মানবাধিকার সংগঠন আয়োজিত সম্মেলনে বিশিষ্ট আইনজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের মতামত
আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট সংবিধান পরিপন্থি
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনবিদ ও বুদ্ধিজীবীগণ ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) এ্যাক্ট এবং সাম্প্রতিক তার সংশোধনী দেশের সংবিধান, সাক্ষ্য আইন ও ফৌজদারী দন্ডবিধিসহ দেশের মৌলিক আইন কাঠামোর বিপরীত বলে অভিহিত করেছেন। তারা বলেন, বিচারের আগেই রায় দিয়ে দেয়া হয়েছে এমন বক্তৃতা করছেন মন্ত্রীরা। এতে স্পষ্ট যে রায় ঠিক করেই রাখা হয়েছে। যে আইনে বিচার করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার তার কোন বৈধতা নেই। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সব আইনের সর্বোচ্চ দৃষ্টিভঙ্গি এখানে উপেক্ষিত হবে।
অপরাধী খালাস পেয়ে যাক তবুও একজন নির্দোষ ব্যক্তিও যেন সাজা না পায় আইনের এই মূলনীতি প্রস্তাবিত বিচারিক আইনে উপেক্ষা করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় বিচার হলে যারা এই বিচারের সাথে জড়িত তাদেরও এক সময় আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন খ্যাতনামা আইনজীবীগণ। তারা সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, বিচারের নামে আইনের শাসন পরিপন্থি এই কাজ করা হলো দেশের হাজার হাজার আইনজীবী তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। বিচারককে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়ার অর্থ দাঁড়াবে এই যে, হাত-পা বেঁধে গরু জবাই করার মতো প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসিতে ঝুলানোর মত। স্বাধীনতা পরবর্তী সরকার শিমলা চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে ছেড়ে দেয়ার ফলে ঐ বিচার আর প্রয়োজন নেই।
খুন, ধর্ষণ, লুটপাটসহ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার দেশীয় আইনেই যে কোন সময় করা সম্ভব। এর জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজন নেই। মানবতার বিরুদ্ধে রক্ষীবাহিনী চরম অপরাধ করেছে তাদের বিচার হতে হবে। এখন যারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করছে তাদেরও বিচার হতে হবে।
দি ন্যাশনাল ফোরাম ফর প্রটেকশন অব হিউম্যান রাইটস (এনএফপিএইচআর) এর উদ্যোগে গতকাল শুক্রবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ওপর আয়োজিত সম্মেলনে বিশিষ্ট খ্যাতিমান আইনজীবী ও বুদ্ধিজীবীগণ উপরোক্ত মতামত ব্যক্ত করেন।
সরকার যখন কথিত যুদ্ধাপরাধ বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করেছে তখন যে আইন দিয়ে বিচার করতে যাচ্ছে তার ওপরেই একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণমূলক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগীয় বার থেকে আগত প্রতিনিধিরাও সম্মেলনে যোগদান করেন। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আব্দুর রউফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল ফর রুয়ান্ডার সাবেক বিচারপতি বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী বিচারপতি টি এইচ খান। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, সাবেক স্পীকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. এমাজউদ্দিন আহমদ। এছাড়াও বক্তৃতা করেন সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক এডভোকেট জয়নাল আবেদীন, ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন এমপি, ব্যারিস্টার ফাতেমা আনোয়ার, ব্যারিস্টার বেলায়েত হোসেন।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন দি ন্যাশনাল ফোরাম ফর প্রটেকশন হিউম্যান রাইটসের সদস্য সচিব এডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
