মোহাম্মদ আবুল হোসেন ও আমিনুল ইসলাম লিটন: চুল দিয়ে তৈরি হচ্ছে হীরা। আর এই দামি শিল্পের পণ্য চুলের বিপুল যোগান এই বাংলাদেশ থেকেই। দেশের দড়্গিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা শহর ঝিনাইদহে গড়ে উঠেছে বিশাল বাজার ও প্রক্রিয়াকরণ কারখানা। লাখ লাখ টাকার চুল বেচাকেনা হচ্ছে সেখানে। রীতিমতো ক্রয় অফিস খুলে তা কিনে নিচ্ছেন বিদেশীরা।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পনেরোটির বেশি জেলায় চুল বিকিকিনি হচ্ছে এখানে। বিদেশী ক্রেতারা চুল কিনছেন সামান্য মূল্যে। হীরা তৈরির কাজে এটির ব্যবহারের কথা খুব একটা জানাজানি হয়নি। বিদেশী ক্রেতাদের ভাষ্য-কেনা চুল দিয়ে তাদের ফ্যাক্টরিতে বটিচুল, পরচুলা ও অন্যান্য সৌখিন জিনিস তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি তারা বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ চুল সংগ্রহ করা সম্ভব বলে জানান।
কেননা মেয়েদের এত লম্বা চুল উন্নত বিশ্বে দুর্লভ।
কিন্তু বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের কোন কোন অঞ্চলে সুলভ। এখানে বড় ধরনের চুলের বাজারের স্বর্ণ সম্ভাবনার আশাবাদও ব্যক্ত করেন তারা। ইন্টারনেট সূত্র এবং বৈজ্ঞানিক তথ্যাদি ঘেঁটে জানা যায়- মানুষের চুল থেকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে ল্যাবরেটরিতে বানানো হচ্ছে মহামূল্যবান হীরা। এতে প্রয়োজন হয় দশমিক ৫ থেকে ২ গ্রাম পর্যনত্ম চুল।
আবার দেহভস্ম দিয়েও সে কাজ করা হচ্ছে। দেহভস্ম হলে প্রয়োজন হয় ১০০ গ্রাম। চুল বা দেহভস্ম থেকে মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে সেখান থেকে কার্বন কণাকে বের করে নেয়া হয়। পৃথিবীর অভ্যনত্মরভাগে যে প্রাকৃতিক পরিবেশে হীরার জন্ম সেই একই পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয় ল্যাবরেটরিতে। মেশিনের ভিতরে কার্বন কণা দিয়ে সেখানে সৃষ্টি করা হয় অতি উচ্চ চাপ ও তাপ।
এর সঙ্গে রাসায়নিক কিছু বিক্রিয়ার মাধ্যমে চুল ও দেহভস্ম থেকে সংগৃহীত কার্বন পরিণত হয় হীরায়। তবে যে প্রক্রিয়ায় এ হীরা তৈরি করা হয় তার বিসত্মারিত বিবরণ ব্যবসার স্বার্থেই প্রকাশে অনীহা উৎপাদকদের। এ উপায়ে উৎপাদিত হীরা হয় অনন্য। অর্থাৎ একজন ব্যক্তির চুল থেকে যে হীরা তৈরি করা হয় তা একটিই হয়। আরেকটি হীরার সঙ্গে তা মেলে না।
ফলে এ উপায়ে উৎপাদিত হীরা একজন মানুষের ডিএনএ বহন করে বলে দাবি উদ্ভাবকদের। এ পদ্ধতিতে হীরা তৈরির জন্য পশ্চিমা বিশ্বে অনেক কোম্পানি গড়ে উঠেছে। তারা এ ব্যবসা করে উপার্জন করছে কোটি কোটি ডলার। গত বছর পপসম্রাট মাইকেল জ্যাকসন মারা যাওয়ার পর শিকাগোর একটি কোম্পানি এরকম এক ঘোষণা দেয়।
