে। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পা ঝেড়ে গুঁড়াগুলো ফেলার চেষ্টা করছে কিন্তু সব গুঁড়া পরছে না, আটকে থাকছে। তবে এখনও স্বস্তি যে ফ্রকটায় কোনো দাগ ভরে নি। বিছিয়ে রাখা টিনে হাত লাগলে খুকু টের পায় রোদে টিন তপ্ত হয়ে আছে। তিনতলার ওপরের দেয়ালে মচ্মচ্ শব্দ হচ্ছে।

ইটের মাঝের সিমেন্ট ধীরে ধীরে খসে পড়ছে। কচ্কচ্ আওয়াজ হচ্ছে। আকস্মিকভাবে ধড়াম একটি শব্দ হল, দেয়ালের কতকগুলো ইট আলগা হয়ে গড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ খুকুর গলায় প্রচণ্ড চিৎকার “আ, আ,আ... ”। মাথায় তীব্র ব্যথা, ভয়ংকর যন্ত্রণা হচ্ছে, “আম্মু... ” আর্তনাদ শোনা গেল।

লালফ্রক সহই খুকু মাটিতে শুয়ে পড়ল। ফাটা মাথা থেকে গড়গড়িয়ে রক্ত ঝরছে। উঁচু থেকে খসা মাঝারি আকারের কয়টি ইট তীব্র মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সঞ্চার করে অব্যর্থ নিক্ষেপের মতো খুকুর মাথার ঠিক মাঝখানটিতে আঘাত করে খুকুর পাশেই নিরীহ বস্তুর মতো পড়ে রইল, শুধু ঠাস শব্দ হবার সাথে সাথে যেইটুকু রক্ত ছিটকে ছিল তার খানিকটা ইটের কোণাতে লেগেছে। খুকুর মাথার চান্দি ফেটে মাথা থেকে দড়দড়িয়ে আর নাক থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরছে। ব্যস্ত এই নগরে খুকুর চারপাশের মানুষদের মাঝে ছুটোছুটি পড়ে গেছে।

খুকুকে ঘিরে আছে এক দল মানুষ, কয়েকজন গেছে খুকুর মাকে খবর দিতে। খুকুর মা আর পাড়ার দুইজন ছেলে খুকুকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালের দিকে ছুটছেন। মা হাউ হাউ করে কাঁদছেন। ফোনে খবর পেয়ে খুকুর বাবাও তাড়াতাড়ি করে সময় বাঁচাতে বাসের বদলে সিএনজি নিলেন, পকেটে আপাতত হাজারখানেক টাকা আছে, তা-ই ভাড়া নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। বাবার বুকের ভিতর কেমন কান্না চাপা পড়ে আছে।

খুব অস্থির লাগছে Ñ যত যত যত তাড়াতাড়ি পারেন হাসপাতালে পৌঁছাতে হবে। কিছুদূর যাবার পরে সিএনজি থেমে গেল, রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে একজন পুলিশ সার্জেন্ট ছুটোছুটি করছে, কয়েকজন পুলিশ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো ভিআইপি যাবেন, তা-ই অন্য কোনো গাড়ি যেতে দেওয়া হচ্ছে না। খুকুর বাবা পুলিশ সার্জেন্টকে একটু বুঝাতে চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু পুলিশ সার্জেন্টের শোনবার সময় নেই, হাতে ওয়ারলেস নিয়ে সে দৌড়াদৌড়ি করছে। খুকুর বাবা সিএনজির পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি দিচ্ছেন, কখন রাস্তা খালি হবে? সিএনজি-র ড্রাইভার বলা আরম্ভ করল, “এই মাঙ্গের পোলারা ন্যাতা হইয়া খালি পয়সা কামায়, যত মরণ আমগোর।

” খুকুর বাবার দিকে তাকিয়ে তিনি আরও বলেন, “দ্যাখছেন না, বাপের কোলে মাইয়া গুলি খাইল, আর হারামজাদা কয় আল্লার মাল আল্লায় নিছে। ” কথাটা শুনে খুকুর বাবার বুকে ধক্ধকানি লাগে। হাসপাতালের বারান্দায় খুকুর মা ধপ্ করে বসে পড়েছেন, বুক চাপড়াচ্ছেন, চিৎকার করে “আল্লাহ্, আল্লাহ্” করছেন। হাসপাতালে উপস্থিতদের কানে চিৎকারটি লাগছে। তবে খবরের কাগজ, মিডিয়া এরা যেন এই ঘটনাকে তিল থেকে তাল না করে তার সিস্টেম ইতোমধ্যেই মালিকপক্ষ, পাড়ার পুলিশ ও মাস্তানরা মিলেমিশে করে ফেলেছেন।

খবরের কাগজে বা নতুন যন্ত্রণা মিডিয়াতে একজন মা বুক চাপড়িয়ে আর গলা ফাটিয়ে চোখের নাকের জল মিলিয়ে কাঁদছেন এমন খবর প্রচার হলে সামনের কয়েকদিন মালিক পক্ষের বেশ ঝামেলা আর লোকসান হতে পারে। খুকুর বাবা আর মা দু’জনেই খুকুর পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। আজ থেকে ঠিক চার বছর আগে এই হাসপাতালে খুকু কান্না করে তার আগমন ঘোষণা দিয়েছিল। সেই খুকু এখন কোনো শব্দ করছে না। সে চোখ বুজে শুয়ে আছে।

আর খুকুর লাল ফ্রকটি রক্তে আরও একটু বেশি গাঢ় হয়ে উঠছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।