আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

3D আভটারঃ কল্পবিজ্ঞান নয়, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক অনন্য শিল্প।

চলতাছে আরকি

ছুটির দিন। সাইকেল আর পানির বোতল নিয়ে ভোরে বেরিয়ে গেলাম ঘুরতে। দেখলাম আমার বাড়ির পাশের সিনেমা হলে অভতার এর থ্রিডি ভার্সন এসেছে এতদিন পরে। দেখতে মনস্থ করলাম। আগে ডিভিডিতে টুডি ভার্সন-এ দেখে ভালো লেগেছিল।

থ্রিডি ভার্সন দেখে আগের অভিজ্ঞতাকে নিতান্তই খেলোই মনে হল। সত্যি অসাধারন। দু একবার তো চমকে চমক উঠেছিলাম। মনে হচ্ছিল সত্যিকারের বস্তুরাজি পর্দা থেকে বের হয়ে আমার গায়ে আছড়ে পড়ছে। মনে হয় চাইলেই আমি পর্দার সবকিছু ছুয়ে দেখতে পারি।

অভতার রিলিজ হওয়ার আগে পরে এ নিয়ে অনেক পোষ্ট এসেছে বিভিন্ন ব্লগে। তখন আর এটা নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করেনি। আজ থ্রিডিতে দেখে মত পাল্টালাম। ব্লগে দেখলাম কেউ কেউ এটাকে বলেছেন সাই-ফাই ছবির আদর্শ, কেউ বলেছেন রূপকথার গল্প। কোন একটা পোষ্টে দেখলাম একজন বলেছেন যে ক্যামেরন নাকি গাঁজা খেয়ে ছবি বানিয়েছেন।

আমার বিচারে এই প্রথম জেমস ক্যামেরন একটা ছবি বানালেন যেটা দার্শনিক বিচারে অনেক উন্নত, বক্তব্যের বিচারে অনেক মানবিক আর উদার, টেকনলজির কথা তো আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। ক্যামেরনের আগের ছবি গুলো ব্যবসা সফল কিন্তু মূলত হলিউডি বিনোদনেকে মাথায় রেখে তৈরি হয়েছিল। অভতার-এ ক্যামেরন শুধুমাত্র সাই ফাই বিস্ময় বা অসাধারন টেকনিক এ আবদ্ধ থাকেননি। আরেকধাপ এগিয়ে গেছেন দর্শন, বিজ্ঞান আর রাজনীতির ইন্টারপ্রিটেশন-এ। অভতার কথা বলেছে আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদ ও প্রকৃতিবাদ নিয়ে এবং দেখিয়েছে আগ্রাসি ভোগবাদি লোভের ফলশ্রুতিতে কিভাবে আমরা সব ধ্বংশ করছি।

দূরের গ্রহ প্যান্ডোরার দূর্লভ খনিজ উবেনিয়াম এর প্রতি লোভ মার্কিন কর্পোরেট হাউজ এর। কর্পোরেট হাউজের প্রতিনিধি পার্কার প্যান্ডোরায় হাজির হয়েছে আর্মি নিয়ে, উদ্দেশ্য মূল্যবান এন্টি-গ্র্যাভিটির উবেনিয়াম দখল করা। কিন্তু প্যান্ডোরার আদিবাসিরা তাদের ভুমি থেকে সরবে না। কাজেই উপায় হল তাদের ধ্বংশ করা। এর জন্য যদি নারী শিশুসহ সবাইকে মেরে কেটে তাদের ভিটে উচ্ছেদ করতে হয় তাতেও অসুবিধা নেই।

প্যান্ডোরার আদিবাসি নাবীদের (NABI) নিয়ে কাজ করছিলেন বিজ্ঞানী ড. গ্রেস। গ্রেস এবং তার দল তৈরি করলেন অভতার- দেহ নাবীদের কিন্তু চেতনা মানুষের। গল্পের নায়ক জ্যাক সুলি এবং গ্রেসের দল চান নাবীদের সাথে একটি সমঝোতা। কিন্তু খনিজের লোভে অন্ধ কর্পোরেট প্রতিনিধি পার্কার অপেক্ষায় নারাজ। গ্রেস এবং পার্কারের কথপকোথন লক্ষ্য করলে দেখবেন লোভী সাম্রাজ্যবাদ এবং মানবতাবাদী বিজ্ঞানের মধ্যেকার দ্বন্দ।

পার্কার বলছে যে আমি ওদের এখনই মেরে ফেলছিনা কারন পত্রিকায় এ খবর গেলে শেয়ার এর দাম পড়ে যেতে পারে। এই প্রজেক্টের টাকা আসে শেয়ার হোল্ডারদের কাছ থেকে। তারা অতশত বোঝেনা, তারা বোঝে তাদের পুজির লাভ । এটা করতে গিয়ে নাবীদের তথাকথিত সভ্য বানানোরও একটা প্রকৃয়া চলে। তাদের জন্য স্কুল খোলা, রাস্তা বানানো ইত্যাদি ইত্যাদি।