শিকাগোর লাইফজেম নামের ওই সংস্থা ঘোষণা দেয়- ১৯৮৪ সালে পেপসির বিজ্ঞাপন নির্মাণের সময় যখন পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসনের চুলে আগুন ধরে যায়।
তখন তারা সেই চুলের কিছু অংশ সংগ্রহ করেছিলেন। তা দিয়ে তারা হীরা বানিয়েছেন। ওই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ডিন ভ্যানডেনবেসিন বলেছিলেন, তারা ওই চুল দিয়ে ১০টি হীরা বানিয়েছেন। তারা ২০০৭ সালে সংগীতস্রষ্টা বিঠোফেন-এর চুল থেকে উৎপাদন করেছেন তিনটি হীরা। এর এক একটি বিক্রি করেছেন ২ লাখ ডলার মূল্যে।
ল্যাবরেটরিতে উৎপাদিত এসব হীরা কি প্রাকৃতিক হীরার মতো- তা নিয়ে কৌতূহল সবার। তবে কোম্পানিগুলো বলছে- হ্যাঁ, অবিকল একই। কোন পার্থক্য নেই কৃত্রিম উপায়ে উৎপাদিত হীরা ও প্রাকৃতিক হীরার মধ্যে। কৃত্রিম উপায়ে হীরা উৎপাদন শুরম্ন করে জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানি। সে ১৯৫৬ সালের কথা।
ওই সময়ে তারা যে হীরা উৎপাদন করে তা ছিল ড়্গুদ্র আকারের রত্নপাথর। তবে আরও ১৫ বছর সাধনা করে এই কোম্পানি ১৯৭১ সালে উৎপাদন করে রত্ন-মানের এক ক্যারেটের হীরা। কৃত্রিম উপায়ে হীরা উৎপাদনের ইতিহাস এখান থেকেই শুরম্ন। উৎপাদনকারীরা বলেছেন, কৃত্রিম উপায়ে এই যে হীরা বানানো হচ্ছে এগুলো প্রাকৃতিক হীরার মতোই উজ্জ্বল। মহারানী ভিক্টোরিয়ার সময় থেকেই ‘শোকের পাথর’ হিসেবে হীরা পরিচিত।
অর্থাৎ কাউকে স্মরণে রাখতে হীরা ব্যবহার করা হতো। কারও হাতে একটি আংটি বা গলার হার স্মরণ করিয়ে দিতো হারানো স্বজনের কথা। কিন্তু প্রযুক্তির উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়জনের ওই সব উপহার বহনের চেয়ে তাকে আরও কাছে রাখার উপায় উদ্ভাবন করেছেন বিজ্ঞানীরা। আর তা হলো প্রিয়জনের চুল বা দেহভস্ম ব্যবহার করে হীরা উদ্ভাবন। এর ফলে যে হীরা উৎপাদন হয় তা ব্যবহার করলে যে কেউ হারানো স্বজনকে সব সময় নিজের সঙ্গে সঙ্গে রাখতে পারেন।
এজন্য এভাবে তৈরি করা হীরা প্রস্তুতকারক কোম্পানির নামও আকর্ষণীয়। কোনটির নাম মেমোরিয়াল ডায়মন্ড, কোনটি হার্ট ডায়মন্ড, কোনটি লাইফজেম।
ঝিনাইদহে চুলবাজার
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্তত ১৫টি জেলার চুল বিকিকিনি হয় ঝিনাইদহে। বিদেশীরা অফিস খুলেছে চুল কেনার। শহরের স্বর্ণপট্টিতে চীনের জেডসিডি কোম্পানির চুল ক্রয় কেন্দ্রে ভিড় লেগেই থাকে।
প্রতিদিন অন্তত ৩০-৩৫ কেজি চুল সংগ্রহ করা হয়। এক কেজি চুলের মূল্য ৩০০০-৩৫০০ টাকা। চুলের কারখানায় কয়েক শ’ মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
