মৃত্যু বলে কিছু নেই..তুমি যাকে মরণ বল..সে শুধু মারবে তোমাকেই..
(১১ই সেপ্টেম্বর,২০০১-এ টুইন টাওয়ার এ হামলা হয়। আল কায়েদার আঘাতে চূর্ণ হয়ে যায় আমেরিকার গর্ব ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। প্রাণ হারায় নিরীহ মানুষ।
তার ঠিক ২৮ বছর আগে আরো একটি নাইন/ইলেভেন এ, সেই আমেরিকারই ষড়যন্ত্রে শহীদ হন চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দে। আলেন্দের গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে আমেরিকার মদদে একটি সামরিক ক্যু সংঘটিত হয়।
মৃত্যুর ঠিক আগে, প্রেসিডেন্ট প্যালেসে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় বিপ্লবী আলেন্দে জাতির উদ্দেশ্যে শেষবারের মত যে ভাষণ দেন, আজো তা হয়ে আছে প্রেরণার উৎসধারা।
এর প্রায় ২ বছর পর, হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশে একই কায়দায় প্রাণ হারাতে হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কে। )
আলেন্দের শেষ ভাষণ
বন্ধুরা,
নি:সন্দেহে আপনাদের সাথে কথা বলার এটিই আমার শেষ সুযোগ। বিমানবাহিনী ইতিমধ্যেই রেডিও পোর্টালস এবং রেডিও করপোরেশন এ বোমা হামলা চালিয়েছে।
আমার কথাগুলোতে রাগ নেই, আছে হতাশা।
হয়তো কথাগুলো তাদের জন্য একটি নৈতিক শাস্তি, যারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে : চিলির সৈনিকেরা, তথাকথিত কমান্ডার ইন চীফ অ্যাডমিরাল মেরিনো, যে নিজেকে নৌবাহিনীর কমান্ডার বলে দাবি করেছে, এবং মেন্ডোজা, সেই নির্লজ্জ জেনারেল যে মাত্র গতকাল সরকারের প্রতি নিজের আনুগত্য ও সমর্থন জানিয়েছে এবং আজ নিজেকে ক্যারাবিনেরো (জাতীয় পুলিশ বাহিনী)র প্রধান হিসেবে ঘোষণাও করেছে।
এই অবস্থায় শ্রমিকদের প্রতি আমার শুধু এটুকু বলার আছে যে, আমি পদত্যাগ করছি না।
এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, আমি জীবনের বিনিময়ে জনগণের প্রতি আমার দায়বদ্ধতার মূল্য পরিশোধ করতে যাচ্ছি। এবং আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলে দিতে চাই যে, হাজার হাজার চিলির জনগণের অকুন্ঠ সমর্থনে যে বীজ আমরা বপণ করেছি, তা কখনো শুকিয়ে যাবে না।
তাদের শক্তি আছে, এবং তারা হয়তো আমাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করবে, কিন' সমাজপ্রগতিকে অপরাধের দ্বারা কিংবা বল প্রয়োগ করে থামানো যায় না।
ইতিহাস আমাদের, এবং মানুষই ইতিহাস সৃষ্টি করে।
আমার দেশের শ্রমিকেরা: আমি তোমাদের বিশ্বস্ততার জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই, যা তোমাদের সবসময়েই ছিল। তোমরা বিশ্বাস রেখেছিলে এমন একটি মানুষের উপর, যে শুধুমাত্র ন্যায়বিচার পাওয়ার মহান আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করেছে, যে কথা দিয়েছিল সংবিধান এবং আইন এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে, এবং সে ঠিক তাই করেছে। এই নির্ধারক মুহূর্তে, যখন শেষবারের মত তোমাদের সাথে কথা বলছি, আমি আশাপ্রকাশ করছি যে তোমরা এ ঘটনাবলী থেকে শিক্ষা নেবে: বৈদেশিক পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদ একসাথে এমন একটি পরিস্থি'তি তৈরী করেছে যেখানে সশস্ত্রবাহিনী তাদের ঐতিহ্যকে ধূলিস্যাৎ করেছে, যে ঐতিহ্যের কথা তাদের শিখিয়েছিলেন জেনারেল স্নেইডার ও পরবর্তীতে কমান্ডার আরায়া, এবং আশা করছে বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে তারা ক্ষমতা পুনর্দখল করবে এবং তাদের মুনাফা এবং সুযোগসুবিধাকে রক্ষা করবে।
