আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

১৪১৭-পহেলা বৈশাখ-পান্তাভাত-সর্ষে ইলিশ, সাদা লাল শাড়ি, পান্জাবী ও আমার কিছু বৈশাখী প্যাচাল


সেই যে এক পান্তাবুড়ি। চোরে রোজ তার পান্তাভাত খেয়ে যায়। বুড়িকে সবাই উপদেশ দিলো রাজার কাছে বিচার দিতে। বুড়ি লাঠি ভর দিয়ে চললো রাজার বাড়ির উদ্দেশ্যে। ঠুক ঠুক ঠুক ঠুক বুড়ি হাঁটে আর জিরোয় , হাটে আর জিরোয়।

কোমরে বাত, চোখে ছানি। বুড়ির খুব তেষ্টা পেলো । পানি খেতে বসলো পুকুর ধারে। একটা শিং মাছ ভুস করে ভেসে উঠলো। বুড়ির কাছে জানতে চাইলো, ও পান্তাবুড়ি, পান্তাবুড়ি যাচ্ছো কোথায় হুড়মুড়ি? বুড়ি বললো তার দুঃখের কাহিনী।

রোজ চোরে তার পান্তা খেয়ে যায়। শিং মাছ বললো, ওসব বিচার রাজাকে দিয়ে হবেনাগো, রাজা বাদশাহদের কাজ বড় বড় চুরি ডাকাতির বিচার করা। গরীবের কেউ নেই বুড়ি। আমাকে সাথে নিয়ে চলো। আমি চোরবেটার মজা দেখিয়ে দেবো।

অগত্যা কি আর করা? বুড়ি মাছটাকে ঝুলিতে পুরে নিলো। এইভাবে একে একে বেল, গোবর আর কাঁচি বুড়ির সঙ্গী হলো । বুড়ির পান্তাহাড়িতে লুকিয়ে রইলো শিংমাছটা চুপি চুপি, বেল রইলো চুলার ভেতর, গোবরটা পড়ে রইলো বুড়ির দরজার গোড়ায়। আর বুড়ির বাড়ির সামনের ঘাসে লুকিয়ে রইলো কাঁচিটা। তারপর চোর রাত দুপুরে যেইনা বুড়ির বাড়িতে ঢুকে বুড়ির পান্তা হাড়িতে হাত দিয়েছে, শিংমাছ দিলো কাঁটা ফুটিয়ে।

চোর ঊঊউ করে হাতটা সেকতে গেলো চুলার আগুনে। বেল ফটাস করে ফুটে লাগলো গিয়ে চোরের চোখে । চোর আ আ করে ছুটলো পালাতে। দড়াম করে পিছলে পড়ে সারা গায়ে গোবর মেখে ভুত হলো । গায়ের গোবর মুছতে গেলো বাড়ির সামনের ঘাসে।

আর কাঁচি দিলো কুচ করে চোরবেটার পা গেলো কেটে। চোর তো বাবারে মারে করে চেঁচাতে লাগলো। আর গাঁয়ের সকল লোক ধরে ফেললো চোরটাকে। ছোটবেলায় পান্তাবুড়ির গল্পটা ছিলো আমার প্রিয় গল্প। হয়তো গরীব দুখী বুড়ির পান্তা চুরির আচ্ছামত শিক্ষা পাবার জন্যই গল্প শেষে আমি অনেক খুশী হয়ে উঠতাম।

আবার পান্তাবুড়ির পান্তাভাতের মত দাদীমা বা বাড়ির যে কোনো লোকের পান্তা খাওয়া দেখলেই আমার মনটা আনচান করে উঠতো। তাই আমি শিশুকাল থেকেই পান্তা প্রিয় একটা বাচ্চা হয়ে গেলাম। আর হরেক রকম উপাধি ও নামাকরণের ভিড়ে আমার আরো একটি নাম জুটলো 'পান্তা বুড়ি' হিসেবে। যাইহোক আমার প্রিয় এই গল্পটা আমি বেশ কয়েকবার একালের বাচ্চাদেরকে শুনাতে চেয়েছিলাম। আমার বোনের বাচ্চাটা তো বলেই বসলো , 'থামোতো খালামনি, বুড়িটা একটা বোকা।

চোরকে ধরতে এতকিছু করতে হয়। পান্তাভাতের হাড়িটে শিং মাছ এনে রাখতে হয় কষ্ট করে? ল্যানির‌্যাট দিয়ে রাখলেই তো চোরটা ইদুরের মত মরে যেত। " বলে কি বাচ্চাটা? এই বয়সেই মানুষ মারার বুদ্ধি। তবে কথায় আছে এ যুগের ছেলেমেয়ে। যাইহোক, কয়েকদিন আগে এক পত্রিকায় পড়লাম এ যুগের পান্তাবুড়ি।