সরজমিনে ঝিনাইদহের ঋষিপাড়ায় দেখা গেছে, ঋষি নারীরা সবাই ব্যস্ত, তারা কাজ করেন চুলের কারখানায়। তাদের গ্রামে গড়ে উঠেছে বিশাল কারখানা।
যেখানে ফেলে দেয়া ও বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত জটবাঁধা চুলের জট ছাড়ানো হয়। সকালে কারখানার কাজে যান নারীরা, বিকাল পর্যন্ত কাজ করেন সেখানে। ঋষি সমপ্রদায়ের নারীরা জানান, আগে স্বামীর অভাবের সংসারে তাদের কিছুই করার ছিল না। ছেলেমেয়েদের মুখে তারা ঠিকমতো খাবার তুলে দিতে পারতেন না। এখন তারা কাজ পেয়েছেন, নিজেরা আয় করছেন।
ঝিনাইদহের ষাটবাড়িয়া গ্রামেও বেশ কয়েকটি কারখানা গড়ে উঠেছে। গত এক বছর ধরে তাদের এলাকায় এ চুলের কারখানার কাজ চলছে। এ সকল কারখানায় কয়েক শ’ নারী কাজ করছেন। এ পাড়ার সহস্রাধিক ঋষি পরিবারের প্রায় সবার বাড়িতে এই জট ছাড়ানোর কাজ চলছে।
ষাটবাড়িয়া গিয়ে দেখা যায়, এক সঙ্গে প্রায় ৭০ জন নারী চুলের জট ছড়াচ্ছেন।
বিশাল এক গুদাম ঘরের মধ্যে সারিবদ্ধভাবে তারা এই কাজ করছেন। সেখানে কর্মরত নারী দীপু দাসী জানান, তার স্বামী বৃন্দাবন দাস রিকশা চালিয়ে সংসার চালান। তার চার সনত্মান। তিনি জানান, ইতিপূর্বে তাদের সংসার ঠিকমতো চলছিল না। তিনি বাড়িতে মাঝে মধ্যে ডালা-কুলা তৈরির কাজ করতেন।
এতে সামান্য কিছু আয় হতো। স্বামীর আর তার সামান্য আয় দিয়ে কোন রকমে বেঁচে ছিলেন। এখন তিনি প্রতিদিন ৭০ টাকা আয় করছেন। তিনি জানান, চুলের জট ছাড়ানো কাজ পেয়ে তারা খুশি। তবে তাদের পারিশ্রমিক খুব কম।
মজুরি একটু বাড়িয়ে দিলে তারা ঠিকমতো সংসার চালিয়ে বেঁচে থাকতে পারবেন। প্রবীর দাসের স্ত্রী প্রেয়সী দাস জানান, এখন প্রতিদিনের পয়সা প্রতিদিন পাচ্ছেন। এতে কিছুটা সংসার চালাতে পারছেন। তবে তাদের মজুরিটা অনেক কম। যশরত দাসের স্ত্রী সীমা দাস জানান, তাদের এ কাজ প্রচণ্ড কষ্ট করেই করতে হয়।
সারাদিন একটানা বসে থাকতে হয়। তাছাড়া জটবাঁধা চুলের ময়লা নাক ও মুখের মধ্যে প্রবেশ করে। এ কারণে তাদের সর্দি-কাশি লেগেই থাকে। তিনি আরও জানান, এ কাজে ব্যবহৃত সুচ তাদের কিনতে হয়। মালিকপক্ষ শুধু মজুরি দেয়।
তিনি বলেন, এরপরও তারা এই কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। একই পাড়ার সুভাষ দাসের বালিকা কন্যা রূপসী দাস জানায়, সে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। স্কুলে ক্লাসের ফাঁকে এখানে কাজ করে সে-ও দিনে ২০-২৫ টাকা আয় করে। তার মতো অনেক শিক্ষার্থী পড়ালেখার পাশাপাশি এই কাজ করছে।
কারখানার মালিক চুয়াডাঙ্গার আজগর আলী জানান, তিনি এই জটছাড়ানো চুল আগে ঢাকায় পাঠাতেন- এখন ঝিনাইদহে বিদেশীরা অফিস খোলায় সেখানে দেন।