এছাড়াও সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন বরিশাল আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন জুম্মন, চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সদস্য এডভোকেট মনজুর আহমেদ আনসারী, রাজশাহী আইনজীবী সমিতির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক এডভোকেট আবু হোসেন সেলিম, খুলনা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট আব্দুল মালেক ও সিলেট আইনজীবী সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি এডভোকেট এ এইচ এম আব্দুল গফুর।
বিচারপতি টি এইচ খান বলেন, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্টের মধ্যে শুধু ইন্টারন্যাশনাল শব্দটা ছাড়া আইনী কোন মিল বা সম্পর্ক নেই। আন্তর্জাতিক আইনের সাথে এই আইনের পার্থক্য আকাশ পাতাল।
তিনি বলেন, যে আইনে বিচার করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতে দেশে প্রচলিত সাক্ষ্য আইন ও ফৌজদারী আইনকে নির্বাসন দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আমি রুয়ান্ডা ট্রায়ালের বিচারক ছিলাম। সেখানে ৬ জন বিচারক নিয়োগ করা হয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে। যুগোশ্লাভিয়ায় ট্রায়েল হয়েছিল ৯ জন বিভিন্ন দেশের বিচারক নিয়ে। রোম ট্রায়েল শুরু হয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ১৮ জন বিচারককে নিয়ে। এসব ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রক্রিয়ার সাথে বর্তমান ট্রাইব্যুনালের কোন মিল নেই।
এখানে অবস্থা হলো আমিই বরের মা- আমিই কনের মা। তারাই তদন্তকারী, তারাই উকিল, তারাই বিচারক। কাদের নিয়ে এসব গঠিত হয়েছে তাদের সবাই চেনে। এটা আন্তর্জাতিক কোন মানদন্ডেই গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি বলেন, একজন নির্দোষ ব্যক্তি যেন সাজা না পায় প্রয়োজনে ১০ জন দোষী খালাস পেয়ে যাক- এটা হলো আইনের মূলনীতি।
সেই মূলনীতি এখানে উপেক্ষিত হয়েছে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে কাউকে দোষী বলা যাবে না। আইনের এই মূলনীতি উপেক্ষা করে মন্ত্রীরা কারও কারও নাম ধরে বলছে তাদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে বিচার কার্যকর করা হবে। তার মানে রায় আগেই দেয়া হয়ে গেছে।
টিএইচ খান আরও বলেন, মূল সাক্ষ্য আইনকে এই বিচারিক আইনে কবর দেয়া হয়েছে।
পত্রিকার রিপোর্ট, ফটো এটাও নাকি সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে। ‘অমুক অপরাধী। আমি তার সহযোগী হিসেবে তার সাথে ছিলাম'। এমন সাক্ষ্যও গ্রহণযোগ্য করা হয়েছ। অথচ ঐ সহযোগী অপরাধী নয়।
এ এক অভিনব আইন।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাথে এই আইনের তুলনা ‘কোথায় লিভারপুল-আর কোথায় হাতিরপুল' এর মতই।
তিনি আরও বলেন, গত বছর জুলাইতে ৭৩ এর এ্যাক্টের ওপর যে সংশোধনী সংসদে পাস করা হয়েছে সেটা সংসদের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে। আগে যেখানে ছিল যুদ্ধাপরাধী হবে আর্মড ফোর্স, ডিফেন্স ফোর্স এবং অক্সিলারী ফোর্স। তার সাথে এই সংশোধনীর মাধ্যমে যোগ হয়েছে ব্যক্তিগত অপরাধকারী এবং অপরাধকারী গ্রুপ।
এই সংশোধনীর উদ্দেশ্যে হলো যেনতেন ভাবে তাদের টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ সাজা দেয়া। এটা হবে বিচারের নামে প্রহসন। অবিচার হলে বা বিচারে সন্তুষ্ট না হলে হাইকোর্ট রিভিউ করারও এখতিয়ার রাখা হয়নি এই আইনে। তিনি আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা আরও জানুন, বুঝুন। আইনের পোশাক পরে আপনারা কোর্টেও যেতে পারবেন না।
