আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আর কত ধৈর্য ধারণ

Only I know what is my goal, My heart is my temple.

কাজী সায়েমুজ্জামান: ২০০৯-১০ অর্থবছর শেষ হতে আর এক মাস বাকি। চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী ২০০৯ সালেই ৯৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্ত এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎও সরকারীভাবে উঃপাদন করতে পারেন নি। তিনিই এখন বলছেন, সরকার বিদ্যুৎ ছাড়া অন্যসব ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। এর আগে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে দিন বদলের সনদে বিদ্যুৎ সংকটকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।

সরকার গঠনের পরে আরো বেশি স্বপ্ন দেখিয়েছিল ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে। এ অবস্থায় এখন বারবার বলা হচ্ছে, ধৈর্য ধারণের জন্য। এক বছরে গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো যায়নি। চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুৎও উৎপাদিত হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষ এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বিদ্যুৎ সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।

ধৈর্য ধারণের পরামর্শ : বিদ্যুৎ পরিস্থিতি যখন আগের চেয়েও ভয়াবহ ঠিক তখনই সরকারের পক্ষ থেকে বারবার ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সংসদের চতুর্থ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণকে ধৈর্য ধারণ করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জনগণকে বলবো ধৈর্য ধরতে। আমরা বসে নেই। ’ ‘বিদ্যুতের অভাবে মানুষ প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছে।

নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে না। এটি এখন জাতির জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা। জনগণের জন্য আমরা কাজ করছি। তাই জনগণের কাছে আমরা কিছু লুকাতে চাই না। ২০১৫ সালের মধ্যে দেশে বর্তমান উৎপাদনের দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

’ এর আগেও প্রধানমন্ত্রী কয়েকবার এ সংকটে ধৈর্য ধারণ করতে বলেছিলেন। গ্রামে সেচের কথা বলে নগরবাসীকে কষ্ট মেনে নেওয়ার আহবান জানিয়েছিলেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী। সরকারের এ ব্যর্থতা ঢাকতে প্রতিটি বিষয়ের মতোই আগের সরকারগুলোর ওপর দোষারোপ চলেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের কোন উদ্যোগই কাজে আসছে না। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ও ডে লাইট সেভিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এর পর এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এটি বাস্তবায়ন করা যায়নি। বর্তমানে দুই ঘণ্টা করে লোডশেডিং ব্যবস্থার প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু দুই ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ গেলেও চার ঘণ্টায়ও তার দেখা মিলছে না। সর্বশেষ সরকার সন্ধ্যার পর এসি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।

বিদেশে রোডশো করে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগও ব্যর্থ হয়েছে। সারকারখানার গ্যাস বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করেও পরিস্থিতির উন্নতি করা যায়নি। বিদ্যুতের এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে তাহলে সরকার এক বছরের বেশি সময়ে এর সমাধানে কি করেছে? অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ সময়ে সরকার আসলে কার্যকর কিছুই করেনি। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে জরুরি ভিত্তিতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পদক্ষেপ নিলেও এ বছর কোনো কাজে আসছে না। কারণ সেচ মৌসুম শেষ হয়ে যাবে।

সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত ৫৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন যুক্ত হয়েছে। এ বছর আরো ৪৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হতে পারে। এর মধ্যে সরকারিভাবে ৩৬০ ও বেসরকারি খাতে ১০৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতে পারে। তবে এসব কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া আগের সরকারগুলোর আমলেই শুরু হয়েছিল। এ বিদ্যুৎ যে যথেষ্ট নয় তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে।

সেচ মৌসুম শুরু হওয়ার আগে চাহিদা ছিল সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। শুধু সেচ কাজে যেসব মিটার রয়েছে তার বিপরীতেই প্রয়োজন দুই হাজার মেগাওয়াট। ফলে এ মুহূর্তে দেশে বিদ্যুতের মোট চাহিদা সাড়ে সাত হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু উৎপাদন দিন দিন কমে চার হাজার মেগাওয়াটের নিচে অবস্থান করছে। ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি ও তেল, ডিজেল সরবরাহ করতে গিয়ে সরকারের ২০০ কোটি টাকা গচ্চা যাবে।

ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্র থেকে ১৬ টাকা ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্র থেকে ৮ টাকা দরে বিদ্যুৎ কিনে ২ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ৫ টাকা বিক্রি করতে হবে। সংকটের এ মুহূর্তে টেন্ডার ছাড়াই তড়িঘড়ি করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যাদেশ দেওয়ারও ঘটনা ঘটেছে। ফলে এ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র : বিদ্যুতের এ সংকট মেটাতে সরকার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর জন্য তোড়জোড় শুরু করলেও কাজ শুরু করতে পারেনি। এ কেন্দ্র থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে বলে সরকার বলছে।

