আগামী জুলাই থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে জাতীয় বেতন-স্কেল কার্যকর হচ্ছে। একই সঙ্গে কাটা হচ্ছে টাইম স্কেল। আর এ টাইম স্কেল কাটার ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রায় ১ হাজার ৫০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন কমে যাবে। এ ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।
সোমবার সকালে প্রায় দুশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কার্যালয়ের সামনে ভিড় করেন।
দুপুর ১টার দিকে তারা বিষয়টি নিয়ে গভর্নরের সঙ্গে কথা বলেন। সারাদেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন ব্রাঞ্চের অঞ্চলভিত্তিক ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েশন এবং সমিতির সভাপতি ও সেক্রেটারিরা বিষয়টি নিয়ে গভর্নরের সঙ্গে আলোচনা করেন।
বৈঠক থেকে বের হয়ে ব্যাংকের কয়েক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে জানান, প্রায় ১ হাজার ৫০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন কমে যাবে। তারা গভর্নরকে বলেছেন, জাতীয় বেতন-স্কেল বাস্তবায়নের ফলে টাইম স্কেলের যে টাকা কাটার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাতে অনেকের বেতন কমে যাবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রমোশন দিয়ে এ সমস্যা নিরসনে গভর্নরকে অনুরোধ করা হয়েছে।
গভর্নর বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর ব্যাপারে কি হয় তা দেখে পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ডেপুটি ডিরেক্টর তার বেতন কাঠামোর উদাহরণ দিয়ে বলেন, জাতীয় বেতন-স্কেলে তার বেসিক ১৮ হাজার টাকার ওপর হওয়ার কথা। কিন্তু টাইম স্কেলে বেতন কাটলে সেটা ১৪ হাজার টাকা হয়ে যাবে। এখন তার বেসিক ১৫ হাজার ২০০ টাকা। এ হিসাবে বেতন ১ হাজার ২০০ টাকা কমে যাবে।
তিনি আরো বলেন, যেখানে তারা অপেক্ষায় আছেন জাতীয় বেতন-স্কেলের আওতায় বেতন বাড়বে, সেখানে এখন তা কমে যাচ্ছে। এ কারণে ভুক্তভোগীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, তারা জাতীয় বেতন-স্কেল বাস্তবায়নের বিপক্ষে নন। যদিও তারা স্বতন্ত্র বেতন-স্কেল আশা করছেন। এ ব্যাপারে সরকার এবং গভর্নর আন্তরিক আছেন বলে মনে হয়।
সরকার স্কেল দেয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ানোর জন্য। কিন্তু বেতন-স্কেল বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কারো বেতন যেন না কমে- এ ব্যাপারে সতর্ক নজর রাখার জন্য গভর্নরের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, তাদের যদি বেতনের অতিরিক্ত অর্থ দেয়া হয়- সেটা কর্তৃপক্ষের ভুল, তাদের ভুল নয়; আর কর্তৃপক্ষের ভুলের খেসারত দিতে গেলে এখন তাদের প্রত্যেককে প্রায় দুই লাখ টাকার ওপর ফেরত দিতে হবে, যা অনেকের পক্ষে অসম্ভব।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় ৩ হাজার ২৫৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রায় ৭০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা বেশি দেয়া হয়েছে। এর ফলে গড়ে প্রত্যেককে ২ লাখ ১৭ হাজার টাকা করে ফেরত দিতে হবে।
তাদের মধ্যে ৪৩৫ জন এরই মধ্যে এলপিআর বা অবসরে গেছেন, যাদের টাকার পরিমাণ প্রায় ৬ কোটি ৫৬ লাখ। এছাড়া ২ হাজার ৮৪০ জন কর্মরত রয়েছেন, যাদের কাছে পাওনা টাকার পরিমাণ প্রায় ৬৪ হাজার ২৮ লাখ।
সূত্রগুলো জানায়, বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিম্ন বেতনভুক্ত হওয়ায় এবং এরই মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী পেনশনে চলে যাওয়ায় এবং কয়েকজন মৃত্যুবরণ করায় টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়টি তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব। এ বিষয়টি উল্লেখ করে ২০০৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২০০৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দেয়া থেকে অব্যাহতির আবেদন জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তের জন্য সরকারি হিসাব সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনার কথা রয়েছে।