কেউ মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে আইনের দৃষ্টিতে যে অপরাধী অথচ এই আইনে তা উপেক্ষা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এটা হলো হাত-পা বেঁধে কুরবানীর গরু জবাই করার মতো কাউকে জোর করে ফাঁসি দেয়া।
এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, কলাবরেটর এ্যাক্টে এমন কোন অপরাধ ছিল না যার বিচার করা যেত না। কিন্তু সেটা কারা বাতিল করেছিল তা সময় মত ফাঁস করে দেব। মূল অপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে সহযোগিদের বিচার করা দুনিয়ায় কোন নজীর নেই।
যারা ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দিয়েছিল তারাও অপরাধী। আগে তাদের বিচার হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, যে আইনে বিচার করা হচ্ছে সেটা কোন সভ্য সমাজের আইন হতে পারে না। সেখানে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে সেখানে এমন কালো আইন চলতে পারে না। দেশে আইনের শাসন এবং মানবাধিকার থাকলে এই আইন চলতে পারে না।
প্রচলিত আইনকে অকার্যকর করা হয়েছে। আইনের হাত-পা বেঁধে দেয়া হয়েছে। চোরে চুরি করলে কোন না কোন চিহ্ন রেখে যায়। তাই আগেই ট্রাইব্যুনাল প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। হাইকোর্টের বিচারপতি চাকরি থেকে ইস্তফা না দিয়ে ট্রাইব্যুনালের বিচারক হতে পারে না।
কিন্তু সেটাও করা হয়েছে।
সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ৭১ সালের পর আপনারাই ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু তখন বা ৯৬-২০০১ এই সময়েও জাতিসংঘে তো একটি অপরাধও তুলতে পারেননি। টোকিও ট্রায়েলে ঐ দেশ থেকে ৯ জন বিচারক নেয়া হয়েছিল। বিচার করতে হলে সেইভাবে নিরপেক্ষতা দেখাতে হবে।
পৃথিবীর কাছে উদাহরণযোগ্য বিচার হতে হবে। রাজনৈতিক উদ্দেশে বিচার করা হলে বাংলাদেশের মানুষ তা প্রতিহত করবে। তিনি বলেন, আইনজীবীরা আইনের শাসনে বিশ্বাসী। আইনের শাসনবিরোধী কিছু করা হলে দেশের ২৬ হাজার আইনজীবী রুখে দাঁড়াবে। কাজেই এখনো সময় আছে।
সাবধান হোন।
ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, সিমলা চুক্তির মাধ্যমে ৯৪ থেকে ৯৮ হাজার যুদ্ধবন্দী এবং ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দেয়ার পর আর এই বিচার চলতে পারে না। এই বিচারের আর প্রয়োজন নেই। তবে যদি বিচার করতেই হয় তবে দেশীয় আইন ও সংবিধানের মৌলিক মানবাধিকার বহাল রেখে করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানদন্ডে উন্নীত করতে হবে আইন।
যে আইনে বিচার করা হচ্ছে তা মানবাধিকার পরিপন্থী।
তিনি আন্তর্জাতিক ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্টের বিভিন্ন সেকশন পৃথক পৃথকভাবে উল্লেখ করে বলেন, বিচারক নিজেই তার প্রয়োজন মতো আইন প্রণয়ন করতে পারবেন। এরূপ বিধান দুনিয়ার কোন সভ্য সমাজের আইন হতে পারে না। এরূপ ক্ষমতা থাকলে বিচারক যাকে অভিযুক্ত করতে চাইবে সেইরূপ আইন তিনি বানাবেন। এটা কোর্ট মার্শালের চেয়েও ভয়াবহ।
এটা একতরফা বিচারের শামিল। এই আইনে দেশের প্রচলিত ফৌজদারী আইন উপেক্ষা করা হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলেই তাকে গ্রেফতার করা হবে আর তাকে জামিন দেয়া হবে না। এমন বিধান রয়েছে এই আইনে। ট্রাইব্যুনালের কাছে সাধারণ জ্ঞান বা কমন নলেজ দিয়েও বিচারের কথা বলা হয়েছে।