তিনি জানান, ঋষি সমপ্রদায়ের লোকজন ছাড়া এই কাজে শ্রমিক পাওয়া যায় না। এ কারণে তিনি ঝিনাইদহের এই ঋষি পাড়াকে বেছে নিয়েছেন। এখানে তিনি একটি ঘর ভাড়া নিয়ে চুলের কাজ করাচ্ছেন। তিনি জানান, তার কারখানায় গড়ে ৭০ জন নারী প্রতিদিন কাজ করে। একেক দিন একেক সংখ্যক শ্রমিক কাজ করে।
তিনি জানান, যে চুল চিরুনিতে আটকে যায় সেই চুল তারা হকারের মাধ্যমে কিনে থাকেন। চুল কেনেন ১৫শ’ টাকা কেজি দরে। জট ছাড়ানোর পর ২৫শ’ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। ১২ ইঞ্চির বেশি যত লম্বা হবে তত বেশি দামে বিক্রি হয়। এই চুল দিয়ে নানা ধরনের পণ্য তৈরি করা হয়।
জেলা শহরের স্বর্ণপট্টিতে গড়ে উঠেছে খুলনা বিভাগের একমাত্র চুল ক্রয় কেন্দ্রের বিদেশী অফিস। চীন দেশের জেডসিডি কোম্পানির ঝিনাইদহ ক্রয় কেন্দ্রের কর্মকর্তা দোভাষীর মাধ্যমে জানান, এসব চুল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পট চুল তৈরি করা হয়, বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ব্যাপারে এসব পট চুল বেশি ব্যবহার হয়। এছাড়াও এসব চুল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের শৌখিন জিনিস তৈরি করা হয়। ঝিনাইদহ ক্রয় কেন্দ্র প্রতিদিন গড়ে ৩০ কেজি করে চুল সংগ্রহ করা সম্ভব হয় বলে বলে জানান তিনি। এখানে কর্মরত ঢাকার মিরপুর এলাকার দোভাষী আক্তার জানান, গ্রামাঞ্চলে ফ্যাশনের ছোঁয়া ও বিউটি পার্লার ছড়িয়ে পড়ায় এখন আর মেয়েরা চুল বড় করতে চায় না।
তাই আশানুরূপ চুল সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছে না, ১০ ইঞ্চির বেশি লম্বা চুল খুব একটা মিলছে না।
বিশেষজ্ঞের মত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল খায়ের বলেন, মানুষের চুলে প্রোটিন থাকে। এই চুল যখন মানুষের মাথায় থাকে তখন অন্যান্য পদার্থের মতো সজীব থাকে। সেলুনে গিয়ে যখন চুল কেটে ফেলা হয় তখন এই প্রোটিন প্রাণহীন হয়ে পড়ে। এই চুলকে পোড়ালে একপ্রকার কার্বন (অঙ্গার, অঙ্গারক)-এর সৃষ্টি হয়।
কার্বনকে বিশেষ ব্যবস্থায় হীরায় পরিণত করা সম্ভব। কার্বন থেকেই মূলত হীরা তৈরি হয়। চুল থেকে পাওয়া হীরা দৈবিকভাবেই হীরার উপযোগী। তিনি বলেন, দড়্গিণ আফ্রিকায় যেখানে কয়লার খনি রয়েছে, তার কিছু দূরেই ডায়মণ্ড বা হীরকের খনি রয়েছে। ভূ-অভ্যনত্মরের তাপ ও চাপ যখন সঠিক মাত্রায় হয় তখনই মূলত কার্বন রূপানত্মরিত হয় হীরায়।
কাঠ থেকেও কার্বন তৈরি হয়। কিন্তু তা থেকে হীরা উৎপাদন সম্ভব নয়। কাঠ থেকে পাওয়া কার্বনের সূক্ষ্ম গঠন আর চুল থেকে পাওয়া কার্বনের সূক্ষ্ম গঠন এক নয়। তাই কাঠ থেকে পাওয়া কার্বন থেকে হীরা উৎপাদন করা সম্ভব নয়
মানবজমিন-
http://www.debaterx.com/
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।