সে শিং মাছের বদলে পান্তায় দিয়েছে আলপিন, বেলের বদলে চুলায় রেখেছে ককটেল ইত্যাদি ইত্যাদি এরপর আমি আবার ট্রাই করলাম বোনের পিচ্চিটাকে এই নবযুগের গল্প শুনাতে। সে বেশ বড় বড় চোখ করে হা করে শুনলো ও তৃপ্তির নিশ্বাস ফেললো। তার কাছে শিং মাছ ফাছ এর বদলে এই আলপিন ককটেল অনেক বেশী গ্রহনযোগ্য। এখন বলি আমি এতক্ষন ধান ভানতে শিবের গীত গাইলাম কেনো? এই শিবের গীতের কারণটাই পান্তাভাত। একটা প্রশ্ন বার বার মনে জাগে, পান্তাভাতই কি বাঙ্গালীর প্রধান খাদ্য? গরম ভাত কি বাঙ্গালীরা খায়না? নাকি পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান গুলোতে একটা দিনের জন্য শখ করে মানুষের মনে গাঁয়ের কিষান হবার লোভ জাগে? সে যাই হোক, আমার তো বেশ ভালোই লাগে।

এত কিছু ভাবার থেকে সেই ভালো। পান্তাবুড়ির পান্তাভাত শুকনা মরিচ পোড়া,পেয়াজ লবন দিয়ে বেশ করে মেখে খেতে। পহেলা বৈশাখকে ঘিরে বেশ কিছুদিন যাবৎ সাজ সাজ রব। বিপনীবিতান গুলোতে সাদা আর লালের যাদু। বৈশাখী বিভিন্ন অফার।

সাজগোজ, দুল, মালা, চুড়ি কেনা। আমিও গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসালাম জনতার আনন্দ উল্লাস আর আদিখ্যেতা যেটাই বলা হোক না কেনো সেটাতে। শুনেছিলাম এ্যগোরায় নাকি পাওয়া যায় সেরা মেঘনার ইলিশ। ছুটলাম সেখানে। শ্বাসুড়ির আবদার, সরষে ইলিশ খাবেন।

১৭৫০ টাকার দুইটা পিচ্চি পিচ্চি ইলিশ। কি আর করা? হাজার হোক পহেলা বৈশাখ, তায় আবার শ্বাসুড়ীর আবদার। মরি বাঁচি কিনতেই হবে। পান্তাভাত খেতেই হবে, সরষে ইলিশ আর ইলিশ ভাজা চাখতেই হবে। নাইলে শাশুড়ির দেওয়া বৈশাখী উপহার সাদা লাল গরদ শাড়িটা কাঁটা হয়ে ফুটবে গায়ে।

ভোর ছটায় উঠে সর্ষে ইলিশ ও পান্তাভাত, মুড়ি মুড়কিতে আনন্দ উল্লাসে পেট পূজা সারা হলো। তারপর ছুটলাম রমনায়। তখন সাতটা। মনে হলো চারিদিকে সাদা সাদা, লাল লাল ফুল ফুটে আছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ফুলগুলো আরো বেশী ফুটে উঠছিলো।

কি স্নিগ্ধ মায়াময় পরিবেশ চারিদিক জুড়ে। সত্যি চোখ জুড়ালো, মন ভরালো! কিন্তু বেশীক্ষণ মন ভরানো গেলোনা। বিদায় নিতে হলো সেখান থেকে। ৯ টার মধ্যে ফিরে আসতে হবে অন্য একটি বৈশাখী আয়োজনে। সেখানের আবার সেই পান্তা, ইলিশ মুড়ি মুড়কি।

কিন্তু তফাৎ শুধু এখানে বিচিত্র রমনী পূরুষের বিচিত্ররকম বেশ ভুশা দেখে জীবন ধন্য হলো (তবে মন জুড়াতে পারলাম না বলে দুস্কিত। মাঝে মাঝে কিছু কিছু কিশোর কিশোরী, তরুণ তরুনীর এই বাংলাবছরের প্রথম দিনটিতে এমন বিচিত্র বেশ ভুশা ও ইংলিশ কথন দেখে ভাবছিলাম এই বয়সে আমি এমন বিচিত্র পোশাক অঙ্গে ধারন করিলে আমার মা জননী আমার পিঠ খানার কি দফা রফা করিতেন) তবে এখানে এই পিচ্চি বাউলের গান শুনে সত্যি মুগ্ধ হলাম। । যাইহোক এরপর আমার স্বামী মহাশয়ের প্রাণে ইচ্ছা জাগলো বাড়ির বাইরের বাঙ্গালী খানা খাওয়ার। ( বড়ই অপমান জনক ব্যাপার র‌্যাপার।

আমি কি রন্ধন পটিয়াসী নহি। কেনো তবে বাড়ির বাইরের বাঙ্গালী খাদ্য গ্রহন?) গেলাম সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে সাত মসজীদ রোডের কড়াই গোস্তে। মরি মরি! বাঙ্গালী খানার মৌ মৌ সুবাস! গিজগিজা মানুষজন। কোথাও তিল ধারনের জায়গা নেই। নেমে এসে ফখরুদ্দিনে উঁকি দিলাম।