এতে ন্যায় বিচার ব্যাহত হবে। হাইকোর্টে রিভিউয়ের বিধান না রেখে সরাসরি আপিলেট ডিভিশনে আপিল করার বিধানও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আপিল বিভাগে আর্গুমেন্ট কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে সীমিত থাকে। তিনি বলেন, ৫৭ বছরের কম বয়সী কাউকে টাচ করা যাবে না। কারণ ১৮ বছরের কম বয়সে কেউ মুক্তিযোদ্ধা বা রাজাকার কোনটাই হতে পারে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজ উদ্দিন আহমদ বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার সঠিকভাবে হবে তা বলার সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধ ছিল হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণের যুদ্ধ। এটা ছিল জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে জাতীয় অর্জন। এর বিপক্ষে তখন কোন ক্ষুদ্র গোষ্ঠী থাকলে তার বিচারও জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে তখন করা যেতো। এখন যা করা হচ্ছে তা রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য করা হচ্ছে।
সংবিধানকে লংঘন করে কোন বিচার গ্রহণযোগ্য নয়। বিচার হতে হবে স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। আমরা কাচের ঘরে বাস করছি। এমন কোন কিছু করা উচিত হবে না যাতে করে আমরা পরে বিপদে পড়ে যাই।
সভাপতির বক্তব্যে বিচারপতি আবদুর রউফ বলেন, আইনটিতে অনেক গলদ রয়েছে।
সংবিধানকে এড়িয়ে আইন হলে তা খুবই জঘন্যতম হিসেবে বিবেচিত হবে। এ আইনে জুডিশিয়াল রিভিউর অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। এটি বিচারপ্রার্থীর একটি মৌলিক অধিকার এবং সংবিধানের মৌল ভিত্তি। রাতারাতি আইন করলে যা হয় ১৯৭৩ সালের আইনের ক্ষেত্রেও তা হয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক মানদন্ড রক্ষিত হয়নি।
স্বাধীনতার পরও মানবতাবিরোধী অনেক অপরাধ হয়েছে। যা এ আইনে আসতে পারে। স্বাধীনতা পরবর্তী রক্ষী বাহিনীর নির্যাতনকেও মানবতাবিরোধী আইনের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তিনি আরো বলেন, হাইকোর্টের বিচারপতিকে দিয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে তা আইনসিদ্ধ হবে না। এটি সংবিধানের স্কীম নয়।
সংবিধানের মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলে চলবে না। ১৯৭৩ সালের আইনে ২০০৯ সালে সংশোধন আনা হয়। এটিও বিতর্কিত। প্রহসনের বিচার করলে কেউ রেহাই পাবে না। আর এমন কোন বিচার করবেন না যাতে আপনাদের আবার বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়।
ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, আইনটির কতিপয় বিধান সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হবার কারণেই ১৫ জুলাই ১৯৭৩ তারিখে সংবিধানের ১ম সংশোধনী আইন পাস করে তার বৈধতা দেয়া হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে ৪৭(৩) ও ৪৭ক অনুচ্ছেদ সংবিধানে সংযোজন করা হয়। এ দুটি সংযোজনীর মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তির মৌলিক অধিকার হরণ করাকে সাংবিধানিক বৈধতা দেয়া হয়েছে। জুডিশিয়াল রিভিউ একটি মৌলিক অধিকার হলেও তাও হরণ করা হয়েছে। অনেকে মনে করেন, যেহেতু সংবিধানের ৪৭(৩), ৪৭ক অনুচ্ছেদে এ আইনের প্রটেকশন দেয়া আছে এবং যেহেতু সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৬, ২৭, ৩১, ৪৪, ১০২ অনুচ্ছেদসমূহ অভিযুক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হবার বিধান ৪৭(৩), ৪৭ক তে বলা আছে।
সেহেতু ১৯৭৩ সালের আইনকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। তিনি বলেন, আইনের শাসন হলো আমাদের সংবিধানের প্রাণ এবং গণতন্ত্রের মূলভিত্তি। এই আইনের শাসনের জন্যই জুডিশিয়াল রিভিউয়ের অধিকার সংবিধানে স্বীকৃত। আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও জুডিশিয়াল রিভিউ এসব সংবিধানের অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ। এগুলো সংবিধান সংশোধন করেও খর্ব করা যায় না।