সূত্র জানায়, সংসদীয় কমিটির সভাপতি আ হ ম মোস্তফা কামাল বিষয়টির মানবিক দিক বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অর্থ মওকুফ করার পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেন, টাইম স্কেলজনিত কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ৪২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী অতিরিক্ত বেতন-ভাতা গ্রহণ করেছেন, তাদের অনেকেই অবসরে চলে গেছেন। ত্রুটি কর্তৃপক্ষের, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এর দায় বহন করবে কেন? সুবিধা দেয়ার পর সেটি আর ফেরত না নেয়া একটি প্রচলিত নিয়ম বলেও মত দিয়েছেন মোস্তফা কামাল।
সূত্র জানায়, ১৯৯৪ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বস্তরের কর্মচারী ও পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ব্যাংকের বিদ্যমান পদবিন্যাস অনুযায়ী সন্তোষজনকভাবে ৮, ১২ ও ১৫ বছর চাকরি পূর্তিতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় উচ্চতর টাইম-স্কেল দেয়া হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ১৯৮৪ সালের ১ ডিসেম্বরের স্মারক নং-১৫৫ এর ‘ট’ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ব্যাখাসহ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন সময় জারিকৃত বিভিন্ন ব্যাখ্যা, আদেশ পর্যালোচনা করে ১৯৯৪ সালের ২৭ মার্চ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর খোরশেদ আলম অর্থ মন্ত্রণালয়ের তখনকার অতিরিক্ত সচিব এইচ আর দত্তর সঙ্গে আলাপ করে তার উপস্থিতিতে এ টাইম-স্কেল অনুমোদন করেন।
১৯৯৭-৯৮ সালে বিশেষ বাণিজ্যিক নিরীক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংকে ৪২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নথি নিরীক্ষা করে আপত্তি উত্থাপন করে নিরীক্ষা অধিদপ্তর। ওই নিরীক্ষায় বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের আদেশ-নির্দেশের ভুল ব্যাখ্যা করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টাইম-স্কেল নির্ধারণ করে অতিরিক্ত অর্থ দিয়েছে; যা আদায়যোগ্য। ওই নিরীক্ষা আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জবাবের আলোকে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ থাকলেও নিরীক্ষা অধিদপ্তর রাজি না হওয়ায় সেটি ২০০৫ সালের ১৪ মার্চ অষ্টম জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত (পিএ) স্থায়ী কমিটির ২৭তম বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। পিএ কমিটির বৈঠকে একই দিন থেকে ওই টাইম-স্কেল বন্ধ করে গ্রহণ করা অতিরিক্ত অর্থ ফেরত নেয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নির্দেশনা দেয়ার ব্যাপারে মতামত দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ সচিব ও মহাহিসাব নিরীক্ষকের নেতৃত্বে এক সভায় তখনকার অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর সুপারিশ অনুসারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করে অর্থ আদায় থেকে অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ করা হয়।
ওই সুপারিশের ভিত্তিতে ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট অনুষ্ঠিত পিএ কমিটির এক বৈঠকে ২০০৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ৪২৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অর্থ আদায় থেকে অব্যাহতি দেয়ার ব্যাপারে মতামত দেয়া হয়। একই সঙ্গে পিএ কমিটি ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি কার্যকর নতুন বেতন-স্কেল অনুযায়ী বেতন নির্ধারণ করার নির্দেশনা দেয়।
এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিষয়টি এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে আছে। এটি নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে আলোচনার কথা রয়েছে। স্থায়ী কমিটি যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটিই চূড়ান্ত হবে।
তাই বিষয়টি নিয়ে পৃথকভাবে ব্যাংকিং বিভাগের কিছু বলার নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।