কাজ শুরু করার পরও এ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পাঁচ বছর লাগবে। এ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি হলেও চূড়ান্ত চুক্তি হয়নি। এর আগে এ কেন্দ্র তৈরিতে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়ার সহায়তা চাওয়া হয়। কিন্তু তারা আগ্রহী হয়নি। এ কেন্দ্র নির্মাণে অর্থায়ন কিভাবে হবে তা এখনো অনিশ্চিত।

ফলে বর্তমান সরকারের আমলে এ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই। বিকল্প বিদ্যুৎ : সরকার বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানির কথা বলছে। বলা হচ্ছে, ঢাকা শহরের বাসাবাড়ির ছাদের ওপর সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে। ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও সৌর বিদ্যুৎ বসানো হয়েছে। কিন্তু ১৯৯৬ সালে পাওয়ার সেল নবায়নযোগ্য জ্বালানির একটি নীতিমালা মন্ত্রণালয়ে জমা দিলেও সরকার তা ফেলে রাখে।

২০০৮ সালে এ নীতিমালা অনুমোদন করা হয়। তবে সময়মতো বাস্তবায়ন না করায় গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফান্ডের তহবিল থেকে বঞ্চিত হয় দেশ। বর্তমান উদ্যোগ বাস্তবায়নে তহবিলও জোগাড় করতে পারেনি সরকার। বিদ্যুৎ আমদানি : বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ক্রাশ প্রোগ্রামের আওতায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে আমদানির ওপর নজর দেয়। নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার থেকে বিদ্যুৎ আমদানির চেষ্টা করা হয়।

এসব প্রচেষ্টার কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে ১১ জানুয়ারি নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতার জন্য একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এ সমঝোতা অনুযায়ী ভারত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা যাবে। তবে এর জন্য বাংলাদেশকে ২০১২ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর এই বিদ্যুতের জন্য কানেক্টর বাবদ বাংলাদেশকে ব্যয় করতে হবে ১১০০ কোটি টাকা।

বিদ্যুতের দাম পড়বে প্রতি ইউনিট পাঁচ টাকার উপরে। ফলে জরুরি ভিত্তিতে আমদানির যৌক্তিকতা দেখানো হলেও বাস্তবে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পেতেই দুই বছর লাগছে। এ সময়ের মধ্যে সরকারিভাবেই এ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতো। ব্যর্থ রোড শো : গত বছরের ডিসেম্বর থেকেই সরকার বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য রোড শো আয়োজন করে। গত ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর লন্ডনে, ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি সিঙ্গাপুরে, ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি নিউইয়র্কে রোড শোর আয়োজন করা হয়।

উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে ৪ হাজার ৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা। কিন্তু তেমন কোনো সাড়া পায়নি সরকার। অর্থমন্ত্রী যা বলেছিলেন : অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিত বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘বর্তমানে আমাদের গড় চাহিদা প্রায় ৫০০০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে ৩৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। ২০২১ সাল নাগাদ দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা ২০০০০ মেগাওয়াট ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথাযথ পদক্ষেপ নিতে চাই।

২০১১ সাল নাগাদ বিদ্যুতের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে সক্ষম এমন একটি অবস্থানে পৌঁছতে চাই। তিনি বলেন, ২০০৮-এর কয়েক মাসে ৩০৭ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন বেসরকারি খাতে শুরু হয়েছে। ২০০৯ সালে সরকারি খাতে ৪টি প্রকল্পে ৫০০ মেগাওয়াট এবং বেসরকারি খাতে ১১টি প্রকল্পে ৪৪০ মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। ৪৫০ মেগাওয়াটের বিবিয়ানা বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণে দরপত্র আহবানের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমরা আশা করি পরিকল্পনামতো এগুতে পারলে সরকারি খাতে ১৩টি প্রকল্পে ২০১৩ সালের মধ্যে আরও ২ হাজার ৮১০ মেগাওয়াট ও বেসরকারি খাতে বিবিয়ানাসহ ৩টি প্রকল্পে ১ হাজার ৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে।

’ অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী ২০০৯ সালেই ৯৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই বছরে সরকারি খাতের চারটি প্রকল্প থেকে এক মেগাওয়াটও বিদ্যুৎ আসেনি। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার : আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কথা ছিল না। কিন্তু সরকার তা করেছে। তবে ইশতেহারে বর্ণিত প্রতিশ্রুত কোন প্রকল্পই বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