দোকানের সামনে সর্ষে ইলিশ, বড় বড় চিংড়ি ভাজা , গোল করা বাটি চাপা ভাত । আহা! রন্ধনপটিয়সীপনার দুঃখ ঘুচে গেলো। কিন্তু কোথাও একটু বসে শান্তিতে খাবার জায়গা নাই। ৪৫ মিনিটস অপেক্ষা করে লাইন দিয়ে অবশেষে বাঙ্গালীখানা ভাগ্যে জুটলো। বাড়ি ফিরে আসবার সময় রাস্তায় আনন্দ মুখর জনতার ঢল দেখে মনে হচ্ছিলো আসলেই বাঙ্গালী জাত শত দুঃখ কষ্টেও মলিন হয়না।

মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছিলো একিরকম পান্জাবী বা ফতুয়ায় সজ্জিত বাচ্চা ও বাবা। মা মেয়ে বা একদল বোনেদের কলকাকলী। কখনও কখনও এক ঝাঁক উচ্ছল তরুণ। পহেলা বৈশাখের দিনটি বেশ ভালোই কেঁটেছিলো। তবে যখন রাত্রী নেমে এলো।

আমার সকল আনন্দ মলিন হয়ে গেলো একরাশ ভীতি, শঙ্কা ও উৎকন্ঠার সাথে সাথে বয়ে যাওয়া কিছু প্রহর নিয়ে। সারাদিনের একরাশ ক্লান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তখন রাত তিনটা বাজে। হঠাৎ ঘুম ভাঙলো কারো ডাকে। চোখ মেলে দেখলাম বিছানার পাশে আমার স্বামীকে।

ডিম লাইটের আলোকে তাকে একটু অন্যরকম লাগলো। ফিস ফিস করে বললেন। " বাড়িতে ডাকাত ঢুকেছে"। ঘুমচোখে আমার মাথা কাজ করছিলো না । সে ইশারায় আমাকে চুপ করতে বলে বললেন, "ড্রইং রুমের জানালার কাঁচ ও গ্রীল ভেঙ্গে ফেলেছে ।

এখন সম্ভবত বাসার মধ্যেই বিচরণ করছে। যাই হোক থানায় ফোন করতে হবে। " আমি বিস্ফারিত নেত্রে তার দিকে তাকিয়েই আছি। কি পরিমান খারাপ মূহুর্ত বলে বোঝানো যাবেনা। আমি মাথার কাছে মোবাইল খুঁজে পেলাম না।

টি এন টিতে ফোন দিলাম থানায়। আমার গলা এত কাঁপছিলো । ( কেউ হাসবেনা যেন এই কথা পড়ে) নিজের হার্টবিটের শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছিলাম। আমরা যে এলাকায় থাকি সেই নিরাপত্তা রক্ষীদের কে ইতিমধ্যে ফোন দিয়েছিলেন আমার স্বামী। আমাদের নিজেদের নৈশ প্রহরীদের কোনো সাড়া শব্দ পাচ্ছিলাম না।

তাদের মোবাইলগুলোও কাজ করছিলো না। সে কটি মুহুর্ত বলে বোঝানো যাবেনা। আমার স্বামী আমার ভয় সামলাবেন নাকি অন্যখানে যোগাযোগ করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না নিশ্চয়। ( আমি যে এত ভীতু আগে জানতাম না। ) যাইহোক কিছু পরেই হৈ হৈ করে আশে পাশে শব্দ শুনেই আমরা বেড রুমের দরজা খুলে বের হলাম।

আমি অবশ্য বের হতে চাচ্ছিলাম না। ভাবছিলাম যা ইচ্ছে তাই হোক আমি ডাকাতদের দরজা ভাঙ্গা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। কিন্তু আমার বীরপুরুষ স্বামীর যন্ত্রনায় বের হতেই হলো। বের হয়ে আবিষ্কার করলাম সব নানা রকম এ্যাডভেন্চারাস কাহিনী। যাইহোক এ যাত্রা প্রানে বেঁচেছি আমার নিশাচর স্বামীর বদৌলতে।

সবাই যখন গভীর ঘুমে আছন্ন তিনি গভীর মনোযোগে ওকালতি বই অধ্যয়নে রত ছিলেন। এরি মাঝে শুনতে পান জানালার কাঁচ ভেঙ্গে পড়ার শব্দ। ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেই দেখেন কিছু নীল আলোর (ডাকাতদলের টর্চের )বিচ্ছুরন। উনারা বাইরে দারোয়ানদেরকে বেঁধে , জানালার কাঁচ ভেঙ্গে ভেতরে ঢুবার প্রাক্কালে আমার স্বামীর নজরে পড়ে গিয়েছিলেন। তারপর সারারাত হৈ চৈ থানা পুলিশ, নির্ঘুম রাত ও দিন।

পান্তা বুড়ি রাজার কাছে বিচার না পেলেও শিং মাছ ও অন্যন্যরা সেই চোরের যথাযথ বিচার করেছিলো, আমি কার কাছে বিচার চাইবো? এবারের পহেলা বৈশাখ এমন স্মৃতি উপহার দিয়ে গেলো যা কখনও মুছে যাবার নয়। তবুও চাওয়া হোক সকলের জন্য- মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নি স্নানে সূচী হোক ধরা।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।