ঐতিহাসিক ৮ম সংশোধনী মামলার রায়েও বলা হয়েছে, জুডিশিয়াল রিভিউ সংবিধানের একটি অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ। হাইকোর্টের এ অন্তর্নিহিত ক্ষমতা খর্ব করা যায় না। সুতরাং সংবিধানের ১ম সংশোধনী আইন, অনুচ্ছেদঃ ৪৭(৩) ৪৭ক, ১৯৭৩ সালের আইন সবই অসাংবিধানিক। ১ম সংশোধনী সংবিধানের প্রাণসত্তা-আইনের শাসন ও জুডিশিয়াল রিভিউ-এর মত মৌলিক স্তম্ভ ধ্বংস করেছে। ঐ সংশোধনী যে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারেন।
১৯৭৩ সালের আইনটি একটি ত্রুটিযুক্ত আইন, এ আইনের প্রয়োগ অসাংবিধানিক। এর আলোকে বিচার হলে তা হবে অবৈধ। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে এ আইনের তীব্র সমালোচনা করা হচ্ছে। এ আইনে অভিযুক্তের অধিকার রক্ষিত হয়নি। সংবিধান, দেশীয় আইন-কানুন, আন্তর্জাতিক আইনের মূলনীতি সবকিছুর বিচারে এ আইনটি একটি ডিফেকটিভ আইন বলে ধরে নেয়া যায়।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আরো বলেন, এ ট্রাইব্যুনালের গঠন, সদস্যদের নিয়োগ কোন আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। আবার ২৪নং ধারায় বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালের কোন আদেশ, রায়, দন্ড কোন আদালতে প্রশ্ন করা যাবে না। শুধু বিচার শেষে ২১ ধারার বিধান বলে দন্ড হয়ে গেলে আপীল করা যাবে। সুতরাং অন্তর্বর্তীকালীন কোন ইস্যুতে অভিযোগ গঠন, সাক্ষ্য গ্রহণ বা অন্য কোন বেআইনী আদেশ কোনটাই প্রশ্ন করা যাবে না। তিনি বলেন, আইনের প্রতিষ্ঠিত নীতি হলো- কোন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাক্ষ্য প্রদানে বাধ্য করা যায় না।
তার নীরব থাকার অধিকার আছে। কিন্তু এ আইনে নীরব থাকা সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য। ওই ধারা রহিত করতে হবে। ১৯ ধারায় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে হ্যারাসি বা হয়রানি সাক্ষ্যকে গ্রহণযোগ্যতা দেয়া হয়েছে। তার ভিত্তিতে শাস্তি এমনকি মৃত্যুদন্ডও দেয়া যাবে।
ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষ্যগত মূল্য বিচারের ক্ষেত্রে তা আমলে নেয়া সম্পর্কিত আইন আমাদের জুরিকডিকশনে এখনও অপূর্ণাঙ্গ, তবুও ১৯৭৩ সালের আইনের আলোকে গঠিত ট্রাইব্যুনাল পত্রিকা রিপোর্ট, ম্যাগাজিন, ফিল্ম, টেপ রেকর্ড ইত্যাদি সাক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হবে। এবং বলা হলো যে সমস্ত বিষয় কমন নলেজে আছে তা ট্রাইব্যুনাল সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করবে, কোন প্রমাণের প্রয়োজন হবে না। কথা হল কমন নলেজ কি? সাক্ষ্য আইন যদি প্রযোজ্য না হয় তাহলে যে সাক্ষ্যের ভিত্তিতে শাস্তি আপনি দেবেন সে সাক্ষ্যের সাক্ষ্যগত মূল্য, গ্রহণযোগ্যতা কিভাবে নির্ধারিত হবে। এ প্রশ্ন আমাদের সবার। এখানেই ন্যায় বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
কিন্তু আপনি উচ্চ আদালতে যেতে পারবেন না। তিনি আরো বলেন, এ আইনের অধীনে বিচার অবৈধ ও অসাংবিধানিক। সংবিধান, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের আদর্শ সমুন্নত রাখতেই ১৯৭৩ সালের কালো আইনটি বাতিল করা জরুরী।
এ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন বলেন, ২০১০ সনে মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের জন্য যে ট্রাইব্যুনাল হয়েছে তাকে নিরপেক্ষতা দেখাতে হবে। আইনটির প্রবিধানে আন্তর্জাতিক মানদন্ড নিশ্চিত হয়েছে কি না তা জাতির কাছে পরিষ্কার করতে হবে।
ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন এমপি বলেন, যুদ্ধারপরাধীদের বিচার এতো দেরী করে কেন তা দেশব্যাপী জানতে চায়। হঠাৎ করে আওয়ামী লীগ সরকার এ ব্যাপারে কেন এতো উৎসাহ দেখাচ্ছে? তারা এখন যুদ্ধাপরাধী বিচারের পরিবর্তে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার ঘোষণা দিয়েছে। এ বিচার করতে গিয়ে যেন নতুন করে অমানবিক আচরণ পথ উন্মুক্ত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলো। তরুণ প্রজন্ম তা জানতে চায়।
তিনি সংবিধানের মৌলিক অধিকার সকল অবস্থায় সংরক্ষণ করার দাবি জানান।
এ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক অপরাধগুলোর বিচার করতে গিয়ে অনেক ভুল করেছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হলে মারাত্মক পরিণতি হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘন যাতে না হয় সে জন্য এ আইনের সংশোধন জরুরী।
ব্যারিস্টার ফাতেমা আনোয়ার বলেন, ১৯৭৩ সালের অনেক ধারাই আন্তর্জাতিক আইনের মানদন্ডের অনেক নিচে।
আইনটাতে ফৌজদার আইনের বিষয়ের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালকে অনিয়ন্ত্রিত সক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারের অনেকগুলোই এখানে অভিযুক্তির জন্য সংরক্ষণ করা হয়নি। প্রচলিত সাক্ষ্য আইন ও ফৌজদারী কার্যবিধি অপ্রয়োজনযোগ্যতা এ আইনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তিনি বিতর্কিত অংশগুলো বাদ দেয়ার আহবান জানান।
ব্যারিস্টার বেলায়েত হোসেন বলেন, আইনটিতে কোন গাইডলাইন ছাড়াই বলা হয়েছে ট্রাইব্যুনাল তার নিজস্ব বিধি প্রণয়ন করবে।
এতে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড দন্ড থেকে যে কোন শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে অথচ কোন গাইডলাইন নেই। সাক্ষ্য আইনের প্রতিষ্ঠিত নীতি, ফৌজদারী কার্যবিধি এ ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। একদিকে দীর্ঘদিন আগের অপরাধ, অন্যদিকে আইনের দুর্বলতা, কীভাবে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে তা সচেতন মহলের বুঝে আসছেনা।
স্বাগত বক্তব্যে দ্যা ন্যাশনাল ফোরাম ফর প্রটেকশন অব হিউম্যান রাইটস-এর সদস্য সচিব ও সুপ্রিমকোর্টের এ্যাডভোকেট মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ ও সচেতন মহল যুদ্ধাপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক মানদন্ড নিশ্চিত হয়েছে তা দেখতে চায়। সম্প্রতি জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক ও ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধিও বলেছেন, জাতিসংঘ একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার আশা করে।
তিনি বলেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের অনেক মূলনীতির সাথে এ আইনের সাজুয্য নেই। ইতোমধ্যে এ আইনের কতিপয় প্রবিধানের সমালোচনা হয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। ১৯৭৩ সাল থেকে আজ অবধি আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের মূলনীতি ও ব্যখ্যা বিশ্লেষণে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আপনারা অবগত আছেন বিগত ২৯ ডিসেম্বর ২০০৯, ইন্টারন্যাশনাল বার এসোসিয়েশন ওয়ার ক্রাইমস কমিটি আন্তর্জাতিক অপরাধ সম্পর্কিত আমাদের আইনটির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ইউকে পার্লামেন্ট হিউমেন গ্রুপের কাছে ১৭ দফা সুপারিশসহ তাদের আইনী মতামত দিয়েছেন। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে প্রণীত এ সুপারিশমালার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের আইনটি সংশোধিত না হলে বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানদন্ডে উত্তীর্ণ হতে পারবেনা।
অভিযুক্তদের অধিকার রক্ষিত হবে না। ন্যায়বিচার পরাজিত হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।