ইশতেহারে বলা হয়েছিল, ‘তিন বছর মেয়াদি ক্র্যাশ প্রোগ্রামের আওতায় বর্তমানে নির্মাণাধীন ও গৃহীত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র দ্রুত বাস্তবায়ন, জরুরিভিত্তিতে ১০০-১৫০ মেগাওয়াট গ্যাস টারবাইন প্রকল্প, বৃহৎ ও ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণসহ আওয়ামী লীগ আমলে বেসরকারি খাতে ১০, ২০ ও ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এছাড়া পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও ওভারহোলিংয়ের ব্যবস্থা করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করা হবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়িত করা হবে। আগামী তিন বছরে অর্থাৎ ২০১১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫ হাজার মেগাওয়াটে, ২০১৩ সালের মধ্যে ৭ হাজার মেগাওয়াটে এবং ২০২১ সালে ২০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা হবে। ’ বর্তমান সরকারের মেয়াদ ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে শেষ হবে।

অথচ সরকার বিদ্যুৎ নিয়ে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ২০২১ সালের। এর আগে ২০১৩ সালের একটি প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সরকার জরুরি ভিত্তিতে ১০০-১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সরকার : ২০১১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে প্রতিশ্রুতি তা এখন আর সরকারের কেউ উল্লেখ করতে চান না। গত ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধনকালে তার বক্তব্যে ২০১১ সাল উল্লেখও করেননি।

তিনি ২০১৩ সালের মধ্যে ৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কথা বলেন। ফলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী ২০১১ সালের মধ্যে তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের কথা উল্লেখ করে বলেন, তার সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এই পরিকল্পনার আওতায় বেসরকারি খাতে প্রথম পর্যায়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাড়াভিত্তিক এবং সরকারি খাতে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে আরো প্রায় ১ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যাদেশ দেওয়া হবে।

প্রধানমন্ত্রী বর্তমান অবস্থাকে কঠিন বলে মন্তব্য করলেও দুই মাস আগে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক ও স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুবিদ আলী ভূইয়া ভিন্ন কথা বলেছিলেন। ২২ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘তিন মাসের মধ্যে গ্রিডে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ যুক্ত হচ্ছে। আমরা আশা করছি, গ্রীষ্ম মৌসুমের শেষ দিকে সংকট কিছুটা কমে আসবে। সেচ মৌসুমে যাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ দেওয়া যায় সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে গত এক বছরে মহাজোট সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।

নতুন কয়েকটি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে। একই দিন বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় সভাপতি সুবিদ আলী ভূঁইয়া বলেন, দেশে দৈনিক যে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি হচ্ছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে সরকার নানামুখী কর্মপরিকল্পনা ও কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তিনি আরো বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিদ্যুতের চাহিদা কিভাবে পূরণ করে তা দেখতে কয়েকটি দেশ সফরে যাবেন সংসদীয় কমিটির সদস্যরা। কমিটির সভাপতি আরো বলেন, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে বিদ্যুতের অবস্থা উন্নতির পথে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এই সরকারের মেয়াদ শেষে যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন, বিদ্যুৎ নিয়ে বিদ্যমান ঝামেলা তাদের পোহাতে হবে না।

সঠিক তথ্য দিচ্ছে না সরকার : বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বিভিন্ন বক্তব্য আসছে। তবে সঠিক চিত্র এখনো উপস্থাপিত হয়নি। কেউই আসল কথা বলছে না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর বিদ্যুৎ নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশ করেছিল। এতে বলা হয়েছিল, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধির সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা প্রতিবছর ৫ থেকে ৮শ’ মেগাওয়াট বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ হিসেবে দুই বছরেই বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে দেড় হাজার মেগাওয়াটের বেশি। সরকারের হিসাবে বর্তমানে ১৩ থেকে ১৪শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে। এর আগেও একই রকমের ঘাটতি ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ ছিল না। আসলে বর্তমান চাহিদা সাড়ে সাত হাজার মেগাওয়াট থাকলেও পিডিবি তা প্রকাশ করে না।