সেই তথাকথিত সভ্য বানানোর প্রকৃয়া দেখলে আমার উপমহাদেশে বৃটিশ ঔপেনিবেশিক দখল বা আফ্রিকায় সভ্য বানানোর নামে যে লুণ্ঠন তার কথা মনে পড়ে। এবার পাঠকবৃন্দ পার্কার-এর জায়গায় বুশকে কল্পনা করুন। প্যান্ডোরার জায়গায় ইরাক, আর উবেনিয়ামের জায়গায় তেল। তাহলেই দখবেন গল্পের ছলে কিভাবে ক্যামেরন আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। গল্পের এক পর্যায়ে আর্মি কমান্ডার নাবীদের উপর হামলা করার উদ্দেশ্যে বলছে যে “আমরা টেররকে টেরর দিয়ে মোকাবেলা করব”।

কি আশ্চর্য মিল, ওরাই নাবীদের গ্রহ দখল করেছে আবার নাবীদেরই বলছে টেরর। আমার মনে হচ্ছে অভতার এর অস্কার না পাওয়ার পিছনে এই প্রতিবাদী দর্শন এর কোন ভূমিকা থাকতেও পারে। আরেকটি বিষয় হল প্রকৃতিবাদ। নাবীরা আমাদের মত টেকনলজিতে উন্নত নয়। কিন্তু তারা প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ও প্রকৃতিকে ভালবাসে।

টেকনলজিতে উন্নত হয়ে আমরা আমাদের সব ধ্বংশ করে দিচ্ছি। কিন্তু নাবীরা অপ্রয়োজনে একটি পশুও হত্যা করতে চায়না। তাই তো নায়িকা, প্রথম পরিচয়ে জ্যাক সুলিকে বলে, তুমি একটা বাচ্চা। তুমি জাননা কিভাবে চলতে হয়। মানুষের কাছ থেকে তাদের কিছুই নেয়ার নেই।

কারন হিংস্র হানাহানি আর লোভ ছাড়া মানুষ তাদের কিছুই দিতে পারবে না। তারা প্রকৃতির সাথে চলে এক বন্ধনে। তাদের ঘোড়া বা তরুক পাখির সাথে চুলের মাধ্যমে গড়ে তোলে আত্মিক বন্ধন। এভাবেই প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে যে সমাজ তা গড়ে তোলে এক উন্নত সংস্কৃতি। যে সংস্কৃতি আমাদেরও ছিল একসময়।

সামাজিক বিবর্তনের প্রাথমিক ধাপগুলোতে। তাদের আমাদের মত যান্ত্রিক সভ্যতা নেই, কিন্তু আছে এক চমতকার সামাজিক সহযোগিতার সংস্কৃতি যা আমরা আমাদের যান্ত্রিক সভ্যতা গড়তে খুইয়ে ফেলেছি। আজকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর হুমকি ও এর সমাধানে লজ্জাজনক নিরবতা আমাদের অন্তহীন লোভেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ। উপরোক্ত দুটি মূল বিষয় ছাড়াও এই ছবিতে আরো অনেকগুলো উপাদান আছে ভাবার মত। যেমন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অভিশাপ না কি আশির্বাদ তা নিয়ে ভাবনা।

এছাড়া আছে প্যাগান ধর্মের বিবর্তন ও বিশ্বচেতনার সাথে আত্মিক চেতনার সম্মিলন। আছে নাস্তিকতার উপাদান। (ড গ্রেস মারা যাওয়ার আগে জ্যাক সুলিকে বলে “আমি বিজ্ঞানী, তাই পরকালের রূপকথায় বিশ্বাস করিনা”), আছে সামরিক শক্তির প্রতি তীব্র ঘৃণা (গ্রেস একসময়ে আর্মি কমান্ডারকে দেখিয়ে পার্কারকে বলে, তোমার কুত্তাটাকে থামতে বল), আছে অভতার নামের মাজেজা (হিন্দু দর্শনের উপাদান)। আর অতশত দেখেতো ছবি উপভোগ করা যায় না। সোজা গল্পে বললে আমরা মনে রাখতাম না।

সেটা হত স্লোগান বা ভাষন। একটা সুন্দর আকর্ষনীয় গল্প দিয়ে ক্যামরন রুপকের ছলে আমাদের দেখিয়েছেন। এভাবেই শিল্প মানুষকে, সমাজকে পালটায়। তবে অভতার নিয়ে আরো অনেক জোরালো লেখা আছে ড বিপ্লব পাল এর ব্লগ এ। তার এই অসাধারণ বিশ্লেষণ (আমার মতে এখনো পর্যন্ত বাংলায় সেরা বিশ্লেষণ) সবারই পড়া উচিত।

আম্বা-বিম্পির ক্যাচালের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা যদি আমাদের ব্লগারদের থেকে থাকে তাহলে এই লিংক থেকে ড বিপ্লব পালের লেখাটা (আলোচনা সহ) পড়ে দেখতে পারেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।