আমি স্মরণ করতে চাই আমাদের মাটির সেই দুর্বার নারীকে, ক্যাম্পেসিনা কে যা আমাদের প্রতি বিশ্বাস রেখেছিল, সেই শ্রমিককে যে বেশি শ্রম দিয়েছিল, সেই মা কে যে ছিল শিশুদের নিয়ে আমাদের ভাবনা সম্পর্কে সজাগ।
আমি চিলির সেই দেশপ্রেমিক পেশাজীবিদের স্মরন করতে চাই, যারা কিছু পেশাজীবি সংস্থা এবং শ্রেণীভিত্তিক সংগঠনের মদদ দ্বারা সৃষ্ট অরাজকতা সত্ত্বেও কাজ অব্যাহত রেখেছিল, যা একটি পুঁজিবাদী সমাজের গুটিকতক সুবিধাভোগীর পথকে রুদ্ধ করেছিল।
আমি সেই সব তরুণদের কথা বলতে চাই, যারা গেয়ে উঠেছিল এবং আমাদের দিয়েছিল উচ্ছলতা এবং সংগ্রামের উদ্দীপনা। আমি সেই সকল চিলির মানুষ, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবির উদ্দেশ্যে বলতে চাই যারা শাসি-র সম্মুখীন হতে যাচ্ছেন , কারণ ফ্যাসিজম ইতিমধ্যেই আমাদের দেশে আস্তানা গেড়েছে...সন্ত্রাসী আক্রমণ করে, ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে, রেললাইন কেটে রেখে, তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন উড়িয়ে দিয়ে, এবং যাদের এগুলো দমন করার দায়িত্ব ছিল তাদের নিরবতার মধ্য দিয়ে। তারা ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইতিহাস তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করবে।
নি:সন্দেহে রেডিও মেগালেন্সকে স্তব্ধ করে দেয়া হবে, এবং আমার কন্ঠস্বর আর তোমাদের কাছে পৌঁছাবে না। তাতে কিছু যায় আসে না। তোমরা তবু আমাকে শুনতে পাবে। আমি সবসময়েই তোমাদের পাশেই থাকবো। অন্তত সেই মানুষটির স্মৃতিটুকু থেকে যাবে যে ছিল একজন আত্মমর্যাদাশীল মানুষ, ছিল শ্রমিকদের প্রতি অনুগত।
জনগণ অবশ্যই নিজেদের রক্ষা করবে, কিন্তু তারা অবশ্যই নিজেদের ত্যাগ করতে পারে না। জনগণ নিজেদের ধ্বংস করতে অথবা গুলির আঘাতে নিজেদের জর্জরিত করতে দিতে পারে না, আবার নিজেদের অপমানিত ও হতে দিতে পারে না।
চিলির শ্রমিকেরা, আমার চিলি এবং চিলির ভাগ্যেও প্রতি বিশ্বাস রয়েছে। এই অন্ধকার এবং তিক্ত সময়,যখন বিশ্বাসাতকেরা আপাতদৃষ্টিতে জয়ী হতে চলেছে, একসময় মানুষই তাকে পরাজিত করবে। এটি জেনে এগিয়ে যাও যে, আগে হোক অথবা পরে, রাস্তাগুলো আবার খুলে যাবে, যেখানে মুক্ত মানুষেরা হেঁটে যাবে একটি মহৎ সমাজ গড়বার লক্ষ্যে।
চিলি দীর্ঘজীবী হোক। মানুষ দীর্ঘজীবী হোক। দীর্ঘজীবী হোক শ্রমিকেরা।
এটিই আমার শেষ উচ্চারণ, এবং আমি নিশ্চিত যে, আমার আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না, আমি নিশ্চিত যে, নিদেনপক্ষে এটি হবে একটি নৈতিক শিক্ষা, যা অন্যায়, কাপুরুষতা এবং বিশ্বাসঘাতকতাকে শাস্তি দিতে শেখাবে।
(১১ই সেপ্টেম্বর,১৯৭৩-সকাল ৯টা ১০ মিনিট)
(ইংরেজী থেকে অনুবাদ: অভিনু কিবরিয়া ইসলাম)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।