তারা সেচ কাজের জন্য বাড়তি বিদ্যুতকে রাতের উৎপাদনের সঙ্গে মেলায়। নতুন সংযোগ দেওয়া বন্ধ রয়েছে। সেচ মৌসুম শুরুর আগে গত ১৮ ফেব্রুয়ারী প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী সেচ গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু তৃণমূল থেকে প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী, এবার গতবারের চেয়েও সেচকাজে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমেছে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং আইএমএফের পরামর্শ : বিদ্যুৎ পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, এর প্রধান কারণটি হলো এ খাতকে ক্রমান্বয়ে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত। এর পেছনে বিশ্বব্যাংক আর এডিবির ভূমিকা রয়েছে। বিশ্বব্যাংক কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস আলোকে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ সব সেবা খাতকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার যে চাপ দিয়ে যাচ্ছে তাই বিদ্যুৎ খাতকে এ করুণ পরিস্থিতির মধ্যে নিয়ে এসেছে। এ চাপের কাছে নতি স্বীকার করার কারণেই বিদ্যুৎ খাতের নিয়ন্ত্রণ সরকারের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের ‘এ্যানার্জি সেক্টর স্টাডি রিপোর্ট’-এর মধ্য দিয়ে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে তিনটি নির্দিষ্ট কর্মসূচি দেওয়া হয়।

প্রথমটি হলো, বেসরকারি বিদেশী বিনিয়োগ, দ্বিতীয়টি হলো, রাষ্ট্রীয় সংস্থা ভেঙ্গে ফেলা এবং সর্বশেষ গ্যাস রফতানি করা। বিদেশী বিনিয়োগে বেশ কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হয়েছে ঠিকই, তবে তাদের কাছ থেকে ডলারে বিদ্যুৎ কিনে লোকসান গুনতে গিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান পিডিবি ফতুর হয়ে গেছে। কোনো কেন্দ্র নির্মাণে এ সংস্থাকে একেবারেই অক্ষম করে দেওয়া হয়েছে। তাদের সুপারিশের ফলেই আইপিপি বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে এ আইপিপির জন্ম হয়েছিল।

বর্তমান ভয়াবহ সংকটে বাকি কাজটুকুও সমাধা করার প্রক্রিয়া চলছে। সরকারের বর্তমান প্রকল্পগুলো দেখলেও এটা প্রতীয়মান হয়। সরকার ছোট ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথা বলে আগামী দিনের চাহিদার সব বিদ্যুৎ কেন্দ্রই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দিচ্ছে। এদের কাছ থেকে তিনগুণ বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে বিদ্যুৎ খাতে দেওয়া বরাদ্দের অর্থ গচ্ছা দেওয়ার কাজই করছে সরকার। আর কত ধৈর্য ধারণ : সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পরপরই বলে আসছিল তারা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বিদ্যুৎ সমস্যা লাঘবে কাজ করছে।

এ সময় তাদের আমলে বিদ্যুৎ যুক্ত হওয়ার সাফল্যের দাবিও করে আসছিল। এমনকি এ বছরের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করতে গিয়ে সমস্যা সমাধানে তার সাফল্যের কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেচ মৌসুম শুরু হলে শহরবাসীকে বলা হয় সেচ কাজের জন্য গ্রামে বিদ্যুৎ পাঠাতে হচ্ছে। এ জন্য ধৈর্য ধরতে হবে। কিন্তু বাস্তবে সেচ কাজেও সেভাবে বিদ্যুৎ পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।

বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ভয়াবহ অবনতির দিকে যাচ্ছে। জনগণ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। এ সময় খোদ জনপ্রতিনিধিরা জনবিস্ফোরণের আশংকা করেছেন। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীও সব সংসদ সদস্যের কাছে চিঠি দিয়ে এ সংকটে জনগণকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত রাখার অনুরোধ করেছেন। এমনকি মহাজোটের শরিক বিভিন্ন দলও এ দাবি করে আসছে।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েকবার বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি এ বিষয়টিকে কঠিন সমস্যা বলে জনগণকে ধৈর্য ধরার আহবান জানিয়েছেন। তবে জনগণকে কতদিন ধৈর্য ধারণ করতে হবে তার সুনির্দিষ্ট সময় তিনি ঘোষণা করতে পারেননি। তিনি নির্বাচনী ইশতেহারই গড় গড় করে বলে গেছেন। এক বছরে সরকারের কি সফলতা তা বলতে পারছেন না।

এখন কথামালার রাজনীতি বন্ধ করে দৃশ্যমান কার্যক্রম এবং ঘোষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন জরুরি। বিদ্যুৎ সংকট লাঘবে কতটা সময় ধৈর্য ধারণ করতে হবে তার সুনির্দিষ্ট সময়সীমা জনগণ জানতে চায়। http://budhbar.com/2010/04/08/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।